কুফা কাটছে না চট্টগ্রাম বার্ন ইউনিটের। ১০ বছরে অগ্রগতি শূন্য। পাহাড়ে কোপ দিয়ে কাজ শুরু করায় প্রথমেই হোঁচট খেয়েছে। আপাতত কাজ বন্ধ রেখেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে অর্থায়ন থাকায় তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে চায় চীনারা।

প্রকল্প পাস হতে ১০ বছর পার
মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা পাঠানোর পর ২০১৪ সালে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখিয়ে চীনের প্রতিনিধি দল চট্টগ্রামে আসে। তখন থেকে শুরু প্রকল্পের আলাপ-আলোচনা। মাঝখানে চলে যায় ১০টি বছর। অনেক আগে থেকে চূড়ান্ত করা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ভেতর গোঁয়াছি বাগানে ঘুরপাক খেয়েছে সবাই। এত বছর ধরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, মন্ত্রণালয়, চীনসহ একাধিক টিম এই স্থান পরিদর্শন করেছে। গত বছরের ৯ মে একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। ২৮৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পে চীন সরকার অর্থায়ন করবে ১৮০ কোটি টাকা। আর বাংলাদেশ সরকার দেবে ১০৫ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হয়। গোঁয়াছি বাগানের চারপাশ জঞ্জালমুক্ত করা 
হয়। আগামী ডিসেম্বরে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।

শুরুতেই গলদ, কাজ বন্ধ
ছয়তলা ভবন নির্মাণ করার জন্য চলতি মাসে পাহাড়ে কোপ দেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এতে ক্ষুব্ধ হন পরিবেশবাদীরা। এর প্রতিবাদে বেশ কয়েকটি সংগঠন মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভাসহ নানা  কর্মসূচি পালন করেছে। সর্বশেষ ২২ জানুয়ারি প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করে বাংলাদেশ পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনসহ (বাপসা) কয়েকটি সংগঠন। পাহাড় কাটার স্থানে রোপণ করে গাছের চারা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, পাহাড় কাটা কিংবা ড্রেসিং (মোচন) করার আগে নিতে হয় ছাড়পত্র এবং এনভায়রনমেন্টাল ইমপেক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ)। এর আগেই এক্সক্যাভেটর দিয়ে পাহাড়ের একটা বড় অংশ সাবাড় করা হয়েছে। এর পর বিষয়টি নজরে আসে পরিবেশ অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের। তাই পাহাড় কাটা বন্ধের পাশাপাশি কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্য উপদেষ্টা।

সরেজমিন যা দেখা গেল
সম্প্রতি সরেজমিন গোঁয়াছি বাগানে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প এলাকার চারপাশ ঘেরাও করে রাখা হয়েছে। দূর থেকে চোখে পড়ছে অবৈধভাবে পাহাড় কাটার চিহ্ন। কয়েকটি স্থানে পড়ে আছে পাহাড় কাটার কিছু সরঞ্জাম ও কেটে ফেলা গাছ।

আছে চীনা দলের চাপ
পাহাড় কাটায় নতুন করে জটিলতা তৈরি হওয়ায় দ্রুত কাজ শুরুর জন্য কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে চট্টগ্রামে আসা চীনা প্রতিনিধি দল। এতে বেকায়দায় পড়েছে প্রকল্প-সংশ্লিষ্ট প্রশাসন।
চীনা প্রতিনিধি দলের প্রধান মে ইইউ চ্যং সমকালকে বলেন, ‘পাহাড়টির মাটি খুব নরম। পানির স্পর্শ পেলে সেটি নিচের দিকে চলে আসার শঙ্কা রয়েছে। প্রকৌশলীরা সয়েল নেইলিং প্রযুক্তির মাধ্যমে পাহাড়টি ড্রেসিং করে কলাম বসিয়ে কাজ করবেন। পরে ঘাস লাগানো হবে।’
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘এমনিতে নানা কারণে এ প্রকল্পের কাজ বহুবার পিছিয়েছে। অনেক বছর পর কাজ শুরু হয়ে আবার বন্ধ হয়ে গেছে। এমন হলে চীনা প্রকৌশলীরা কাজ না করে চলে যাবেন। অর্থও ফেরত দিতে হবে। কাজ শুরু করতে চীনা প্রতিনিধিরা আমাদের খুব চাপাচাপি করছেন। এরই মধ্যে চীন থেকে বেশকিছু মালপত্র এনেছেন।’

ক্ষুব্ধ পরিবেশবাদীরা
পরিবেশবিদ বীর মুক্তিযোদ্ধা ড.

মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বার্ন ইউনিট অত্যন্ত প্রয়োজন। এটি চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি। কিন্তু সেটি পাহাড় কেটে, পরিবেশ ধ্বংস করে নয়।’
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) চট্টগ্রামের সমন্বয়ক মনিরা পারভীন বলেন, ‘হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পাহাড় কাটা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিলেও তা মানেনি। যে পরিমাণ পাহাড় কাটা হয়েছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।’

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মুক্তাদির হাসান বলেন, ‘অনুমতি না নিয়ে বিশাল আকৃতির পাহাড় কাটার প্রমাণ পেয়েছি। এ ব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছি। মন্ত্রণালয় করণীয় ঠিক করবে।’
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তসলিম উদ্দিন বলেন, ‘কাজ বন্ধ রয়েছে। চীনাদের সঙ্গে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার বৈঠক করার কথা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পের অর্থ বরাদ্দের বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’ অভিযোগ ওঠার পর পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে টার্মস অব রেফারেন্স এবং ইআইএ পেয়েছেন বলে জানান তিনি।
বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘গাছ কাটলে তা লাগাতে পারবেন। কিন্তু পাহাড় সৃষ্টি করার কোনো জাদু নেই। মানুষের জন্য হাসপাতাল অবশ্যই প্রয়োজন। তবে সেটি পাহাড় কেটে নয়।’

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: প রকল প র ক জ বন ধ উপদ ষ ট

এছাড়াও পড়ুন:

সত্তার অনুসৃষ্টি

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে সুপরিচিত অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী, যাঁর অভিনয় রুপালি পর্দায় দেখে আমরা মুগ্ধ হয়েছি। গেল অতিমারিকালে কোভিড প্রায় অকালেই কেড়ে নেয় তাঁর অমূল্য প্রাণ। তাঁর জীবনীভিত্তিক উপন্যাস কবরী রচনায় কেন প্রবৃত্ত হলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী?

আলোচ্য উপন্যাসটি সংলাপবহুল। সাংবাদিক সজীব কবরীর সাক্ষাৎকার নেয় প্রায় পুরো বইতেই। এতে কথোপকথন ও ফ্লাশব্যাকের সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় ভিন্নতর আঙ্গিক। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু হরর নভেল সাক্ষাৎকারভিত্তিক। কিন্তু বাংলায়? নজির সুলভ নয়। লেখকের ভাষাও কি সহজ-সরল? সংলাপ কঠিন নয় স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু ঔপন্যাসিকের ন্যারেশন কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাব্যিক এবং এর কিছু চিরন্তন মানবিক সত্য উচ্চারণ চিত্তাকর্ষক। আর পাঠকের মনের কথা বলার ক্ষমতা? এখানে সজীবই কৌতূহলী পাঠকের প্রতিনিধি। তাই কবরীর কোনো কোনো উত্তরে সংবেদনশীল পাঠকের চোখ ভিজে আসে। কবরী শুরুতে মধ্যবিত্ত ছিলেন না। নিম্নমধ্যবিত্ত বাবা কৃষ্ণদাস পাল ১৩ বছর বয়সী কন্যা মিনা দাসকে (কবরী) বড় পরিবারের আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় সিনেমায় অভিনয় করতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাঠান। এ ঘটনা এখনো অকল্পনীয় ঠেকে প্রায়। ২০ বছর বয়সের মধ্যেই তিনি জমি ও গাড়ির মালিক হয়ে উঠলেও দাম্পত্য জীবনে প্রায় সর্বহারাই থেকে যান কবরী। বাবার বয়সী প্রথম স্বামী চিত্ত চৌধুরীর সঙ্গে ১৪ বছরের সংসারে তিনি কেবল শোষিতই হন না, নিয়মিত নির্যাতিতও হন। তাঁর অজানা অধ্যায় কী? সজীব এখানে নায়িকাকে খুঁচিয়ে-খেপিয়ে তুলে আনে কিংবদন্তি পরিচালক জহির রায়হানের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অজ্ঞাত গল্প। জহিরের মৃত্যুর ঘটনাও লোমহর্ষক। এগুলো অবশ্য এ উপন্যাস পাঠের তথ্যগত প্রাপ্তি।

এ উপন্যাসের প্রধান ভিত্তি কবরীর লেখা আত্মজীবনী স্মৃতিটুকু থাক। তা হলে কবরীর বিশিষ্টতা কোথায়? অনুকরণ নয়, উল্লিখিত জীবনীর অনুসৃজনে ব্রতী হন ঔপন্যাসিক। সজীবের সঙ্গে আলাপকালীন কবরীর প্রতিটি অভিব্যক্তির উৎস, কার্যকারণ—সব মিলিয়ে তিনি বাঙ্ময় করে তোলেন গভীর অভিনিবেশযোগে, নিবিড় পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে। এভাবে সচেতন পাঠকের পরম সম্পদ হয়ে ওঠে বিশ ও একুশতম অধ্যায়ে বিধৃত কবরীর ১৯৭১ পর্ব। ভারতের বিভিন্ন জনসমাবেশে কবরীর ভাষণ দেওয়া, সে দেশের ফিল্মে অভিনয়ের জন্য প্রাপ্ত সম্মানীর অর্ধেক বাংলাদেশের যুদ্ধাহত শরণার্থীদের দান, সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ইত্যাদি ঘটনা স্মৃতিকথার অধিক ব্যঞ্জনা লাভ করে বিশ্বজিতের হাতে।

এক রাজনীতিক পরিবারের সন্তান সফিউদ্দীন সারোয়ারের সঙ্গে দ্বিতীয় বিয়ের ২০ বছর পর রাজনৈতিক হিংসা-প্রতিহিংসার কারণে তা ভেঙে গেলেও এ পর্বে কবরীকে আমরা হার না-মানা সংগ্রামী ব্যক্তিত্বরূপে পাই। বিষম সমাজ-আরোপিত লৈঙ্গিক ও সাম্প্রদায়িক বিভেদের ঊর্ধ্বে নিজেকে স্থাপন তাঁকে মহিমান্বিত করে তোলে। জীবনের শেষ পর্বে সুচিত্রা সেন ও এই বাংলারও একাধিক নায়ক-নায়িকা যেখানে যাঁর যাঁর সাম্প্রদায়িক পরিচয়কে প্রাধান্য দেন, কবরী সেখানে থাকেন উদার এবং প্রাগ্রসর জীবনচেতনার প্রতি উন্মুখ।

ঔপন্যাসিকের সৃজনশীল কল্পনা এই জীবনীভিত্তিক আখ্যানকে প্রাঞ্জল করে তুলেছে। যদিও উপন্যাসের কোথাও সজীব বলেনি, সারেং বৌ ছবিতে কবরী নবিতুনের সঙ্গে জীবন বদল করেছিলেন। তবে শেষ চার অধ্যায় লেখকের নিজস্ব রচনা, বলা যায়। এ অংশে করোনাকালের ভয়াবহতার বিবরণ পাঠককে সেই দুঃস্বপ্নে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তিন বছর পর সজীবের স্ত্রীর প্রত্যাবর্তন কিছুটা অস্বাভাবিক ঠেকলেও অনতি পরে এ ক্ষেত্রে মহানুভব কবরী ম্যাডামের গোপন ভূমিকা পাঠককে তাঁর প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল করে তোলে। তবু সেই অবস্থায় সজীবের সস্ত্রীক কক্সবাজার যাত্রা, তাঁদের কন্যার অবাধ্যতা ইত্যাদি যেন মেনে নেওয়া যায় না। তবে শেষ অধ্যায়ে কবরীর অসুস্থতার সংবাদে সজীবের অসম্ভব বিচলিত হওয়ার বর্ণনায় পাঠকও ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধ করে।

কবরী
বিশ্বজিৎ চৌধুরী

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন
প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০২৫
প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল
পৃষ্ঠা: ২০০
মূল্য: ৫০০ ৳

সম্পর্কিত নিবন্ধ