ড্রাগন ফল বিক্রি করে কারও আয় ১০ লাখ, কারও ১৫ লাখ টাকা
Published: 13th, December 2025 GMT
ইউটিউবে স্ক্রল করতে গিয়ে একটি ভিডিওতে চোখ আটকে যায় উসাইনু মারমার (৩৫)। পর্দায় ভেসে ওঠে একটি ভিডিও—‘ড্রাগন চাষে ভাগ্যবদল’। কৌতূহল থেকে পুরো ভিডিওটি দেখেন তিনি। সেদিনই সিদ্ধান্ত নেন, তিনিও ড্রাগন ফলের চাষ করবেন। ঘটনাটি ২০২১ সালের। পরের বছর থেকেই বাগানে ড্রাগনের চারা রোপণ শুরু করেন। সেই সিদ্ধান্তই বদলে দিয়েছে তাঁর জীবনের গতিপথ।
বান্দরবান সদরের জামছড়ি এলাকায় উসাইনুর বাগানে এখন চার হাজার ড্রাগনগাছ। প্রতিবছর এ ফল বিক্রি করে তাঁর আয় হচ্ছে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা। ২৫ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা উসাইনু মারমার বাগানের নাম ‘চিং এগ্রো ফার্ম’। এর মধ্যে তিন একর জমিতে সারি বেঁধে রোপণ করা হয়েছে ড্রাগন ফলের চারা। গাছগুলোর বয়স এখন দুই থেকে তিন বছর।
হিসাব কষে উসাইনু মারমা জানান, এক মৌসুমেই তাঁর বাগান থেকে প্রায় ১১ হাজার কেজি ড্রাগন ফল পাওয়া যায়। আকারভেদে ফলের দামও ভিন্ন। ছোট আকারের ড্রাগন বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৫০ থেকে ১০০ টাকায়, মাঝারি আকারের ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় এবং বড় আকারের ড্রাগন বিক্রি হয় প্রতি কেজি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায়।
শুধু উসাইনু মারমা নন, পার্বত্য তিন জেলা—বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে এখন শতাধিক কৃষক ও উদ্যোক্তা ড্রাগন চাষের দিকে ঝুঁকছেন। কম খরচে বেশি লাভ হওয়ায় নতুন প্রজন্মের কৃষকদের কাছেও এই ফল চাষ দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষিবিষয়ক প্রকাশনা ‘কৃষি বাতায়ন’-এর তথ্যমতে, ড্রাগন ফল মূলত আমেরিকার একটি প্রসিদ্ধ ফল। বাংলাদেশে এ ফলের যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে বিভিন্ন জাতের ড্রাগন ফল দেশে আনা হয়।কৃষি কর্মকর্তা ও কৃষকেরা বলছেন, ড্রাগনগাছ একবার রোপণ করলে ১০ থেকে ১৫ বছর বা তারও বেশি সময় ধরে ফল দেয়। প্রতিবছর এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ সময়জুড়ে ফল আসে। গাছে রোগবালাই তুলনামূলক কম হয়, ফলও নষ্ট হয় কম। এসব সুবিধার কারণেই ড্রাগন চাষ দ্রুত বাড়ছে। তিন পার্বত্য জেলা মিলিয়ে সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রায় ৩৪ কোটি টাকার ড্রাগন ফল বিক্রি হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষিবিষয়ক প্রকাশনা ‘কৃষি বাতায়ন’-এর তথ্যমতে, ড্রাগন ফল মূলত আমেরিকার একটি প্রসিদ্ধ ফল। বাংলাদেশে এ ফলের যাত্রা শুরু হয় ২০০৭ সালে। সে সময় থাইল্যান্ড, ফ্লোরিডা ও ভিয়েতনাম থেকে বিভিন্ন জাতের ড্রাগন ফল দেশে আনা হয়। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় চাষাবাদ। তবে শুরুতে এ ফলের দাম ছিল আকাশছোঁয়া। উৎপাদন বাড়তে থাকায় এখন দাম কিছুটা কমেছে, তবে জনপ্রিয়তা কমেনি।
কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, ড্রাগন ফল চাষ এখন আর পরীক্ষামূলক উদ্যোগ নয়; এটি সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে রূপ নিয়েছে। পাহাড়ি এলাকার মাটি ও কম পানির চাহিদা এ চাষের জন্য উপযোগী।বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থানার উত্তর ঘুমধুম এলাকার কৃষক সুগত বড়ুয়া এক একর জমিতে ড্রাগন চাষ করছেন। গত বছর তিনি প্রায় তিন হাজার চারা রোপণ করেন। এর মধ্যে চলতি বছর কিছু গাছে ফলন এসেছে। এতে তাঁর আয় হয়েছে প্রায় দেড় লাখ টাকা। সুগত বড়ুয়া বলেন, আধুনিক পদ্ধতিতে ড্রাগনের চাষ করছেন তিনি। আরও দুই থেকে তিন বছর পর ভালো ফলন পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বান্দরবানে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ড্রাগনের চাষ হয়েছিল মাত্র ৮ হেক্টর জমিতে। তখন উৎপাদন ছিল মাত্র ১২ টন। এরপর প্রতিবছরই ফলন বাড়তে থাকে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫ হেক্টর জমিতে উৎপাদন হয় ৭০ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩০ হেক্টরে ১৪৩ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩২ হেক্টরে ১৪৯ টন, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৮ হেক্টরে ৩৭৯ টন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭৪ হেক্টরে ৬২৩ টন এবং সর্বশেষ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৯২ হেক্টর জমিতে উৎপাদন দাঁড়ায় ৮৪৭ টনে। অর্থাৎ সাত বছরের ব্যবধানে জমি বেড়েছে সাড়ে ১১ গুণ, উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৭০ গুণ।
কম পরিশ্রমে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকেরা ড্রাগন চাষে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া ড্রাগনগাছ খরাসহিষ্ণু। পাহাড়ি এলাকার ড্রাগন স্বাদে অনন্য—সমতলের তুলনায় কিছুটা বেশি মিষ্টি হওয়ায় বাজারে এর চাহিদাও ভালো।—আবু নঈম মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন, উপপরিচালক, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, বান্দরবানবান্দরবানের আরেক উদ্যোক্তা মংমংসিং মারমার চার একরের বাগান রয়েছে জামছড়ি পাড়ায়। সেখানে চার হাজার ড্রাগনগাছ আছে। ২০২০ সাল থেকে তিনি ড্রাগন চাষ করছেন। প্রতিবছর ফল বিক্রি করে ১৮ থেকে ২০ লাখ টাকার লেনদেন করেন তিনি। খরচ বাদ দিয়ে তাঁর মুনাফা থাকে ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা। তাঁর বাগানের ড্রাগন স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি চট্টগ্রামেও সরবরাহ করা হয়।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বান্দরবানের উপপরিচালক আবু নঈম মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বলেন, কম পরিশ্রমে লাভ বেশি হওয়ায় কৃষকেরা ড্রাগন চাষে ঝুঁকছেন। এ ছাড়া ড্রাগনগাছ খরাসহিষ্ণু। পাহাড়ি এলাকার ড্রাগন স্বাদে অনন্য—সমতলের তুলনায় কিছুটা বেশি মিষ্টি হওয়ায় বাজারে এর চাহিদাও ভালো।
দুই জেলায়ও বাড়ছে উৎপাদনরাঙামাটিতেও ড্রাগন চাষ বাড়ছে দ্রুত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রাঙামাটিতে মাত্র ৪ হেক্টর জমিতে ড্রাগনের চাষ হতো, উৎপাদন ছিল ৩৩ টন। সাত বছর পর, অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরে জমি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ হেক্টরে, উৎপাদন হয়েছে ৫৪৮ টন। এতে জমি বেড়েছে সাড়ে ১২ গুণ, উৎপাদন বেড়েছে সাড়ে ১৬ গুণ।
রাঙামাটি পৌরসভার বাসিন্দা জ্ঞানময় তঞ্চঙ্গ্যার বাগানে ৩০০টি গাছ। তিনি সবে শুরু করেছেন। এ বছর তিনি প্রায় ৪২ হাজার টাকা পেয়েছেন ড্রাগন বিক্রি করে। জ্ঞানময় প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় লোকজনের কাছে শুনে তিনি এ ফল চাষ শুরু করেছেন। প্রথম বছরই লাভ পেয়েছেন।
খাগড়াছড়িতেও একই চিত্র। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সেখানে ৮ হেক্টর জমিতে উৎপাদন ছিল মাত্র ৬ টন। সাত বছরের ব্যবধানে জমি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৫ হেক্টরে, উৎপাদন হয়েছে ৩০১ টন। অর্থাৎ উৎপাদন বেড়েছে ৫০ গুণ, জমি বেড়েছে ১০ গুণ।
এ জেলার দীঘিনালা উপজেলার ডলুছড়ি এলাকার কৃষক সুমতিলাল চাকমার বাগানে গাছের সংখ্যা ২ হাজার। ২০২৩ সাল থেকে তিনি এ ফল চাষ করছেন। সুমতিলাল জানান, প্রায় ৭ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন। এর মধ্যে লাভের পরিমাণ ২ থেকে ৩ লাখ টাকা।
ড্রাগন ফল.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: চ ষ করছ ন ব ন দরব ন ফল ব ক র এল ক র ফল চ ষ হওয় য় ত বছর
এছাড়াও পড়ুন:
চট্টগ্রাম নগরের জনসংখ্যা আসলে কত লাখ, ৩২ নাকি ৬০
চট্টগ্রাম জেলার আয়তন সব মিলিয়ে ৩ হাজার ২৮২ বর্গমাইল। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত এলাকার আয়তন ৬০ বর্গমাইলের মতো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন—দুই সংস্থার হিসাবেই রয়েছে এমন তথ্য। তবে নগর বা সিটি করপোরেশন এলাকায় জনসংখ্যা কত তা নিয়ে এই দুই সংস্থার হিসাবে রয়েছে বিশাল ব্যবধান। সিটি করপোরেশনের হিসাবে যে সংখ্যক জনসংখ্যার কথা বলা হয়, তা পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবের প্রায় দ্বিগুণ।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, নগরে জনসংখ্যা আনুমানিক ৬০ লাখ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার জনসংখ্যা ৩২ লাখ ৩০ হাজার ৫০৭ জন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাব অবশ্য কোনো জরিপের ভিত্তিতে করা হয়নি, অনুমানের ভিত্তিতেই করা। উত্তর দিকে লতিফপুর-জঙ্গল সলিমপুর; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর ও কর্ণফুলী নদী; পূর্ব দিকে কর্ণফুলী নদী থেকে হালদা, চিকনদণ্ডী এবং পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর, ভাটিয়ারী ও জঙ্গল ভাটিয়ারী—কাগজে–কলমে এটিই চট্টগ্রাম নগরের সীমানা।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কোনো অঞ্চলে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের আগে সেখানে বসবাসকারী মানুষের প্রকৃত সংখ্যা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা অত্যন্ত জরুরি। কারণ, জনসংখ্যার সঠিক হিসাব না থাকলে প্রকল্প পরিকল্পনা, বাজেট নির্ধারণ, অবকাঠামোর আকার, সেবাদানের সক্ষমতা—সবকিছুতেই ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঝুঁকি থাকে। এতে সরকারি সম্পদের অপচয় হয় এবং জনগণ প্রত্যাশিত সেবা পায় না।
নথিপত্রে জনসংখ্যার হিসাব
২০২২ সালের জনশুমারি ও গৃহগণনা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম জেলার জনসংখ্যা ৯১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৫। এর মধ্যে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এবং ১৫টি উপজেলা এলাকা রয়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যা দেখানো হয় আনুমানিক ৬০ লাখ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যা বলা হয় আনুমানিক ৭০ লাখ। অর্থাৎ করপোরেশন বলছে, তিন বছরে জনসংখ্যা ১০ লাখ বেড়েছে।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ২০২০-২১ অর্থবছরের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যা দেখানো হয় আনুমানিক ৬০ লাখ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বার্ষিক প্রশাসনিক প্রতিবেদনে জনসংখ্যা বলা হয় আনুমানিক ৭০ লাখ। অর্থাৎ করপোরেশন বলছে, তিন বছরে জনসংখ্যা ১০ লাখ বেড়েছে।নগরে ৭০ লাখের মতো জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ১৫ লাখ ভাসমান, এদের ভাসমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও ২০২৪ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১৯ লাখ ৫১ হাজার ৫২ জন।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন তাঁদের ওয়েবসাইটে উল্লেখ করেছে, মাত্র ছয় বর্গমাইল আয়তন নিয়ে ১৮৬৩ সালে যাত্রা শুরু করে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালটি। ১৯৮২ সালে পৌরসভাকে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নামে যাত্রা শুরু হয় ১৯৯০ সালে। কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন হিসেবে যাত্রা শুরুর সময় জনসংখ্যা ছিল ২০ লাখ। যদিও বিবিএসের হিসাবে ১৯৯১ সালে সিটি করপোরেশনে জনসংখ্যা ১৩ লাখ ৬৬ হাজার।
চট্টগ্রাম নগরের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত