সাফল্যের পথে বেশ কিছু বাধা রয়েছে, যা সমাজ ও জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়:
১. আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপমানুষ যখন নিজেদের মনগড়া মূল্যবোধ সৃষ্টি করে, আল্লাহর কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে এবং আল্লাহর নাজিলকৃত আয়াত ও বিধানসমূহ প্রত্যাখ্যান করে, তখন তারা কখনো সফল হতে পারে না।
এই কাজ যারা করে, তাদের দুনিয়া ও আখেরাতে কোনো সাফল্য নেই, “যারা আল্লাহর ওপর মিথ্যা আরোপ করে, তারা কখনো সফল হয় না।” (সুরা নাহল, আয়াত: ১১৬)
জুলুমের ফলে সমাজে নানা ধরনের ফ্যাসাদ বা অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এর পরিণতিতে খরা, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মহামারি, যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুর নিপীড়ন নেমে আসে।২.জুলুম
জুলুমের মধ্যে সবচেয়ে বড় জুলুম হলো শিরক বা আল্লাহর অংশীদার স্থাপন করা। এটি বুদ্ধি, নৈতিকতা ও কর্মের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর। জুলুমের ফলে সমাজে নানা ধরনের ফ্যাসাদ বা অরাজকতা সৃষ্টি হয়। এর পরিণতিতে খরা, দুর্ভিক্ষ, বন্যা, মহামারি, যুদ্ধ এবং অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত শত্রুর নিপীড়ন নেমে আসে।
যেমন কোরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই জালিমরা সফল হয় না।” (সুরা আনআম, আয়াত: ২১)
অতএব, সাফল্য কেবলমাত্র সত্য ও ন্যায়ের ধারক-বাহকদের জন্যই নির্ধারিত।
আরও পড়ুনবরকতের শত্রু অহংকার২২ জুন ২০২৫৩. ধর্মে নতুন কিছু উদ্ভাবনযা ধর্মের কোনো বিধানের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয় ধর্মে এমন নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করাকে বলে বিদ’আত। এটি ধর্মের মৌলিক কাঠামোকে বিকৃত করে, আল্লাহর ওপর ও তাঁর রাসুলের ওপর মিথ্যা আরোপ করে এবং মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে।
বিদ’আত সামাজিক কাঠামোর জন্য ক্ষতিকর এবং দুনিয়া ও আখেরাতে সাফল্যের পরিপন্থী। (শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলভি, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/২৫৬, মাকতাবাতুল গাজালি, লাহোর)
৪. কৃপণতাকৃপণতার সঙ্গে লোভ বা অত্যাবশ্যকীয় হক আদায়ে বিরত থাকাকে ইসলামে বলে ‘শুহ’। সম্পদের প্রতি অতিরিক্ত লোভ, তা জমা করে রাখা এবং আল্লাহ ও বান্দার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা—এগুলো জাতিগুলোর ধ্বংসের অন্যতম কারণ।
রাসুল (সা.) সতর্ক করে বলেছেন, “তোমরা কৃপণতা থেকে দূরে থাকো। কেননা কৃপণতাই তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে। এটি তাদের রক্তপাত ঘটাতে এবং হারামকে হালাল করতে প্ররোচিত করেছে।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস: ২৫৭৮)
আল্লাহ তায়ালা কৃপণতার বিপরীতে বদান্যতাকে সাফল্যের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেছেন, “আর যারা নিজেদের প্রবৃত্তির কৃপণতা থেকে রক্ষা পেয়েছে, তারাই সফলকাম।” (সুরা হাশর, আয়াত: ৯)
আরও পড়ুনসফলতা ও বিজয়ের জন্য ঐক্যের গুরুত্ব ১৬ আগস্ট ২০২৪নীরবতা নিজেই একটি অপরাধ এবং আল্লাহর প্রতি শিথিলতার প্রমাণ। যখন পুরো সমাজ নীরব থাকে, তখন শাস্তি ব্যাপক আকার ধারণ করে।৫. অসৎ কাজ দেখে নীরব থাকাঅসৎ কাজ বা অন্যায় দেখে নীরব থাকলে সমাজে বিপর্যয় নেমে আসে। এটি দু’ভাবে ক্ষতির কারণ হয়:
প্রথমত: প্রকাশ্য পাপ এবং তার ওপর নীরবতা বিপদ ও শাস্তির কারণ হয়।
দ্বিতীয়ত: নীরবতা নিজেই একটি অপরাধ এবং আল্লাহর প্রতি শিথিলতার প্রমাণ। যখন পুরো সমাজ নীরব থাকে, তখন শাস্তি ব্যাপক আকার ধারণ করে। আল্লাহ বলেছেন, “আর তোমরা সেই ফিতনাকে ভয় করো যা তোমাদের মধ্যে শুধু জালিমদের ওপরই আপতিত হবে না।” (সুরা আনফাল, আয়াত: ২৫)
নবীজি (সা.) অন্যায় দেখে নীরব থাকার অবস্থাকে একটি নৌকার যাত্রীদের উদাহরণের মাধ্যমে বোঝান। নৌকার নিচের তলার কিছু যাত্রী যদি উপরের তলার লোকজনকে কষ্ট না দেওয়ার অজুহাতে নিজেদের অংশে ছিদ্র করতে চায়, তবে উপরের তলার যাত্রীরা তাদের বাধা না দিলে সবাই ডুবে যাবে; আর যদি বাধা দেয়, তবে সবাই রক্ষা পাবে। (সহিহ বুখারি, হাদিস: ২৪৯৩)
এই উদাহরণ স্পষ্ট করে যে, অসৎ কাজে নীরবতা সমাজের সামগ্রিক ধ্বংস ডেকে আনে। সচেতন সমাজের জন্য এটি একটি গুরুতর বিপদ, কারণ অসচেতন বা অসৎ কিছু লোকের কারণে পুরো সমাজের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে।
আরও পড়ুনচিরন্তন সফলতার অপরিহার্য ১০ শর্ত১২ ডিসেম্বর ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন রব থ ক আল ল হ স ফল য র জন য র ওপর অসৎ ক ন রবত ক পণত
এছাড়াও পড়ুন:
চিরন্তন সফলতার অপরিহার্য ১০ শর্ত
সাফল্য অর্জনের জন্য মুমিন সমাজকে সম্মিলিতভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে বেশ কিছু মৌলিক শর্ত পালন করতে হয়:
১. আত্মশুদ্ধিআত্মশুদ্ধি হলো ব্যক্তির ভেতরের সৎ ও ন্যায়ের দিকে ধাবিত হওয়া সহজাত প্রবণতাগুলোকে পরিচর্যা করা এবং সেগুলোকে বিকশিত করা।
বাহ্যিক পরিবেশ, নির্দেশনা ও উদ্দীপনা এই সহজাত প্রবণতাকে জাগ্রত করতে, শাণিত করতে ও সঠিক পথে চালিত করতে সাহায্য করে, যাতে মানুষ সত্যকে তার সঠিক রূপে উপলব্ধি করতে পারে। কোরআনের ভাষ্য অনুযায়ী, “নিশ্চয় সে-ই সফলকাম হয়েছে, যে আত্মাকে পবিত্র করেছে।” (সুরা শামস, আয়াত: ৯)
২. সবরসবর হলো ধৈর্য, যা সাফল্যের একটি শক্তিশালী ভিত্তি। এটি তিন ধরনের হয়:
আনুগত্যে ধৈর্য: আল্লাহর বিধান ও ইবাদত পালনে ধৈর্যধারণ করা।
পাপ থেকে বিরত থাকার ধৈর্য: নফসের কামনা, লোভ ও আকাঙ্ক্ষা এবং শয়তানের প্ররোচনা থেকে দূরে থাকার জন্য নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা।
বিপদাপদে ধৈর্য: বাতিল ও অসত্যের বাড়াবাড়ি, জালিমের নির্লজ্জতা, দুর্দিনে সাহায্যকারীর অভাব এবং কঠিন মুহূর্তে হতাশা ও সন্দেহের বিরুদ্ধে অবিচল থাকা।
এর পাশাপাশি বিজয় ও ক্ষমতা লাভের পর বিনয় ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ধৈর্যও জরুরি। সকল পরিস্থিতিতে—সুখে-দুঃখে—আল্লাহর সঙ্গে দৃঢ় সংযোগ বজায় রাখা এবং তাঁর ফয়সালার কাছে আত্মসমর্পণ করাই সবর। (গাজালি, ইহইয়াউ উলুমিদ্দিন, ৪/৫৯, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ২০০৫)
৩. অবিচলতাঅবিচলতা মানে এখানে শত্রুদের চেয়েও বেশি দৃঢ় ও অবিচল থাকা। এটি শত্রুর ধৈর্যের বিরুদ্ধে নিজেদের ধৈর্যের এক প্রতিযোগিতা। যখন ভ্রান্তপন্থীরা তাদের পথে অবিচল থাকে, তখন সত্যপন্থীদের উচিত আরও বেশি দৃঢ়তা ও সাহসের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া।
আল্লাহ বলেন, “যদি তোমরা কষ্ট পাও, তবে তারাও তোমাদের মতোই কষ্ট পাচ্ছে, আর তোমরা আল্লাহর কাছে এমন কিছু আশা করো যা তারা আশা করে না।” (সুরা নিসা, আয়াত: ১০৪)
আরও পড়ুনসফলতা ও বিজয়ের জন্য ঐক্যের গুরুত্ব ১৬ আগস্ট ২০২৪৪. সতর্ক অবস্থানইসলামি পরিভাষায় একে বলে মুরাবাতা। অর্থাৎ, জিহাদের স্থানে, সীমান্ত ও স্পর্শকাতর অঞ্চলে সর্বদা সতর্ক ও প্রস্তুত থাকা। ইসলাম প্রচারের গুরুদায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই মুসলিম উম্মাহ সবসময় শত্রুদের বাধার সম্মুখীন হয়েছে। এটি নবীদের ও তাদের অনুসারীদের ক্ষেত্রে আল্লাহর এক সাধারণ নীতি। যখন ওয়ারাকা ইবনে নওফল রাসুল (সা.)-কে বলেছিলেন যে, “আপনার মতো বার্তা নিয়ে এমন কেউ আসেনি, যার বিরুদ্ধে শত্রুতা করা হয়নি” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৩), তখন এটিই প্রমাণিত হয়েছে।
এই কারণে মুসলিম উম্মাহকে তার স্থায়ী ও স্বাভাবিক শত্রুদের থেকে সুরক্ষিত থাকার জন্য সর্বদা সতর্কতা ও পাহারায় থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা ধৈর্য ধারণ করো এবং ধৈর্যে প্রতিযোগিতা করো এবং সীমান্ত পাহারায় প্রস্তুত থাকো আর আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ২০০)
৫. খোদাভীতিখোদাভীতি হলো ভেতরের সেই সুরক্ষা, যা ব্যক্তিকে খারাপ পরিস্থিতিতে প্রভাবিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। কঠিন সামাজিক বা অর্থনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা সামরিক পরাজয় ততক্ষণ পর্যন্ত সামান্যই ক্ষতি করতে পারে, যতক্ষণ না তা মৌলিক নীতি, নৈতিকতা ও আত্মাকে পরিবর্তন করে ফেলে।
আল্লাহকে ভয় করা সমাজের আত্মাকে পরিমার্জিত, শক্তিশালী ও উন্নত করার পথ। এর মধ্যে রয়েছে সৎ আচরণ, হারাম কাজ থেকে বিরত থাকা (যেমন সুদ, মদ, জুয়া), কঠোরভাবে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, লোভের প্রতিরোধ করা, সহযোগিতা, আত্মত্যাগ, আল্লাহর পথে ব্যয় এবং জাতীয় সম্পদ রক্ষা করা।
খোদাভীতিই বিবেক বা চেতনার সতর্ক প্রহরী, যা ব্যক্তিকে ভুল পথে বা দুর্বলতায় পতিত হওয়া থেকে রক্ষা করে। এটিই সাফল্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু, “সুতরাং হে জ্ঞানীরা, তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সুরা মায়েদা, আয়াত: ১০০)
৬. সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধসমাজকে সংশোধন ও সাফল্যের পথে পরিচালিত করার জন্য এই কাজটি অপরিহার্য। এটি ধর্ম, জীবন, জ্ঞান, সম্পদ ও বংশ—এই পাঁচটি মৌলিক প্রয়োজনীয়তাকে রক্ষা করে। এর মাধ্যমে সমাজের কল্যাণ নিশ্চিত হয় এবং স্থিতিশীলতা বজায় থাকে।
এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই আল্লাহ উম্মাহকে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছেন, “আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত, যারা কল্যাণের দিকে আহ্বান করবে, সৎ কাজের আদেশ দেবে এবং অসৎ কাজের নিষেধ করবে; আর এরাই হলো সফলকাম।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৪)
আরও পড়ুনবিশ্বাসীরা কখন সফল হবে০৮ মে ২০২৫৭. রাসুল (সা.)-এর খাঁটি অনুসরণসাফল্যের জন্য আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য একমাত্র সেই পদ্ধতিতেই করতে হবে, যা তিনি তাঁর রাসুল (সা.)-এর মাধ্যমে বিধিবদ্ধ করেছেন। যারা রাসুলের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, তাঁকে সাহায্য করে এবং তাঁর সঙ্গে নাজিলকৃত নূর (কোরআন) অনুসরণ করে, তারাই সফলকাম। (সুরা আরাফ, আয়াত: ১৫৭)
৮. অনুতাপ ও প্রত্যাবর্তনতওবা মানে আল্লাহর দিকে দ্রুত ফিরে আসা এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। এটি ভ্রান্ত পথ থেকে সরে আসার প্রতীক। আল্লাহ তায়ালা তওবাকে সাফল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করেছেন, “হে মুমিনগণ, তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তওবা করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সুরা জুমার, আয়াত: ৩১)
৯. আল্লাহকে স্মরণ করাআল্লাহর জিকির বা স্মরণ অধিক পরিমাণে করলে সফলতা অবশ্যম্ভাবী। কোরআনে বলা হয়েছে, “আর তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।” (সুরা জুমুআ, আয়াত: ১০)
১০. আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়াআল্লাহর নেয়ামত ও অনুগ্রহের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, যা তিনি কৃতজ্ঞদের জন্য প্রস্তুত রেখেছেন, এর মাধ্যমেও সাফল্য লাভ হয়: “সুতরাং আল্লাহর অনুগ্রহের কথা স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফল হতে পারো।” (সুরা আরাফ, আয়াত: ৬৯)
আরও পড়ুনসফল মুমিনের বৈশিষ্ট্য২৫ মার্চ ২০২৪