দেশে ব্যবহৃত জ্বালানি তেলে নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি সালফার পাওয়া গেছে। আর সরকারিভাবে নির্ধারিত মাত্রাও গ্রহণযোগ্য সীমার ৩৫ গুণ বেশি, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বায়ুদূষণের একটি বড় কারণ হলো জ্বালানি তেলে সালফার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ও বায়ুমানবিষয়ক গবেষক আবদুস সালাম প্রথম আলোকে বলেন, সালফার শুধু নিজে দূষণ করে না, বস্তুকণা তৈরি করে আরও কিছু উপাদানের দূষণে সহায়তা করে। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। তাই সারা পৃথিবীতে জ্বালানি তেলে সালফার কমিয়ে রাখে। দেশে পরীক্ষায় যে মাত্রায় সালফার পাওয়া গেছে, তা ভয়াবহ।
দেশে জ্বালানি তেল পরীক্ষা হয়েছে দুটি সংস্থায়। একটি হলো বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। দ্বিতীয়টি বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর)। এসব পরীক্ষায় কিছু নমুনায় জ্বালানি তেলে সালফার নির্ধারিত মাত্রা, অর্থাৎ ৩৫০ পিপিএমের (পার্টস পার মিলিয়ন) নিচে পাওয়া গেছে। কিছু নমুনায় পাওয়া গেছে ১ হাজার ৩৪৮ থেকে ২ হাজার ৮০০ পিপিএম পর্যন্ত।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চমাত্রায় সালফার পাওয়া ভয়াবহ ঘটনা। আর ৩৫০ পিপিএমের নিচে পাওয়া মানেই ভালো, তা নয়। কারণ, জ্বালানি তেলে সালফারের গ্রহণযোগ্য মাত্রা আসলে ১০ পিপিএম। ইউরোপের দেশগুলো ১০ পিপিএম মাত্রার ভালো মানের জ্বালানি তেল ব্যবহার করে। প্রতিবেশী দেশ ভারতও বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জ্বালানি তেলে সালফারের মাত্রা ঠিক করেছে ১০ পিপিএম।
বাংলাদেশে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৩ সালে কম দামে জ্বালানি তেল আমদানির সুযোগ তৈরি করতে সালফারের মাত্রা বাড়িয়ে ৩৫০ পিপিএম নির্ধারণ করে।
বিএসটিআই ও বিসিএসআইআরের বাইরে জ্বালানি বিভাগ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পরীক্ষাগারেও জ্বালানি তেল পরীক্ষা করেছে। সূত্র জানিয়েছে, সেখানে নির্ধারিত মাত্রার বেশি হারে সালফার পাওয়া যায়। তবে পুরো চিত্র প্রকাশ করেনি জ্বালানি বিভাগ।
মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনের ক্ষতি ও তেলের ট্যাংকে দ্রুত মরিচা পড়া নিয়ে নিয়মিত গ্রাহকের অভিযোগ আসছে।বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, বায়ুদূষণের বেশ কয়েকটি কারণ আছে, যার সবগুলো পরিবেশ অধিদপ্তর বা পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে নয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণটা হলো জ্বালানি তেলের মানমাত্রা। এটা ঠিক করা উচিত। তিনি বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরের বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর দায়িত্ব কী, সেটা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এক দেশের মানুষের ফুসফুস অন্য দেশের মানুষের চেয়ে ভিন্ন হয় না। তাই যেটা আন্তর্জাতিক মান, সেটায় উন্নীত হতে হবে।
বায়ুদূষণ ও জ্বালানি তেল
বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ শহরের মধ্যে নিয়মিত থাকছে ঢাকার নাম। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের ‘বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪’ অনুযায়ী, বায়ুদূষণে ২০২৪ সালে দেশ হিসেবে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। আর নগর হিসেবে বিশ্বের তৃতীয় শীর্ষ দূষিত নগর ছিল ঢাকা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের বায়ুমান গবেষণাকেন্দ্রের হিসাবে, বায়ুদূষণের তৃতীয় বড় উৎস হলো যানবাহনের কালো ধোঁয়া। এ ধোঁয়ার উৎস ডিজেল, পেট্রল ও অকটেনের মতো জীবাশ্ম জ্বালানি তেল।
জ্বালানি তেল আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্বে আছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। বেসরকারি পরিশোধনাগার থেকেও তেল কিনে নেয় বিপিসি। সরকারি তিনটি কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা পরিবেশকদের মাধ্যমে তেল বিক্রি করে বাজারে। জ্বালানি খাতের এসব সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তেল চুরি এবং ভেজাল মেশানোর অভিযোগ আছে। নিম্নমানের তেল নিয়ে একাধিকবার লিখিত অভিযোগ করেছে তেল কোম্পানির পরিবেশক ও ফিলিং স্টেশন (পেট্রলপাম্প নামে পরিচিত) মালিক সমিতি।
এক দেশের মানুষের ফুসফুস অন্য দেশের মানুষের চেয়ে ভিন্ন হয় না। তাই যেটা আন্তর্জাতিক মান, সেটায় উন্নীত হতে হবেসৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, পরিবেশ উপদেষ্টাউচ্চমাত্রার সালফার
দেশে বিভিন্ন পণ্যের মান নির্ধারণ করে বিএসটিআই। বাধ্যতামূলকভাবে মান সনদ নিতে হবে, এমন পণ্যের সংখ্যা ২২৯। এর মধ্যে জ্বালানি তেলও রয়েছে। ডিজেলের মান পরীক্ষার জন্য বিএসটিআইয়ের পরীক্ষাগার আছে শুধু ঢাকায়।
সূত্র বলছে, ঢাকার ১২টি ফিলিং স্টেশন থেকে সংগ্রহ করা তেলের নমুনা গত জুন ও জুলাইয়ে পরীক্ষা করেছে বিএসটিআই। এসব পরীক্ষার প্রতিবেদন নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চূড়ান্ত করা হয়। এর মধ্যে ৯টি নমুনায় সালফারের মানমাত্রা ৩৫০–এর নিচে পাওয়া গেছে। তবে অধিকাংশের মান ৩৫০–এর কাছাকাছি। একটিতে সবচেয়ে কম পাওয়া গেছে, যা ১০৮ পিপিএম।
তিনটিতে সালফার পাওয়া গেছে অনেক বেশি। গত ২৬ জুন ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে মেঘনা তেল কোম্পানির এক পরিবেশকের কাছ থেকে ডিজেলের নমুনা নেয় বিএসটিআই। এতে সালফারের মান পাওয়া গেছে ২ হাজার ৫৬৫ পিপিএম। একই এলাকায় পদ্মা তেল কোম্পানির এক পরিবেশকের কাছ থেকে ডিজেলের নমুনা নেয় বিএসটিআই। এতে সালফারের মান পাওয়া গেছে ১ হাজার ৮৮০ পিপিএম। একই দিনে যাত্রাবাড়ীতে যমুনা তেল কোম্পানির একটি পরিবেশক থেকে সংগ্রহ করা নমুনার ফল বলছে, ডিজেলে সালফারের মান ১ হাজার ৩৪৮ পিপিএম।
মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনের ক্ষতি ও তেলের ট্যাংকে দ্রুত মরিচা পড়া নিয়ে নিয়মিত গ্রাহকের অভিযোগ আসছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে গত ১০ অক্টোবর গাজীপুরে মেঘনা তেল কোম্পানির এক পরিবেশকের কাছ থেকে অকটেনের নমুনা সংগ্রহ করে একটি মোটরসাইকেল উৎপাদন ও বিপণনকারী কোম্পানি। তারা তা বিসিএসআইআরে পরীক্ষা করায়। গত ২০ অক্টোবর পাওয়া প্রতিবেদন বলছে, এতে সালফারের মাত্রা ২ হাজার ৮০০ পিপিএম।
এদিকে বিএসটিআই বলছে, ফিলিং স্টেশনমালিকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলে তাঁরা তেল কোম্পানিকে দোষারোপ করেন। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এবার তেল কোম্পানির ডিপো বা মজুতাগার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
সালফার শ্বাসনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এর ফলে অ্যাজমা, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ (সিওপিডি), ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্ট ও শিশুদের ফুসফুসের রোগের ঝুঁকি বাড়ে।জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক সাজিদ হোসেন খানদেশে পরিশোধিত তেলে উচ্চমাত্রায় সালফার
জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ৩৫০ পিপিএম পর্যন্ত সালফারযুক্ত ডিজেল উৎপাদিত হয়। ২০২২ সালে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে গেলে কম দামের ডিজেল আমদানির অনুমতি চায় বিপিসি। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সংস্থা বিএসটিআইতে আবেদন করে তারা। নিয়ম শিথিল করে শর্ত সাপেক্ষে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে ক্ষতিকর ডিজেল আমদানির সম্মতি দেয় শিল্প মন্ত্রণালয়। মানমাত্রায় ছাড় পাওয়ার ফলে ৫০০ থেকে আড়াই হাজার পিপিএম সালফারযুক্ত ডিজেল আমদানির সুযোগ পায় বিপিসি।
যদিও শিল্প মন্ত্রণালয়ের শর্তে বলা হয়, আমদানি করা ডিজেলের মাত্র ২০ শতাংশ হতে পারবে অধিক সালফারযুক্ত ডিজেল। আর তা বাজারজাতকরণের সময় বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মানের (৩৫০ পিপিএম) মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। যদিও তা মানা হচ্ছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি তেল শোধনাগার ৫৭ বছরের পুরোনো। এখানে সালফার পরিশোধনের প্ল্যান্ট নেই। নতুন শোধনাগার নির্মাণের পরিকল্পনায় এটা যুক্ত করা হয়েছে। এটা হলে সালফার কমে আসবে। তিনি বলেন, বাজারে ভেজাল তেলের বাণিজ্য প্রতিরোধে অভিযান চালানো হবে। ধাপে ধাপে সালফারের মাত্রা কমিয়ে আনা হবে।
বিএসটিআই বলছে, ফিলিং স্টেশনমালিকদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হলে তাঁরা তেল কোম্পানিকে দোষারোপ করেন। তাই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এবার তেল কোম্পানির ডিপো বা মজুতাগার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।নতুন শোধনাগার কত দূর
বিপিসির অধীনে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) বর্তমান শোধনাগারটি তৈরি হয় ১৯৬৮ সালে। জ্বালানি তেল পরিশোধনে ৩০ লাখ টন সক্ষমতার ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল-২’ নামের নতুন প্রকল্প নেওয়া হয় ২০১২ সালে। এটি করা গেলে বছরে প্রায় ২৪ কোটি ডলার বা আড়াই হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হওয়ার কথা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছিল। ফ্রান্সের কোম্পানি নিয়োগের আলোচনাও হয়েছিল।
কিন্তু বিগত সরকারের পুরো মেয়াদে অর্থায়ন নিশ্চিত করা যায়নি। অথচ প্রতিবছর তিন থেকে চার হাজার কোটি টাকা মুনাফা করছে বিপিসি। গত বছর এস আলমের সঙ্গে যৌথভাবে এটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত দেয় আওয়ামী লীগ সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে এটি বাতিল করে দেয়।
এদিকে এখন নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তবে প্রকল্পের খরচ বেড়ে হয়েছে ৪২ হাজার ৯৭৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ দেবে সরকার, আর ৪০ শতাংশ দেবে বিপিসি। মডার্নাইজেশন অ্যান্ড এক্সপানশন অব ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড নামের প্রকল্পটি এখনো পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, দুটো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। প্রথমত, মানকাঠামো ঠিক করা। দ্বিতীয়ত, তেল আমদানি করে দেশে আনার পর নতুন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে পরিশোধনের মাধ্যমে সালফার কমিয়ে আনা। নতুন পরিশোধনাগার নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপি শিগগিরই অনুমোদন হতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
শিশুমৃত্যুর পেছনে বায়ুদূষণ
বায়ুদূষণে ক্ষতি কত, তা নিয়ে বিশ্বব্যাংক ২০২২ সালের ডিসেম্বরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ২০১৯ সালে ৭৮ থেকে ৮৮ হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য বায়ুদূষণ দায়ী ছিল। যেসব এলাকায় বায়ুদূষণ বেশি, সেসব এলাকার মানুষ তুলনামূলক বেশি মাত্রায় বিষণ্নতায় ভোগে। বায়ুদূষণের কারণে ক্ষতি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৪ দশমিক ৪ শতাংশ।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক সাজিদ হোসেন খান প্রথম আলোকে বলেন, সালফার শ্বাসনালিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং ফুসফুসের কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। এর ফলে অ্যাজমা, দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ (সিওপিডি), ব্রঙ্কাইটিস, শ্বাসকষ্ট ও শিশুদের ফুসফুসের রোগের ঝুঁকি বাড়ে। অল্প মাত্রার সালফারও সংবেদনশীল ব্যক্তিদের মধ্যে হাঁপানি ‘অ্যাটাক’ সৃষ্টি করতে পারে। দীর্ঘ মেয়াদে এটি হৃদ্রোগের ঝুঁকি বাড়ায়। তিনি বলেন, বাতাসে সালফারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ত ল ক ম প ন র এক শ ব সতন ত র র প রথম আল ক ল আমদ ন র প রকল প পর ব শ ব শ বব পর ক ষ প রক শ পর শ ধ ত ল পর উৎপ দ ইনস ট সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
স্বাদুপানির মাছ কমে যাচ্ছে: প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে
‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ শব্দবন্ধটি একসময় শুধু পাঠ্যবইয়ের বুলি ছিল না, ছিল আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। বর্ষায় থই থই করা বিলে মাছের দাপাদাপি, জলের রুপালি ফসলে জেলের মুখে হাসি, আর পাতে ভাপে সেদ্ধ বা ঝোল করা দেশি মাছের স্বাদ—বাঙালির সংস্কৃতির এই অবিচ্ছেদ্য অংশটি আজ হুমকির মুখে।
আমাদের স্বাদুপানির মাছ বা দেশি মাছের ভান্ডার আজ আশঙ্কাজনক হারে ফুরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি কি কেবলই আমাদের রসনার তৃপ্তি বা আমিষের অভাব? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়?
হারিয়ে যাওয়া শৈশব ও বর্তমান বাস্তবতাবেশি দিন আগের কথা নয়, গ্রামবাংলার খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ছিল দেশি মাছের প্রজননক্ষেত্র। পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, খলিসা, মলা, ঢেলা, শোল, গজার নামগুলো বলে শেষ করা যাবে না।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ ছিল; কিন্তু বর্তমানে এর একটি বিশাল অংশ বিপন্ন, অতি বিপন্ন অথবা বিলুপ্তির পথে।
আমরা এখন বাজারে যে মাছ দেখি, তার বড় অংশই চাষের—পাঙাশ, তেলাপিয়া কিংবা হাইব্রিড কই। এই মাছগুলো আমাদের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে সত্য; কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মাছের যে অভাব তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়।
কেন এই বিষণ্নতামাছ কমে যাওয়ার পেছনে একক কোনো কারণ নেই; বরং এটি মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের সমষ্টিগত ফল। উন্নয়নের নামে নদী, খাল ও বিল ভরাট করে তৈরি হচ্ছে আবাসন বা শিল্পকারখানা। মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র বা ‘নার্সারি গ্রাউন্ড’ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবার কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও কৃষিজমিতে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশছে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলছে।
কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন মাছের বংশবিস্তারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের অস্থিতিশীল আবহাওয়া মাছের প্রজননে প্রভাব ফেলছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা ও তাপমাত্রার পরিবর্তন মাছের প্রজনন চক্রকে ব্যাহত করছে।
প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবেএখন মূল প্রশ্ন এখানেই—মাছ কমে গেলে পরিবেশের কী এমন ক্ষতি হবে? উত্তর হলো চরম বিপর্যয় ঘটবে।
খাদ্যশৃঙ্খলে ধস: স্বাদুপানির মাছ কেবল মানুষের খাদ্য নয়, এটি জলজ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের একটি অপরিহার্য অংশ। মাছ কমে গেলে মাছরাঙা, বক, চিল, পানকৌড়ি এবং ভোঁদড়ের মতো প্রাণী খাদ্যসংকটে পড়ে। ইতিমধ্যে গ্রামবাংলা থেকে অনেক মাছশিকারি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পানির গুণ রক্ষা: অনেক প্রজাতির মাছ (যেমন আবর্জনাভুক মাছ) পানি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এরা পচনশীল দ্রব্য খেয়ে জলাশয়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। মাছ না থাকলে জলাশয়গুলো দ্রুত দূষিত হবে এবং মশা-মাছির উপদ্রব বাড়বে।
বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য: জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং প্লাঙ্কটনের ভারসাম্য রক্ষায় মাছের ভূমিকা অপরিসীম। মাছের অভাব পুরো জলজ পরিবেশকে মৃতপ্রায় বা ডেড জোনে পরিণত করতে পারে।
সুতরাং মাছ কমে যাওয়া মানে কেবল খাবারের প্লেটে সংকট নয়; বরং পুরো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার সতর্কবার্তা।
অর্থনৈতিক ও পুষ্টির সংকটগ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন এ–এর প্রধান উৎস ছিল ছোট মাছ। এই মাছগুলো হারিয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া যারা বংশপরম্পরায় জেলে পেশায় জড়িত, নদীতে মাছ না পেয়ে তাঁরা আজ বেকার। বাধ্য হয়ে তাঁরা পেশা পরিবর্তন করছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।
হতাশার মধ্যে ও আশার আলো হলো প্রকৃতিকে সুযোগ দিলে সে নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ—
মৎস্য অভয়াশ্রম বৃদ্ধি: হাওর ও নদীগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অংশকে সারা বছরের জন্য বা প্রজনন মৌসুমে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করে কঠোরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।
দূষণ রোধ: শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলার আগে শোধন (ইটিপি ব্যবহার) বাধ্যতামূলক করতে হবে। কৃষিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।
জনসচেতনতা ও আইন প্রয়োগ: কারেন্ট জাল বা বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
জলাশয় পুনরুদ্ধার: ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-বিল খনন করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।
স্বাদু পানির মাছ রক্ষা করা কেবল মৎস্য অধিদপ্তরের কাজ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নদী বাঁচলে মাছ বাঁচবে; আর মাছ বাঁচলে টিঁকে থাকবে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জাদুঘরে গিয়ে জানবে—একদা এ দেশে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ নামে একটি জাতি ছিল।
প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র টিঁকে থাকবে কি না, তার উত্তর নির্ভর করছে আজ আমরা প্রকৃতির প্রতি কতটা সদয় আচরণ করছি, তার ওপর। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।
হেনা শিকদার দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়