পাক-বাহিনীর গুলিতে আমাদের বাসার দেয়াল ছিদ্র হয়ে গিয়েছিলো
Published: 13th, December 2025 GMT
১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ দুপুরবেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ডামি রাইফেল নিয়ে প্রশিক্ষণ শেষ করে আমি আর শিরীন আখতারবাড়ি ফেরার সময় জেনে এসেছিলাম— আজ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বিকালে খবর এলো ‘রাতে পাক আর্মি ঢাকা শহরে অভিযান চালাতে পারে’। আজিমপুর কলোনির ছেলেরা, আজিমপুর সংলগ্ন রাস্তায় ব্যারিকেড দিতে নেমে গেলো। তারা ব্যারিকেড দিয়ে ফিরে আসার কিছু সময় পরে ২৫ মার্চ, আনুমানিক রাত, ১২ টা নাগাদ পাক আর্মির বর্বরোচিত হামলা শুরু হলো।
আমাদের বাসা ছিল আজিমপুর কলোনির ১৪ নম্বর বিল্ডিংয়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কের গুলি আমাদের বাসার দেয়াল ছিদ্র করে দিয়েছিল। সেই রাতে আমরা সবাই প্রাণ বাঁচাতে খাটের নিচে আশ্রয় নিয়েছিলাম।
আরো পড়ুন:
কক্সবাজার হানাদারমুক্ত দিবস ১২ ডিসেম্বর
আদিল একাই পিলখানার বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়েছিলেন
২৭ মার্চ পাক আর্মির দেওয়া সান্ধ্য আইন শিথিল হলে, অনেকেই প্রাণ বাঁচানোর উদ্দেশ্য বিভিন্ন জায়গায় চলে যাচ্ছিলো। আমরা ১১ ভাই বোন। তারপর আবার আমাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। তিতাস নদীর গোকর্ণ ঘাট সংলগ্ন হওয়ায় আমাদের বাড়িতে স্বাধীনতাকামী মানুষ ক্যাম্প করেছিল। সে খবর আব্বা জানতে পেরেছিলেন। এজন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন—আজিমপুরের বাসাতেই থাকবেন এবং মরতে হলে এখানেই মরবেন।
এপ্রিল থেকে কলোনির তরুণরা একে একে বাড়ি ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চলে গেলো। আমরা যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম। বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করারপরে সংগঠনের নেতাদের কাছ থেকে খবর এলো ‘দেশে থেকেই কাজ চালিয়ে যেতে হবে’।
আমরা নিজেরা একটা দল গঠন করলাম। আমাদের দলে ছিল - আজিমপুর কলোনির ১০ নম্বর বিল্ডিং এর খালা,ফৌজিয়া মির্জা, শিরীন আখতার,আমি, মলি, নীলু,বেবী, লিটু। এরপরে সংযুক্ত হলো সানু ভাই (সেক্টর টু থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে)। প্রথমে ঠিক করলাম কলোনির পাকি প্রেমি দালালদের ‘লাল ছিঠি দিব’। লাল চিঠিতে লাল কালি দিয়ে লেখা থাকবে সাবধান বাণী। চিঠির ভেতরে কালো কালি দিয়ে লিখলাম ‘‘তোমরা যা যা করছো সব খবর মুক্তিবাহিনীর কাছে চলে যাচ্ছে, সাবধান হয়ে যাও।’’
চিঠি লিখে গোপনে তাদের টিঠির বক্সে রেখে আসতাম। সে সময় কলোনির সামাজিক সম্পর্ক এমন ছিল যে—যখন-তখন একজন আরেকজনের বাড়িতে যেতে পারতো। পরের দিন আমাদের মধ্যে কেউ একজন, সেই বাড়িতে গিয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া দেখে আসতো। লাল চিঠি পেয়ে তাদের ভীত, চিন্তিত চেহারা দেখে আমরা আনন্দিত হতাম।
আমাদের দলের সদস্যরা আরও একটি দায়িত্ব পালন করার নির্দেশ পেয়েছিলো, তাহলো বাড়ি বাড়ি মুক্তিযুদ্ধের খবর পৌঁছে দিতে হবে। কীভাবে তা সম্ভব? লিফলেট বিলি করা ছাড়া তা সম্ভব ছিলো না। সানু ভাই দায়িত্ব নিলেন,লিফলেট তৈরি করার। তিনি গোপনে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের একজন কর্মচারীকে দিয়ে সাইক্লোস্টাইল করে লিফলেট বানিয়ে এনে দিলেন। আজিমপুর বিশাল এলাকা জুড়ে রাতের অন্ধকারে আমরা বাড়ি বাড়ি,চিঠির বক্সে, কিংবা দরজার নিচ দিয়ে লিফলেট রেখে আসতাম।
তখনকার আজিমপুর কলোনি ঘিরে সড়কগুলো ছিল সবই পরিচিত। আজিমপুর কলোনির পাশ দিয়ে নিউ মার্কেট হয়ে মিরপুর সড়ক। শহীদ মিনার থেকে আরেকটি সড়ক আজিমপুর কলোনির দুই ভাগের মাঝ দিয়ে চলে গেছে নিউ পল্টন ইপিআর গেটের দিকে। এই সড়কগুলোতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আনাগোনা বেশি ছিল। আমরা সড়কগুলোতে পোস্টার লাগানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।
আজিমপুর এর পাশে শেখ সাহেব বাজারে, অনেক প্রেস ছিল।কিন্ত গোপনীয়তার কারণ সেখান থেকে পোস্টার তৈরি করা সম্ভব নয়। লিটু সানু,ভাই মিলে গোপনে ‘পাইওনিয়ার প্রেস’ থেকে পোস্টার ছাপিয়ে নিয়ে এলো। ফৌজিয়া খালার বাসায় রেখে আামরা পোস্টারগুলো রংতুলি দিয়ে পাক আর্মিদের ছবি এঁকে আরো উজ্জ্বল করেছিলাম। যাতে পাক আর্মির দৃষ্টি পড়ে। আমি আর শিরীন আপা ফজরের আজান দেওয়ার আগে আটা দিয়ে আঠা বানিয়ে পোস্টার নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে পড়তাম। কলোনির গেইট দিয়ে বাইরে বের হয়ে দ্রুত রাস্তায় পোস্টার সাঁটিয়ে কলোনিতে ঢুকে পড়তাম। ফজরের আজান এর সময়, অনেকে নামাজ পড়তে মসজিদে যেতেন। আমাদের পোস্টার যেমন আজিমপুর কলোনিতে সাড়া ফেলেছিল, ঠিক তেমনি পাকিস্তান আর্মিকে চিন্তিত করেছিল। সে সময় পাকিস্তান আর্মি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিদিনের ঘটনা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাতো। সাংবাদিক আরিফুর রহমান সে দলিল সংগ্রহ করে,বই আকারে প্রকাশ করেন – ‘৭১ এর গোপন দলিল’ নামে। বইটির ৮৫ পৃষ্ঠায়, আমাদের আজিমপুর কলোনির রিপোর্ট উল্লেখ আছে—
‘‘১৪ আগস্ট ৭১ ঢাকার আজাদ মসজিদ বাস স্টপের কাছে আজিমপুর কলোনির দেয়ালে বাংলা ভাষায় লিখিত কয়েকটি পোস্টার সাঁটানো অবস্থায় পাওয়া যায়। এগুলোতে লেখা আছে।
১/ বঙ্গবন্ধুর বিচার বাতিল কর।
২/শান্তি কমিটি হুশিয়ার
৩/১৪ আগস্ট নয় ২৬ মার্চ ’’
১৯৭১ সালের নভেম্বরে ঈদ এলো। পাক- সরকার পূর্ব পাকিস্তানের সব স্বাভাবিক আছে— তা দেখাবার জন্য মানুষকে ঈদ উদযাপন করতে বাধ্য করার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরা স্থির করলাম, ঈদ উদযাপন না করার জন্য বাড়ি বাড়ি চিঠি বিলি করবো। সে সময় মলির লেখালেখির ঝোঁক ছিল। মলিকে দিয়ে ঈদের চিঠি লেখালাম। সানু ভাই ছিলেন আর্ট কলেজের শিক্ষক। তিনি সামসুল ইসলামকে দিয়ে চিঠির উপরে ছবি এঁকে আনলেন। আজিমুর কমিউনিটি সেন্টার এর একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারিকে দিয়ে ঈদের চিঠি সাইক্লোস্টাইল করে নিয়ে এলেন। আমরা পুরো রোজার মাসব্যাপী আজিমপুর কলোনিতে গোপনে চিঠি বিলি করলাম। এই চিঠি সেক্টর টু এর সহযোগিতায় ঢাকার অন্যান্য এলাকায়ও বিলি করা হয়েছিল।
আজিমপুর কলোনির মুক্তিযোদ্ধা সজীব বাহিনীর সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিল। সজীব ভাই,প্রয়োজনে আমাদের সাথে যোগাযোগ করতেন। আমরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতাম।
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আম দ র ব প ক আর ম ল ফল ট করল ম
এছাড়াও পড়ুন:
কাস্টমস কর্মকর্তাদের ভয় দেখাতে হামলা, নির্দেশদাতা এখনো পলাতক
চট্টগ্রাম নগরে কাস্টমসের দুই কর্মকর্তার প্রাইভেট কার থামিয়ে হামলার ঘটনায় দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে নগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। আজ বৃহস্পতিবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে বান্দরবান থেকে কাজী মো. ইমন হোসেন (২৩) ও মো. সুজন (২৪)–কে গ্রেপ্তার করে ডিবি (পশ্চিম)। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জানান, এক ব্যক্তির নির্দেশে কাস্টমস কর্মকর্তাদের ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে এ হামলা চালান। সেই নির্দেশদাতা এখনো পলাতক।
নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (গণমাধ্যম) আমিনুর রশীদ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেন, হামলার সময় ওই ব্যক্তির মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়। কাস্টমস কর্মকর্তাকে ভয় দেখানোই ছিল হামলার লক্ষ্য। পলাতক অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে।
৪ ডিসেম্বর সকালে নগরের ডবলমুরিং থানার সিডিএ আবাসিক এলাকায় কাস্টমসের রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান খান ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা বদরুল আরেফিন ভাড়ায় নেওয়া প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছিলেন। এ সময় মোটরসাইকেলে করে তিন ব্যক্তি তাঁদের গাড়ি থামিয়ে চাপাতি দিয়ে গাড়ির কাচে কোপ দেন। গাড়ির কাচ ভাঙার পাশাপাশি হামলাকারীরা একজন আরেকজনকে বলতে থাকেন, ‘গুলি কর, গুলি কর’। তবে দুই কর্মকর্তা দ্রুত গাড়ি সরিয়ে ঘটনাস্থল থেকে চলে আসেন।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের ধারণা, সম্প্রতি বিভিন্ন অনিয়ম, রাজস্ব জালিয়াতি ও নিষিদ্ধ পণ্য আমদানি আটকে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়ে জড়িত চক্র হামলা চালাতে পারে। কাস্টমসের তথ্য অনুযায়ী, গত কয়েক মাসে প্রায় ১০ কোটি টাকা মূল্যমানের নিষিদ্ধ পপি বীজ ও ঘন চিনি, প্রায় ৩০ কোটি টাকার নিষিদ্ধ সিগারেট এবং মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা বিপুল পরিমাণ প্রসাধনী জব্দ করা হয়েছে। এসব অভিযানে দুজন কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন। প্রসাধনী জব্দের পর মো. আসাদুজ্জামানকে ফোনে হুমকিও দেওয়া হয়।
হামলার নির্দেশদাতার পরিচয় এখনো প্রকাশ করেনি পুলিশ। তদন্তের স্বার্থে নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে তারা। তবে হামলায় ওই ব্যক্তির ব্যক্তিগত মোটরসাইকেল ব্যবহার করা হয়েছিল।
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের ডেপুটি কমিশনার মো. তারেক মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, নিষিদ্ধ পপি বীজ, ঘন চিনি ও মিথ্যা ঘোষণায় আসা প্রসাধনী জব্দের কারণে একটি সিন্ডিকেট ক্ষুব্ধ। গত দুই মাসে এসব সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এরপর থেকেই বিভিন্ন নম্বর থেকে হুমকি আসছে।
আরও পড়ুনগাড়ি থামিয়ে কাচে চাপাতির কোপ, একজন বলতে থাকেন, ‘গুলি কর, গুলি কর’০৪ ডিসেম্বর ২০২৫