‘সকল মহিমা তোমার’ আহমেদ স্বপন মাহমুদের দম ও ধ্যানে সৃষ্ট এক প্রকার আত্মচরিত। ‘আত্ম’ মানে আপন ও অপরের অভেদ ভাব, অখণ্ডতা। এই কাব্য মানবজীবনের অদৃশ্য অস্তিত্বের রহস্যভরা ছায়াছবি– মানুষের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক অথবা সম্পর্কহীনতার বিশালতা নিয়ে এ এক গভীর দার্শনিক জগতের গাঢ় বিশ্লেষণ।

এ কাব্য পরমের, পরমের আকারহীনতা, ঐশ্বরিক ভালোবাসা, আত্ম-অনুভব– আত্মমৈথুনের অনুভবও হয়তো বা। জীবনের চক্রবৃদ্ধি শেষে শূন্যতায় লীন হওয়ার প্রকৃতি-বিধান থেকে উৎসৃত গম্ভীর কাব্য। মানবাত্মার যাত্রাবিন্দু ও বিকাশকে একবার আকারে, একবার সাকারে, একবার নিরাকারে অনুসন্ধান করতে করতে কবি যেন ইন্দ্রিয়জ ও ইন্দ্রিয়াতীত জগৎ পরিভ্রমণের পথে মায়া হয়ে যান। পরামানবিক এবং মানবিক জীবনের পারস্পরিক সম্পর্ক চর্চা করতে করতে আহমেদ স্বপন মাহমুদ মরমি হয়ে ওঠেন, নিজেই হয়ে ওঠেন পরম।

পরম তো সৃষ্টির মূল, আবার পরমেই বিলয়-সারত্বের অমীয় ধারণা, বিমূর্ত অথচ সর্বপ্রাণে বহুমূর্তরূপে প্রকাশের ধারণা। একি জীবন, নাকি জীবনের অবশেষ? কিংবা হয়তো অজানা জগতে মগ্ন হয়ে আত্ম-প্রতিবিম্বের দিকে মহাযাত্রা। বোধ ও বোধাতীত প্রকাশ ও অপ্রকাশের সৌন্দর্য; ভালোবাসা ও রিপুতাড়িত আকাঙ্ক্ষার শিকলে ছটফট করতে করতে আহমেদ স্বপন মাহমুদ অতিক্রমযোগ্য এক অতীন্দ্রিয় মহাজগতের দিকে ধাবিত হন। 

কিন্তু ভক্ত ও পরমের মিলনকে তিনি উল্টোভাবে দেখান, সম্ভবত ‘সত্য’ উন্মোচন করেন; দেখা যায়, পরমই এগিয়ে আসে জীবাত্মায় মিলিবার লাগি! সবকিছু ঘটে আত্মার মধ্যে, আসলে এই দেহে। দেহভান্ডে উপনীত হয়ে ব্রহ্মাণ্ড যেন গুটিসুটি মেরে বসে থাকে বিভ্রান্ত হয়ে। স্রষ্টা বসে থাকে সৃষ্টির গহিন গহ্বরে। অন্যদিকে আত্মার বাইরে, মানবজীবন শ্রেষ্ঠ প্রেমানন্দের উৎস সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। বাইরে খোঁজে পরমকে– ভুলে যায় যে, আত্মতেই আছে গভীর ধ্যান ও আত্মসমর্পণ উপলব্ধি করার সক্ষমতা অর্জনের সাধনা, যেখানে পরম এবং মরণশীলের দিদার লাভের ঘটনা ঘটে। যে জানে, সেই জানে। জানেন হয়তো আহমেদ স্বপন মাহমুদ। কিংবা জানার এক অলীক মুহূর্ত তাঁর জীবনে উপস্থিত হয়– তিনি লিখে ফেলেন সকল মহিমা তোমার। 

মানবজীবন, সর্বপ্রাণের জীবন, এক তীর্থযাত্রার মতো ফুটে ওঠে এই কবিতায়। যেখানে জীবাত্মা ধাবমান হয় পরমাত্মার দিকে, পরম নামে জীবের কলবে। পৃথিবীর অভিজ্ঞতার বিভ্রমে সেই যাত্রা সাধারণ্যের মনোজগৎ থেকে মুছে যায়। কেউ কেউ দেখার চোখ অর্জন করে নিরন্তর সাধনায়। সকল মহিমা তোমার সেই সাধনা– সেই মহাযাত্রার বর্ণিল বর্ণনা, যেখানে সৃষ্টি ও ধ্বংসচক্রের মধ্য দিয়ে জ্ঞান এবং সত্যের অনুসন্ধান চলমান। প্রেম ও বেদনার ঐক্যে আত্মা যেখানে পরিশুদ্ধ হয়; দুঃখ, ক্ষয়, শূন্যতা হয়ে ওঠে পরাজাগতিক পূর্ণতার সর্বনাম। 

এই মহাকবিতার অঙ্গে অঙ্গে প্রকৃতির বিচিত্র উপাদান– আলো, পানি, বায়ু এবং মহাজাগতিক অদৃশ্য শক্তির অদ্ভুত চিত্রকল্প খেলা করে; যেখানে নদী, নৌকা, তীরের মতো প্রতীকগুলো মানবাত্মার যাত্রারম্ভের ইঙ্গিত দেয়– অস্তিত্বের বিভিন্ন স্তর থেকে অনস্তিত্বের দিকে। যেতে যেতে বলতে চায়– পৃথিবীর প্রপঞ্চগুলো আসলেই তুচ্ছ এবং আসল হলো পরমের সঙ্গে মিলিত হবার প্রাণময় বাসনা।

কবিতাটি ঘোরে-বেঘোরে মানুষের অস্তিত্বের পরস্পরবিরোধী অবস্থানগুলোর বিতর্ক তোলে; জীবন এবং মৃত্যুর সমীকরণ রচনা করে। ‘এক’ থেকে আলাদা হওয়ার যন্ত্রণা, পরমের সঙ্গে লীন হওয়ার বাসনার মধ্য দিয়ে প্রশমিত করতে করতে হাহাকার করে। যন্ত্রণাবিদ্ধ মানব-হৃদয়ের এ এক উন্মত্ত আত্মক্রন্দন। আত্মসমর্পণের প্রয়োজনীয়তা ছাড়া পার্থিব ইচ্ছাকে নগণ্য জ্ঞান করতে পারার মহৎ ক্রন্দন। অথবা, এসব কিছুই নয় হয়তো। কেবল শূন্যতা ও অস্তিত্বের মধ্যে দুলতে থাকা অশেষ পেন্ডুলাম ঝুলে থাকে অলীক অন্তরীক্ষে।  

এই কাব্যটি এক ধরনের প্রার্থনা মনে হয়। স্তুতি স্তোত্রও বটে। কার স্তুতি! পরমের। কে এই পরম! যদি সে মানবাত্মায় বিরাজ করে– তাহলে মানুষই তো। মানুষই পরম। 

এমনও মনে হয় যে, ‘সকল মহিমা তোমার’ একটি আহ্বান। মানব জীবনের পবিত্রতা উপলব্ধি করে পরমের সঙ্গে একীভূত হওয়ার যুগপৎ কামার্ত ও নিষ্কাম আহ্বান। 
সকল মহিমা তোমার।। আহমেদ স্বপন মাহমুদ।। কবিতা।। মাটিয়া মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন্স।। প্রচ্ছদ: সারা তৌফিকা ।। পৃষ্ঠা: ৩২।। মূল্য :  ১০০ টাকা

নূরুননবী শান্ত, কথাসাহিত্যিক ও ফোকলোর গবেষক
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: বইম ল শ ন যত জ বন র হওয় র

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ইসরায়েলের হামলা

রবিবার বিকেল থেকে ইরানজুড়ে নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

রবিবার রাতে ইরানের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাইদ খাতিবজাদেহ ইসরায়েলি হামলার তথ্য নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ একটি পোস্টে তিনি জানান, রবিবার রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। খবর তুরস্কের বার্তা সংস্থা আনাদোলুর।

এক্স-পোস্টে সাইদ বলেছেন, “ইসরায়েলের অপরাধী শাসকগোষ্ঠী রাজনৈতিক ও আন্তর্জাতিক গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ভবনে ইচ্ছাকৃত এবং নির্মম হামলা চালিয়েছে।”

আরো পড়ুন:

ইসরায়েলের নতুন হামলায় ইরানের আইআরজিসির গোয়েন্দা প্রধান নিহত

ইসরায়েলে ৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ল ইরান, তেল আবিব ও হাইফাতে সরাসরি আঘাত

উপ-মন্ত্রী আরো বলেন, “এই হামলায় বেশ কয়েকজন বেসামরিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, আমার বেশ কয়েকজন সহকর্মীও আহত হয়েছেন, যাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।”

সাইদ বলেন, “এটি আরো একটি স্পষ্ট যুদ্ধাপরাধ, ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীর চলমান ও নিয়মতান্ত্রিক আগ্রাসন অভিযানের অংশ।”

এর আগে শনিবার ইরানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সদর দপ্তরে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।

ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, তারা তেহরানের অস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতা ধ্বংস করার লক্ষ্যে ইরানের আইআরজিসি ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে রবিবার নতুন করে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়েছে।

বিবৃতিতে  বলা হয়, এই হামলায় ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি), গার্ডস কুদস ফোর্স এবং ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর অবকাঠামো লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী আরো জানিয়েছে, ইরানজুড়ে অসংখ্য অস্ত্র উৎপাদন কেন্দ্রে হামলা চালানো হয়েছে। 

ইরানি বার্তাসংস্থা তাসনিম নিউজ জানিয়েছে, ইসরায়েলের এই হামলায় আইআরজিসিরি গোয়েন্দা প্রধান মোহাম্মদ কাজেমি এবং তার সহকারী হাসান মোহাকিক নিহত হয়েছেন। এছাড়া মোহসেন বাঘারি নামে আইআরজিসির আরো একজন জেনারেল নিহত হয়েছেন। এর প্রতিশোধ নিতে রবিবার রাতে ইসরায়েলে ৫০টি ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও শতাধিক ড্রোন ছুড়েছে ইরান।

ইসরায়েলের ফায়ার ও রেসকিউ সার্ভিসের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, উত্তর ইসরায়েলে দুটি এবং হাইফায় একটি আবাসিক ভবনে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র সরাসরি আঘাত হানার খবর পেয়েছে তারা।

ইসরায়েলি জাতীয় জরুরি সেবা সংস্থা জানিয়েছে, হাইফায় ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে সাতজন আহত হয়েছেন। এছাড়া কিরিয়াত গাটের কাছে দক্ষিণাঞ্চলীয় একটি শহরে একজন আহত হয়েছেন।

এ ঘটনায় ইসরায়েলি সেনাপ্রধান ইয়াল জামির ইরানের ওপর আক্রমণ আরো তীব্র করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। একটি বিবৃতি জারি করে ইসরায়েরি সেনাপ্রধান বলেছেন, “আমরা আমাদের অভিযান তীব্রতর করে যাব এবং এটি করে, আগামী বছরগুলোতে আমাদের নিরাপত্তা জোরদার করব। আমরা জানতাম এর একটি মূল্য দিতে হবে এবং এটিই বোঝায় যে, আমরা কেন এখনই পদক্ষেপ নিয়েছি, তা অনেক দেরি হওয়ার আগেই।”

ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শুক্রবার থেকে ইসরায়েলি হামলায় ২২৪ জন নিহত এবং ৯০০ জন আহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত এবং ৩৭০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ