শূন্যতা ও অস্তিত্বের মধ্যে দুলতে থাকা অশেষ পেন্ডুলাম
Published: 6th, February 2025 GMT
‘সকল মহিমা তোমার’ আহমেদ স্বপন মাহমুদের দম ও ধ্যানে সৃষ্ট এক প্রকার আত্মচরিত। ‘আত্ম’ মানে আপন ও অপরের অভেদ ভাব, অখণ্ডতা। এই কাব্য মানবজীবনের অদৃশ্য অস্তিত্বের রহস্যভরা ছায়াছবি– মানুষের আধ্যাত্মিক সম্পর্ক অথবা সম্পর্কহীনতার বিশালতা নিয়ে এ এক গভীর দার্শনিক জগতের গাঢ় বিশ্লেষণ।
এ কাব্য পরমের, পরমের আকারহীনতা, ঐশ্বরিক ভালোবাসা, আত্ম-অনুভব– আত্মমৈথুনের অনুভবও হয়তো বা। জীবনের চক্রবৃদ্ধি শেষে শূন্যতায় লীন হওয়ার প্রকৃতি-বিধান থেকে উৎসৃত গম্ভীর কাব্য। মানবাত্মার যাত্রাবিন্দু ও বিকাশকে একবার আকারে, একবার সাকারে, একবার নিরাকারে অনুসন্ধান করতে করতে কবি যেন ইন্দ্রিয়জ ও ইন্দ্রিয়াতীত জগৎ পরিভ্রমণের পথে মায়া হয়ে যান। পরামানবিক এবং মানবিক জীবনের পারস্পরিক সম্পর্ক চর্চা করতে করতে আহমেদ স্বপন মাহমুদ মরমি হয়ে ওঠেন, নিজেই হয়ে ওঠেন পরম।
পরম তো সৃষ্টির মূল, আবার পরমেই বিলয়-সারত্বের অমীয় ধারণা, বিমূর্ত অথচ সর্বপ্রাণে বহুমূর্তরূপে প্রকাশের ধারণা। একি জীবন, নাকি জীবনের অবশেষ? কিংবা হয়তো অজানা জগতে মগ্ন হয়ে আত্ম-প্রতিবিম্বের দিকে মহাযাত্রা। বোধ ও বোধাতীত প্রকাশ ও অপ্রকাশের সৌন্দর্য; ভালোবাসা ও রিপুতাড়িত আকাঙ্ক্ষার শিকলে ছটফট করতে করতে আহমেদ স্বপন মাহমুদ অতিক্রমযোগ্য এক অতীন্দ্রিয় মহাজগতের দিকে ধাবিত হন।
কিন্তু ভক্ত ও পরমের মিলনকে তিনি উল্টোভাবে দেখান, সম্ভবত ‘সত্য’ উন্মোচন করেন; দেখা যায়, পরমই এগিয়ে আসে জীবাত্মায় মিলিবার লাগি! সবকিছু ঘটে আত্মার মধ্যে, আসলে এই দেহে। দেহভান্ডে উপনীত হয়ে ব্রহ্মাণ্ড যেন গুটিসুটি মেরে বসে থাকে বিভ্রান্ত হয়ে। স্রষ্টা বসে থাকে সৃষ্টির গহিন গহ্বরে। অন্যদিকে আত্মার বাইরে, মানবজীবন শ্রেষ্ঠ প্রেমানন্দের উৎস সন্ধানে ছুটে বেড়ায়। বাইরে খোঁজে পরমকে– ভুলে যায় যে, আত্মতেই আছে গভীর ধ্যান ও আত্মসমর্পণ উপলব্ধি করার সক্ষমতা অর্জনের সাধনা, যেখানে পরম এবং মরণশীলের দিদার লাভের ঘটনা ঘটে। যে জানে, সেই জানে। জানেন হয়তো আহমেদ স্বপন মাহমুদ। কিংবা জানার এক অলীক মুহূর্ত তাঁর জীবনে উপস্থিত হয়– তিনি লিখে ফেলেন সকল মহিমা তোমার।
মানবজীবন, সর্বপ্রাণের জীবন, এক তীর্থযাত্রার মতো ফুটে ওঠে এই কবিতায়। যেখানে জীবাত্মা ধাবমান হয় পরমাত্মার দিকে, পরম নামে জীবের কলবে। পৃথিবীর অভিজ্ঞতার বিভ্রমে সেই যাত্রা সাধারণ্যের মনোজগৎ থেকে মুছে যায়। কেউ কেউ দেখার চোখ অর্জন করে নিরন্তর সাধনায়। সকল মহিমা তোমার সেই সাধনা– সেই মহাযাত্রার বর্ণিল বর্ণনা, যেখানে সৃষ্টি ও ধ্বংসচক্রের মধ্য দিয়ে জ্ঞান এবং সত্যের অনুসন্ধান চলমান। প্রেম ও বেদনার ঐক্যে আত্মা যেখানে পরিশুদ্ধ হয়; দুঃখ, ক্ষয়, শূন্যতা হয়ে ওঠে পরাজাগতিক পূর্ণতার সর্বনাম।
এই মহাকবিতার অঙ্গে অঙ্গে প্রকৃতির বিচিত্র উপাদান– আলো, পানি, বায়ু এবং মহাজাগতিক অদৃশ্য শক্তির অদ্ভুত চিত্রকল্প খেলা করে; যেখানে নদী, নৌকা, তীরের মতো প্রতীকগুলো মানবাত্মার যাত্রারম্ভের ইঙ্গিত দেয়– অস্তিত্বের বিভিন্ন স্তর থেকে অনস্তিত্বের দিকে। যেতে যেতে বলতে চায়– পৃথিবীর প্রপঞ্চগুলো আসলেই তুচ্ছ এবং আসল হলো পরমের সঙ্গে মিলিত হবার প্রাণময় বাসনা।
কবিতাটি ঘোরে-বেঘোরে মানুষের অস্তিত্বের পরস্পরবিরোধী অবস্থানগুলোর বিতর্ক তোলে; জীবন এবং মৃত্যুর সমীকরণ রচনা করে। ‘এক’ থেকে আলাদা হওয়ার যন্ত্রণা, পরমের সঙ্গে লীন হওয়ার বাসনার মধ্য দিয়ে প্রশমিত করতে করতে হাহাকার করে। যন্ত্রণাবিদ্ধ মানব-হৃদয়ের এ এক উন্মত্ত আত্মক্রন্দন। আত্মসমর্পণের প্রয়োজনীয়তা ছাড়া পার্থিব ইচ্ছাকে নগণ্য জ্ঞান করতে পারার মহৎ ক্রন্দন। অথবা, এসব কিছুই নয় হয়তো। কেবল শূন্যতা ও অস্তিত্বের মধ্যে দুলতে থাকা অশেষ পেন্ডুলাম ঝুলে থাকে অলীক অন্তরীক্ষে।
এই কাব্যটি এক ধরনের প্রার্থনা মনে হয়। স্তুতি স্তোত্রও বটে। কার স্তুতি! পরমের। কে এই পরম! যদি সে মানবাত্মায় বিরাজ করে– তাহলে মানুষই তো। মানুষই পরম।
এমনও মনে হয় যে, ‘সকল মহিমা তোমার’ একটি আহ্বান। মানব জীবনের পবিত্রতা উপলব্ধি করে পরমের সঙ্গে একীভূত হওয়ার যুগপৎ কামার্ত ও নিষ্কাম আহ্বান।
সকল মহিমা তোমার।। আহমেদ স্বপন মাহমুদ।। কবিতা।। মাটিয়া মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিকেশন্স।। প্রচ্ছদ: সারা তৌফিকা ।। পৃষ্ঠা: ৩২।। মূল্য : ১০০ টাকা
নূরুননবী শান্ত, কথাসাহিত্যিক ও ফোকলোর গবেষক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইম ল শ ন যত জ বন র হওয় র
এছাড়াও পড়ুন:
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে যশোর আইনজীবী সমিতির চার সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে যশোর আইনজীবী সমিতির চার সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় ওই চারজনের কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবের শুনানি শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বহিষ্কৃত সদস্যরা হলেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ কবির হোসেন, রফিকুল ইসলাম রফিক ও তরফদার আবদুল মুকিত। তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আদালতের সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ গফুর বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হওয়াতে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউ সমিতির নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে নন। বৃহস্পতিবার ওই চার সদস্যকে বহিষ্কারের বিষয়টি নোটিশ দিয়ে জানানো হবে।’
সমিতি সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য সৈয়দ কবির হোসেনের (জনি) কাছে ৩৫ লাখ টাকায় শহরের বারান্দীপাড়া কদমতলা এলাকায় জমি বিক্রি করেন ইমরান হাসান। জমি রেজিস্ট্রির আগে সব টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও সৈয়দ কবির হোসেন ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। বাকি ২৫ লাখ টাকা না দিয়ে টালবাহানা করতে থাকেন। পরে তিনি আরও ১৭ লাখ টাকা দেন। বাকি ৮ লাখ টাকা চাইলে হুমকি দিতে থাকেন কবির হোসেন। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ইমরান হাসান আইনজীবী সমিতি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর শুনানি শেষে কবির হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় সমিতির সুনাম ক্ষুণ্ন করায় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কবির হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।
এ বিষয়ে আইনজীবী কবির হোসেন বলেন, ‘বহিষ্কারের বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে যে বিষয়ে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই বিষয়ে অভিযুক্ত আমি নই। তারপরও আইনজীবী সমিতি আমার অভিভাবক; তারা যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তার বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’
অন্যদিকে অভয়নগরের নওয়াপাড়ার জয়েন্ট ট্রেডিং করপোরেশন পাওনা টাকা আদায়ে আবদুর রাজ্জাককে মামলার আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক আটটি চেকের মামলা পরিচালনা করেন। এসব মামলার রায় ও আপিল বাদীর অনুকূলে যাওয়ার পর আটটি চেকের ৪১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে নেন আবদুর রাজ্জাক। এ টাকা জয়েন্ট ট্রেডিং কর্তৃপক্ষকে না দিয়ে তিনি ঘোরাতে থাকেন। চলতি বছরের ৪ জুন তিনি ১৫ লাখ টাকার একটি চেক দেন। চেকটি ব্যাংকে জমা দিলে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় নগদায়ন করা যায়নি। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে জয়েন্ট ট্রেডিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল ওহাব গত ২৮ জুলাই আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে যশোর আইনজীবী সমিতি বরাবর অভিযোগ করেন।
এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আবদুর রাজ্জাককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় যশোর আইনজীবী সমিতি। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় আবদুর রাজ্জাককে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া রফিকুল ইসলাম রফিক তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে অসদাচরণ ও মামলা করতে টাকা ও কাগজপত্র নিয়ে মামলা না করায় সমিতির সুনাম ক্ষুণ্ন করায় সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আইনজীবী তরফদার আবদুল মুকিতের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।