গুণ্ডামি যখন গভর্ন্যান্সের আউটলেট, তখন সবই প্রায় প্রান্ত
Published: 20th, February 2025 GMT
কেন্দ্র ও প্রান্ত খুব সহজেই রেটোরিক হয়ে পড়তে পারে। রাজনীতিতে তো বটেই, বিদ্যাজগতের আলোচনাতেও। অনেকটা সরকারের মুখে শোনার মতো– ‘জনগণ আমাদের সাথে আছে’। কিংবা বিদ্বানের মুখে শোনার মতো– ‘মানুষের উপকারের জন্য আপনাদের পড়ালেখা করতে হবে’। সরকার যখন বলেন ‘জনগণ’, তখন তা মূলগতভাবেই প্রান্তের দ্যোতনা আচ্ছামতো নিজেদের কণ্ঠে ঠেসে দিয়ে বলেন। তেমনি বিদ্যাজগতে যখন বলা হয় ‘সাধারণ মানুষের জন্য উপকারী’, তখনও একই ঘটনা ঘটে। আচ্ছামতো প্রান্ত কণ্ঠস্বরে ঠেসে। এই রেটোরিকের উপদ্রবের মধ্যে আসল বা ‘খাঁটি’ প্রান্ত নিজেই অত নিশ্চিত হতে পারে না যে সে আছে নাকি নাই, থাকলে ঠিক কোথায় আছে। ভাষা প্রসঙ্গে এই কেন্দ্র-প্রান্ত আরও যথেচ্ছ ধরনের গোলমেলে। এত গোলমেলে যে, প্রান্তজন নিয়ে কোনো ধরনের ঠাহর করাই মুস্কিল। বাংলাদেশের জনগণের রাজনৈতিক জীবনে এই দুর্যোগ আরও ঘনীভূত। আমল নির্বিশেষে এই দুর্যোগের আমলনামা বদলায় না। আমি ঠিক করেছি, আজকে গাদাগাদা উদাহরণই দেব।
মাত্র বছরখানেক আগেও যদি তালিকা করতে যেতেন যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বাংলাদেশে কত বই আছে, আপনার হিমশিম খাবার জোগাড় হতো। এই কৌতূহল আমার দেখা দিয়েছিল একদা। আমি ডিজিটাল বাংলাদেশে, বাসায় বসে-বসেই বিভিন্ন দপ্তরের ওয়েবসাইট ঘেঁটে কখনো দেড় হাজার কখনো দুই হাজারের অধিক বইয়ের তালিকা ডাউনলোড করেছি। তারপর কোন তালিকায় কোন বইগুলো অভিন্ন তা নিয়ে কম্পুস্ক্রিনে খোঁজাখুঁজি করেছি। এখনো কোন কোন শিরোনামে বঙ্গবন্ধুবিষয়ক আরও বই লিখিত হতে পারে তার কিছু শিরোনামও বানিয়েছিলাম। নিজে লিখব ভেবে নয়, বরং নতুন উৎসাহী রচয়িতা কেবল শিরোনামের অভাবে না– লিখতে পারেন এই দুর্যোগ যেন তাঁর জীবনে না আসে সেই মহতী মন নিয়ে করেছিলাম। ভেবেছিলাম কেউ চাইলে দিতে পারব। আমার এই নিবিড় গবেষণা ও সৎকর্মে কী লাভ হয়েছে তা যদি জিজ্ঞাসা করেন তো জবাব দিতে পারব না। তবে অনুসন্ধিৎসা তো এরকমই হবার কথা! আমার ধারণা নেই এই ফাইলগুলো ওসব দপ্তর এখনো আপলোড করে রেখেছে কিনা। কিন্তু এই ধারণা আমার আলবৎ আছে যে গত ছয় মাসে ওসব লেখকের অনেকেই চাইছেন না যে আপনি তাঁর কষ্টসৃজিত কিতাবখানি আবিষ্কার করে ফেলুন। তিনি কোন প্রান্তে যেএখন আছেন তা ভাবতেই গা ছমছম করে। সাকিব আল হাসানকে ঠিক সুবক্তা বলার মতো কিছু ঘটেছিল না আমার জীবনে। তাছাড়া তাঁর বক্তৃতাই বা শুনেছি কোথায়! মৃদুমন্দ হাসিমুখে তিনি কিছু বিজ্ঞাপনের মুখস্থ বাক্য বলতে টিভিতে আসতেন। তাঁর হাসি সুন্দর, পণ্যটার ছবিও স্ক্রিনে থাকত। তাঁর ভাষাতে অত মনোযোগ না দিলেও চলত। এর বাইরে তো চৌকষ দুর্দান্ত খেলোয়াড় তিনি। কখনো তাঁকে প্রান্ত ভাবার মতো কিচ্ছুটি ঘটেনি। কিন্তু যেই না তিনি ‘জন’জবানে ‘দালাল’ সাব্যস্ত হলেন, অমনি তাঁকে বেচারি মনে হতে শুরু করল। তবে ষোলকলার তখনও বাকি। যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা, তাঁর কষ্টার্জিত হাসিহীন মুখে যখন বার তিনেক অন্তত ব্যাখ্যা দিলেন সাকিবের কী ধরনের নাকখৎ দিয়ে জনতৃপ্তি আনতে হবে, তখন প্রকৃতই সাকিবকে প্রান্ত মনে হতে বাধ্য। লক্ষ্য করুন, আমরা শুনছি একজন জনপ্রশাসকের মুখের ভাষা। তদুপরি একটা অভ্যুত্থান-উত্তর সরকারের প্রতিনিধির ভাষা। সেই ভাষাতে কোনো স্নেহ নাই, দায়িত্ব নাই, দায় নাই, দরদ নাই। আছে কেবল কেন্দ্রের ধামকি। তখন মহাতারকা সাকিবও প্রান্ত হতে বাধ্য। এই উদাহরণ দেবার কারণে পরীমণির উদাহরণ না দিলেও চলে। কেন্দ্র ও প্রান্ত নিয়ে ন্যূনতম আমাদের বোঝাবুঝির জন্য সাধারণভাবে যাকে বুর্জোয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত বলা হয়, সেটার নিশ্চয়তাও জরুরি হয়ে পড়ে। যখন সেই ব্যবস্থাও আমাদের অধরা থাকে, প্রান্ত তখন সর্বত্রময়। এই কথা বলার মাধ্যমে ঐতিহাসিক প্রান্তিকতাতে লঘু করা আমার আগ্রহ নয়। আমি চাইছি ভাষার প্রান্তিকতা ও প্রান্তজনের ভাষার চক্রাকার দশাটা যেন বিস্মৃত না হই।
লেখক ও কথক হিসেবে আমি নিজের দশাকেও লাগাতার বিশ্লেষণ করার মুডে থাকি। রচনাতে তৎসম-তদ্ভব শব্দের পাশাপাশি কিছু আরবি-ফারসি শব্দ ও ‘গ্রামীণ’ শব্দ ব্যবহারের কারণে আমি সেক্যুলার পরিচিতদের কটাক্ষের মধ্যে পড়তাম। সেসব কটাক্ষের কিছু সামনে প্রকাশিত হতো। বেশির ভাগই আমার সামনে নয়, কিন্তু এতটাই তীব্রভাবে যে না-টের পাবার উপায় ছিল না। এর মধ্যে একটা ছিল “অমুকের ভাব ধরছেন?” কিন্তু এটাই সবচেয়ে কর্কশ নয়। সবচেয়ে কর্কশটা ছিল “আপনারা তো ইসলামি/পাকিস্তানের ভাষা প্রোমোট করতেছেন”। পাকিস্তানের যে একটা বাংলা ভাষা থাকতে পারে এই কল্পনাই তো কঠিন! আর এই বহুবাচনিক সর্বনাম ‘আপনারা’তে অতি অবশ্যই আমি ও অমুক বলবৎ থাকতাম। যে অমুকের কথা বলা হতো, তাঁর শব্দসীমানা ও চিন্তাসীমানা আমার আগ্রহের জায়গা। কিন্তু ওই টিপ্পনিতে গৌরব বোধ করব নাকি পোতানো বোধ করব, একা করব নাকি সেই অমুক চিন্তক সমেতই করব তা ফয়সালা অত নিশ্চিত ছিল না। কিন্তু জগৎ মধুর শ্লেষময়। এই একই বর্গ আমার কথনে/বচনে সম্পূর্ণ আরেক ফয়সালা করত: “দাদাদের ভাষায় কথা কন”। এখানে দাদা না কোনো সম্মানের, না কোনো সত্যের। ঢাকা শহরে যাকে ‘প্রমিত’ বাংলা হিসাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে তা নিছকই উচ্চারণীয়, ক্রিয়াপদীয় ও অল্প কিছু অব্যয়-সংশ্লিষ্ট। কিন্তু এই সাব্যস্তকরণের মধ্যে যদি বাচনিকভাবে কেউ ‘প্রমিত’পন্থি ঠাহরিত হন, তাহলে তাঁর নির্দিষ্ট অল্প কিছু আসর ছাড়া আর কোথাও আরামসে চলাফেরার বন্দোবস্ত নাই। তিনি একটা বিশাল প্রান্তই হবেন। আমি এমনকি সেসব আসরেও যাই না। তাহলে আমার কপাল ভাবুন! আমার বেলাতে কম্বোপ্যাকেজটা বেশ দুর্লভ তা পাঠকের স্বীকার করে নেয়াই উত্তম। লিখনে ‘ইসলাম’ প্রমোটার ও বচনে ‘দাদা’ধারী।
দুইটাই প্রায় সমবর্গ থেকে নির্ধারিত, দুইটার কোনোটাই, পরিপ্রেক্ষিত বিচারে, আমাকে কোনো আরামদায়ক মর্যাদা দেয় নাই। এখন, পাঠককে নিশ্চয়ই মনে করিয়ে দেবার দরকার নাই যে আগস্ট-২০২৫ পরবর্তীকালে আমার এই দশার (বা দুর্দশার) পূর্বতন ব্যাকরণটা একইভাবে অটুট আছে কিনা তা আবার খতিয়ে দেখতে হবে। বইমেলার ঠিক প্রাক্কালে, ৩১ জানুয়ারি, পুলিশের সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা (মানে পুলিশের কর্মকর্তারা) বলেছিলেন যেন বইমেলায় আনার আগেই পাণ্ডুলিপি তাঁদের দেখানো হয়। যেসব বইয়ের বিষয়বস্তু/কন্টেন্ট পরিস্থিতি ‘অস্থিতিশীল’ করতে পারে সেগুলো ঠেকানোর উদ্যোগ হিসেবেই তাঁরা এই রূপরেখাটি সামনে এনেছেন। ২০২৬ সালের বইমেলা থেকে এই ব্যবস্থা চালু করতে সুপারিশ তাঁদের। লেখক, পাঠক অনেকেই পুলিশের এই প্রস্তাবে হাসাহাসি করেছেন, বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু আমি একদম হাসাহাসি করিনি, বিরক্তির তো প্রশ্নই নেই। বরং, আমি পুলিশের (ঊর্ধ্বতন) কর্মকর্তাদের এই প্রস্তাবে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা পেয়েছি। এখানে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা নিয়ে একটা বাক্য না-বললেই নয়।
যা কিছুকে আমার বিচক্ষণ লাগে তা কিছুকে আমার দূরদর্শীও লাগে। বস্তুত, বিচক্ষণ মাত্রই দূরদর্শী, বা উল্টোটা। এই সিদ্ধান্তে আসার পর আমি আগামীতে দুইটা পদ/বিশেষণ একত্রে আর ব্যবহার করব কিনা তা নিয়ে সংশয়ে পড়ে গেছি। যাহোক, পুলিশের কর্মকর্তারা দেখলেন ০৫ আগস্টের পর নিম্নপদস্থ পুলিশদের ন্যায্য দাবিগুলো পড়বার বা শুনবার বা আলাপ করবার কোনো উদ্যোগ সরকারের নাই।
এমনকি কিছুদিন যদি তাঁরা (ঊর্ধ্বতনরা) একটু উৎকণ্ঠায় থাকেনও সেটা কাটতে সময় লাগেনি। পুলিশ বিভাগ বুঝেছেন, এই সরকারও বড় পুলিশদেরই কাছের সরকার। পুলিশের কর্তারা দেখলেন যে প্রশাসকেরা ধমক দেন বেশি, গভর্ন্যান্স প্রণালীর সুষমতা আনয়নে সময় প্রায় দেনই না। মবে জুজু দেখে, সরকারও তাই দেখে। কখনো আনসার জুজু, কখনো শ্রমিক জুজু, কখনো আগস্ট ৩১-এর মধ্যে ‘প্রতিবিপ্লবের’ জুজু। মবে ধমকায়, সরকারও তাই। জনগণ সন্ত্রস্ত, সরকারও তাই। এতটাই সন্ত্রস্ত যে সকালের সিদ্ধান্ত বিকালে বদলান। ‘আয়নাঘর’ দেখার অনুমতি পান সরকার পাক্কা ৬ মাস পর। কার অনুমতি তা আজকে বলব না। বেঁচে থাকলে আগামীতেও না বলতে পারি। এরকম একটা রাষ্ট্রব্যবস্থা দেখার পর পুলিশের কর্তারা যদি সরকার-অংশ হিসেবে পাণ্ডুলিপি পড়ে মেলায় আসার ছাড়পত্র দিতে চান, তাকে দূরদর্শী বা বিচক্ষণ না-বলবেন কীভাবে?
ডিএমপি কমিশনারের এই বিচক্ষণ ঘোষণার মাত্র দুই সপ্তাহের মাথাতেই যখন কবি গ্রেপ্তার (মতান্তরে নিরাপত্তা হিফজত) পেলেন, তখন কি প্রমাণ হলো না তাঁদের দাবির যৌক্তিকতার? মেলায় বই আসতে দিয়ে মবলেলানির থেকে অবশ্যই কবি/লেখকের নিরাপত্তা অধিক কাঙ্ক্ষিত। এর থেকে অবশ্যই ভাল ‘বই সরা ব্যাডা, বাসায় গিয়া ছালামুড়ি দিয়া শুইয়া থাক’ বলা। কারণ সেটা প্র্যাগম্যাটিক, জানমালের জন্য অধিক আশ্বস্তকার।
প্রান্ত তামাম দেশের প্রান্তর জুড়ে আছে। আছে খোদ কেন্দ্রে। সরকারের মধ্যেও। ধ্রুপদি সংজ্ঞায় প্রান্তজন কে বা কারা তা নিয়ে আরেকদিন ভাবার অবকাশ নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। কিন্তু একটা অভ্যুত্থান-পরবর্তী সরকারের নাজুকতা দেখবার কালে প্রান্তকে কেন্দ্রে দেখার চর্চা করবারই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি। গভর্ন্যান্সকে মব-গুণ্ডামির আউটলেট হতে দেখবার পরিস্থিতিতে কেন্দ্র আর প্রান্তের সম্পর্কের পুনর্বিবেচনা দেবার দরকার দেখছি আমি। হতে পারে এই মুহূর্তের বাংলাদেশে কেন্দ্র চিনবার আরও আরও শক্ত চোখ তৈরি করতে হবে আমাদের।
লেখক
কথাসাহিত্যিক
শিক্ষাবিদ
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প ল শ র কর দ রদর শ সরক র র আম দ র র জন য কর ত র
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।