কবিতা আমার কাছে এমন কিছু, যা পড়ার পর অনেক দিন রেশ থেকে যায়; ফুরিয়ে যায় না। কবিতার কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসতে হয় এবং প্রতিবার পাঠে বদলে যায় অর্থ। এমন কবিতার সন্ধানে আমাদের প্রচুর কবিতা পড়তে হয়।
কোনোটা কম ভালো লাগে, কোনোটা বেশি; কোনোটা একেবারে ভালো লাগে না। দু-একটা এমন কবিতা পাওয়া যায়, যা আমি সব সময় বয়ে নিয়ে যাই।
এমন কবিতার সন্ধানে আমি এক দিন রাসেল রায়হানের কবিতার কাছে এসেছিলাম। তাঁর কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয়টা প্রায় এক দশকের। ‘সুখী ধনুর্বিদ’, ‘বিব্রত ময়ূর’ পেরিয়ে আজ ‘মূকাভিনেতার ডায়েরি’ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে রাসেলের কবিতা। এর মধ্যে আরও নানা ধরনের কাজ করেছেন রাসেল। কবিতার যাত্রার নানা অলিগলি পেরিয়ে খুব কাছ থেকে তাঁর কবিতাকে একটা পরিণতির দিকে যেতে দেখেছি। এরই আরেকটি সংস্করণ ‘মূকাভিনেতার ডায়েরি’।
নতুন সময়ের কবিতা কেমন হতে পারে, তার একটা ছাপও এই কবিতাগুলোয় পড়তে দেখেছি। মনে হয় না, সব সময় খুব সচেতনভাবে রাসেল এটা করেছেন। তাঁর পথটাই এমন। সহজাতভাবে এটা আয়ত্ত করে কবিতাকে এত দূর নিয়ে এসেছেন তিনি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন সেই কবিতা?
রাসেল প্রথম কবিতায় লিখেছেন, ‘মুকুট পাখির মতো, এ ডাল থেকে ও ডালে গিয়ে বসে।’ এই সুরটা রাসেলের চিরায়ত। পড়তে নিরীহ মনে হলেও, চূড়ান্ত রাজনৈতিক অভিলাষ নিয়ে লেখা একটা পঙ্ক্তি। যদিও ইশারা ভাষায় ছুড়ে দেওয়া পঙ্ক্তিগুলো বহু অর্থই চাইলে করে নেওয়া যায়। কিন্তু রাজনীতির এই উত্তাল সময়ে রাজনৈতিক ভাষ্যটাই সবার আগে মনে আসে। এর পর যতই এই বইয়ের ভেতরে প্রবেশ করেছি, হাত ধরাধরি করে এগিয়েছে রাজনীতি, রহস্য আর ইশারা। তবে কোথাও সেভাবে উচ্চকিত স্লোগান হয়ে উঠে কবিতার নীরবতাকে আহত করেনি। কিছু জায়গায় স্লোগান হয়ে উঠতে চাইলেও শেষ পর্যন্ত রাসেল ঠিকই সামলে নিয়েছেন।
কোন সময় ও বাস্তবতার ভেতর বসে রাসেল এ কবিতাগুলো লিখছেন, সেটা বুঝতে পারা বিশেষ জরুরি। কবিতার নিচে প্রকাশের তারিখ ও মাধ্যম উল্লেখ করে সম্ভবত পাঠকের সঙ্গে এই বোঝাপড়াটুকু আগেভাগে করে নিতে চেয়েছেন কবি।
একটি কবিতায় তিনি লিখছেন, ‘কত ধীরে প্রেম হয়,/ প্রেম হয়ে যায় কত দ্রুত—/ সে কি শুধু রানী বোঝে?/ সে তো বোঝে ভিখিরি মাহুতও।’ রাজনৈতিক ইশারা ভাষার রাসেল মুহূর্তে মুহূর্তে এমন কিছু প্রেমের ঝলকানিও হাজির করেছেন। কিন্তু সে-ও অত সরলভাবে নয়। ‘বোধ’ কবিতায় যা প্রেমের কথা বলছে, ‘প্রেম’ নামের কবিতায় তা আমূল বদলে যাচ্ছে। তবে শুধু রাজনীতি বা প্রেম এই বইয়ের শেষ কথা নয়। বোধের নানা স্তরে রাসেল আমাদের ভ্রমণ করান। ফলে নানামুখী ভাবনা আমাদের আরও গভীরে টেনে নিয়ে যায়। কিন্তু সবকিছু থাকার পরও এই বই শেষ পর্যন্ত আমার কাছে রাজনৈতিক। যেমন রাসেল এক জায়গায় লিখছেন, ‘.
প্রেম আর দ্রোহের এই যে মিলেমিশে যাওয়া, এটাই বইয়ের কবিতাগুলোর সত্য। নানামাত্রিক ব্যঞ্জনা তৈরির পরও এই বই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক হয়ে উঠতে চাইছে, যা নানা কথা বলতে চাইছে সময়কে অতিক্রম করে। বর্তমান পরিস্থিতিতে কবিতার কাছে এর বেশি আর কী চাওয়া থাকতে পারে!
মূকাভিনেতার ডায়েরি, রাসেল রায়হান, প্রতিভাষা প্রকাশন, ২০২৫, পৃষ্ঠা ৬৪, মূল্য ২০০ টাকা।
হাসনাত শোয়েব, কবি ও সাংবাদিক
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইম ল র জন ত ক আম দ র এমন ক
এছাড়াও পড়ুন:
বৃষ্টিস্নাত রমনায় সবুজের উল্লাস
রমনা উদ্যানের গাছগুলো বৃষ্টিতে ভিজছে, ভিজছে মাটি ও মাটির ওপরের ঘাসগুলো। বর্ষায় রমনার রূপ হয় দেখার মতো। চারদিকে কেবল সবুজ আর সবুজ। বসন্তের মতো ফুল নেই তো কী হয়েছে? আছে শ্যামল রূপ, আছে অপার স্নিগ্ধতা। বুকভরে ধুলাহীন নিশ্বাস নেওয়ার অবকাশ, প্রকৃতির উদার আমন্ত্রণ।
‘পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে’ ঢাকার রমনা পার্কের গাছের পাতাগুলো এখন আরও সবুজ। টলটলে জলের নয়নাভিরাম ঝিলটা টইটম্বুর। ধুলাময়লাহীন পায়ে চলার পথ। আর গাছের পাতার ফাঁকে রয়েছে অজস্র ফুল। কোনোটা লাল, কোনোটা বেগুনি আবার কোনোটা সাদা। বৃষ্টির মধুর আশকারা পেয়ে রমনা পার্কে এখন সবুজের উল্লাস।
এই পার্কটিকে ঢাকার ফুসফুস বলা হয়। এর যথেষ্ট কারণ আছে অবশ্য। এ রকম প্রগাঢ় নিরেট সবুজ এ শহরে কমই আছে। রমনা তাই ঢাকার জনজীবনের স্পন্দন। এটি কেবল একটি পার্ক নয়, বরং নাগরিক জীবনের পরম আনন্দ-আশ্রয়।
সম্প্রতি ‘বৃষ্টি নেশাভরা’ এক বিকেলে অরুণোদয় ফটক দিয়ে রমনা পার্কে প্রবেশ করলাম। অনেকে শরীরচর্চায় ব্যস্ত। কেউ দল বেঁধে করছেন, কেউ একাকী। কোনো দল ব্যায়াম করে ভোরে, কেউ আবার বিকেলে বা সন্ধ্যায়। আবার অনেকে আছেন দুই বেলাই হাঁটাহাঁটি করেন। হাঁটা সেরে কেউ কেউ লেকের পাশে এসে দুদণ্ড জিরিয়ে নেন। লেকে চলছিল বোট।
বর্ষার ফুলের উৎসব
বর্ষা এলেই রমনা পার্ক যেন রঙের নতুন ভাষা শেখে। আমাদের ঋতুচক্র অনুযায়ী, বসন্ত ও গ্রীষ্মকালেই এ দেশে ফোটে অধিকাংশ ফুল। তবে বর্ষারও নিজস্ব কিছু ফুল আছে, আর গ্রীষ্মের কিছু ফুল টিকে থাকে বর্ষা পর্যন্ত। সেদিন রমনায় গিয়ে এমনই কিছু ফুল চোখে পড়ল—বৃষ্টিভেজা পাতার ফাঁকে তাদের রং যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। মনে হলো, প্রকৃতির এই নিঃশব্দ উৎসবেও কত কথা লুকিয়ে থাকে!
রমনার গোলাপবিথি সেদিন দর্শনার্থীদের সবচেয়ে বেশি মনোযোগ কাড়ছিল। সারি সারি ঝোপে ফুটে আছে হরেক রঙের গোলাপ—লাল, সাদা, হলুদ, কমলা, গাঢ় গোলাপি। বর্ষার ভেজায় যেন আরও সতেজ, আরও তাজা হয়ে উঠেছে প্রতিটি পাপড়ি। নরম আলো আর বৃষ্টিজলে ভেজা ফুলগুলোর সৌন্দর্য মোহিত করেছে পথচলার মানুষকে। কেউ থেমে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছেন, কেউ ভিডিও করছেন—মুঠোফোনে বন্দী হচ্ছে বর্ষার রঙিন রমনা।
এটি কেবল একটি পার্ক নয়, বরং নাগরিক জীবনের পরম আনন্দ-আশ্রয়।