মেঘনায় বেপরোয়া বালু উত্তোলন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন
Published: 27th, February 2025 GMT
কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন দ্বীপের মতো; চারদিকে নদী বেষ্টিত। সড়কপথে সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেই, একমাত্র নৌযানই যাতায়াতের মাধ্যম। এটা অবৈধ বালু উত্তোলনকারী চক্রের জন্য সুবিধাজনক জায়গায় পরিণত হয়েছে। রাত বাড়লেই রামপ্রসাদের চরে শুরু হয় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত নদীর বুক চিরে চলে এ তৎপরতা এবং দিনের আলো ফোটার আগেই চক্রটি উধাও হয়ে যায়।
নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে ইতোমধ্যে রামপ্রসাদের চর এলাকার প্রায় ৩০০ বিঘা জমি বিলীন হওয়ার পথে। এতে নদী তীরের বিস্তীর্ণ এলাকা ধসে যাচ্ছে, বাড়ছে ভাঙনের ঝুঁকি।
চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা সমকালকে জানান, বালুখেকোদের লাগামহীন দৌরাত্ম্যে এলাকার কৃষিজমি ও বসতভিটা হারিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে স্থানীয়ভাবে একটি সমন্বয় সভা হয়। সেখানে বালু উত্তোলনকারীরা কার্যক্রম বন্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। এর পর ১৫-২০ দিন বন্ধ ছিল, সপ্তাহখানেক আগে আবার শুরু হয়েছে রাতভর বালু উত্তোলন।
এলাকাবাসী জানান, বালুখেকোরা বাল্কহেড ও ড্রেজারগুলো দিনের বেলায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, আড়াইহাজার ও মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় লুকিয়ে রাখে। রাত ১১টার পর বাল্কহেডগুলো আড়াইহাজার ও বৈদ্যেরবাজার হয়ে মেঘনা সেতুর নিচ দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়। বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। স্থানীয়রা বাধা দিতে গেলে বা প্রশাসন ও সাংবাদিকদের জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ফলে আতঙ্কিত হয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। ইউএনওকে বললেই বলেন, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশকে জানিয়েছেন অভিযান চালাবে, কিন্তু তেমন কোনো বড় পরিসরে অভিযান চালায় না।
কথা হয় রামপ্রসাদের চরের বাসিন্দা কুমিল্লা জেলা উত্তর যুবদলের সদস্য, মেঘনা উপজেলা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মেঘনা উপজেলা যুবদলের সভাপতি পদপ্রার্থী হোসাইন মোহাম্মদ মহসিন মিয়ার সঙ্গে। তারা বলেন, তাদের এলাকার মানুষ খুবই গরিব, কৃষিকাজ করে সংসার চালায়। বালুখেকোরা এই কৃষিজমির মাটি ড্রেজার দিয়ে দিনের বেলা কেটে নিত, এখন রাতে কেটে নিয়ে যায়। তাদের অভিযোগ, নলচর গ্রামের চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রবিউল্লাহ রবি ও তাঁর সহযোগীরা এই অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। এসব অপকর্মের অভিযোগে আগেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে অভিযুক্ত রবিউল্লাহ রবির সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
চালিভাঙ্গা নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আজমগীর হোসাইন বলেন, ‘আমি অনেকবার অভিযান চালিয়েছি, কিন্তু তারা রাতে কাজ করে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া এটি বন্ধ করা কঠিন। সম্প্রতি নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছি। বালুখেকোরা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।’ তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি, আমাদের আরও জনবল প্রয়োজন। যৌথ অভিযান ছাড়া তাদের থামানো আমাদের নৌ-পুলিশের পক্ষে অসম্ভব।’
চাঁদপুর অঞ্চলের কোস্টগার্ডের কমান্ডার তাকিউল আহসান জানান, চালিভাঙ্গা এলাকাটি তাদের আওতার বাইরে। তার পরও জনস্বার্থে অভিযান চালান তারা। তবে জেলা প্রশাসন
যদি দায়িত্ব দেয়, তাহলে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে।
চালিভাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বালু উত্তোলন করা হয়। বাধা দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ আমাদের দল ক্ষমতায় নেই। যারা বালু উত্তোলন করে, তারাই নদীপথ থেকে প্রতিদিন প্রায় লাখ টাকা চাঁদা ওঠায়।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হ্যাপী দাসের ভাষ্য, এটি নৌপুলিশের কাজ। নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের জনবল কম, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। শিগগিরই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এর আগেও তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান, কিন্তু তার কিছুই হয়নি। এ ব্যাপারে ইউএনও বলেন, ‘আমি মেঘনা উপজেলায় এসেছি তিন মাস হয়েছে। এর আগেও বালু উত্তোলন হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বালুখেকোরা সিগনেচার (চুক্তি) করেছিল, এরপর ২০ দিন বন্ধ ছিল, আপনি জানেন সেটা। এখন আবার শুরু করেছে বালু উত্তোলন।’
রামপ্রসাদের চর গ্রামের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান জানান, বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর দুর্বলতার কারণেই বালুখেকোরা ভয় পায় না। নিয়মিত মামলা হলেও তারা সহজেই জামিন নিয়ে ফিরে আসে। গভীর রাতে লাখ লাখ টাকার বালু উত্তোলন করে তারা। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের দাবি তাঁর। তিনি বলেন, ‘বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়াকে বলেছিলাম, তিনি পদক্ষেপ নিলে কিছুদিন বন্ধ ছিল। এরপর আবার শুরু হয়েছে বালু উত্তোলন।’
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদ না হলে অবরোধের হুঁশিয়ারি আপ বাংলাদেশের
জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির দাবিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশ। আজ শুক্রবার রাজধানীর শাহবাগে গণজমায়েত থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়। দাবি পূরণ না হলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ কর্মসূচি পালনের হুঁশিয়ারি দিয়েছে সংগঠনটি।
‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের দাবি’ শীর্ষক গণজমায়েতে অংশ নেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আপ বাংলাদেশের নেতা–কর্মীরা। জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পার হলেও জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারি না হওয়াকে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছেন তাঁরা।
আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ‘আমরা একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম। কিন্তু আহতদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। আমরা দেখেছি, যারা জুলাইয়ের নেতৃত্বে ছিল, জুলাইয়ের পরে তাদের পকেট ভারী হয়েছে। আমি বলতে চাই, আপনাদের এই পকেটের হিসাব দিতে হবে।’
অন্তর্বর্তী সরকারকে উদ্দেশ করে আলী আহসান বলেন, ‘আপনারা জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে পারবেন কি পারবেন না, তা জানান; না পারলে আমরা আছি। যারা জীবন দিতে প্রস্তুত ছিলাম, বাংলাদেশের (সেই) ২০ কোটি জনগণ জুলাই ঘোষণাপত্র জারি করবে।’
আপ বাংলাদেশের আহ্বায়ক বলেন, ‘৩৬ জুলাইয়ের মধ্যে যদি জুলাই ঘোষণাপত্র না হয়, তাহলে ৬ আগস্ট থেকে দেশজুড়ে অবরোধ শুরু হবে। এ সরকারের কোনো হুমকি আমাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।’
গণজমায়েতে অংশ নিয়ে ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বলেন, আপ বাংলাদেশের নেতারা এখনো কোনো প্রটোকল ছাড়া রাস্তাঘাটে হাঁটেন। কিন্তু তাঁরা যেদিন প্রটোকল নিতে শুরু করবেন, সেদিন থেকে তাঁদের বিরুদ্ধেও তিনি কথা বলা শুরু করবেন।
জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র জারির আহ্বান জানিয়ে শরীফ ওসমান বলেন, এখন পর্যন্ত বিদ্যমান আইনি কাঠামোয় জুলাই শহীদেরা রাষ্ট্রদ্রোহী। তাঁদেরকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। আজকের মধ্যে সরকার দিনক্ষণ না জানালে আগামী ৩ তারিখ (আগস্ট) ইনকিলাব মঞ্চের উদ্যোগে কফিন মিছিল নিয়ে সচিবালয় অবরোধ করা হবে।
বিগত এক বছর থেকে একটি দুর্বল সরকার দেশ চালাচ্ছে উল্লেখ করে আপ বাংলাদেশের সদস্যসচিব আরেফিন মোহাম্মদ বলেন, ‘জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে ঘোষণাপত্রের জন্য আমাদের আবারও গণজমায়েত করতে হচ্ছে। এর চেয়ে লজ্জাজনক আর কী হতে পারে?’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এ বি জুবায়ের বলেন, ‘আমরা যে মৌলিক সংস্কার চেয়েছিলাম, এখনো তার কিছুই হয়নি। এখনো শহীদ পরিবারের পুনর্বাসন ও আহতদের চিকিৎসা নিশ্চিত হয়নি। আমি উপদেষ্টাদের উদ্দেশে বলতে চাই, অবিলম্বে জুলাই সনদ ঘোষণা করুন। আপনাদের কাছে আমাদের চাওয়া–পাওয়া খুব বেশি নেই।’
গণজমায়েতে র্যাপ গান পরিবেশন করেন আপ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য আহনাফ তাহমিদ। স্বাগত বক্তব্য দেন জুলাই শহীদ ওসমান পাটোয়ারীর বাবা আবদুর রহমান। গণজমায়েতে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন আপ বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়কারী রাফে সালমান রিফাত, প্রধান সংগঠক নাঈম আহমেদ, মুখপাত্র শাহরিন সুলতানা প্রমুখ।