রাহেমুর রহমান। গত ১৬ থেকে ১৯ জানুয়ারি চার দিনব্যাপী রাজধানীর তেজগাঁওয়ের আলোকি কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত আর্কা ফ্যাশনউইক-২০২৫-এ প্রথমবার অংশগ্রহণ করেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি সাউথ এশিয়ান এই ব্রাইডাল ডিজাইনার। পোশাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে পরিযায়ী বাংলাদেশিদের যাপনকে তুলে ধরতে চাওয়া এই স্বপ্নবাজ তরুণকে নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ
রাজধানীর তেজগাঁওয়ের আলোকি কনভেনশন সেন্টারে গত ১৬ থেকে ১৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আর্কা ফ্যাশনউইক-২০২৫। আর্কার তৃতীয় এই আসরে ছিল ফ্যাশনের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবন ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে উদযাপনের নানা আয়োজন। আলাদা চারটি থিম নির্বাচন করা হয়েছে চার দিনের এই ফ্যাশনউইকের জন্য। প্রথম দিনের থিম ছিল ডেনিম। সময়কাল ছাপিয়ে এই ফেব্রিকের আবেদন, বহুমুখিতা ও জনপ্রিয়তার প্রতিফলন দেখা গেছে আর্কা ফ্যাশনউইকের প্রথম দিনে। দ্বিতীয় দিনের থিম হিসেবে ছিল মডার্ন কনটেম্পরারি। তৃতীয় ও চতুর্থ দিনে থিম ছিল ফিউশন ও সাসটেইনেবিলিটি। তবে এবারের আর্কা ফ্যাশনউইকের মূল আকর্ষণগুলোর অন্যতম ছিল মাস্টারক্লাস। প্রথম দিনেই দুপুর ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত ৬টি মাস্টারক্লাস আয়োজিত হয়েছে। ফ্যাশন জগতের শীর্ষস্থানীয় বিশেষজ্ঞরা এ ক্লাসগুলো নিয়েছেন। ডিজাইনের বিভিন্ন দিক, উদ্ভাবন ও সাসটেইনেবিলিটি নিয়ে আলোচনা করছেন তারা। বিশেষ চমক হিসেবে তাঁতে বেনারসি বুনেছিলেন মিরপুরের বেনারসিপল্লি থেকে আসা দক্ষ তাঁতিরা। ছিল ফ্যাশন শোয়ের মহড়া। আলোচিত আর্কা ফ্যাশনউইকের তৃতীয় আসরে প্রথমবারের মতো অংশ নেন ব্রিটিশ বংশোদ্ভূত বাংলাদেশি সাউথ এশিয়ান ব্রাইডাল ডিজাইনার রাহেমুর রহমান। কাট ও প্যাটার্নের চমৎকারিত্ব তিনি দেখালেন আর্কার তৃতীয় দিনের ফিউশন রানওয়েতে।
দেশীয় পোশাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন
স্নাতক পাস করেই লন্ডন ফ্যাশনউইকে অংশ নেন এই তরুণ। সেখানে সবাই নিজের ব্র্যান্ডের বিভিন্ন নাম দিচ্ছিলেন, রাহেমুরও নিজের নামে ব্র্যান্ড শুরু করেন–‘রেহমুর রহমান’। মূলত প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মেলবন্ধনে পরিযায়ী বাংলাদেশিদের যাপনকে তুলে ধরতে চান তরুণ রাহেমুর রহমান। তাঁর জন্ম ব্রিটেনে হলেও বাবা-মা দু’জনই সিলেটের। দুরন্ত রাহেমুন কৈশোরে ভুল পথে চলে গেলেও তরুণদের ক্লাবে যোগ দিয়ে ফিরে আসেন আলোর পথে। সেই ক্লাবে তিনি শেখেন কাট, প্যাটার্ন, ক্রুশ ও টেক্সটাইলের কাজ। ফ্যাশন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন ‘সেন্ট্রাল সেন্ট মার্টিনস স্কুল অব আর্ট ডিজাইন’। বিষয় ছিল মেনসওয়্যার। বর্তমানে একই প্রতিষ্ঠানে তিনি স্নাতক শ্রেণিতে শিক্ষকতা করছেন। এই প্রতিষ্ঠানে পড়ার সময়েই তিনি বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাপন নিয়ে জানতে ও পড়তে
শুরু করেন।
ডিজাইনে প্রাধান্য
রাহেমুর কাঁচামাল বা উপাদান বাছাই করার ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেন কাপড় বা পোশাক কতটা পরিবেশবান্ধব হতে পারে। অথবা আজ থেকে ২০০ বছর পর এই কাপড়ের কী পরিণতি হবে? একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর এই কাপড়ের স্থান হবে কোন থ্রিপট শপ বা কোনো কারখানায় ওয়েস্ট ম্যাটারিয়াল হিসেবে। যদি এতে আন-অর্গানিক কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়, তবে ২০০০ বছর পর্যন্ত সময় লাগবে মাটির সঙ্গে মিশতে। সে কারণেই তিনি প্রাকৃতিক উপাদান, প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করেন। কেবল তাই নয়; তিনি পোশাকের মধ্যে উদ্ভিদের বা ফলের বীজ দিয়ে দেন, যাতে কখনও ক্রেতা সেটিকে মাটিতে ফেলে দিলে বা নিজের বাগানে পুঁতে রাখলে সেখান থেকে গাছ জন্মাতে পারে। পরিবেশের প্রতি মানুষ হিসেবে তিনি যে দায়বদ্ধ, সেই ভাবনা থেকেই এই প্রয়াস।
দেশীয় ক্র্যাফটে গর্ব
বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত ক্র্যাফটের বয়স কয়েকশ’ কিংবা হাজার বছরের; যার খানিকটা অংশ পশ্চিমবঙ্গ কিংবা নেপালে দেখা যায়। একেক প্রজন্ম একেকভাবে দেশীয় ক্র্যাফটকে তুলে ধরেছে। যেমন বিবি রাসেল দেশীয় গামছাকে আন্তর্জাতিক পরিসরে পাশ্চাত্যের মিশেলে তুলে ধরেছেন। সেভাবে কাজ করতে হবে আমাদের ঐতিহ্যবাহী ক্র্যাফট নিয়ে। আমি আমার নিজস্ব পোশাকে ব্লক, টাই-ডাই, প্যাচওয়ার্ক, এমব্রয়ডারি, নকশিকাঁথা ব্যবহার করেছি, যাতে আমাদের ঐতিহ্যের ছোঁয়া থাকে। প্রথমে দেখলে লোকাল ক্র্যাফট চোখে পড়বে না, হাই ফ্যাশন ভাববে। এভাবেই আমাদের নিজস্ব ক্র্যাফটকে তুলে ধরতে হবে। আমাদের নিজস্ব ক্র্যাফটকে নতুনভাবে উপস্থাপন করে বিশ্বের বিভিন্ন ফ্যাশনউইকে প্রদর্শন করা যেতে পারে। আন্তর্জাতিকভাবে কিন্তু সেভাবেই ফ্যাশনউইক হয় লন্ডন, মিলান, নিউইয়র্ক, প্যারিস–এভাবে ঘুরে ঘুরে ফ্যাশন সব খানে ছড়িয়ে পড়ে। আমাদেরও সে রকম নিজেদের একটি গণ্ডি তৈরি করতে হবে এশিয়ার মধ্যে।
আগামীর স্বপ্ন
রেকর্ড গড়তে ও ভাঙতে পছন্দ করেন এই তরুণ। প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে লন্ডন ফ্যাশনউইকে অংশ নেওয়া এবং প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ভিঅ্যান্ডএতে পোশাক প্রদর্শিত হওয়া এই ডিজাইনার মনে করেন, বাংলাদেশিরা ট্যাবু নিয়ে থাকে– এ কাজ তারা পারবে না। এ ধারণা থেকে সবাইকে বের করে আনতে চান তিনি। কেবল তাই নয়, দেশের তরুণদের কীভাবে কাপড় বুনতে হয় সেটি গভীরভাবে জানতে হবে, কাপড় নিয়ে পড়াশোনা করতে হবে। বিভিন্ন ডিজাইনারের পোশাক দেখতে হবে। ইনোভেশন, অভিনবত্ব ও কাট– এই তিন বিষয়ের কমতি রয়েছে বাংলাদেশের ফ্যাশনে। বেশির ভাগ বাংলাদেশি ডিজাইনার প্রথাগত কাট ও প্যাটার্ন থেকে বের হয়ে নিরীক্ষা করতে ভয় পান। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, তবেই পরিবর্তন আসবে বলে মনে করেন এই তরুণ!
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ম র রহম ন ড জ ইন র আম দ র প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
সবার নজরের বাইরে থাকা চৈতী দেশের জন্য আনল স্বর্ণপদক
একটু বড় হওয়ার পর মেয়েকে দেখে চিন্তায় পড়ে যান মা–বাবা। অন্য শিশুদের মতো বাড়ছে না সে। হাত–পা ছোট, উচ্চতাও থমকে গেছে। পরে বুঝতে পারেন—চৈতী বামন।
যে মেয়েকে নিয়ে একসময় দুশ্চিন্তার পাহাড়ে আটকা পড়েছিল পরিবার, আজ সেই চৈতীই আনন্দের আলো ছড়াচ্ছে। দেশের জন্য প্রথমবারের মতো এশিয়ান ইয়ুথ প্যারা গেমসে স্বর্ণপদক এনে দিয়েছে চৈতী রানী দেব।
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভূনবীর গ্রামের শিলু রানী দেব ও সত্য দেবের মেয়ে চৈতীর বয়স ১৩ বছর। উচ্চতা মাত্র ৩ ফুট ৭ ইঞ্চি। কিন্তু তার লক্ষ্য নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া । সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে চলমান এশিয়ান ইয়ুথ প্যারা গেমস ২০২৫–এ বর্শা নিক্ষেপ ও ১০০ মিটার দৌড়ে সে জিতে নিয়েছে দুটি স্বর্ণপদক। ৭ ডিসেম্বর এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে, চলবে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
চৈতীর প্রতিভা আছে। অনুশীলনে সে খুব আন্তরিক। সে কিছু করতে চায়। আশা করছি, ওকে দিয়ে একটা ভালো ফলাফল পাবমেহেদী হাসান, বিকেএসপির প্রধান প্রশিক্ষকচৈতীর স্বর্ণপদক পাওয়ার বিষয়টি দুবাই থেকে প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইনডিপেনডেন্সের (শি) প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী শারমিন ফারহানা চৌধুরী।
যে মেয়েকে সবাই দেখত শুধু উচ্চতায়ভূনবীর দশরথ হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী চৈতী একসময় গ্রামবাসীর নজরে পড়ত শুধু তার খর্বাকৃতির জন্য। খেলাধুলায় তার যে অসাধারণ প্রতিভা আছে, তা ছিল চোখের আড়ালে।
তবে এই ছবি এখন বদলে গেছে। গ্রামবাসী বাড়িতে এসে খোঁজ নেন। শিক্ষকেরা খেলতে উৎসাহ দেন, ছবি তোলেন। স্কুলে সে এখন ‘তারকা’।
দুবাইয়ে বর্শা নিক্ষেপে স্বর্ণপদক জয়ের পর চৈতী