ট্রাম্পকে সামলাতে ইউরোপের ‘হাতিয়ার’ কিয়ার স্টারমার
Published: 3rd, March 2025 GMT
ইউরোপ এখন বড় সংকটের মুখে। সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে দেশগুলো নিজেদের স্বার্থই আগে দেখে। আন্তর্জাতিক জোট, অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা চুক্তিগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও, যদি এগুলো সময়ের চাহিদা মেটাতে না পারে, তাহলে তা উপেক্ষিত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে। এখন ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) সেই সংকটে পড়েছে।
গত শুক্রবার রাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে যেভাবে অপমান করেছেন, তা দেখে সবাই একমত যে ট্রাম্প ইউক্রেনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, রাশিয়ার প্রতি অস্বাভাবিক সমর্থন দেখিয়েছেন এবং ইউরোপকে বলেছেন, নিজেদের প্রতিরক্ষা তারা নিজেরাই সামলাক। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এতে সমাধান দ্রুত করতে হবে।
এই সংকটে তিনটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতারা নিজেরাই নেতৃত্ব নিচ্ছেন। ইইউ কমিশন এবং কিছুটা হলেও ন্যাটোকেও তারা একপাশে ঠেলে দিচ্ছেন।
দ্বিতীয়ত, ট্রাম্প প্রশাসন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে ইইউর প্রতি বেশি বিদ্বেষ দেখাচ্ছে। ট্রাম্প দাবি করেছেন, ইইউ তৈরি হয়েছে আমেরিকাকে ঠকানোর জন্য। তাঁর এই দাবি অযৌক্তিক ও উদ্ভট। এখন তিনি ইউরোপীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বসানোর হুমকি দিচ্ছেন। ইউক্রেন নিয়ে আলোচনায় তিনি ইইউকে বাদ দিতে চান। অথচ ভবিষ্যতে ইউরোপকেই শান্তি রক্ষার দায়িত্ব নিতে বলছেন।
তৃতীয় বিষয়টি হলো, দীর্ঘদিন ইউরোপ থেকে নিজেদের গুটিয়ে রাখার পর, ব্রিটেন আবারও ইউরোপের রাজনীতির কেন্দ্রে চলে আসছে। ব্রেক্সিট যে ভুল ছিল, তা এখন আগের চেয়ে বেশি পরিষ্কার। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার চান, ইউরোপ ও আমেরিকার মধ্যে সেতুবন্ধন করুক ব্রিটেন। কিন্তু ট্রাম্পের উদ্দেশ্য অন্য। তিনি ব্রিটেনকে ইউরোপের মধ্যে বিভক্তি তৈরির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চান।
জাতীয় নেতাদের মধ্যে ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ সবচেয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন। ট্রাম্প যখন আচমকা ইউক্রেনের পাশে না দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন, তখন মাখোঁ প্যারিসে জরুরি বৈঠক ডাকেন। এরপর তিনি দ্রুত হোয়াইট হাউসে গিয়ে ইউরোপের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান। আর তা শুধু ইউক্রেনের জন্য নয়, বরং পুরো ইউরোপের জন্য।
এদিকে, জার্মানির নবনির্বাচিত চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস ইউরোপীয় নেতাদের আহ্বান জানাচ্ছেন যত দ্রুত সম্ভব নিজেদের শক্তিশালী করতে, যাতে তাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল না থাকেন। মের্ৎস মনে করেন, বর্তমান অবস্থায় ন্যাটো তেমন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না।
প্রথাগতভাবে, ন্যাটোর নেতৃত্বে একজন মার্কিন জেনারেল থাকেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্বে রাখার দরকারই বা কী? ন্যাটোর ৩২টি সদস্য দেশের মধ্যে ৩০টি ইউরোপীয়। অর্থনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল হলেও, ট্রাম্পের হাত থেকে মুক্ত একটি ‘ইউরোপীয় বাহিনী’ গঠনের মাধ্যমে ইউক্রেন ও ইউরোপের প্রতিরক্ষা আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। এটি শুধু রাশিয়াকেই প্রতিহত করবে না, বরং প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রকেও চাপে রাখবে।পোল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্কও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন যে পুতিনের কাছে আত্মসমর্পণ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ট্রাম্পের নীতির কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি। তাঁর দাবি, ইউরোপের প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়াতে হবে, যেমনটা পোল্যান্ড ইতিমধ্যে করছে।
কিন্তু এমন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) পিছিয়ে রয়েছে। গত সপ্তাহে রাশিয়ার আক্রমণের বার্ষিকীতে ইইউ কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেন কিয়েভ সফর করলেও তা ছিল প্রতীকী। ওয়াশিংটনের কাছে ইইউ যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে। ট্রাম্প প্রশাসন ইউক্রেন বা অন্য কোনো বিষয়েই ইইউর সঙ্গে আলোচনা করতে চাইছে না।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতিপ্রধান কাইয়া কালাস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে অবশেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর সঙ্গে বৈঠকের সুযোগ পেলেন। কিন্তু যখন তিনি আকাশপথে ছিলেন, তখন রুবিও হঠাৎ সেই বৈঠক বাতিল করেন। এটা পরিষ্কার ইচ্ছাকৃত অপমান, ইইউর প্রতি ট্রাম্প প্রশাসনের অবজ্ঞার প্রকাশ।
এ অবস্থায় ইইউ নিজেদের আবার আলোচনার কেন্দ্রে আনতে মরিয়া। এ সপ্তাহেই আরেকটি জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে ইউক্রেনকে ২০ বিলিয়ন ইউরো–সহায়তা নিয়ে আলোচনা হবে। কিন্তু ঐকমত্যের অভাব স্পষ্ট। ইতালি, স্পেন ও পর্তুগাল এ বিষয়ে আগ্রহী নয়। আর হাঙ্গেরি আগেও রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইইউর নিষেধাজ্ঞায় বাধা দিয়েছিল। এবারও তারা একই ভূমিকা নিতে পারে।
বর্তমান সংকটে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে ইইউর পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ দরকার। জাতীয় স্বার্থে একক দেশগুলোর ভেটো ক্ষমতা সীমিত করা এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথ খুলতে হবে।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়তো আবারও পিছিয়ে যাবে ১৯ মার্চ পর্যন্ত। সে সময় আরেকটি সম্মেলনে যৌথ প্রতিরক্ষা উৎপাদন, ক্রয় ও অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা হবে। তবে তখনো হয়তো ট্রাম্পের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কোনো নির্দিষ্ট পরিকল্পনা গৃহীত হবে না। এই বিলম্বই বড় সমস্যার ইঙ্গিত দিচ্ছে। সংকটের সময় ২৭ দেশের ইইউ যথেষ্ট দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বরং অচলাবস্থার শিকার হয়। এখন জরুরি হয়ে উঠেছে পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তার বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জাতীয় পর্যায়ের ভেটো ক্ষমতা কমানো।
কিন্তু এই সংকট তো অপেক্ষা করবে না। ফলে ইউক্রেনকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে সহায়তা করার দায়িত্ব এখন জাতীয় সরকারগুলোর ওপর বর্তেছে। একটা জোট গড়ে কয়েকটি দেশ যৌথভাবে পদক্ষেপ নিতে পারে, যাতে ট্রাম্প ও পুতিন ইউরোপকে নিজেদের মতো ভাগ করে নিতে না পারেন। এখানেই যুক্তরাজ্যের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার ইউক্রেনের জন্য একটি ‘নিরাপত্তা বাহিনী’ গঠনের বিষয়ে মাখোঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছেন। তিনি লন্ডনে ইউরোপীয় নেতাদের নিয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। সেখানে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর আলোচনার বিষয়ে ব্রিফ করবেন।
যুক্তরাজ্যের এই নেতৃত্ব কেবল সামরিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং এটি ইউরোপের সামগ্রিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে নতুনভাবে সংগঠিত করতেও সাহায্য করতে পারে। ব্রেক্সিটের পর সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকলেও, এই নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সহযোগিতা দীর্ঘ মেয়াদে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের মধ্যে বাণিজ্য, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ, মুক্ত চলাচলসহ অন্যান্য বিষয়ে নতুন আস্থার সৃষ্টি করতে পারে।
এদিকে, ন্যাটোও এখন একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। ইউক্রেন ইস্যু বাদ দিলেও, ট্রাম্পের প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ ইউরোপ থেকে মার্কিন সেনাসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন। ফলে এখন প্রশ্ন উঠেছে, ন্যাটোর বিখ্যাত ৫ নম্বর অনুচ্ছেদ, যেখানে একটি দেশ আক্রান্ত হলে সব দেশ তার পাশে দাঁড়াবে, সেটি আদৌ কার্যকর থাকবে কি? যদি পোল্যান্ড আক্রমণের শিকার হয়, তবে ট্রাম্প কি সত্যিই যুদ্ধ করবেন? ন্যাটোর শেষ ভরসা, মার্কিন পারমাণবিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। সেই ভরসা এখনো সচল আছে তো? এসব প্রশ্ন কিছু মাস আগেও অকল্পনীয় ছিল। কিন্তু এখন বাস্তব হয়ে উঠেছে।
প্রথাগতভাবে, ন্যাটোর নেতৃত্বে একজন মার্কিন জেনারেল থাকেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রকে নেতৃত্বে রাখার দরকারই বা কী? ন্যাটোর ৩২টি সদস্য দেশের মধ্যে ৩০টি ইউরোপীয়। অর্থনৈতিকভাবে ব্যয়বহুল হলেও, ট্রাম্পের হাত থেকে মুক্ত একটি ‘ইউরোপীয় বাহিনী’ গঠনের মাধ্যমে ইউক্রেন ও ইউরোপের প্রতিরক্ষা আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। এটি শুধু রাশিয়াকেই প্রতিহত করবে না, বরং প্রয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রকেও চাপে রাখবে।
বর্তমানে বিশ্ব স্বৈরশাসক ও চরম জাতীয়তাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। এমন সময় ইইউ, আফ্রিকান ইউনিয়ন ও আরব লীগের মতো বহুপক্ষীয় সংগঠনগুলোর গুরুত্ব আরও বেড়েছে। তবে এগুলো যদি কার্যকর না হয়, তাহলে তাদের অস্তিত্বই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, নিরাপত্তা পরিষদসহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখন সংস্কারের তাগিদ অনুভব করছে। এমন সংকটময় সময়ে প্রয়োজন নতুন ও সাহসী চিন্তাভাবনা। সামনে দুটিমাত্র পথ—পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া অথবা ট্রাম্পের হাতে নিয়ন্ত্রণ হারানো।
সাইমন টিসডাল অবজারভারের বিদেশবিষয়ক পর্যালোচক
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ও ইউর প র ইউর প র প পরর ষ ট র ইউক র ন র ইউর প য় ইইউর প কর ছ ন মন ত র র জন য ন ইউর
এছাড়াও পড়ুন:
খালেদা জিয়াকে নিয়ে বিএনপির নির্বাচনী যাত্রা শুরু
সব জল্পনার অবসান হলো—বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া নির্বাচন করছেন। তিনি ফেনী-১, বগুড়া-৭ ও দিনাজপুর-৩ আসনে প্রার্থী হবেন। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য সোমবার বিএনপি ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে দলের দুই শীর্ষ নেতার নির্বাচন করা এবং তাঁদের নির্বাচনী আসনগুলো নিশ্চিত করা হয়। এ ছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ঠাকুরগাঁও-১ আসনে নির্বাচন করবেন।
তারেক রহমান বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচন করবেন, অনেক আগে থেকেই এমন আলোচনা আছে। তবে অসুস্থতার কারণে এবার খালেদা জিয়ার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া নিয়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে সংশয় ছিল। আবার তাঁর নিজেরও নির্বাচন করার ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহ ছিল না।
দলীয় সূত্র বলছে, নির্বাচন ঘিরে নানামুখী শঙ্কা, বিশেষ করে ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে নেতৃত্ব দিতে রাজি করানো হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁর প্রার্থী হওয়ার ঘোষণায় নেতা-কর্মীরা আনন্দিত।
স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, নানা কারণে আসন্ন নির্বাচন বিএনপির জন্য খুব স্বস্তিদায়ক না-ও হতে পারে। খালেদা জিয়াকে নির্বাচন করতে রাজি করানোর মধ্য দিয়ে সার্বিকভাবে নির্বাচনের গুরুত্বটা আরও বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি নির্বাচন নিয়ে নতুন কোনো জটিলতার উদ্ভব হলে, সেটা মোকাবিলায়ও তাঁর ভোটে অংশগ্রহণ পরিস্থিতির ওপর একটা প্রভাব ফেলবে।
জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে সোমবার ২৩৭ আসনে মনোনীত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়। বাকি ৬৩টি আসনে প্রার্থিতা পরে ঘোষণা করা হবে।
বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, স্থগিত রাখা কিছু আসনে প্রার্থিতা নিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যা আছে। আর কিছু আসন জোট ও সমমনা দলগুলোর প্রার্থীদের জন্য রাখা হয়েছে, যাদের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে।
ঘোষিত তালিকা অনুযায়ী, বিএনপির চেয়ারপারসন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান, মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির ১২ জন সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছেন। অন্যরা হলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন (কুমিল্লা-১), মির্জা আব্বাস উদ্দিন আহমেদ (ঢাকা-৮), গয়েশ্বর চন্দ্র রায় (ঢাকা-৩), আবদুল মঈন খান (নরসিংদী-২), আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী (চট্টগ্রাম-১০), ইকবাল হাসান মাহমুদ (সিরাজগঞ্জ-২), সালাহউদ্দিন আহমদ (কক্সবাজার-১), হাফিজ উদ্দিন আহমদ (ভোলা-৩) এবং এ জেড এম জাহিদ হোসেন (দিনাজপুর-১)।
স্থায়ী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য জমির উদ্দিন সরকার, সেলিমা রহমান ও নজরুল ইসলাম খান এবার নির্বাচন করছেন না। তবে বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা জমির উদ্দিন সরকারের পঞ্চগড়-১ আসনে তাঁর ছেলে মোহাম্মদ নওশাদ জমিরকে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২৩৭ আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। তবে তিনি বলেছেন, এটি প্রাথমিক তালিকা। প্রয়োজন বোধ করলে স্থায়ী কমিটি প্রার্থিতা পরিবর্তন করতে পারবে।
সোমবার বিকেল পাঁচটার দিকে প্রার্থী ঘোষণার আগে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করতে তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের স্থায়ী কমিটির জরুরি সভা হয়। দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী সভা হয়। সেখানে জুলাই সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন নিয়ে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়েও আলোচনা হয়। পরে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের নিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেন। এ সময় বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকেরাও উপস্থিত ছিলেন।
এবারের প্রার্থী তালিকায় রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দলের ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু। তাঁকে ফেনী-৩ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে।
আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘জীবনে প্রথম সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হচ্ছি। দল আমার ওপর আস্থা রেখেছে, সে আস্থা রাখার জন্য ধন্যবাদ। আমি আগামীকাল (আজ মঙ্গলবার) ম্যাডামের (খালেদা জিয়া) সঙ্গে দেখা করব, সালাম জানাব।’
যে কারণে ঢাকার সাতটি আসন ফাঁকাঢাকার ২০টি আসনের মধ্যে ১৩টিতে প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। বাকি সাতটি আসন ফাঁকা রাখা হয়েছে। নেতা-কর্মীরা বলছেন, ঢাকায় প্রার্থিতা নিয়ে মারাত্মক পর্যায়ে অভ্যন্তরীণ কোন্দল নেই। তাঁদের ধারণা, নির্বাচনী সমঝোতার জন্য আসনগুলোতে প্রার্থিতা স্থগিত রাখা হয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, সাতটি আসনের মধ্যে জাতীয় নাগরিক পাটির (এনসিপি) সঙ্গে সমঝোতা হলে তাদের জন্য অন্তত তিনটি আসন ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ তালিকায় গণতন্ত্র মঞ্চ, বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের নামও আছে।
তবে এনসিপির নেতারা যেসব আসনে নির্বাচন করতে চান বলে আলোচনা আছে, সে আসনগুলোর একটি (ঢাকা-৯) ছাড়া বাকিগুলোতে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম (ঢাকা-১১), সদস্যসচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা (ঢাকা-৯), দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ (কুমিল্লা-৪), উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১) ও জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদের (নোয়াখালী-৬) স্ব স্ব আসনে তাঁদের কমবেশি তৎপরতা আছে।
ঢাকা-৯ আসন স্থগিত রাখা হলেও সেটা কার জন্য, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সেখানে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব হাবীব উন নবী খানকে (সোহেল) প্রার্থী করা হতে পারে বলে দলে আলোচনা আছে।
ঢাকা-১৪: মায়ের ডাক-এর সানজিদাঢাকা-১৪ আসনে এবার প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ পড়লেন এস এ খালেকের ছেলে এস এ সিদ্দিক (সাজু)। সেখানে গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের ব্যক্তিদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর সংগঠক সানজিদা ইসলামকে (তুলি) প্রার্থী মনোনীত করেছে বিএনপি। এই আসনে ইতিমধ্যে জামায়াত প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুমের শিকার মীর আহমদ বিন কাসেমকে (আরমান)। তিনি আট বছর গুম ছিলেন। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর গোপন বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্তি পান।
সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। ডিসেম্বরের শুরুর দিকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হবে বলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকেই বিএনপি জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে দলটি অভ্যন্তরীণ জরিপসহ সাংগঠনিক উপায়ে প্রার্থী বাছাই সম্পন্ন করেছে। সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের নাম প্রকাশ করে নির্বাচনের পথে যাত্রা শুরু করল বিএনপি।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশের মানুষ বিগত ১৫-২০ বছর ভোট দিতে পারেনি। এখন জাতি উৎসাহিত হচ্ছে ভোটের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। তিনি বলেন, উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দিতে মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা, সেটি পূরণ করার লক্ষ্যে বিএনপি প্রার্থী মনোনয়ন ঘোষণা করে একটা বড় পদক্ষেপ নিল। ইতিমধ্যে অনেকে মাঠে চলে গেছেন, এ ঘোষণার পর বাকিরাও মাঠে যাবেন। এর মাধ্যমে ভোটের একটা উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি হবে।
১০ নারী প্রার্থীঘোষিত ২৩৭ আসনের প্রার্থী তালিকায় নারী রয়েছেন দশজন। এর মধ্যে অন্যতম বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বাকিরা হলেন সিলেট-২ আসনে তাহসিনা রুশদীর, ফরিদপুর-২ আসনে শামা ওবায়েদ ইসলাম, ফরিদপুর-৩ আসনে নায়াব ইউসুফ আহমেদ, মানিকগঞ্জ-৩ আসনে আফরোজা খান রিতা, শেরপুর-১ আসনে সানসিলা জেবরিন, ঝালকাঠি-২ আসনে ইসরাত সুলতানা ইলেন ভুট্টো, যশোর–২ আসনে সাবিরা সুলতানা, ঢাকা-১৪ আসনে সানজিদা ইসলাম ও নাটোর-১ আসনে ফারজানা শারমিন।
মনোনয়ন না পেয়ে দুই মহাসড়ক অবরোধমাদারীপুর-১ আসনে বিএনপি প্রার্থী ঘোষণা করে কামাল জামান মোল্লাকে। এর প্রতিবাদে আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী সাজ্জাদ হোসেন লাভলু সিদ্দিকীর অনুসারীরা রাত আটটার দিকে ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।
চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড) আসনে বিএনপির সাবেক যুগ্ম মহাসচিব আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন না দেওয়ায় তাঁর অনুসারীরা সন্ধ্যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন।