আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য ‘অধিকার, সমতা, ক্ষমতায়ন/ নারী ও কন্যার উন্নয়ন’ একটি শক্তিশালী বার্তা বহন করে, যা বিশ্বব্যাপী নারী ও কন্যার জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোকে মোকাবিলা করার আহ্বান জানায়। এই প্রতিপাদ্য শুধু নারীর অধিকারের প্রতি সমর্থনই নয়; বরং একটি বৈষম্যহীন, সমতাভিত্তিক ও ন্যায়সংগত সমাজ গঠনের দিকে অগ্রসর হওয়ার অঙ্গীকার প্রতিফলিত করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রতিপাদ্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, কারণ এদেশ জেন্ডার সমতা অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করলেও নারীরা এখনও সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর ফলে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা ও বৈষম্য অব্যাহত রয়েছে, যা তাদের ক্ষমতায়ন ও সমঅধিকারের পথে বড় বাধা। আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশ নারীর রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় অগ্রগামী দেশগুলোর মধ্যে একটি। দীর্ঘ তিন দশক ধরে দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নারী, যা বৈশ্বিকভাবে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি (২০১১) এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন (২০১০) নারীর সুরক্ষা ও অধিকারের জন্য একটি আইনি কাঠামো তৈরি করেছে। তবে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। নারীরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করলেও, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি তাদের। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নারীর প্রতিনিধিত্ব এখনও সীমিত এবং নারী নেতৃত্বের বিকাশে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাধা বিদ্যমান।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় নারীরা আন্দোলন, নীতিগত আলোচনা এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা সহিংসতা ও হুমকির মুখেও গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা এবং মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছে। জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ একটি স্বৈরাচারী সরকার অপসারিত হওয়ার পর নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণের সুযোগ বেড়ে গেছে। তবে নারীর স্বাধীন চলাফেরা ও জনপরিসরে অবস্থান এখনও হুমকির সম্মুখীন। রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীকে গ্রহণ করার মানসিকতা এখনও সমাজে অনুপস্থিত। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম করা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা দিচ্ছে।
বাংলাদেশে নারীরা এখনও ব্যাপকভাবে সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বিবিএস এবং ইউএন উইমেন পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণা অনুযায়ী, সবচেয়ে প্রচলিত সহিংসতার ধরন হলো পারিবারিক সহিংসতা। এছাড়া ধর্ষণ, বাল্যবিয়ে এবং কর্মস্থলে হয়রানির হারও উদ্বেগজনক। নারীর সুরক্ষার জন্য বিদ্যমান আইনগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জেন্ডার সংবেদনশীল প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি। পাশাপাশি ভুক্তভোগীর জন্য সুরক্ষা ও পুনর্বাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
২০০৯ সালের স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদে নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন থাকলেও তাদের নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা সীমিত। স্থানীয় সরকারে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। নারীর রাজনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি। পাশাপাশি রাজনৈতিক শিক্ষা প্রদান এবং নেতৃত্ব বিকাশের জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। স্থানীয় পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন গোটা সমাজের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, যেখানে নারীরা বিশেষভাবে বেশি প্রভাবিত হয়। উপকূলীয় ও নদীভাঙনপ্রবণ অঞ্চলে বসবাসকারী নারীর বাসস্থান হারানো, জীবিকা সংকট এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবারের জন্য খাদ্য, পানি ও জ্বালানির সংস্থান করতে গিয়ে নারীরা অতিরিক্ত চাপের মুখোমুখি হয়। তবে, নারীরা এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় পর্যায়ে তারা কৃষি, মাছ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব জীবিকা গড়ে তুলছে। কিন্তু তাদের এই অবদান নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পর্যাপ্ত স্বীকৃতি পাচ্ছে না। জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। নারী নেতৃত্বাধীন জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পগুলোর সম্প্রসারণ প্রয়োজন, যাতে তারা এই সংকট মোকাবিলায় আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত নীতিমালায় সমতা ও ন্যায্যতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এছাড়া, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো গড়ে তোলা, নারীর জন্য বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং অভিযোজন কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন। নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত করা গেলে তা কেবল তাদের ক্ষমতায়নই নয়, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সামগ্রিক সাফল্যও নিশ্চিত করবে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক বাজেটিং অপরিহার্য।
বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও তারা এখনও বৈষম্যের শিকার। বিশেষ করে গার্মেন্টস খাতে নারীরা কম মজুরি, অনিরাপদ কর্মপরিবেশ এবং মৌলিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকা দরকার। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং সামাজিক সুরক্ষা খাতে নারীর জন্য পৃথক তহবিল গঠন করা উচিত। পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তার জন্য সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা, প্রশিক্ষণ ও বাজারে প্রবেশের সুযোগ তৈরি করতে হবে। নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সমান কাজের জন্য সমান মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। নারীকে কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও সম্মান দেওয়া হলে, তা শুধু নারীর ক্ষমতায়নই নয় বরং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত নারীরা সমাজ পরিবর্তনের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে আসছে। বিশেষ করে শ্রমজীবী নারী, কৃষি ও উদ্যোক্তা খাতে কর্মরত নারীরা অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। নারীর নেতৃত্ব ও সামাজিক পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনের পথ সুগম করা সম্ভব।
নারীর অধিকার সংরক্ষণে পরিবার ও সমাজের মনোভাব পরিবর্তন জরুরি। স্কুল পর্যায়ে জেন্ডার সমতাবিষয়ক পাঠ্যক্রম চালু করা এবং গণমাধ্যমের দ্বারা নারীবান্ধব সচেতনতা বাড়ানো দরকার। নারীর শিক্ষা ও সচেতনতা বাড়ানোর মাধ্যমে তাদের ক্ষমতায়নের পথ সুগম করা সম্ভব।
নারীকে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষ করে তুলতে হবে, যাতে তারা তথ্য ও সেবা সহজে পেতে পারে। ডিজিটাল মাধ্যমে নারী নেতৃত্ব এবং সামাজিক সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে অনলাইন হয়রানির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নারীর ক্ষমতায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে ব্যবহার করা হয়।
বাংলাদেশ নারীর অগ্রগতিতে অনেক দূর এগিয়েছে, কিন্তু ন্যায্যতা ও সমতার লড়াই এখনও অসমাপ্ত। ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তন একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের সম্ভাবনা তৈরি করেছে। আমাদের নতুন প্রজন্ম, যারা বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে, তাদেরই দায়িত্ব নিতে হবে একটি ন্যায়সংগত সমাজ গঠনের জন্য, যেখানে প্রত্যেক নারী সমান মর্যাদায় ও নিরাপত্তায় জীবনযাপন করতে পারবে।
লেখক
নির্বাহী পরিচালক
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র ক ষমত য ন ন শ চ ত কর র র জন ত ক ন র জন য র জন য স ন য য যত র র জন য ব যবস থ পর য য ক ত কর গ রহণ জলব য
এছাড়াও পড়ুন:
দুই মাস ফ্রিজে রাখার পর মামুনের মাথায় খুলি পুনঃস্থাপন
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থী মামুন মিয়ার মাথায় খুলি প্রায় দুই মাস ফ্রিজে সংরক্ষণ করার পর সফলভাবে পুনঃস্থাপন করা হয়েছে।
শনিবার (১ নভেম্বর) চট্টগ্রাম পার্কভিউ হাসপাতালে অপারেশনের মাধ্যমে খুলি পুনঃস্থাপন করেন চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, মামুন মিয়ার মাথায় সফলভাবে অপারেশন করা হয়েছে। তিনি এখন সুস্থ আছেন।
গত ৩০ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে মাথায় আঘাত পেয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলেন মামুন মিয়া।
চট্টগ্রাম নগরীর পাঁচলাইশের পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ টি এম রেজাউল করিম জানিয়েছেন, চবিতে সংঘর্ষের দিন গুরুতর আহত অবস্থায় মামুন মিয়াকে পার্কভিউ হাসপাতালে আনা হয়েছিল। সেই থেকে তিনি এখানে চিকিৎসাধীন আছেন। অপারেশনের সময় তার মাখার খুলি খুলে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়েছিল। দীর্ঘ প্রায় দুই মাস পর সফল অপারেশনের মাধ্যমে শনিবার মামুনের মাথার খুলি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন।
গত ৩০ আগস্ট তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চবি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষ হয়। এতে মামুনসহ চবির অন্তত ৫০০ শিক্ষার্থী আহত হন। মাথায় মারাত্মক আঘাতের কারণে মামুনের মাথার খুলি খুলে রেখে দেওয়া হয়েছিল।
ঢাকা/রেজাউল/রফিক