সাহ্রির সময় গাজায় হামলা, কাটছে না দুঃস্বপ্নের রাত
Published: 20th, March 2025 GMT
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার বাসিন্দাদের অনেকে তখন গভীর ঘুমে। কেউ কেউ সাহ্রির প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। এমন সময় বিকট শব্দে কেঁপে ওঠে চারপাশ। রাতের অন্ধকারে আহত-রক্তাক্ত মানুষের আর্তচিৎকার এবং আতঙ্কিত মানুষের ছোটাছুটি। গত মঙ্গলবার থেকে এমন নৃশংস হামলার মধ্যে রোজা পালনের জন্য সাহ্রি করছেন গাজার বাসিন্দারা। নতুন করে হামলার ফলে জানুয়ারি থেকে চলমান যুদ্ধবিরতি চুক্তির কার্যত সমাপ্তি ঘটেছে। এতে আবার দুঃস্বপ্নের রাত ফিরে এসেছে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ এ উপত্যকায়।
১৫ মাস ধরে চলা নৃশংস হামলার পর গত জানুয়ারিতে হওয়া যুদ্ধবিরতি গাজাবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল। বাড়িঘরে ফিরে ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন তারা। পবিত্র রমজানে খাবার সংকটের মধ্যে নতুন করে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার।
গত মঙ্গলবার ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর থেকে গাজায় ২০০ শিশুসহ অন্তত ৫০৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৯০৯ জন আহত হয়েছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শুধু গতকাল বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই যুদ্ধবিধ্বস্ত এই অঞ্চলে কমপক্ষে ১১০ জন নিহত হয়েছেন। এ পর্যন্ত ইসরায়েলের আগ্রাসনে গাজায় অন্তত ৪৯ হাজার ৬১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহতের সংখ্যা এক লাখেরও বেশি। নিহতদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
তিনটি হাসপাতালের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থা এপি জানিয়েছে, মধ্যরাতে ঘুমন্ত মানুষের ওপর হামলা করা হচ্ছে। আবাসিক ভবনকে লক্ষ্য করে বোমা ফেলা হচ্ছে। বুধবারেও রাতভর গাজায় বোমা নিক্ষেপ করেছে ইসরায়েলের বিমানবাহিনী। তারা জানিয়েছে, হামাসের পরিকাঠামোগুলো লক্ষ্য করে এই আক্রমণ চালানো হয়েছে। যদিও হামাসের তরফে বলা হয়েছে, এতে বহু সাধারণ মানুষ নিহত হয়েছেন।
আবার গাজায় মানবিক সহায়তা ও বাণিজ্যিক পণ্য সরবরাহের জন্য সবক’টি সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ রাখা হয়েছে। ফলে সেখানে খাদ্য সংকটও প্রকট আকার ধারণ করেছে। কিছু পণ্যের দাম ২০০ শতাংশের বেশি বেড়ে গেছে।
ইসরায়েল সেনাবাহিনী জানিয়েছে, মধ্য গাজায় একটি বাফার জোনের দখল নিতেই তারা স্থলবাহিনী পাঠিয়েছে। পাশাপাশি বিমানবাহিনীর আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। এ ছাড়া ইসরায়েলি সেনারা বৃহস্পতিবার উত্তরাঞ্চলীয় রাজধানী গাজা শহরের অবরোধ পুনর্বহাল করেছে। তারা বাসিন্দাদের গাজা শহরের উত্তরে যাতায়াতের জন্য প্রধান রাস্তা ব্যবহার না করার জন্য সতর্ক করেছে।
অন্যদিকে ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠীরা ইসরায়েলে ছোড়া একটি ক্ষেপণাস্ত্রের দায় স্বীকার করেছে। যদিও সেটা প্রতিহত করা হয়েছে। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত এক বিবৃতিতে হুতিদের সামরিক মুখপাত্র জানিয়েছেন, তেল আবিবের কাছে বেন গৌরি বিমানবন্দর লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রটি ছোড়া হয়েছিল।
গাজায় ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরুর পর থেকে উত্তর গাজাকে দক্ষিণ থেকে বিভক্তকারী নেতজারিম করিডোর ৫০০ মিটার প্রস্থ থেকে ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সুতরাং, এটি এখন আর শুধু করিডোর নেই। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী ক্রমাগত সম্প্রসারণে এটি একটি বাফার জোনে পরিণত হয়েছে। ৮ কিলোমিটার পর্যন্ত সম্প্রসারণের জন্য সেনাবাহিনী এলাকার অনেক আবাসিক ভবন ধ্বংস করে দিয়েছে। আশপাশে একটি নতুন প্রতিষ্ঠিত শহর ছিল, যা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন ইসরায়েলি বাহিনী এটিকে আরও সম্প্রসারণের পরিকল্পনা করছে। এর অর্থ হলো– আরও কৃষিজমি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে।
এদিকে, দখলদার ইসরায়েলের বাণিজ্যিক রাজধানী তেল আবিব লক্ষ্য করে তিনটি দূরপাল্লার রকেট ছুড়েছে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এর মধ্যে একটি রকেট আটকে দিতে সমর্থ হয় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। বাকি দুটি রকেট খোলা স্থানে পড়েছে বলে দাবি করেছে তারা।
গাজায় অভিযান বন্ধের দাবিতে ইসরায়েলে হাজারো মানুষের বিক্ষোভ
গাজায় সামরিক অভিযান বন্ধ এবং সেখানে অবরুদ্ধ জিম্মিদের মুক্তির দাবিতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে ইসরায়েলে। বুধবার রাজধানী জেরুজালেমে পার্লামেন্ট ভবনের কাছে অনুষ্ঠিত এ বিক্ষোভে অংশ নিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, জেরুজালেমে বিগত বেশ কয়েক মাসের হিসেবে গতকালের বিক্ষোভ ছিল সবচেয়ে বড়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ইসর য় ল র র জন য স ইসর য
এছাড়াও পড়ুন:
‘ভোল পাল্টে’ সক্রিয় কিশোর গ্যাং, অতিষ্ঠ বাসিন্দারা
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার চর আবাবিল ইউনিয়নের উদমারা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাতে অতিষ্ঠ বাসিন্দারা। এলাকায় নারীদের উত্ত্যক্ত করা, মাদক সেবন, মারামারি, খুনসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের এসব সদস্যদের বিরুদ্ধে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত বছরের ৫ আগস্টের আগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার ছত্রচ্ছায়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। তবে এখন ভোল পাল্টে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ভিড়েছে তারা।
সম্প্রতি এলাকাটিতে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হয়ে চিকিৎসাধীন জাহাঙ্গীর আলম (৫২) নামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। জাহাঙ্গীর আলম স্থানীয় মসজিদ কমিটির সভাপতি ছিলেন। মসজিদের পাশে জুয়ার আসর বসানো ও মাদক সেবনে বাধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে তাঁর ওপর হামলার অভিযোগ রয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে। গত ৩ এপ্রিল তাঁর ওপর হামলা করা হয়। এরপর গত শনিবার তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
স্থানীয় বাসিন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কিশোর গ্যাংয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন কয়েকজন স্থানীয় তরুণ। ওই তরুণেরা রাজনীতিতে যুক্ত থাকায় মিছিল-সমাবেশে কিশোরদের ব্যবহার করে আসছেন। ফলে স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক নেতাও এসব কিশোরকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে প্রশ্রয় দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, আগে এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের নিয়ন্ত্রণ ছিল চর আবাবিল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম ও ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দারের হাতে। তাঁরা এসব কিশোরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ওই কিশোরেরা ভোল পাল্টে বিএনপির কর্মসূচিতে সক্রিয় হচ্ছে। আবদুর রহিম নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি এসব তরুণকে নতুন করে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন। রহিম ইউনিয়ন বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও তাঁর পদপদবি নেই।
জাহাঙ্গীর আলম খুনের ঘটনায় আবদুর রহিমকেও আসামি করা হয়। মামলার পর তিনি আত্মগোপনে রয়েছেন। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের আমি প্রশ্রয় দিচ্ছি—এমন অভিযোগ প্রায় করা হচ্ছে। তবে এসব অভিযোগ সত্য নয়। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে মামলায় জড়ানো হয়েছে।’
ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিদ্দিক সর্দার বলেন, ‘কিশোর গ্যাংকে আমি কখনো প্রশ্রয় দিইনি। তারা (কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা) আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করত।’ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজুল ইসলাম আত্মগোপনে থাকায় তাঁর বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে রায়পুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক জেড এম নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির দলীয় কোনো নেতা-কর্মী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের প্রশ্রয় দিলে তাঁদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো নেতা-কর্মীর অপকর্মের দায় দল নেবে না।
জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলার ঘটনায় গত ৭ এপ্রিল লক্ষ্মীপুরের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯ জনের নাম উল্লেখ ও ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলার আবেদন করেন তাঁর স্ত্রী রাজিয়া বেগম। আদালত রায়পুর থানাকে মামলাটি গ্রহণের নির্দেশ দেন। মামলার এজাহারে অভিযোগ করা হয়, মসজিদের আশপাশে জুয়ার আসর ও মাদক সেবন করত কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এসব বিষয়ের প্রতিবাদ করাকে কেন্দ্র করে সাব্বির হোসেন, জুবায়ের হোসেনসহ কয়েকজনের নেতৃত্বে ৮–১০ জন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য জাহাঙ্গীর আলমের ওপর হামলা করেছেন। নিহত জাহাঙ্গীর আলমের মেয়ে শারমিন আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, মামলার পর আতঙ্কে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের। স্থানীয় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা মামলা প্রত্যাহারের জন্য হুমকি দিয়ে আসছে।
জানতে চাইলে রায়পুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, কিশোর অপরাধীদের বিরুদ্ধে পুলিশের ধারাবাহিক অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
লক্ষ্মীপুর সরকারি ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন পাঠান বলেন, কিশোর-তরুণদের খেলাধুলা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের ফেরাতে না পারলে অপরাধ আরও বেড়ে যাবে। কেউ যাতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবাইকে তৎপর থাকতে হবে।