চোখ জুড়ানো মন ভোলানো সবুজ চা বাগান। আছে টিলার পরে টিলা। আকাশের নীল দিগন্তে মিশে আছে সবুজের রেখা। মাঝখানে লাল টিলায় ছোট্ট ঘর। দেখে মনে হয় চায়ের দেশে এক মিনি সাজেক। ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের অপেক্ষায় মৌলভীবাজারের এই মিনি সাজেক।
প্রকৃতির এমন দৃশ্য রয়েছে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার হিঙ্গাজিয়া চা বাগানের ভেতরের ১২নং সেকশনে। এখানে আরো রয়েছে টিলার ফাঁকে স্বচ্ছ জলের লেক।
মিনি সাজেক দেখার জন্য ভ্রমণ পিপাসুরা ছোটেন স্থানটিতে। দৃশ্য দেখে যাতায়াতের কষ্ট ভুলে যান তারা। নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চায়ের রাজ্যে মৌলভীবাজারে লুকিয়ে থাকা মনোহরি কত দৃশ্য ধরা পড়ে ভ্রমণ পিপাসুদের চোখে।
সরেজমিনে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার ব্রহ্মণবাজারের কানু পট্টি হয়ে হিঙ্গাজিয়া চা বাগানের ভেতরে প্রায় ৩ কিলোমিটার সবুজ টিলার বুক পেরিয়ে ১২নং সেকশনে গিয়ে কথা হয় অনেকের সাথে। তারা বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হওয়ায় পর্যটকরা মিনি সাজেক দেখার জন্য পড়ন্ত বিকেলে এখানে আসেন।
বেড়াতে আসা একই বাগানের বাসিন্দা স্বপন মিশ্র বলেন, “হিঙ্গাজিয়া বাগানের ভেতরের ১২নং সেকশনের এই সুন্দরতম দৃশ্য দেখে অনেকেই মিনি সাজেকের স্বাদ অনুভব করেন। তাই এলাকায় এটি মিনি সাজেক হিসেবে প্রকাশ পাচ্ছে।”
পড়ন্ত বিকেলে দেখা হয় পর্যটক শুভ যাদবের সাথে। তিনি বলেন, “এখানে এলে মনে সাজেকের ভাব আসে। আকাশের সাথে মেঘের ভেলা বা কুয়াশার মিতালী। প্রকৃতির এমন দৃশ্য দর্শনার্থীদের মন চুরি করে।”
এসময় কথা হয় ভ্রমণ পিপাসু কামরানের সাথে। তিনি বলেন, “মিনি সাজেক মনে করে এসে খুব ভালো লেগেছে। দেখার মত সুন্দর একটা স্পট। যারা ঈদের ছুটিতে মৌলভীবাজার চায়ের দেশে বেড়াতে আসবেন, তারা মিনি সাজেক দেখে যেতে পারেন।”
হিঙ্গাজিয়া চা বাগানের ব্যবস্থাপক মাসুম চৌধুরী বলেন, “চা বাগান হচ্ছে সংরক্ষিত এলাকা। এখানে জনসাধারণের যাতায়াতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। স্থানটিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য লেক খনন করা হয়েছিল। এরপর লোকজনের আসা যাওয়াতে এটি হয়ে গেছে মিনি সাজেক। পর্যটক এলে আমরা নিষেধ করতে পারি না।”
ঢাকা/আজিজ/এস
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
দাদন ফাঁসে ‘দাসের’ জীবনে শ্রমিক
২০ বছর ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের চাতালে কাজ করেন ছোবহান মিয়া। এখন আছেন উপজেলার আলমনগরের ছিদ্দিক অটো রাইস মিলে। ওই চাতালে যোগ দেওয়ার সময় মালিকের কাছে দাদন হিসেবে টাকা নেন। এখন এই পরিমাণ দুই লাখ টাকার ওপর। এই টাকার জন্য স্ত্রী খায়রুন বেগমকেও (৩৫) খাটতে হয় ছোবহানের সঙ্গে।
ছিদ্দিক অটো রাইস মিলে ২০ বছর খেটেও দাদনের টাকা শোধ হয়নি ছোবহানের (৪৭)। আগে এখানেই কাজ করতেন তাঁর বাবা হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার শিবপুর গ্রামের আফসর মিয়া। তিনি মারা গেছেন কয়েক বছর আগে। বছর দুয়েক আগে ছোবহানের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন মা জাহানারা বেগমও। মা, তিন সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ছিদ্দিক অটো রাইস মিলের পাশে গড়ে তোলা খুপরি ঘরেই থাকেন ছোবহান। মায়ের নামেও নেওয়া হয়েছে দাদন।
ছোবহানের মতো জীবনের গল্প আশুগঞ্জের দেড়শ চাতালে কর্মরত আট হাজারের বেশি শ্রমিকের। তাদের এক-তৃতীয়াংশই পুরুষ। যাদের নেই কোনো সরকারি-বেসরকারি মজুরি কাঠামো। প্রতি বাংলা বছরের শুরুতে তারা চাতাল মালিকের কাছে থেকে ‘দাদন’ নিয়ে কাজ করেন। তবে কাজ না করলে মজুরি মেলে না তাদের।
শ্রমিকরা জানান, প্রতি চাতালে গড়ে ৪০-৫০ জন নারী-পুরুষ শ্রমিক সপরিবারে কাজ করেন। পুরুষরা সপরিবারে কাজের কথা বলেই দাদন নেন। ধানের মাঠ বা বস্তা হিসেবে নির্ধারিত হয় তাদের মজুরি। সাধারণত একটি চাতালে ৬০০-৭০০ মণ ধান শুকানো যায়। মাঠ হিসেবে মজুরির জন্য শ্রমিকদের ভেজা ধান গাড়ি থেকে নামানো, সেদ্ধ করা, শুকানো, চাল তৈরির পর গাড়িতে উঠানো পর্যন্ত দায়িত্ব নিতে হয়। সাধারণত আবহাওয়া ভালো থাকলে এই কাজ সম্পন্ন হতে তিন-চার দিন লেগে যায়। বৃষ্টি থাকলে লেগে যায় ৮-১০ দিন পর্যন্ত। এ কাজ শেষ করা হলে পুরুষ শ্রমিকরা মজুরি হিসাবে ৩০০-৪০০ টাকা ও নারী শ্রমিকরা ৫০-৬০ টাকা পান। এ ছাড়া খোরাকি বাবদ সব শ্রমিককে প্রতি ১০০ মণ ধানে দেওয়া হয় ২৫ কেজি চাল।
বস্তা হিসেবে মজুরির জন্য সেদ্ধ চালের চাতালে প্রতি বস্তা ধান ও চালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রমিকরা পান ২৮ টাকা, আতপ চালের চাতালে মেলে ২২ টাকা। শ্রমিকরা জানান, কোনোভাবেই পুরুষ শ্রমিকের তিন-চার দিনের মজুরি ৩০০-৪০০ টাকার বেশি হয় না। দৈনিক গড় মজুরি সীমাবদ্ধ থাকে ১০০-১৫০ টাকায়।
দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সর্ববৃহৎ চাল উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আশুগঞ্জের পরিচিতি রয়েছে। এক সময় এখানে চাতালের সংখ্যা ছিল চার শতাধিক। এসব চাতালে কাজ করতেন ২৫-৩০ হাজার শ্রমিক। ২০১৪-১৫ সালের দিকে এ উপজেলায় অটো ড্রায়ার কারখানা বাড়তে শুরু করে। এসব কারখানার দাপটে চাতাল কমতে কমতে টিকে আছে দেড়শর মতো।
ছিদ্দিক অটো রাইস মিলের অপর শ্রমিক কামালের (৩৮) জন্ম আশুগঞ্জেই। তাঁর বাড়ি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম উপজেলার নূরপুরে। চাতাল মালিকের কাছে কামালের দাদন দুই লাখ টাকার বেশি। এখানেই খুপরিতে স্ত্রী জেসমিন ও পাঁচ নাবালক ছেলেকে নিয়ে থাকেন। জেসমিন তাঁর সঙ্গে চাতালে শ্রম দেন। দাদন কীভাবে শোধ করবেন– এমন প্রশ্নের উত্তর ভাগ্যের হাতে সঁপে দেন কামাল। চাতালকেই নিজের ঘরবাড়ির মতো ভাবেন। তাই ঋণ নিয়ে চিন্তাই করবেন না। কামাল বলেন, ‘যেখানেই যাই, কাজ করতেই হবে। আল্লাহর রহমত হলে ও চাতাল মালিকের দয়া হলেই সেই ঋণ কোনোদিন শোধ করা সম্ভব।’
মৌখিক চুক্তিতে নামমাত্র মজুরিতে এই শ্রমিকরা ‘স্বেচ্ছাবন্দি’ হিসেবে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করছেন বছরের পর বছর। কবে এ দশা থেকে মুক্তি মিলবে– তা অজানা তাদের। শ্রমিকরা জানান, যে টাকা আয় হয়, এদিয়ে কোনোমতে সংসার চলে। তাই সঞ্চয় করে দাদন পরিশোধের কোনো টাকাই হাতে থাকে না। চালের উৎপাদন বন্ধ থাকলে মজুরিও পান না। কারও অসুখ-বিসুখ হলে যে টাকার দরকার, তার জন্যও হাত পাততে হয় চাতাল মালিকের কাছে। তখন ‘ভাংতি’ নেওয়া টাকা পরে দাদনের অঙ্কে যোগ হয়। এতে দিনে দিনে তাদের মাথায় বোঝা আরও বাড়তে থাকে। সেই ঋণ শোধ করাও হয় না, মজুরি বাড়ানোর দাবিও তুলতে পারেন না।
ফারুক ‘সর্দারের’ গল্প
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার লক্ষ্মীগঞ্জ গ্রামের মো. মন্নাস মিয়ার ছেলে ফারুক মিয়া (৪৮)। বাবার কোনো জমিজিরাত ছিল না। খুব শৈশবেই এলাকায় শ্রম বিক্রি শুরু করেন। আনুমানিক ১৭ বছর আগে সামসুন্নাহারকে বিয়ে করেন। কিছুদিনের মধ্যেই সংসারের অভাব বেড়ে যায়। এক ভায়রা ভাইয়ের পরামর্শে আশুগঞ্জের এক চাতালে কাজ শুরু করেন। শুরুতে দাদন নেননি। পরে সংসারের প্রয়োজনে প্রথম দফায় ১০ হাজার টাকা নেন। দাদন বাড়তে বাড়তে এখন তাঁর মাথায় তিন লাখ টাকার বোঝা।
আলমনগরের ছিদ্দিক অটো রাইস মিলে ফারুক এখন কর্মরত সর্দার হিসেবে। বিয়ের কয়েক বছর পর স্ত্রীকেও নিয়ে আসেন। তিনিও একই চাতালের কর্মী। ছোট দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ১৬ ফুট দীর্ঘ ও ১০-১২ ফুট চওড়া খুপরিতে থাকেন ফারুক। বড় দুই ছেলে থাকে একই আকারের অন্য কক্ষে। একই চাতালের কর্মী আরও ১৫টি পরিবার একই চাতালের খুপরিতে থাকে। তাদের ব্যবহারের জন্য শৌচাগারের সংখ্যা মাত্র দুটি। খাবার পানির জন্য আছে দুটি নলকূপ। এই খুপরিতে সংযুক্ত বিদ্যুৎ বিল বহন করেন চাতাল মালিক।
১৫ বছরের মতো এই চাতালে কর্মরত ফারুকের ভাষ্য, দাদন বাড়ার জন্য নিজের সাংসারিক প্রয়োজনের পাশাপাশি দায় রয়েছে পালিয়ে যাওয়া কিছু শ্রমিকেরও। এসব শ্রমিকের দাদনের অঙ্কও তাঁর হিসাবে যোগ হয়েছে।
সর্দারের ওপর কেন পালিয়ে যাওয়া শ্রমিকের দাদন চেপে বসে, সে বিষয়ে কথা হয় ব্যবসায়ী মো. মহিউদ্দিন মোল্লার সঙ্গে। তিনি আগে চাতাল পরিচালনা করতেন। এখন যৌথভাবে পরিচালনা করছেন এগ্রো ফুড নামের ড্রায়ার মিল। মহিউদ্দিন মোল্লা বলেন, চাতালের মালিকরা নিজের প্রয়োজনেই শ্রমিক খোঁজেন। তখন সর্দারের মাধ্যমে কাজে আসেন পুরুষরা। তাদের পরিবারে ৩ থেকে ৪ বা ৪ থেকে ৫ জন সদস্য থাকেন। চুক্তি অনুযায়ী, দাদনের টাকা দেওয়া হয় সর্দারের মাধ্যমে। আগে কোনো লিখিত চুক্তিপত্র হতো না। এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র রেখে তা দেখভাল করেন সর্দার। কোনো শ্রমিক পালিয়ে গেলে, দায়ভারও তাঁর ওপর বর্তায়।
জানা গেছে, দাদনের অঙ্কটি সীমাবদ্ধ থাকে মালিক ও সর্দারের মধ্যেই। শ্রমিকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি না হলেও সর্দারের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে লিখিত চুক্তি হয়। কোনো শ্রমিক হাতবদল বা কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করলে যে চাতাল মালিক তাঁকে নেবেন, তিনি ওই শ্রমিকের টাকা দিয়ে দেন। অনেক ক্ষেত্রে আগের চেয়েও বেশি টাকা নেন শ্রমিকরা। এ ঝুঁকির জন্য সর্দাররা দাদনের টাকা থেকেও কমিশন নেন।
চাতাল মিল শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা আব্বাস সরদার, সভাপতি মো. হরমুজ আলী ও সাধারণ সম্পাদক মো. আল আমিনের কথায় শ্রমিকের অসহায়ত্বের কারণ উঠে আসে। তারা বলেন, অধিকাংশ শ্রমিকের পায়ের নিচে মাটি নেই। অথচ গড়ে প্রতি শ্রমিকের মাথার ওপর দেড়-দুই লাখ টাকা দাদন। মজুরি যে তারা পান, তা দিয়ে সংসারই চলে না। তাই দাদন পরিশোধ করতে পারেন না। এটি দুই পক্ষের জন্যই ক্ষতিকর।
আশুগঞ্জ উপজেলা চাতাল মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হেলাল সিকদারও বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি বলেন, দাদন মালিকের জন্যও বোঝা। প্রতি মালিককে দাদনের জন্য বাড়তি বিনিয়োগ করতে হয় ২৫-৩০ লাখ টাকা। এ জন্য ব্যাংকে যেমন সুদ গুনতে হয়, তেমনি শ্রমিক পালিয়ে গেলেও ক্ষতির মুখেও পড়তে হয়। দাদন না নিলে শ্রমিকের মজুরি কিছুটা হলেও বাড়ানো সম্ভব।
আশুগঞ্জ সরকারি শ্রমকল্যাণ কেন্দ্রের জনসংখ্যা পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. নাঈম আহমেদের ভাষ্য, চাতাল শ্রমিকরা চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণের জন্য এখানে আসেন। কিন্তু কখনও তারা ঋণ নিয়ে কথা বলেননি।