ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত হওয়া কেন জরুরি
Published: 1st, April 2025 GMT
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি না, এ নিয়ে কথা হয়। কথা হয় ছাত্ররাজনীতির ধরন কী হতে পারে, তা নিয়েও। অথচ প্রাসঙ্গিক হলেও এই আলাপে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়টি তোলা হয় না। ক্যাম্পাসগুলোয় দেখা যায়, ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী ছাত্রসংগঠন একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রাখে। তারা নিজেদের স্বার্থেই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী হয় না। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে গতানুগতিক ধারার রাজনীতির পরিবর্তন চায়। এ ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত করার বিকল্প নেই। এটি করা গেলে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতিরও মীমাংসা হতে পারত।
১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশে চলা দেশের চারটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন বন্ধ রয়েছে। ১৯৯০ সালের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়েছে মাত্র একবার, ২০১৯ সালে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও তিন দশকের বেশি সময় ধরে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন হয় না। অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রতিনিধি কিংবা কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির নির্বাচন প্রায় নিয়মিতভাবেই হচ্ছে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, সেসব নির্বাচনের একেকজন প্রার্থী থাকেন দলীয় রাজনীতির ধ্বজাধারী হয়ে। ফলে তাঁরা ব্যক্তিস্বার্থেই ছাত্ররাজনীতির কদর্য ও অসুস্থ ধারার বিপরীতে মুখে কুলুপ এঁটে রাখেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, শিক্ষা ও শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম ছাত্র সংসদের মাধ্যমে সফল ও গতিশীল করা সম্ভব। এককভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে যে কাজগুলো করা কঠিন, ছাত্র সংসদের সহায়তায় সেসব কাজ সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা। এর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে এবং আবাসিক হল থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিধান রয়েছে। নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধিদের মধ্যে পাঁচজন সিনেট সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী ব্যাপারে সরাসরি অংশ নিতে পারেন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ার কারণে বেশির ভাগ সময়ে সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি ছিল না। থাকলে তাঁদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা তুলে ধরার সুযোগ তৈরি হতো। প্রশাসনও শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও আন্তরিক হতে পারতেন।
২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বশেষ যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয়, সেটি নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। বর্তমানে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ নির্বাচনের ফলাফল নিজেদের পক্ষে নেওয়ার জন্য নানা রকম কৌশল ও কারচুপির আশ্রয় নেয়। কোনো কোনো আবাসিক হলে আগের রাতেই ব্যালট পেপারে সিল মেরে বাক্স ভরে রাখার প্রমাণ পাওয়া যায়। তা ছাড়া ভোটারের সারিগুলোয় দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা কৃত্রিম ভিড় তৈরি করেন, যাতে হলের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে না পারেন। এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসনকে একরকম নির্লিপ্ত থাকতে দেখা যায়।
ক্ষমতাসীন দল এবং তাদের অনুসারী ছাত্রসংগঠন ক্যাম্পাসে নিজেদের আধিপত্য ধরে রাখার জন্য ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যাপারে আগ্রহী হয় না। তারা বেশ জানে, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তাদের নির্বাচিত হওয়া অসম্ভবপ্রায়। ছাত্র সংসদ না থাকার কারণে ক্যাম্পাসগুলোয় নির্দিষ্ট ছাত্রসংগঠনের সন্ত্রাস ও দখলদারত্ব যেমন বেড়েছে, তেমনি শিক্ষার পরিবেশও মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে চলা নেতিবাচক রাজনীতির ধারা ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারেও বিরূপ মনোভাব তৈরি করেছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বড় অংশ ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা রাজনীতি-সচেতন নন, তাই এমন কথাও শোনা যায়।
ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন নিয়মিত হলে শিক্ষার্থীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চর্চায় গুণগত পরিবর্তন আসত। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের দাবি ও অধিকারের কথা তুলতে পারতেন। ছাত্র সংসদ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে সম্মিলিতভাবে অংশ নিতে দেখা যায় না। বিচ্ছিন্নভাবে সাংস্কৃতিক দল ও ছাত্রসংগঠনগুলো নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এসব অনুষ্ঠান দল ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক হওয়ায় সেখানে সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ থাকে না। তা ছাড়া ছাত্র সংসদ না থাকায় শিক্ষার্থীরা তাঁদের দাবিদাওয়া পেশ করার যথাযথ প্রক্রিয়াও ভুলতে বসেছেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, শিক্ষা ও শিক্ষাসহায়ক কার্যক্রম ছাত্র সংসদের মাধ্যমে সফল ও গতিশীল করা সম্ভব। এককভাবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষে যে কাজগুলো করা কঠিন, ছাত্র সংসদের সহায়তায় সেসব কাজ সহজেই বাস্তবায়ন করা যায়। যেমন পরিচ্ছন্ন ও সবুজ ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে হলে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে ছাত্র সংসদ মূল ভূমিকা রাখতে পারে। আবার অভ্যন্তরীণ ক্রীড়া উৎসব এবং কেন্দ্রীয়ভাবে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ছাত্র সংসদের অংশগ্রহণে তা সর্বজনীন মাত্রা পেতে পারে।
ছাত্র সংসদের বিভিন্ন উদ্যোগ ও কার্যক্রম প্রকারান্তরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ ও চিন্তায়ও পরিবর্তন আনতে পারে। যেমন শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে বিভিন্ন প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি হাতে নেওয়া যায়। ছাত্র সংসদের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বাইরের প্রতিষ্ঠানের সংযোগ বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করা যায়। অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন কাজের সহায়তা করতে পারে ছাত্র সংসদ। ছাত্র সংসদের বিভিন্ন কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখতে পারে। আবার আবাসিক হলগুলোর ডাইনিং ও ক্যানটিন পরিচালনায় অংশ নিয়ে হল প্রতিনিধিরা শিক্ষার্থীদের সুবিধা নিশ্চিত করতে পারেন।
কোনো কোনো মহল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ক্যালেন্ডারে ছাত্র সংসদ নির্বাচনকে যুক্ত করার দাবি উত্থাপিত হয়ে আসছে। এই নির্বাচন শেষ পর্যন্ত যেন গত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনের মতো প্রহসনে পরিণত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের কাজটি পুরোপুরি অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়মিত ও পরীক্ষায় একাধিকবার অকৃতকার্য শিক্ষার্থী কোনোভাবেই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন। প্রয়োজনে নির্বাচনের বিধিমালা ও গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। নির্বাচনী আচরণ ও ভোটদানের পদ্ধতির ব্যাপারেও নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। কারণ, বিদ্যমান ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী ছাত্রসংগঠন নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সুযোগ পেয়ে যায়।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন কেন অনিয়মিত হয়ে গেল এবং এই নির্বাচন নিয়মিত ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য কী করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে অভিমত ও সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পরামর্শক কমিটি গঠন করা দরকার। এই কমিটির সদস্য হবেন অধ্যাপক থেকে প্রভাষক পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের অরাজনৈতিক শিক্ষকেরা। তাঁরা বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে বসবেন এবং ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের বিদ্যমান ধারা ও পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করবেন। দেশে নতুন রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠার আগেই ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত করার ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
● তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জন ত র ত কর র র জন য স গঠন
এছাড়াও পড়ুন:
রাখাইনে করিডোর কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার আলো দেখাবে
রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে নতুন আলোচনা ও বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এর সূত্রপাত হয় সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে হিউম্যানিটারিয়ান বা মানবিক করিডর গড়ে তুলতে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মন্তব্যের মাধ্যমে, যেখানে তিনি বলেন, বাংলাদেশ এ বিষয়ে একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
গত দুই মাসে রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে ক্রমাগত নানা আলোচনা ও সমালোচনা চলমান। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম ইতিবাচক আলোচনা শুরু হয় মার্চ মাসে, যখন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা শরণার্থীশিবিরে পবিত্র রোজার মাসে তাদের সঙ্গে ইফতার করেন।
এ সময় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাদের মেহমান উল্লেখ করে বলেন, তিনি প্রত্যাশা করেন আগামী রোজা রোহিঙ্গারা নিজ দেশে করতে পারবেন।
পরবর্তী সময়ে ষষ্ঠ বিমসটেক সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে একটি পার্শ্ব আলোচনার পর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা প্রাথমিকভাবে ১ লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিতে নীতিগতভাবে সম্মত।
এ নিয়েও জনসাধারণের মধ্যে একধরনের ধোঁয়াশা কাজ করে। কেননা, আরাকান আর্মিকে উপেক্ষা করে এ ধরনের মন্তব্য রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে খুব বেশি আশার আলো দেখাবে না। এর বেশ কিছুদিন পরে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক সময়ে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সঙ্গে যে সহিংস দ্বন্দ্ব চলমান, সে প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন এখনই সম্ভব নয়।
এই চলমান আলোচনায় নতুন বিতর্ক তৈরি হয় রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার আলোচনার মাধ্যমে, যদিও এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কারও সঙ্গে তাঁদের এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমন নানামুখী আলোচনায় জনমনে বিভ্রান্তি আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাখাইনে মানবিক করিডর গড়ে তোলার প্রধান যুক্তি হলো, এতে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে মিয়ানমারে অবস্থানরত জনগোষ্ঠীর সাহায্যার্থে ত্রাণ এবং অন্যান্য প্রয়োজনের সামগ্রী পাঠানো সম্ভব হবে।
মানবিক করিডর ও রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে আলোচনার আগে একটু দেখে নেওয়া যাক মানবিক করিডর বলতে আসলে কী বোঝায়।
জাতিসংঘের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সশস্ত্র সংঘাতপূর্ণ এলাকায় সংঘাত বা যুদ্ধ পরিস্থিতির সাময়িক বিরতির জন্য অনেক ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়, তার মধ্যে একটি হলো মানবিক করিডরের প্রস্তাব।
এই মানবিক করিডরের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এমন একটি জায়গা নির্ধারণ করা হয়, যেখানে সশস্ত্র সংঘাত যেন না ঘটে। সে বিষয়ে দুই পক্ষ জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একমত হয়। মানবিক করিডরের পরবর্তী ধাপে সেই ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীদের একটি নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয় অথবা সেখানে খাদ্য, ওষুধ ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সেবার ব্যবস্থা হয়।
এ ধরনের মানবিক করিডরের উদাহরণ আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে সংঘাতপূর্ণ বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। এখানে সামগ্রিক কর্মকাণ্ড জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে হবে, সেটাই প্রত্যাশা করা হয়। বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, জাতিসংঘের ত্রাণবিষয়ক প্রতিষ্ঠান রেডক্রস এখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলির মধ্যে অন্যতম হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইহুদি শিশুদের যুক্তরাজ্যে স্থানান্তর, নব্বইয়ের দশকে সারায়েভো সংকট, ২০১৮ সালে সিরিয়ার জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা এবং সর্বশেষ দেখতে পাই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে।
যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।রাখাইনকে ঘিরে মানবিক করিডর গড়ে তোলার এই নীতিগত সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপটে গবেষক, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক ও সাধারণ জনগণের মধ্যে বেশ কিছু প্রশ্ন, আশঙ্কা ও দ্বিধা তৈরি হয়েছে।
তবে শঙ্কার পাশাপাশি কোনো কোনো গবেষক মনে করছেন, মানবিক করিডরের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলার চলমান সংলাপ আরও জোরদার হবে, যা ভবিষ্যতে এই সংকট মোকাবিলায়, বিশেষ করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
তবে এই ইতিবাচক প্রত্যাশা ছাপিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনকে কেন্দ্র করে যে দ্বিধা রয়েছে, সেটি হলো এই মানবিক করিডরের মাধ্যমে ভবিষ্যতে কি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হবে, নাকি আরও বিলম্বিত হবে, নাকি আরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পাবে।
ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, এক লাখের ওপরে রোহিঙ্গা শরণার্থী আবারও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ এই দায় যেমন এড়িয়ে যেতে পারছে না, তেমনি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনার ভারও বহন করতেও হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনসহ তাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে মানবিক করিডর কতটা বাস্তবসম্মত হবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কেননা, কোনো বিস্তারিত দিকনির্দেশনা আমাদের সামনে নেই।
অতীতের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষাপট থেকে আমরা দেখতে পাই, মানবিক করিডরের অন্যতম প্রধান ব্যবহার হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ জাতিগোষ্ঠীকে সংঘাতপূর্ণ স্থান থেকে নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করা। যেখানে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে চলমান অনুপ্রবেশ কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেখানে মানবিক করিডরের মাধ্যমে আরও বৃহৎ অংশের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তার স্বার্থে স্থানান্তর করার প্রক্রিয়ায় শুরু অস্বাভাবিক নয়।
এ প্রেক্ষাপটে যদি আরও রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে হয়, তাহলে তাদের দায়দায়িত্ব নিতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত, সেটা ভেবে দেখা জরুরি। কেননা, এখনই এক মিলিয়নের ওপর রোহিঙ্গা বিভিন্ন শরণার্থীশিবিরে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর সঙ্গে রয়েছে তাদের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য আন্তর্জাতিক মহলের অর্থনৈতিক সাহায্য কমিয়ে দেওয়া, যা বাংলাদেশের জন্য এক বড় অর্থনৈতিক বোঝা।
এর বাইরে আরেকটি চিন্তার জায়গা হলো সীমান্ত এলাকা বাংলাদেশ কতটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, সেটি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি দেখলে বোঝা যায়, সীমান্ত প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা খুব যে সুখকর, সেটি বলা যাবে না।
এ ছাড়া এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে মাদক ব্যবসা, মানব পাচার, সহিংসতা ও অন্যান্য নিরাপত্তাঝুঁকির জন্য একটি অন্যতম হটস্পট, যা নিয়ন্ত্রণ করতে আমাদের নানাভাবে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত এলাকার নিয়ন্ত্রণ আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয় কি না, সেটা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। মানবিক করিডরের মাধ্যমে বাংলাদেশ কীভাবে লাভবান হতে পারে, সে বিষয়েও যথাযথ পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে এবং নিজেদের স্বার্থেই আমাদের স্বচ্ছ থাকতে হবে।
এর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোসহ অন্য অংশীজনের সঙ্গে পরামর্শ করারও বিশেষ প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। কেননা, এর পরবর্তী পরিণতি ও ব্যবস্থাপনার দায়দায়িত্ব ভবিষ্যতের নির্বাচিত সরকারকেই গ্রহণ ও বহন করতে হবে। যদিও জাতিসংঘের মানবিক করিডরের প্রস্তাব বেশ পুরোনো, কিন্তু তড়িঘড়ি করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হিতে বিপরীত হতে পারে। শরণার্থী বিষয়ে একটি টেকসই রূপরেখা এবং পরিকল্পনানীতি না থাকার কারণে সরকারকে অ্যাডহক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই সমস্যাজনক হয়।
এসব বিবেচনায় নিয়ে একজন গবেষক হিসেবে আমি বিভিন্ন সময় রোহিঙ্গাবিষয়ক একটি জাতীয় রোডম্যাপ বা রূপরেখা এবং শরণার্থীবিষয়ক নীতি প্রণয়ন করার পক্ষে কথা বলে আসছি। আমাদের সে ধরনের কোনো দৃশ্যমান পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি বিগত সময়ে ছিল না। বিশেষ করে যদি প্রত্যাবাসন ব্যর্থ হয় এবং জাতিসংঘের প্রস্তাবিত মানবিক করিডর আমাদের প্রত্যাশামতো কাজ না করে, তাহলে বিকল্প কী হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি আমাদের থাকা উচিত। সেটি না হলে রোহিঙ্গা সংকট আরও জটিল আকার ধারণ করবে এবং তাদের নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন একটি ‘মিথ’ হিসেবে থেকে যাবে, যা আমাদের ও রোহিঙ্গা উভয়ের জন্যই হতাশার একটি বিষয় হবে।
● বুলবুল সিদ্দিকী সহযোগী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়