Samakal:
2025-12-13@10:05:46 GMT

গোদের উপর বিষফোড়া

Published: 10th, April 2025 GMT

গোদের উপর বিষফোড়া

এক যুগেরও অধিক সময় পূর্বে হালদা নদীর ফটিকছড়িতে ‘রাবার ড্যাম’ স্থাপনের ক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির কথা হইলেও উহাই এখন কৃষকের গলার কাঁটায় পরিণত হইয়াছে। কেবল তাহাই নহে, বুধবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, উক্ত স্থাপনার কারণে খোদ নদীটিই শুষ্ক হইয়া মৃতবৎ।

শুষ্ক মৌসুমে পানি না থাকায় মিঠাপানির মৎস্যের এই গুরুত্বপূর্ণ প্রজননক্ষেত্র ক্ষতিগ্রস্ত হইতেছে। তদুপরি পানি সংকটে দীর্ঘ এলাকাব্যাপী সেচও ব্যাহত হইতেছে। অর্থাৎ রাবার ড্যামের নেতিবাচক প্রভাব উহার উজান ও ভাটি উভয় এলাকায় ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান। 

আমরা জানি, পার্বত্য চট্টগ্রামের বদনাতলী পর্বত হইতে উৎপন্ন হইয়া হালদা নদী ফটিকছড়ির মধ্য দিয়া চট্টগ্রামে প্রবেশ করিয়াছে। এশিয়ার অন্যতম মিঠাপানির এই মৎস্য প্রজননক্ষেত্রের ফটিকছড়ি অংশ পানিশূন্য হইবার কারণে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়িয়াছে। উহার দুই তীরের বাসিন্দাদের চাষাবাদ ও পানি সংকটও চরমে উঠিয়াছে। ফটিকছড়িতে হালদা নদীর পানিশূন্যতার জন্য রাবার ড্যামকে দায়ী করিয়াছেন বিশেষজ্ঞরা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক অধ্যাপক ড.

মঞ্জুরুল কিবরিয়ার ভাষ্য অনুযায়ী, রাবার ড্যামের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরও নামিয়া যাইতেছে। বাঁধটি অপসারণের সুপারিশ করা হইলেও কিছু শিল্প গ্রুপের কারণে তাহা বাস্তবায়ন সম্ভব হয় নাই। আমরা বিস্মিত, ৩১ মার্চ বাঁধটি খুলিয়া দেওয়ার সিদ্ধান্ত হইলেও উহা মান্য করা হয় নাই। 

হালদা নদীর এই সংকটের কারণে মাতৃমৎস্য ডিম্ব না ছাড়িবার আশঙ্কা রহিয়াছে। আমরা দেখিয়াছি, গত বৎসর একই কারণে রুই জাতীয় মৎস্যের প্রত্যাশিত ডিম্ব মিলে নাই। হালদার প্রজননকাল এপ্রিল, মে ও জুন মাসে নদীর এহেন দুরবস্থা অশনিসংকেত। যথায় দেশের জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ হালদার সুরক্ষা জরুরি অগ্রাধিকার পাওয়া ন্যায্য ছিল, তথায় নদীটি লইয়া প্রশাসনের উদাসীনতা হতাশাব্যঞ্জক। দেশের অর্থনীতিতেও হালদা নদীর অবদান অনস্বীকার্য। এই নদী হইতে প্রতি বৎসর যেই পরিমাণ নিষিক্ত ডিম্ব সংগ্রহ করা হয়, উহা জাতীয় অর্থনীতিতে কয়েকশ কোটি টাকার অবদান রাখে।

পানি ও কৃষি সম্পদের মূল্য বিবেচনায় লইলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে হালদার অবদান কয়েক সহস্র কোটি টাকা অতিক্রম করিবে। বস্তুত জীববৈচিত্র্য সুরক্ষায় হালদা নদীর যেই গুরুত্বপূর্ণ অবদান, উহা নিছক অর্থের অঙ্কে পরিমাপ করা যাইবে না। হালদা নদীতে এখনও বিদ্যমান গাঙ্গেয় শুশুকের বিরল প্রজাতিও নদীটিতে বিবিধি সংকটের কারণে বিপন্নপ্রায়।

রাবার ড্যামের কারণে হালদা নদী যদ্রূপ সংকটে পতিত, তদ্রূপ আরও বিবিধ কারণে হালদার জীববৈচিত্র্য অস্তিত্বের ঝুঁকিতে পড়িয়াছে। মাত্রাতিরিক্ত যন্ত্রচালিত নৌযান, নিষিদ্ধ জাল ও খননযন্ত্র লইয়া উদ্বেগ থাকিলেও সেইগুলি বন্ধ হয় নাই। নদীটিতে দূষণের উৎসও নেহাত কম নহে। আমরা মনে করি, গুরুত্ব বিবেচনায় নদীটির সুরক্ষা অগ্রাধিকার হিসাবে লইতে হইবে। হালদাকে বিপর্যয় হইতে রক্ষা করিতে হইলে প্রশাসন, স্থানীয় নাগরিক, বেসরকারি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে হালদা কর্তৃপক্ষ গঠন এবং এই কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে নদী রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জরুরি।

তবে সর্বাগ্রে হালদার উপর রাবার ড্যামের যেই বিষফোড়া রহিয়াছে, উহার অপসারণ অগ্রাধিকাররূপে গ্রহণ করিতে হইবে। আমরা প্রত্যাশা করি, প্রশাসনকে এই ক্ষেত্রে কঠোর হইবার বিকল্প নাই। যেই রাবার ড্যাম হালদার ন্যায় নদী ধ্বংসের উৎস, যেই বাঁধ কৃষকের ক্ষতির কারণ, উহাকে আর কোনো যুক্তিতে বহাল রাখিবার অবকাশ নাই। সুতরাং হালদার জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও কৃষকের স্বার্থ বিবেচনায় লইয়া ফটিকছড়ির রাবার ড্যাম এখনই অপসারণ করিবার ব্যবস্থা লওয়া হউক।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: অবদ ন মৎস য

এছাড়াও পড়ুন:

স্বাদুপানির মাছ কমে যাচ্ছে: প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে

‘নদীমাতৃক বাংলাদেশ’ শব্দবন্ধটি একসময় শুধু পাঠ্যবইয়ের বুলি ছিল না, ছিল আমাদের যাপিত জীবনের প্রতিচ্ছবি। বর্ষায় থই থই করা বিলে মাছের দাপাদাপি, জলের রুপালি ফসলে জেলের মুখে হাসি, আর পাতে ভাপে সেদ্ধ বা ঝোল করা দেশি মাছের স্বাদ—বাঙালির সংস্কৃতির এই অবিচ্ছেদ্য অংশটি আজ হুমকির মুখে।

আমাদের স্বাদুপানির মাছ বা দেশি মাছের ভান্ডার আজ আশঙ্কাজনক হারে ফুরিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু প্রশ্ন হলো, এটি কি কেবলই আমাদের রসনার তৃপ্তি বা আমিষের অভাব? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে এক ভয়াবহ পরিবেশগত বিপর্যয়?

হারিয়ে যাওয়া শৈশব ও বর্তমান বাস্তবতা

বেশি দিন আগের কথা নয়, গ্রামবাংলার খাল-বিল, হাওর-বাঁওড় ছিল দেশি মাছের প্রজননক্ষেত্র। পাবদা, ট্যাংরা, পুঁটি, খলিসা, মলা, ঢেলা, শোল, গজার নামগুলো বলে শেষ করা যাবে না।

আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রায় ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ ছিল; কিন্তু বর্তমানে এর একটি বিশাল অংশ বিপন্ন, অতি বিপন্ন অথবা বিলুপ্তির পথে।

আমরা এখন বাজারে যে মাছ দেখি, তার বড় অংশই চাষের—পাঙাশ, তেলাপিয়া কিংবা হাইব্রিড কই। এই মাছগুলো আমাদের আমিষের চাহিদা মেটাচ্ছে সত্য; কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো মাছের যে অভাব তৈরি হয়েছে, তা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়।

কেন এই বিষণ্নতা

মাছ কমে যাওয়ার পেছনে একক কোনো কারণ নেই; বরং এটি মানুষের অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ডের সমষ্টিগত ফল। উন্নয়নের নামে নদী, খাল ও বিল ভরাট করে তৈরি হচ্ছে আবাসন বা শিল্পকারখানা। মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র বা ‘নার্সারি গ্রাউন্ড’ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আবার কলকারখানার অপরিশোধিত বর্জ্য ও কৃষিজমিতে ব্যবহৃত মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে জলাশয়ে মিশছে। এতে পানি বিষাক্ত হয়ে মাছের বেঁচে থাকা অসম্ভব করে তুলছে।

কারেন্ট জালের ব্যবহার এবং প্রজনন মৌসুমে মা মাছ ও পোনা মাছ নিধন মাছের বংশবিস্তারে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের অস্থিতিশীল আবহাওয়া মাছের প্রজননে প্রভাব ফেলছে। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, খরা ও তাপমাত্রার পরিবর্তন মাছের প্রজনন চক্রকে ব্যাহত করছে।

প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে

এখন মূল প্রশ্ন এখানেই—মাছ কমে গেলে পরিবেশের কী এমন ক্ষতি হবে? উত্তর হলো চরম বিপর্যয় ঘটবে।

খাদ্যশৃঙ্খলে ধস: স্বাদুপানির মাছ কেবল মানুষের খাদ্য নয়, এটি জলজ বাস্তুতন্ত্রের খাদ্যশৃঙ্খলের একটি অপরিহার্য অংশ। মাছ কমে গেলে মাছরাঙা, বক, চিল, পানকৌড়ি এবং ভোঁদড়ের মতো প্রাণী খাদ্যসংকটে পড়ে। ইতিমধ্যে গ্রামবাংলা থেকে অনেক মাছশিকারি পাখি বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

পানির গুণ রক্ষা: অনেক প্রজাতির মাছ (যেমন আবর্জনাভুক মাছ) পানি পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। এরা পচনশীল দ্রব্য খেয়ে জলাশয়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে। মাছ না থাকলে জলাশয়গুলো দ্রুত দূষিত হবে এবং মশা-মাছির উপদ্রব বাড়বে।

বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য: জলজ উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ এবং প্লাঙ্কটনের ভারসাম্য রক্ষায় মাছের ভূমিকা অপরিসীম। মাছের অভাব পুরো জলজ পরিবেশকে মৃতপ্রায় বা ডেড জোনে পরিণত করতে পারে।

সুতরাং মাছ কমে যাওয়া মানে কেবল খাবারের প্লেটে সংকট নয়; বরং পুরো প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ার সতর্কবার্তা।

অর্থনৈতিক ও পুষ্টির সংকট

গ্রামের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টির, বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন এ–এর প্রধান উৎস ছিল ছোট মাছ। এই মাছগুলো হারিয়ে যাওয়ায় গ্রামীণ জনস্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ ছাড়া যারা বংশপরম্পরায় জেলে পেশায় জড়িত, নদীতে মাছ না পেয়ে তাঁরা আজ বেকার। বাধ্য হয়ে তাঁরা পেশা পরিবর্তন করছেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিতে চাপ সৃষ্টি করছে।

হতাশার মধ্যে ও আশার আলো হলো প্রকৃতিকে সুযোগ দিলে সে নিজেকে সারিয়ে তুলতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন আশু পদক্ষেপ—

মৎস্য অভয়াশ্রম বৃদ্ধি: হাওর ও নদীগুলোর নির্দিষ্ট কিছু অংশকে সারা বছরের জন্য বা প্রজনন মৌসুমে মৎস্য অভয়াশ্রম ঘোষণা করে কঠোরভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে।

দূষণ রোধ: শিল্পবর্জ্য নদীতে ফেলার আগে শোধন (ইটিপি ব্যবহার) বাধ্যতামূলক করতে হবে। কৃষিতে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে।

জনসচেতনতা ও আইন প্রয়োগ: কারেন্ট জাল বা বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং জেলেদের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

জলাশয় পুনরুদ্ধার: ভরাট হয়ে যাওয়া খাল-বিল খনন করে পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে।

স্বাদু পানির মাছ রক্ষা করা কেবল মৎস্য অধিদপ্তরের কাজ নয়, এটি আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। নদী বাঁচলে মাছ বাঁচবে; আর মাছ বাঁচলে টিঁকে থাকবে আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্র। আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো জাদুঘরে গিয়ে জানবে—একদা এ দেশে ‘মাছে-ভাতে বাঙালি’ নামে একটি জাতি ছিল।

প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র টিঁকে থাকবে কি না, তার উত্তর নির্ভর করছে আজ আমরা প্রকৃতির প্রতি কতটা সদয় আচরণ করছি, তার ওপর। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনই।

হেনা শিকদার দর্শন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • স্বাদুপানির মাছ কমে যাচ্ছে: প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র কি টিকে থাকবে