নদীতে ফুল ভাসিয়ে পাহাড়ে বর্ষবরণ উৎসব শুরু
Published: 12th, April 2025 GMT
দেশের সমৃদ্ধি, পার্বত্য চট্টগ্রামের সুখ শান্তি ও মঙ্গল কামনা করে নদীতে ফুল নিবেদনের মধ্য দিয়ে আজ শনিবার থেকে তিনদিনব্যাপী পাহাড়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু-বিষু-বিহু সাংক্রাইন, সাংক্রান, পাতা’র আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ভোরে শিশু ও নারী-পুরুষ ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে গঙ্গা মা’র উদ্দেশে উৎসবমুখর পরিবেশে পানিতে কলাপাতায় ফুল নিবেদন করেন।
শনিবার প্রথম দিন ফুল বিজুর দিনে বিজু-সাংগ্রাই-বৈসু-বিষু-বিহু সাংক্রাইন, সাংক্রান, পাতা- উদযাপন কমিটির উদ্যোগে রাঙামাটিতে কেন্দ্রীয়ভাবে সকাল ৭টায় রাজ বন বিহার পূর্বঘাটে পানিতে ফুল নিবেদন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সহ-সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার। এ সময় উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক প্রকৃতি রঞ্জন চাকমাসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে একটি নৃত্য পরিবেশন করা হয়। পরে শোভাযাত্রাসহ ঘাটে গিয়ে পানিতে ফুল নিবেদন করা হয়। এ সময় শিশুসহ নারী-পুরুষ অংশ নেন।
এছাড়া পৃথকভাবে রাঙামাটি শহরে কোরানী পাহাড়, আসামবস্তি, গর্জনতলীসহ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে পানিতে ফুল নিবেদন করেছেন পাহাড়ি সম্প্রদায়ের লোকজন। শহরের কোরানী পাহাড় এলাকায় ভোর থেকে শতশত নারী-পুরুষ ঐতিহ্যবাহী নিজস্ব পোশাকে কলাপাতায় করে কাপ্তাই হ্রদের পানিতে ফুল নিবেদন করেছেন। তারা জানিয়েছেন, উৎসবের প্রথম দিনে ফুল বিজুতে পুরাতন বছরের সমস্ত দুঃখ,কষ্ট, গ্লানি বেদনা, ভয়, অন্তরায় উপদ্রবকে মুছে ফেলে দিয়ে নতুন বছর যাতে সুখ-শান্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি যেন অনাবিল শান্তি বয়ে আনে সেই উদ্দেশ্য নিয়ে কলাপাতার মাধ্যম নদীতে গঙ্গা মা’র উদ্দেশ্যে ফুল নিবেদন করেছেন। ফুল বিজুর দিনে ফুল দিয়ে বাড়ির ঘর সাজায়, ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে। তরুণ-তরুণীরা পাড়ায় পাহাড় বৃদ্ধদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্নান করায়। সন্ধ্যায় বৌদ্ধ মন্দির, নদীর ঘাটে, বাড়িতে প্রদীপ প্রজ্জ্বালন করে থাকে।
আগামীকাল রোববার উৎসবের দ্বিতীয় দিন মূল বিজু। এ দিনে বাড়িতে বাড়িতে শুধু চলে খাওয়া-দাওয়ার পর্ব ও আনন্দ-ফুর্তি। ৩০ থেকে ৪০ প্রকারের তরকারি দিয়ে রান্না করা হয় ঐতিহ্যবাহী পাজন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে উষাতন তালুকদার বলেন, আগামী দিনে একে অপরকে ভ্রাতৃত্ব বন্ধনে আবদ্ধ করে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতির স্থায়ী একটি সমাধান এবং উপনিবেশিক শোষন বন্ধ করে আগামী দিনের নতুন সুন্দর ভষিব্যৎ কামনা করেন তিনি।
পুরাতন বছরের দুঃখ কষ্ট ও গ্লানি মুছে ফেলে নতুন বছরে নব উদ্যোগের শুভকামনা জানাতে বাংলা বর্ষের শেষ দুইদিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এ উৎসব পালন করে থাকে পাহাড়ে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের ১৩ ভাষাভাষী ১৪টি ক্ষুদ্র পাহাড়ি জাতিসত্ত্বার বসবাস। এসব জাতি গোষ্ঠীদের রয়েছে ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক উৎসব হিসেবে বিজু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু, সাংক্রাই, পাতা। তবে এ উৎসবকে চাকমা সম্প্রদায় বিজু, মারমারা সাংগ্রাই, ত্রিপুরা বৈসু, তংচংগ্যারা বিষু, অহমিয়ারা বিহু, খুমিরা সাংক্রাই, সাঁওতালরা পাতা হিসেবে অভিহিত করে থাকলেও এর নিবেদন কিন্তু একই। তাই এ উৎসবটি আদিবাসী পাহাড়িদের শুধু আনন্দের নয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সকল সম্প্রদায়ের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ঐক্য ও মৈত্রী বন্ধনের প্রতীকও বটে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ন বছর
এছাড়াও পড়ুন:
তুলশীগঙ্গার তীরে সন্ন্যাসতলীর শতবর্ষী ঘুড়ির মেলা
জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার মামুদপুর ইউনিয়নের মহব্বতপুর গ্রাম ঘেঁষে তুলশীগঙ্গা নদীর অদূরে সন্ন্যাসতলীর বটতলা। জায়গাটিতে প্রায় একশ বছর আগে থেকে বাংলা জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষ শুক্রবার আয়োজন হয় ঘুড়ির মেলা। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি। অন্তত ৫০ গ্রামের হাজারো মানুষের উপস্থিতিতে শুক্রবার সন্ন্যাসতলী ঘুড়ি উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মেলার দিনক্ষণ মনে রেখে সময়মতো দোকানিদের পাশাপাশি দর্শনার্থীরা ভিড় জমান নিভৃত পল্লীতে। আগে মেলার দিন বৃষ্টি হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটনা ঘটেছে। প্রচণ্ড গরম ও তাপপ্রবাহের মধ্যেই চলে এ আয়োজন। বৈরী পরিবেশের কারণে উৎসবের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, সন্ন্যাসতলীর এ ঘুড়ি উৎসব শুরুর দিন বিকেলে বটতলায় স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় সন্ন্যাস পূজা পালন করেন। তাদের এ পূজা-অর্চনা ঘিরেই মূলত এ মেলার উৎপত্তি। তবে শুরুর কথা কেউ বলতে পারেননি। প্রবীণরা শুধু জানেন, একশ বছরের বেশি সময় ধরে তারা এ মেলার আয়োজন দেখে আসছেন।
মেলার নিজস্ব জায়গা না থাকলেও এর ব্যাপ্তি প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে। প্রচণ্ড গরমের মধ্যেই এক দিনের এ মেলা ঘিরেই জেলার জামালগঞ্জ চারমাথা থেকে ঐতিহাসিক আছরাঙ্গাদীঘি পর্যন্ত রকমারি পণ্যের দোকান বসে। এখান থেকে সংসারের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন আসবাব থেকে শুরু করে ছোট মাছ ধরার বাঁশের তৈরি পণ্য খলসানি, টোপা, ডালা, চালুন কিনে নেন অনেকে।
সুতার তৈরি তৌরা জাল, গৃহস্থালি কাজে ব্যবহৃত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের খেলনা, মিষ্টান্ন, প্রসাধনী, মাটির তৈজসপত্রসহ বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রি হয়। শিশুদের বিনোদনের জন্য ছিল নাগরদোলার ব্যবস্থাও। আর মেলার বড় আকর্ষণ ঘুড়ি ওড়ানো ও বিক্রি। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসেছিলেন ঘুড়ি বিক্রি করতে।
প্রচণ্ড গরমের পাশাপাশি তেমন হাওয়া-বাতাস না থাকায় এবার ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা সেভাবে জমে ওঠেনি। তবে ঘুড়ি বেচাকেনা ও শিশু-কিশোরদের উচ্ছ্বাস ছিল চোখে পড়ার মতো। এ উপলক্ষে আসা হাজার হাজার দর্শনার্থীর নিরাপত্তার জন্য মেলায় সার্বক্ষণিক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টহল ছিল।
আদমদীঘির শিববাটি গ্রামের ঘুড়ি ব্যবসায়ী সালাম হোসেনের ভাষ্য, সন্ন্যাসতলীর মেলা বড় হওয়ায় তিনি এসেছেন ঘুড়ি বিক্রির জন্য। মেলায় প্রত্যাশা অনুযায়ী ঘুড়ি বিক্রি করতে পেরে তিনি খুশি। জয়পুরহাটের পার্বতীপুর এলাকার ঘুড়ি ব্যবসায়ী মফিজ উদ্দিন ও মজনু সরদার বলেন, পূর্বপুরুষের আমল থেকে এ মেলার কথা শুনে আসছেন তারা।
মেলা উদযাপন ও পূজা কমিটির সদস্য মহব্বতপুর গ্রামের মন্টু মণ্ডল বলেন, মেলাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও এটি আসলে সব ধর্মালম্বীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
মামুদপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান মিলন হোসেনের ভাষ্য, এক দিনের আয়োজনে যে এত লোকের সমাগম হতে পারে, তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। মেলায় যেন অনৈতিক কর্মকাণ্ড না হয়, সে ব্যাপারে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
ক্ষেতলাল থানার ওসি মোহাম্মদ ফরিদ হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে এবং মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন সতর্ক আছে। মেলায় অনৈতিক আচরণ লক্ষ্য করা গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।