বরিশালের উজিরপুর উপজেলার সন্ধ্যা নদীর তীরে আজ বৃহস্পতিবারের বিকেলটা ছিল রং, ঢোলের তালে উল্লাস ও হাজারো মানুষের আনন্দমুখর উপস্থিতিতে ভরপুর। আকাশজুড়ে কালো মেঘ—এমন পরিবেশে সন্ধ্যা নদীর বুকজুড়ে ঢেউখেলানো পানিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল মাঝিদের ‘হা-দে-রে-ও’ কোরাস। অনেক দিন পর নদী ও গ্রামের মানুষ একসঙ্গে ফিরে পেয়েছে তাদের হারানো ঐতিহ্য—নৌকাবাইচ।

বিকেল চারটার দিকে উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর কলেজের সামনে থেকে শুরু হয় ‘উজিরপুর নৌকাবাইচ ২০২৫’। প্রতিযোগিতা চলে সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এম এ জলিল সেতু পর্যন্ত। পুরো নদীপাড় তখন উৎসবে পরিণত হয়। দুই তীরে মানুষের ভিড়, ঢোলের আওয়াজ, উৎসাহ আর উচ্ছ্বাসে মুখর হয়ে ওঠে সন্ধ্যা নদীর একূল-ওকূল।

উজিরপুর উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা ‘আভাস’-এর যৌথ আয়োজনে অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার মো.

শরিফ উদ্দীন এবং বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের জনশিক্ষা বিভাগের পরিচালক আসমা ফেরদৌসি। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আলী সুজা। এ আয়োজনে সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও ইউনেসকো।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের প্রতীক। নদী ও নৌকাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই উৎসব আমাদের ঐক্য, সহযোগিতা ও আনন্দের ধারাবাহিকতা টিকিয়ে রাখে। তাই আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে এই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা, লালন করা সবার কর্তব্য।’

এ বছর নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ছয়টি ‘বাচারি’ নৌকা। প্রতিটি নৌকার নামকরণ করা হয় বাংলাদেশের ইতিহাস, সাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের নামে—শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, কবি জীবনানন্দ দাশ, সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, কবি সুফিয়া কামাল ও জুলাই শহীদ।

গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলার অভিজ্ঞ নৌকাবাইচ প্রতিযোগী কালিপদ তালুকদার, লাজারেস ফলিয়া, কিরণ মৃধা, সঞ্জয় রায়, শংকর বাড়ৈ ও সৈকত রায় তাঁদের দল ও নৌকা নিয়ে অংশ নেন এই প্রতিযোগিতায়।

গোপালগঞ্জের প্রতিযোগী লাজারেস ফলিয়া বলেন, ‘এর আগে আমরা উজিরপুরের হারতায় ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচে অংশ নিয়েছিলাম, কিন্তু সন্ধ্যা নদীতে এবারই প্রথম। এত মানুষের ভালোবাসা ও উৎসাহ আমাদের দলকে দারুণ অনুপ্রেরণা দিয়েছে।’

নদীর তীরে দাঁড়িয়ে প্রতিযোগিতা উপভোগ করছিলেন বৃদ্ধ সিরাজ মিয়া। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বসিত আট বছরের নাতি। সিরাজ মিয়া বলেন, ‘আমাদের সময় নৌকাবাইচ ছিল গ্রামের সবচেয়ে বড় উৎসব। আজ নাতিকে নিয়ে এসেছি যেন সে দেখতে পারে আমাদের সেই ঐতিহ্য। আগে আমাদের এলাকায় বৈশাখে কিংবা কালীপূজার সময় প্রতিবছর নৌকাবাইচ হতো। সেই উৎসব ঘিরে মানুষের কত আনন্দ-উচ্ছ্বাস ছিল। কিন্তু এখন আর তেমনটা হয় না। অনেক দিন পর এই উৎসবে এসে পুরোনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল।’

নৌকাবাইচের আয়োজক উন্নয়ন সংস্থা ‘আভাস’-এর প্রতিনিধি শহিদুল ইসলাম বলেন, এটি ইউনেসকো প্রস্তাবিত ঐতিহ্যবাহী উৎসব। স্থানীয় প্রশাসন ও সাধারণ মানুষের আগ্রহে নৌকাবাইচটি এক উৎসবে রূপ নিয়েছে। সামনেও এমন উৎসবের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখার চেষ্টা থাকবে।

প্রতিযোগিতা শেষে অনুষ্ঠিত হয় পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। বিজয়ী দল ছিল শেরেবাংলা ফজলুল হক দল (মাদারীপুরের লাজারেস ফলিয়া দল)। প্রথম রানার্সআপ সেক্টর কমান্ডার এম এ জলিল দল (কালিপদ তালুকদার দল) এবং দ্বিতীয় রানার্সআপ জুলাই শহীদ দল (কিরণ মৃধা দল)।

স্থানীয় তরুণ মো. মাহফুজ বলেন, ‘এই আয়োজন শুধু বিনোদন নয়, বরং বরিশাল অঞ্চলের গ্রামীণ ঐতিহ্য, লোকজ ক্রীড়া ও নদীসংস্কৃতির পুনর্জাগরণ ঘটিয়েছে। আমরা চাই, প্রতিবছর এই আয়োজন অব্যাহত থাকুক।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন সন ধ য বর শ ল আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

মাগুরায় পূজা উপলক্ষে ৯০ ফুটের তোরণ, নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের

মাগুরায় শতবর্ষী কাত্যায়নী পূজা উপলক্ষে শহরের নতুন বাজার সেতুর ওপর নির্মিত হয়েছে প্রায় ৯০ ফুট উচ্চতার একটি বর্ণিল তোরণ, যা নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের। আয়োজকদের দাবি, জেলায় সাধারণত এত উঁচু তোরণ চোখে পড়ে না। তোরণটির নির্মাণে কাজ করেছেন ৩০ জনের বেশি শিল্পী ও শ্রমিক। গতকাল সোমবার ষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে পাঁচ দিনের এই উৎসব।

মাগুরা শহরের নিজনান্দুয়ালী এলাকার নিতাই গৌর গোপাল সেবাশ্রম পূজা উদ্‌যাপন কমিটির পক্ষ থেকে এই তোরণ নির্মাণ করা হয়েছে। বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা হলেও মাগুরায় জাঁকজমকভাবে কাত্যায়নী পূজাই অনুষ্ঠিত হয়।

প্রতিবছর শারদীয় দুর্গাপূজার এক মাস পরই মাগুরায় কাত্যায়নী পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পাঁচ দিনব্যাপী উৎসবের সমাপনী হবে আগামী শুক্রবার।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, কাত্যায়নী পূজার সময় প্রতিবছর উৎসবের শহরে পরিণত হয় মাগুরা। এবারও গোটা শহরকে সাজানো হয়েছে বর্ণিল সাজে। এবার পূজামণ্ডপ এলাকাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন তোরণ, প্যান্ডেল ও চোখধাঁধানো আলোকসজ্জা। দিনে ও রাতে পূজা মণ্ডপগুলোয় হাজারো মানুষের ঢল নামে। পূজামণ্ডপগুলো তৈরি করা হয়েছে প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্থাপত্যকলার আদলে। কয়েক শ পটুয়াশিল্পী প্রায় এক মাস পরিশ্রম করে এসব প্রতিমা, মণ্ডপ ও পূজার আনুষঙ্গিক সাজসজ্জা করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবার জেলায় ৮৭টি মণ্ডপে কাত্যায়নী পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর মধ্যে পৌর এলাকায় ২০টি, সদর উপজেলার অন্য এলাকায় ২০টি, শালিখায় ২৫টি, মহম্মদপুরে ১২টি এবং শ্রীপুরে ১০টি মণ্ডপে পূজা হচ্ছে। এর মধ্যে পৌর এলাকার মণ্ডপগুলো ঘিরেই দর্শনার্থীদের ভিড় বেশি থাকে। পূজাকে ঘিরে প্রতিটি মণ্ডপে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা।

গতকাল সকালে নতুন বাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, দূর থেকে চোখ আটকে যাচ্ছে বর্ণিল এই তোরণে। মাথা উঁচু করে সেটি দেখার চেষ্টা করছেন অসংখ্য দর্শনার্থী।

আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তোরণটির উচ্চতা প্রায় ৯০ ফুট ও প্রস্থ ৩০ ফুট। এটি বাঁশ, কাঠ, কর্কশিট ও নানা রঙের কাপড় দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। তোরণটির কাঠামোয় ব্যবহৃত হয়েছে প্রায় ৫৫০টি বাঁশ। খুলনার শিল্পী নিতাই বিশ্বাস এটির নকশা করেছেন এবং নির্মাণ করেছে স্থানীয় একটি ডেকোরেটর প্রতিষ্ঠান।

ডেকোরেটরটির স্বত্বাধিকারী তরুণ ভৌমিক বলেন, ‘কাত্যায়ানী পূজা মাগুরার বিশেষ একটি উৎসব। এখানে আমরা প্রতিবছর নতুন কিছু প্রদর্শনের চেষ্টা করি। এর আগে একই জায়গায় ৭০ থেকে ৭৫ ফুট উচ্চতার তোরণ নির্মাণ করেছিলাম। তবে এবার আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।’

শিল্পী নিতাই বিশ্বাস বলেন, তোরণটির বিশেষত্বই হচ্ছে এর উচ্চতা। এ ধরনের তোরণ দেশের কোনো প্রান্তেই তেমন একটা চোখে পড়ে না। জনবহুল একটি সেতুর ওপর এটির নির্মাণ করাটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেক দূর থেকে এটি চোখে পড়ছে। ৩০ জনের বেশি শিল্পী ও শ্রমিক প্রায় ৩ সপ্তাহ ধরে এটি তৈরি করেছেন।

নিতাই গৌর গোপাল সেবাশ্রম পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক পাপাই শিকদার বলেন, ‘বড় আকারের তোরণ আমাদের কাত্যায়নী পূজার ঐতিহ্য। গত ১০ বছর লাইট বোর্ডের তোরণ নির্মাণ করা হতো। এবার আমরা আবার পুরোনো ঐতিহ্যে ফিরে গেছি। এবার এই তোরণ নির্মাণে প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • টোকিওতে জমেছে আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব
  • রাঙামাটি রাজবন বিহারে দুদিনের কঠিন চীবর দানোৎসব শুরু
  • ‘নতুন করে সংস্কৃতিতে আঘাত আসছে, বন্ধ হচ্ছে সংগীত, শরৎ উৎসব’
  • মাগুরায় পূজা উপলক্ষে ৯০ ফুটের তোরণ, নজর কাড়ছে দর্শনার্থীদের