পহেলা বৈশাখে পঞ্চগড়ের আশরাফুল-সাজেদা দম্পতির ঘর আলো করে দ্বিতীয় পুত্রসন্তানের জন্ম হয়। কিন্তু জন্মের ২৪ ঘণ্টা পার হলেও নবজাতকের ভাগ্যে জোটেনি নতুন পোশাক। সংসারের অভাবের কারণে এক কেজি মিষ্টি কেনার সামর্থ্যও নেই নবজাতকের বাবা আশরাফুল ইসলামের। বেসরকারি ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ, পরিবার কিংবা অন্য কেউ শুভেচ্ছাও জানায়নি তাদের। ছেঁড়া শাড়ির খণ্ডিত অংশ দিয়ে কলিজার টুকরোকে জড়িয়ে রেখেছেন হতভাগিনী মা। এ যেন রাজপুত্রের গায়ে ছেঁড়া কাপড়। এতেও খুশি এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন আশরাফুল-সাজেদা দম্পতি। পহেলা বৈশাখ দুপুরে জেলা শহরের নিউ আদর্শ ক্লিনিকে গৃহবধূ সাজেদার কোল আলো করে জন্ম নেয় ফুটফুটে এই পুত্রসন্তান। আশরাফুল-সাজেদা দম্পতির বাড়ি জেলা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে পঞ্চগড় সদর উপজেলার কামাত কাজলদীঘি ইউনিয়নের ফুলপাড়া গ্রামে। আব্দুল্লাহ আল আনাস নামে আশরাফুল-সাজেদা দম্পতির তিন বছরের আরেকটি পুত্রসন্তান রয়েছে।
দুই ভাই, তিন বোনের সংসারে আশরাফুল ইসলাম সবার ছোট। রাজমিস্ত্রির সহযোগীর কাজ করে সংসার চালান তিনি। ভাই কোভিদ হাসেন একই পেশায় নিয়োজিত। কাজ পেলে দু’বেলা খাবার জোটে। আশরাফুলের বাবা অন্যের জমিতে কাজ করে এক সময় সংসার চালালেও বর্তমানে তিনি শয্যাশায়ী। ভিটেমাটি ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই আশরাফুলের পরিবারের। আশরাফুল ইসলাম স্থানীয় একটি মাদ্রাসা থেকে আলিম পাস করেছেন। সাংসারিক অনটনে আর লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারেননি।
নবজাতকের মা সাজেদা বেগমের বাড়ি একই ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামে। তাঁর বাবাও একজন রাজমিস্ত্রি ছিলেন। সাজেদা ছিলেন এক ভাই, দুই বোনের মধ্যে বড়। তিনি টুটিরহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ২০২১ সালে ১৮ ফেব্রুয়ারি পারিবারিকভাবে সাজেদা-আশরাফুলের বিয়ে হয়। এরপর এক বছরের মাথায় প্রথম সন্তান আনাসের জন্ম হয়। বর্তমানে আনাসের বয়স তিন বছর। এবার বিশেষ দিনে দ্বিতীয় পুত্রসন্তানের জন্ম সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ মনে করছেন আশরাফুল-সাজেদা দম্পতি।
সাজেদা অন্তঃসত্ত্বা– এমন ধারণায় স্থানীয় ওষুধের দোকান থেকে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করান। পরে জেলা শহরে ডা.
সাজেদা বেগম জানান, পহেলা বৈশাখের কোনো অনুষ্ঠানে জীবনে কখনও যাওয়া হয়নি তাঁর। প্রত্যন্ত গ্রামে বড় হয়েছেন। দারিদ্র্যের জন্য বাড়তি আনন্দের সুযোগও ছিল না। তবে এবার এখানে থাকায় শহরে সকালে আনন্দ শোভাযাত্রার শব্দ শুনতে পান। পঞ্চগড়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করা হয়। সেখান থেকে ক্লিনিকে দূরত্ব এক কিলোমিটারের কম। ক্লিনিকটিও পঞ্চগড়-ঢাকা মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত। ক্লিনিকের বিছানায় শুয়ে বৈশাখী উৎসব এবং শোভাযাত্রার আনন্দ বুঝতে পারেন তিনি। তবে তাঁর মনে আতঙ্ক। পেটের মধ্যে নবজাতকের নড়াচড়া নেই। তিনিসহ পরিবারের লোকজন অপেক্ষা করছিলেন চিকিৎসকের জন্য। ডাক্তার মনসুর আলম এবং তৌহিদ ইসলাম পুলক ক্লিনিকে এলে তাদের তত্ত্বাবধানে অপারেশন শুরু হয়।
এ সময় সাজেদা বেগমের মা মেরিনা বেগম বসে কান্না করছিলেন। অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অন্য স্বজনরা অপেক্ষারত ছিলেন। বেলা ১টা ২৮ মিনিটে তাদের জীবন আলোকিত করে জন্ম নেয় দ্বিতীয় পুত্রসন্তান। কেটে যায় অজানা আতঙ্ক। শিশুটির ওজন ছিল ২ কেজি ৯০০ গ্রাম। তবে অর্থাভাবে পরিবারের কোনো সদস্যের এক কেজি মিষ্টি কেনার সামর্থ্যও ছিল না। ক্লিনিকের ৯ হাজার ৫০০ টাকা পরিশোধের চিন্তাই তাদের বড়। দু-একজনের কাছে ধার চেয়েও পাননি। এ জন্য অন্যভাবে টাকা খরচের কোনো সুযোগ নেই তাদের। পরিবারের অন্য সদস্যদেরও একই অবস্থা। কেউ শুভেচ্ছা জানানো তো দূরের কথা, নতুন কাপড় বা মিষ্টিমুখ করার ব্যবস্থাও দেখা যায়নি।
বড় ছেলে আব্দুল্লাহ আল আনাসের নামের সঙ্গে মিল রেখে আরবি একটি নাম রাখবেন বলে জানান শিশুটির মা সাজেদা। সব সংকট ছাপিয়ে বাবা-মায়ের একটাই প্রত্যাশা– শিশুটি যেন সুস্থ থাকে, মানুষের মতো মানুষ হতে পারে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আশর ফ ল স জ দ প ত রসন ত ন পর ব র র ইসল ম আনন দ
এছাড়াও পড়ুন:
কার্টুন, মিমে অভ্যুত্থানের ভিন্ন ধারার দৃশ্যায়ন
টাকার বস্তার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে আছেন শুভ্র কেশ, সফেদ দাড়ি, চশমা পরিহিত এক লোক। তাঁর ছবি দেখে তো বটেই, এই বর্ণনা থেকেও তাঁকে চিনবেন দেশবাসী। বর্তমানে কারাগারের বাসিন্দা পতিত স্বৈরশাসকের এই উপদেষ্টা বলছেন, ‘টাকার ওপর আমার বিশ্বাস উঠে গেছে।’ এই ছবির পাশেই এক কাটআউট। সেখানে ‘শেখ হাসিনা পালায় না’ বলতে বলতে দৌড়ে পালাচ্ছেন ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতার মসনদ থেকে উৎপাটিত শেখ হাসিনা।
এমন মজার মজার কার্টুন, মিম, গ্রাফিতি, ভিডিও স্থাপনাকর্মসহ বৈচিত্র্যময় সৃজনসম্ভার নিয়ে শুরু হয়েছে ‘বিদ্রূপে বিদ্রোহ’ নামের ব্যতিক্রমী এক প্রদর্শনী। আয়োজন করেছে অনলাইনভিত্তিক স্যাটায়ার সাময়িকী ‘ইয়ারকি’। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে ধানমন্ডির আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের লা গ্যালারিতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দিনের এ প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। চলবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত। সবার জন্য প্রতিদিন বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা।
গত বছর ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে উত্তাল ছিল জুলাই। একটি বৈষম্যহীন, উদার গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য পথে নেমেছিলেন অগণিত মানুষ। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে জীবন উৎসর্গ করেছেন তাঁদের অনেকে। আহত হয়েছেন বেশুমার। রক্তরঞ্জিত রাজপথ বেয়ে এসেছে জনতার বিজয়।
প্রদর্শনীতে প্রবেশপথটির দুই পাশে লাল রঙের পটভূমিতে বড় বড় ডিজিটাল পোস্টার। সেখানে ২ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতিদিনের বিভিন্ন ঘটনার আলোকচিত্র, সংবাদপত্র, অনলাইন পোর্টাল, টেলিভিশনের রিপোর্ট, ছবি, ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমের পোস্ট—এসব তুলে আনা হয়েছে এ পোস্টারগুলোতে। প্রবেশপথটিও লাল রঙের। ‘জুলাই করিডর’ নামে এই রক্তিম পথটি বেয়ে দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীতে প্রবেশের সময় অভ্যুত্থানের উত্তাল দিনগুলোর উত্তাপ ফিরে পাবেন।