সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দেওয়া প্রস্তাব একত্রিত করে ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো প্রকাশে এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগার কথা নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, ‘সে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সনদে স্বাক্ষর করে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করা দরকার। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সেটা ডিসেম্বর পর্যন্ত যাওয়ারও দরকার নেই। ঐকমত্যের পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা সেটা সিদ্ধান্ত নিয়ে, আমরা জাতীয় সনদ সই করে ডিসেম্বরের আগেও নির্বাচন করা সম্ভব। ডিসেম্বরের পরে যাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না; বরং আগে করা সম্ভব।’

আজ রোববার রাজধানীর গুলশানে বিএনপির চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে দলটির লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি ছাড়াও বৈঠকে বিএনপি ভাইস চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, বরকতউল্লা বুলু এবং গণ অধিকার পরিষদের পক্ষে দলটির সভাপতি নুরুল হক নুর, সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, সহসভাপতি ও মুখপাত্র ফারুক হাসানসহ দলটির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

আমীর খসরু বলেন, ঐকমত্য কেউ সৃষ্টি করছে না, সবাই সবার মতামত দিয়েছে, সুতরাং যেসব জায়গায় ঐকমত্য হবে, সেগুলো শুধু আমরা সংস্কারের মধ্যে নিয়ে আসব। আর যেগুলো ঐকমত্য হবে না, সেগুলো নির্বাচনের পরে যার যার ম্যান্ডেটের জন্য যাবে এবং ম্যান্ডেট নিয়ে সংসদে এসে এটা পাস করবে।

সংস্কারের কথাটা খুবই পরিষ্কার, না বোঝার কোনো কারণ নেই উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, ‘বুঝেশুনে না বুঝলে সেটা কোনো সমাধান না। সুতরাং অতিসত্বর আমরা সংস্কারের ঐকমত্য নির্ধারণ করে জাতীয় সনদ সই করে ডিসেম্বরের আগে নির্বাচনের যথেষ্ট সুযোগ রাখা আছে এবং করা সম্ভব।’

সংস্কারের বিষয়কে ‘ওপেন এন্ডেড’ রাখার পরামর্শ দিয়ে আমীর খসরু বলেন, সংস্কারের বিষয়টা খোলা রাখেন, এটা কিন্তু রং মেসেজ (ভুল বার্তা) যাচ্ছে জাতির কাছে। এটা দিনক্ষণ দিয়ে, এটা সমাধান করা সম্ভব। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটা করা উচিত।

বিএনপি বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত ও নিপীড়িত দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি বিচারের দাবি রাখে জানিয়ে আমীর খসরু বলেন, বিচার বিভাগ বিচার করবে। সে জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে।

ছাত্র উপদেষ্টারা পদত্যাগ না করলে আন্দোলন

বৈঠকের সিদ্ধান্তের বিষয়ে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘দেশের ভবিষ্যতের জন্য, গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের জন্য ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত। ডিসেম্বরের পরে নির্বাচন গেলে সেটি দেশে আরেকটা সংকট তৈরি করতে পারে, নানান বাস্তবতায় আমরা সেটি পর্যবেক্ষণ করছি।’

সংস্কারের প্রসঙ্গ তুলে নুরুল হক বলেন, ‘যেহেতু ঐকমত্য কমিশনের কাছে দলগুলো তাদের মতামত দিয়েছে, তারা সে মতামতের ভিত্তিতে একটা জুলাই চার্টার করে এক-দুই মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে পারে। ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা নির্বাচনের একটা সুস্পষ্ট রোডম্যাপ চাই।’

ডিসেম্বর থেকে জুন রাজনীতির মাঠে অনিশ্চয়তা তৈরি করবে জানিয়ে নুরুল হক বলেন, ‘আমরা বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে পরিষ্কার করেছি ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে, বিজয়ের মাসে আমরা বাংলাদেশের একটা নতুন বিজয় উদ্‌যাপন করতে চাই।’

আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে নুর বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট মাসে এটা না থাকলেও এখন আওয়ামী লীগের তৎপরতা বাড়ছে, এটা সরকারের দুর্বলতার কারণে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ ও ফ্যাসিবাদীদের নিষিদ্ধের বিষয়ে আমরা সরকারের একটি শক্ত পদক্ষেপ আশা করছি।’

অন্তর্বর্তী সরকারে দুজন ছাত্র প্রতিনিধি উপদেষ্টা হিসেবে থাকার বিষয়ে নুরুল হক নুর বলেন, ‘এখন যেহেতু তাঁরা একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন, সেহেতু সরকারের নিরপেক্ষতার জন্য এই দুই উপদেষ্টার পদত্যাগ করা জরুরি। আমরা এটাও বলতে পারি, বিএনপির সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে, যদি এই দুই উপদেষ্টা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ না করেন এবং প্রধান উপদেষ্টা এ বিষয়ে ব্যবস্থা না নেন, তাহলে গণ অধিকার পরিষদের পক্ষ থেকেও এ বিষয়ে কর্মসূচি দেওয়া হবে।’

গণ অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে ফলপ্রসূ একটি বৈঠক হয়েছে। আমরা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করেছি, সে আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি, শুধু হাসিনার পতন হয়েছে।’

রাশেদ খান বলেন, ‘আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারে এনসিপির দুজন উপদেষ্টা রয়েছেন এবং বিভিন্ন দপ্তরে এবং সেক্টরে এনসিপির নেতারা রয়েছেন; আমরা মনে করি, সরকারের নিরপেক্ষতার জন্য তাঁদের পদত্যাগ করতে হবে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ড স ম বর র ব এনপ র স ন র ল হক র জন ত ক সরক র র পদত য গ উপদ ষ ট ঐকমত য র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া ছাড়া ঐকমত্য কি টেকসই হবে

বর্তমানে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের অংশীদারদের সঙ্গে একধরনের আলোচনা প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এর লক্ষ্য হলো ভবিষ্যতের জন্য একটি নতুন সাংবিধানিক কাঠামো, প্রতিনিধিত্বশীল শাসন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনৈতিক চুক্তি গঠনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।

এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই আলোচনার পরিধি, কাঠামো ও অংশগ্রহণকারীদের বাছাই কতটা ন্যায়সংগত ও প্রতিনিধিত্বমূলক হচ্ছে?

বাংলাদেশ এখন একধরনের রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বস্তরে আধিপত্য বিস্তার করেছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক নির্বাচন ছিনতাই করেছে, বিরোধীদের কণ্ঠ রোধ করেছে, গুম-খুন চালিয়েছে।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতা–কর্মী রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে ছাত্র–জনতার ওপর সহিংস হামলা চালায়। যেভাবে এই হামলা চালানো হয়েছিল, তা ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধ। গণ-অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত পর্যায়ে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নয়।

আরও পড়ুনক্ষমা না চাইলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করার অধিকার নেই২০ অক্টোবর ২০২৪

এ রকম বাস্তবতার মধ্যেও আমরা যদি শুধু শাসক দলটির পতনকেই গণতন্ত্রের পূর্ণ বিজয় ধরে নিই, তাহলে তা হবে একটি ‘অর্ধসত্য’। কারণ, কোনো ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা শুধু সরকার বা প্রশাসনই তৈরি করে না, তা একটি দীর্ঘমেয়াদি মানসিক কাঠামোও গড়ে তোলে।

এই কাঠামোর অংশ হয়ে যায় কিছু গোষ্ঠী, প্রতিষ্ঠান, এমনকি অনেক সাধারণ মানুষও—যারা হয়তো সরাসরি দমননীতি চালায়নি; কিন্তু চুপ থেকেছে, কিছু না দেখে থাকার ভান করেছে কিংবা নিরাপত্তা ও সুযোগের বিনিময়ে নির্যাতনকে বৈধতা দিয়েছে।

এই মানসিক কাঠামোর ভাঙন কেবল একজন শাসকের পতনেই শেষ হয় না; এটি সম্পূর্ণ হয়, যখন আমরা সাহস করে সেই মানুষদের কথাও বলি—যারা সরাসরি অন্যায় করেনি, কিন্তু চুপ থেকেছে বা নিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে অন্যায় মেনে নিয়েছে।

এখন প্রশ্ন হলো, আমরা কী করব? আমরা কি শুধু অপরাধীদের শাস্তি নিয়ে সন্তুষ্ট থাকব, নাকি একটি ন্যায্য ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়ে তোলার কথা ভাবব?

আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর গ্রামগঞ্জের কর্মী-সমর্থকেরা কী ভাবছেন০৬ জুন ২০২৫একটি ‘সরল’ প্রশ্ন

 ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচন ছিল জালিয়াতি ও প্রহসনের নির্বাচন। এ কারণে এ নির্বাচনগুলোর ভোটের ফলাফল বিবেচনায় নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

আমার প্রশ্ন একেবারে মৌলিক এবং সরল। ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ভোট পেয়েছিল। দেশের অন্তত ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ ভোটার একাধিকবার এই দলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল।

এবার যখন একটি নতুন গণতান্ত্রিক রূপান্তরের সূচনা হচ্ছে, তখন কি এই বিশাল জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অবস্থান, চিন্তা ও মতামত পুরোপুরি উপেক্ষা করা হবে—এই প্রশ্নটি হয়তো অনেকেই বিবেচনায় নিচ্ছেন না।

কেউ কেউ হয়তো ভয় পাচ্ছেন—যেন তাঁদের গায়ে ‘দোসর’ বা ‘দালাল’–জাতীয় কোনো ট্যাগ না লেগে যায়। এ এক নতুন ধরনের পরিস্থিতি, যেখানে সমালোচনার বদলে চলে প্রমাণ ছাড়াই সন্দেহ আর কণ্ঠ রুদ্ধ করার প্রতিযোগিতা!

অনেকেই বলছেন, আওয়ামী লীগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত দলকে কেন সুযোগ দেব? এই দলের সমর্থকেরা এখনো খোলাখুলিভাবে অনুশোচনা প্রকাশ করেনি, ক্ষমা চায়নি। এই ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর যে এই দলের সমর্থকেরা কীভাবে এতটা অনুশোচনাহীন হতে পারে? তারা আত্মসমালোচনা না করে এখনো ‘কনস্পাইরেসি থিওরি’ (ষড়যন্ত্র তত্ত্ব) নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছে।

কিন্তু আমরা কি প্রশ্ন তোলা বন্ধ করে দেব? এই প্রেক্ষাপটেই বরং আমাদের আরও বেশি করে প্রশ্ন করতে হবে ভবিষ্যতের ইতিহাসে আমাদের সামষ্টিক ভূমিকা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়।

বাংলাদেশের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের ভোটার সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য না হলেও ধর্মনিরপেক্ষতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তায় বিশ্বাসী দল বা মতকে সমর্থন করেন, নির্বাচনের সময় এই মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ভোট দেন। আমরা কি পরিপক্ব ও দায়িত্বশীল উদ্যোগ নিয়ে তাঁদের একটি প্রতিনিধিদল নির্বাচন করে তাঁদেরকে ঐকমত্যের আলোচনার মঞ্চে আনতে পারতাম না?

আরও পড়ুনসংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ফেরার শঙ্কা যেখানে০৭ জুলাই ২০২৫আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা

বিশ্বজুড়ে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতনের পর যদি নতুন রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণের সময় শুধু প্রতিশোধ বা একচেটিয়া পক্ষপাতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, তবে তা খুব কম ক্ষেত্রেই টেকসই হয়। সফল এবং স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য প্রয়োজন হয় আলোচনার, ক্ষমা ও অংশগ্রহণের এক প্রজ্ঞাপূর্ণ ভারসাম্য।

দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদী শাসনের পতনের পর নেলসন ম্যান্ডেলার উদ্যোগে ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশন’ গঠিত হয়। এর লক্ষ্য ছিল, শুধু অপরাধী চিহ্নিত করা নয়, বরং একটি গভীর সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে বিভক্ত জাতিকে পুনর্মিলনের দিকে নিয়ে আসা।

 একইভাবে রুয়ান্ডার ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পর ‘গাকাকা আদালত’ নামে একধরনের ‘কমিউনিটি বেইজড’ বিচারব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়, যেখানে অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি সহাবস্থানের নৈতিক ভিত্তি তৈরি হয়।

লাতিন আমেরিকার বহু দেশেও ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন ফোরাম’-এর মতো কাঠামো দেখা গেছে; যেখানে অপরাধ, অপরাধী ও অনুশোচনা—সব কিছুকে যুক্ত করে সমাজে একটি নতুন সম্মিলিত চুক্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়েছে।

আরও পড়ুনজাতিসংঘের প্রতিবেদন: আওয়ামী লীগের সামনে কী অপেক্ষা করছে১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতিমান পণ্ডিত আরেন্ড লাইপহার্ট তাঁর ‘কনসোসিয়েশনাল ডেমোক্রেসি’ তত্ত্বে বলেন, বিভক্ত সমাজে যদি টেকসই গণতন্ত্র গড়ে তুলতে হয়, তবে সব বড় গোষ্ঠীকেই আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; তারা পূর্বতন শাসকের সমর্থক হোক বা না হোক।

একইভাবে মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্যামুয়েল হান্টিংটন দ্য থার্ড ওয়েভ: ডেমোক্র্যাটাইজেশন ইন দ্য লেট টোয়েন্টিথ সেঞ্চুরি বইয়ে দেখিয়েছেন, গণতান্ত্রিক উত্তরণ তখনই টেকে, যখন নতুন শাসকগোষ্ঠী প্রতিপক্ষকে শত্রু নয় বরং অংশীদার হিসেবে দেখে।

বর্তমানে ঐকমত্যের আলোচনা প্রক্রিয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী বা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তার বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করছেন; কিন্তু যাঁরা কোনো দলের মধ্যে নেই, তাঁদের জন্য একটি স্বাধীন ও সম্মানজনক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত কি না, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

আরও পড়ুনআওয়ামী লীগের নেই অনুশোচনা, ষড়যন্ত্র তত্ত্বে ভরসা১১ নভেম্বর ২০২৪বর্তমান বাস্তবতা ও রাজনৈতিক পূর্বাভাস

অনেকেই মনে করছেন যে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে না কিংবা করবে না। আওয়ামী লীগের অতীত ইতিহাস বলছে ভিন্ন কথা। আওয়ামী লীগ সব সময়ই কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে। এমনকি রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও দলটি পুরোপুরি নির্বাচন বর্জনের পথে হাঁটেনি। কাজেই ভবিষ্যতে হয়তো নতুন কোনো নাম বা কাঠামোয় অথবা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মাধ্যমে হলেও দলটি নির্বাচনে অংশ নিতে পারে—এমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বর্তমানে দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক রূপান্তরের নেতৃত্বে রয়েছেন। তিনি এমন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, যিনি সব সময় মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও সামাজিক সংহতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেওয়া একাধিক সাক্ষাৎকার এবং বক্তৃতায় ইউনূস কখনোই আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করার দাবি তোলেননি। তিনি বরং আওয়ামী লীগকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে দলটি গণতন্ত্রের পথে ফিরে আসে।

আরও পড়ুনআওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা উচিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে৩০ অক্টোবর ২০২৪

এ থেকে প্রতীয়মান হয়, ইউনূসের মধ্যে একধরনের ‘ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন’ কৌশল কাজ করছে, যেখানে অপরাধের বিচার হবে, কিন্তু রাজনীতির ময়দানে প্রতিপক্ষকে একেবারে নিশ্চিহ্ন করা হবে না।

এ ছাড়া জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিভিন্ন পর্যবেক্ষণেও দেখা যাচ্ছে, তারা আওয়ামী লীগের অপরাধের বিচার চাইলেও দল হিসেবে নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী নয়। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ২০২৪ সালের আগস্টে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘যদিও আওয়ামী লীগের শাসনামলে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন সংঘটিত হয়েছে, তবে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন এবং পূর্ণ রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ছাড়া বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।’

যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিচারের পক্ষে থাকলেও রাজনৈতিক বহুত্ববাদ নির্মূলের বিপক্ষে।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের এক পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, সব গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করে অংশগ্রহণমূলক একটি নির্বাচনই হলো বাংলাদেশের জন্য বৈধতা পুনঃস্থাপনের একমাত্র পথ।

আগামী নির্বাচন যদি যথাযথভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক না হয়, তবে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দল আসবে কি না—তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন ওঠে, ইউনূসের মতো একজন সংবেদনশীল নেতার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ না করেই কি নির্বাচন হবে?

আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি অংশগ্রহণ করে তাহলে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ভোট পেতে পারে, কিছু জরিপে এমন ফলাফল পাওয়া গেছে। এমন একটি দল, যাদের শতকরা ১৫-২০ শতাংশ ভোট পাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেই দলের সমর্থক বা প্রতিনিধিদের একেবারে উপেক্ষা করে রাজনৈতিক রূপরেখা কতটা যুক্তিসংগত বা টেকসই হবে—তা নিয়ে এখনই প্রশ্ন তোলা দরকার।

আরও পড়ুনভারতের নীতিতে আওয়ামী লীগ–নির্ভরতা ও অপতথ্যের রাজনীতি০৫ ডিসেম্বর ২০২৪কিছু জরুরি প্রশ্ন

এই পরিস্থিতিতে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে তা হলো, আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা হত্যা, সন্ত্রাস, মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিল না, তারা কি একটি নতুন রাজনৈতিক কাঠামোয় ভিন্ন নামে অংশ নিতে পারবে? তাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করা কি ঠিক হবে? সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, ধর্মনিরপেক্ষ ভোটার এবং একসময় আওয়ামী লীগ-ঘরানার আদর্শে বিশ্বাসী অনেক নাগরিক এখন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও সমাজে তাদের উপস্থিতি রয়েছে। তাহলে রাজনীতিতে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে না?

ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় এই মত বা অবস্থানগুলো কোথাও দৃশ্যমান নয়। কমিশন কি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী কাঠামো গঠনের বিষয়টি আমলে নেবে না? আমরা কি এমন একটি প্রক্রিয়া দেখছি, যা ভবিষ্যতের জন্য আরেকটি সংকট তৈরি করছে?

মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার শিক্ষক ও গবেষক, রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

*মতামত লেখকের নিজস্ব

আরও পড়ুনআওয়ামী সমর্থকেরা কাকে ভোট দেবে২৮ জুন ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ‘লন্ডন ঘোষণার বাস্তবায়ন ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদনে’
  • প্রধান বিচারপতি নিয়োগে দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে: আলী রীয়াজ
  • ‘জুলাই ঘোষণা’ সংবিধানের প্রস্তাবনায় নয়, তপশিলে চায় বিএনপি
  • ‘জুলাই ঘোষণা’ সংবিধানে নয়, তপশিলে চায় বিএনপি
  • প্রধান বিচারপতি নিয়োগ সংক্রান্ত দুটি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে: আলী রীয়াজ 
  • রাষ্ট্রপতি ও বিচার বিভাগকে বাইরে রেখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায় গণসংহতি আন্দোলন
  • সবার উদ্দেশ্য এক, লক্ষ্যেও নেই মতভিন্নতা: আলী রীয়াজ
  • ইসির সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক
  • জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতির সঙ্গে কানাডীয় হাইকমিশনারের বৈঠক
  • অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া ছাড়া ঐকমত্য কি টেকসই হবে