সবে ভোরের আলো ফুটেছে। একজন-দু’জন কিংবা কখনও দলবেঁধে কাস্তে-দড়ি, ভার বহনের বাংকুয়া ও কাপড়ের পোঁটলা কাঁধে ঝুলিয়ে জড়ো হচ্ছেন রাস্তার মোড়ে। কেউ বাইসাইকেলে, কেউ অটোরিকশায় ও ভ্যানে চেপে, আবার কেউ এসেছেন হেঁটে। সবাই হাটে এসেছেন গেরস্তের ধানকাটা কাজে শ্রম বিক্রি করতে। অন্যরা এসেছেন শ্রম কিনতে। শ্রমিকদের সঙ্গে দরদাম মিটিয়ে তাদের সঙ্গে নিয়ে গন্তব্যে রওনা দিচ্ছেন কৃষক।

কাকডাকা ভোর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা এই হাটে বিক্রি হয় শ্রম। প্রতিদিন ভোরে শ্রম বেচাকেনা করতে সেখানে জড়ো হন শত শত কৃষক-শ্রমিক। এই চিত্র শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার বালুঘাটা বাজারের শ্রমিক হাটের।

নালিতাবাড়ীতে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে বোরো ধান কাটা শুরু হয়েছে। চলবে আগামী ২০-২৫ দিন। কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টির ভয়ে গেরস্থরা চাইছেন যত দ্রুত সম্ভব ধান কেটে ঘরে তুলতে। তাদের এই চাহিদা মেটাতে জমে উঠেছে কৃষিশ্রমিকের হাট।

জামালপুর থেকে হাটে এসেছেন কৃষিশ্রমিক ময়নদ্দিন (৪৮)। পাঁচজনের দলে তিনি একজন। পাশের তারাকান্দি এলাকার এক গেরস্তের দুই একর জমির ধানকাটা ও বহন করার জন্য চুক্তি হয়েছে। প্রতি একরের জন্য তারা পাবেন ৬ হাজার টাকা। পাঁচজন মিলে দুই একর জমির ধানকাটা ও বহন করতে চার দিন সময় লাগবে। কাজ শেষে তারা পাবেন ১২ হাজার টাকা। এতে তাঁর ভাগে পড়বে ২ হাজার ৪০০ টাকা।

কৃষিশ্রমিক হানিফ মিয়া (৩৮) শেরপুর সদরের খোজিউরা গ্রাম থেকে একই এলাকার ছয়জনের সঙ্গে হাটে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের এলাকায় কাজ কম। যে কাজ আছে, তা দিয়ে সংসার ঠিকমতো চলে না। তাই এ এলাকায় ধানকাটা কাজের সন্ধানে এসেছি। হাটের পাশেই বালুঘাটা এলাকায় এক গেরস্তের বাড়িতে ৬০০ টাকায় দিন হাজিরায় ধান কাটতে যাচ্ছি। সঙ্গে দুই বেলা খাবার। আকাশ পরিষ্কার থাকায় ঝড়-বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাই আমাদের মজুরিও কমে গেছে।’

অন্য শ্রমিকদের মতো শ্রম বিক্রি করতে হাটে এসেছেন সূর্যনগর এলাকার আবদুল কাইয়ুম, লালচাঁন ও জাহিদুল। তাদের ভাষ্য, কয়েক দিন ধরে ধানকাটার কাজ চলছে। প্রচণ্ড রোদে পরিশ্রম বেশি। সব ধরনের জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে। দু’দিন আগেও দিনে ৮০০-৯০০ টাকা মজুরিতে কাজ করেছেন তারা। এখন সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার ওপরে কেউ নিতে চান না। তাদের দাবি, মজুরি কম দিলে পোষায় না। দৈনিক অন্তত এক হাজার টাকা হলেই ন্যায্য মজুরি বলা যাবে।

সরেজমিন জানা গেছে, প্রতিদিন জামালপুর ও শেরপুর জেলার বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকরা ছুটে আসেন এই শ্রমের হাটে। কয়েক দিন আগেও শ্রমের হাটে ভালো কাটতি ছিল শ্রমিকের। কিন্তু দু’দিন যেতে না যেতেই ভাটা পড়েছে। এর কারণ হিসেবে শ্রমিকরা জানান, অনুকূল আবহাওয়া ও ধানকাটার হারভেস্টার বাজারে আসায় শ্রমিকের শ্রমের মূল্য কমে গেছে। এ অবস্থায় শ্রম বিক্রি করতে আসা শ্রমিকরা হতাশা প্রকাশ করেন।

শ্রমিকদের ভাষ্য, প্রতিদিন তীব্র রোদের মধ্যে ঘামে ভিজে অন্যের ক্ষেত-খামারে পরিশ্রম করলেও তাদের উপার্জন বাড়েনি। বাড়তি শ্রম দিয়েও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত পারিশ্রমিক।

কয়েকজন চাষি জানান, সপ্তাহখানেক আগেও ধানকাটা শ্রমিকের মজুরি ছিল ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা। এখন তা কমে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় শ্রম বেচাকেনা চলছে। মজুরি ছাড়াও দুই বেলা খাবার দিতে হচ্ছে শ্রমিকদের। যেহেতু এখন পর্যন্ত আবহাওয়া চাষিদের অনুকূলে রয়েছে, তাতে আবাদ নিয়ে দুশ্চিন্তা তেমন একটা নেই। তাই দরদাম করে অনেকটা কম মজুরি দিয়েই শ্রমিক নিতে কৃষকের আগ্রহ বেশি।

উত্তর নাকশী গ্রামের কৃষক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, ‘আবাদ করতে অনেক খরচ। তার মধ্যে ধানের দাম কম হওয়ায় বেকায়দায় রয়েছি আমরা। শ্রমিকের মজুরি বেশি দিলে পোষায় না।’ তাঁর দাবি, শ্রমিকের মজুরির সঙ্গে অন্যান্য খরচও বেড়েছে। পক্ষান্তরে প্রকারভেদে প্রতি মণ ধান বিক্রি করতে হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা দরে।
কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলার ২৩ হাজার ১৩৩ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২২ হাজার ৯৯২ হেক্টর। ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমে তা কতটুকু হবে- তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

কৃষি কর্মকর্তা আবদুল ওয়াদুদ জানান, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় কৃষক আগ্রহ নিয়ে বোরো ধান কাটছেন। শ্রমিক সংকট মোকাবিলায় কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে পর্যায়ক্রমে ৫০ শতাংশ ভর্তুকিতে ৫০টি কম্বাইন হারভেস্টার বিতরণ করা হয়েছে। কৃষককে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হচ্ছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: এল ক র এস ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

মুসলমান বলেই রোহিঙ্গারা ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা বর্তমান সময়ে অন্যতম করুণ মানবিক সংকট বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, শুধু মুসলমান হওয়ার কারণেই রোহিঙ্গারা এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার।

গতকাল সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় তুরস্কের একটি সংসদীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এ কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। পাঁচ সদস্যের ওই প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন তুরস্ক-বাংলাদেশ সংসদীয় মৈত্রী গ্রুপের সভাপতি ও তুর্কি পার্লামেন্ট সদস্য মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ।

সাক্ষাতে দুই পক্ষ বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রগুলোতে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতা আরও জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করে। এ সময় মেহমেত আকিফ ইয়িলমাজ বলেন, তুরস্ক ও বাংলাদেশের মধ্যে গভীর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান দৃঢ় বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করেন তিনি।

ইয়িলমাজ বলেন, তাঁদের প্রতিনিধিদল রোববার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করেছে এবং তুর্কি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা, বিশেষ করে তুর্কি ফিল্ড হাসপাতালের মানবিক কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হয়েছে। এ সময় রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের প্রতি তুরস্কের অবিচল সমর্থনের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা। তুর্কি উদ্যোক্তাদের বাংলাদেশে বিনিয়োগের আহ্বান জানান তিনি।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের দুরবস্থা আমাদের সময়ের অন্যতম করুণ মানবিক সংকট। তারা শুধু মুসলমান বলেই এই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার এবং তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আট বছর ধরে আশ্রয়শিবিরে থাকায় রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ সুযোগ একেবারেই সীমিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থা হতাশা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ