শোভন কর্মসংস্থান ও বে টার্মিনাল নির্মাণে ৮৫ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক
Published: 24th, April 2025 GMT
গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাংলাদেশকে ৮৫ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে গতকাল দুটি চুক্তি সই করেছে সংস্থাটি।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ বে টার্মিনাল গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা ও জাতীয় সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার আধুনিকীকরণে সহায়তা করার লক্ষ্যে দুটি চুক্তি সই করেছে বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশ। মোট ৮৫ কোটি ডলারের দুটি ঋণ চুক্তি সই হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশবিষয়ক অন্তর্বর্তীকালীন কান্ট্রি ডিরেক্টর গেইল মার্টিন বলেন, টেকসই উন্নয়নের ধারায় টিকে থাকতে হলে বাংলাদেশে মান শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে প্রতিবছর শ্রমবাজারে যে প্রায় ২০ লাখ তরুণ প্রবেশ করছেন, তাঁদের জন্য এই শোভন কর্মসংস্থান সৃষ্টি অত্যাবশ্যক। এ ছাড়া এই ঋণের অংশ হিসেবে বাণিজ্য ও রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সবচেয়ে দুর্বল জনগোষ্ঠীকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থেকে উত্তরণে এবং চাকরির বাজারের জন্য প্রস্তুত হতে সহায়তা করা হবে। তিনি মনে করেন, এই পদক্ষেপ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনবে।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বে টার্মিনাল মেরিন ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (৬৫ কোটি ডলার) সামুদ্রিক অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বন্দরের সক্ষমতা ও কার্যকারিতা বাড়বে। সেই সঙ্গে পরিবহন খরচ ও সময় কমিয়ে বাংলাদেশের রপ্তানি সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে এই প্রকল্প। প্রকল্পে থাকছে ছয় কিলোমিটার জলবায়ু-সহিষ্ণু ঢেউনিরোধক এবং বন্দরে প্রবেশপথের মতো অপরিহার্য অবকাঠামো। গভীর সমুদ্রবন্দর তৈরি হলে বড় জাহাজ ভিড়তে পারবে। তাতে বন্দরে জাহাজ প্রবেশ ও বেরোনোর সময় কমবে। পরিণামে দৈনিক এক মিলিয়ন বা ১০ লাখ ডলার সাশ্রয় হবে।
এই বে টার্মিনালে বাংলাদেশের মোট ৩৬ শতাংশ কনটেইনার ওঠা–নামা করা হবে। এতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সরাসরি উপকৃত হবে। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হতে পারবেন।
অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে ২০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এই প্রকল্পে নগদ সহায়তা দেওয়ার পাশাপাশি ৪৫ লাখ মানুষের জীবিকার উন্নয়নে সহায়তা করা হবে। এর মূল লক্ষ্য থাকবে তরুণ জনগোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, নারী ও জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে আক্রান্ত অঞ্চলের শ্রমজীবী মানুষেরা। নগদ সহায়তার সঙ্গে এই প্রকল্পে দক্ষতা উন্নয়ন ও উদ্যোক্তা তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হবে। প্রায় ২৫ লাখ মানুষের কর্মযোগ্যতা ও আয় বৃদ্ধির সক্ষমতা তৈরি করা হবে এই প্রকল্পে।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব শাহরিয়ার সিদ্দিকী বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং দেশের উন্নয়ন আকাঙ্ক্ষা পূরণে সহায়তা করতে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে দৃঢ় এবং দীর্ঘস্থায়ী অংশীদারি আছে। এই প্রকল্পগুলো দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের ঘাত মোকাবিলা করা এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের নিশ্চিত অপরিহার্য ভূমিকা পালন করবে।
চুক্তিপত্রে বাংলাদেশের পক্ষে শাহরিয়ার সিদ্দিকী এবং বিশ্বব্যাংকের পক্ষে গেইল মার্টিন স্বাক্ষর করেন। অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট মার্টিন রেইজারও অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: এই প রকল প ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করেছে ৬৮% কারখানা
দেশের তৈরি পোশাক খাতের ৩৮৫টি কারখানার ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, নতুন ন্যূনতম মজুরি পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করেছে ৬৮ শতাংশ কারখানা। বাকি ৩২ শতাংশ বিভিন্ন কারণে সরকারের সর্বশেষ ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন করতে পারেনি। এসব কারখানার মধ্যে ২২ শতাংশ আগের চেয়ে মজুরি বাড়িয়েছে।
সাসটেইনেবল টেক্সটাইল ইনিশিয়েটিভ: টুগেদার ফর চেঞ্জ (স্টিচ) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে এ গবেষণা করে। গত বছরের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে জরিপ করা হয়। স্টিচ একটি বহুদেশভিত্তিক কর্মসূচি, যা তৈরি পোশাক এবং বস্ত্র খাতের সরবরাহ চেইনে থাকা শ্রম পরিস্থিতির উন্নয়নে কাজ করে। নেদারল্যান্ডস সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশে এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে এথিকাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভ, মনডিয়া এফএনভি এবং ফেয়ার ওয়্যার ফাউন্ডেশন।
শ্রমিক সংখ্যা বিবেচনায় ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নের হার বেশি। জরিপে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন ১ হাজার ১১৩ জন শ্রমিক। তাদের মধ্যে ৮১ শতাংশ ন্যূনতম মজুরি পান বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (ইপিজেড) থাকা সব কারখানা এবং ইপিজেডের বাইরে থাকা বড় কারখানাগুলো ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করেছে। যেসব কারখানা বাস্তবায়ন করেছে, তাদের ৮০ শতাংশ তৈরি পোশাক উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর সদস্য।
জরিপের ফল নিয়ে গত মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে শ্রমিক সংগঠন, উদ্যোক্তা, সরকার ও শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিনিধি এবং বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করেন। তারা পোশাকশিল্পের ব্যয়, শ্রমিকদের জীবনমান, তাদের ব্যয়ের ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে আরও গবেষণার সুপারিশ করেন। তারা ন্যূনতম মজুরির ওপর শিল্পের অংশীজন নিয়ে সংলাপেরও পরামর্শ দেন।
জরিপে ঢাকার ১৩৫টি, গাজীপুরের ১২৮টি, নারায়ণগঞ্জের ৭১টি, চট্টগ্রামের ৪৬টি, ময়মনসিংহের ৪টি এবং কুমিল্লার ১টি কারখানাকে নমুনা হিসেবে নেওয়া হয়। শ্রমিকদের মধ্যে ৬০ শতাংশ নারী এবং ৪০ শতাংশ পুরুষ। শ্রমিকের বাইরে সরকার, শ্রমিক সংগঠন, ট্রেড ইউনিয়ন, উদ্যোক্তা, বাণিজ্য সংগঠন এবং নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়।
২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে তৈরি পোশাক খাতের ওপর সরকার গঠিত ন্যূনতম মজুরি বোর্ড ইপিজেডের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি ১২ হাজার ৮০০ টাকা নির্ধারণ করে। ইপিজেডের বাইরের কারখানার জন্য নির্ধারণ করা হয় ১২ হাজার ৫০০ টাকা। এর আগে ২০১৮ সালে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৮ হাজার টাকা। উল্লেখ্য, সব গ্রেডে আলাদা ন্যূনতম মজুরি রয়েছে। তৈরি পোশাক বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্প খাত। এ খাতে শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি, যার অর্ধেকের বেশি নারী। কারখানার সংখ্যা চার হাজারের বেশি। এর মধ্যে প্রায় তিন হাজার বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএর সদস্য।
গবেষণার ফলাফলের বিষয়ে এথিকাল ট্রেডিং ইনিশিয়েটিভের পরিচালক (কর্মসূচি ও গবেষণা) মুনীর উদ্দীন শামীম সমকালকে বলেন, নমুনাভুক্ত যেসব কারখানা ঘোষিত ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি তার বেশির ভাগই মাঝারি বা ছোট কারখানা। অন্যদিকে ইপিজেডভুক্ত এবং বড় কারখানার বেশির ভাগ অতি অল্পসময়ে বাস্তবায়ন শুরু করতে পেরেছে। বাস্তবায়নকারী কারখানার ৮০ শতাংশ বিজিএমইএ অথবা বিকেএমইএর সদস্য। এর মানে তারা সরাসরি রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত। এ প্রবণতার একটি অর্থ হচ্ছে– কারখানাগুলোর বিদ্যমান সক্ষমতা মজুরি বাস্তবায়নে একটি বড় ফ্যাক্টর।
তিনি বলেন, গবেষণায় ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নে কিছু চ্যালেঞ্জ উঠে এসেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো–পরিচালন ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া, মজুরি বাড়ার হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্রেতাগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে পণ্যের দাম না বাড়ানো, প্রয়োজনীয় পুঁজির অভাব, পর্যাপ্ত প্রাতিষ্ঠানিক ঋণের ব্যবস্থা না থাকা, সরকারি সহযোগিতার অভাব, কিছু ক্ষেত্রে মালিকদের অনিচ্ছা, নিয়মিত ও ধারাবাহিক কার্যাদেশ না থাকা ইত্যাদি। অনেকে বলেছেন, বিদ্যুৎ, গ্যাসসহ সেবা খাতে ক্রমাগত মূল্যস্ফীতির কারণে তাদের পরিচালন ও উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সামগ্রিকভাবে ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নে অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে। অংশীজনরা আরও কিছু বিষয় উল্লেখ করেছেন। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনায় এমন মত এসেছে যে, ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নে তদারকি সংস্থাগুলোর তেমন কার্যকর উদ্যোগও দেখা যায় না। এছাড়া কার্যকর শ্রমিক প্রতিনিধিত্বের অভাব রয়েছে। কারখানা পর্যায়ে একটি কার্যকর শ্রমিক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা গেলে এবং মালিক-শ্রমিক পক্ষের মধ্যে কার্যকর সামাজিক সংলাপের সংস্কৃতি তৈরি করতে পারলে পারস্পরিক জবাবদিহিতার মধ্য দিয়ে ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন আরও সহজতর হয়ে উঠবে বলে তারা মনে করেন।
বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে বলেন, যারা ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়ন করতে পারছে না, তাদের ক্ষেত্রে প্রধান কারণ হলো– ক্রেতা ন্যায্য দাম দিচ্ছে না। তিনি জানান, কোনো কোনো কারখানার মালিক শ্রমিকদের নিয়োগের সময় ন্যূনতম মজুরি বাস্তবায়নের অক্ষমতার কথা আগেই বলে নেন। তবে ন্যূনতম মজুরি সব কারখানার বাস্তবায়ন করা উচিত। এ কারণে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ব্র্যান্ড–ক্রেতাদের সংগঠনগুলোকে পোশাকের দাম বাড়ানোর জন্য মধ্যস্ততা করতে হবে।
জরিপে পাওয়া আরও কিছু তথ্য
ন্যূনতম মজুরি সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন না করা কারখানার ৩৩ শতাংশ জানিয়েছে, তাদের পরিচালন ব্যয় আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। ২৪ শতাংশ জানিয়েছে, তারা ব্র্যান্ড ক্রেতাদের কাছ থেকে তেমন সহযোগিতা পাননি। যারা বাস্তবায়ন করেছেন, তাদের ৭৫ শতাংশ খরচ বাড়ার কথা জানিয়েছেন। জরিপের আওতায় থাকা ৮৩ শতাংশ কারখানা জানিয়েছে, নতুন মজুরি বাস্তবায়নে তারা সরকার কিংবা ক্রেতার সহযোগিতা পাননি। ইপিজেডের ১৮ শতাংশ এবং ইপিজেডের বাইরের ৩৩ শতাংশ কারখানা ক্রেতারা কিছুটা দাম বাড়িয়েছে বলে জানিয়েছে। শ্রমিকরা জানিয়েছেন, তাদের মজুরি বাড়লেও ক্রয়ক্ষমতা বাড়েনি। কেননা বাজারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বেশি হারে। অন্যদিকে অনেক ক্ষেত্রে পুরুষের সঙ্গে নারীর বেতনের বৈষম্য রয়েছে।