‘চিনিকল বন্ধ করি আগের সরকার তো হামার কপাল খাইছে। আখ চাষ কইরবার না পায়া খ্যায়া না খ্যায়া দিন কাটাওছি। মিল চালু করবে বলি ইউনূস সরকার আসি আখ চাষ কইরবার কইল। কিন্তুক সময় আসি গেইল, এলাও ক্যানবা খবরে নাই।’ কথাগুলো রংপুরের শ্যামপুর চিনিকল এলাকার আখচাষি দবির আলীর। ফের আখ চাষের আশায় জমি ফেলে রেখেছেন তিনি। মিল চালুর লক্ষণ না দেখে হতাশা প্রকাশ করে তিনি এসব কথা বলেন।
শ্যামপুর চিনিকল বন্ধ থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আখ রোপণের অনুমতি দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এতে ফের আশার আলো দেখেছিলেন কৃষক। অনুমতির প্রায় ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও এখনও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এতে দবির আলীর মতো আখচাষিরা হতাশা প্রকাশ করেছেন।
জানা গেছে, পাঁচ বছর আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রংপুরের শ্যামপুর, পাবনা, পঞ্চগড়, সেতাবগঞ্জ, রংপুর ও কুষ্টিয়া সুগার মিলে চিনি উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। সে সময় সংস্কার ও আধুনিকায়নের উদ্দেশ্যে বন্ধ করা হচ্ছে বলে জানানো হয়েছিল। এরপর পাঁচ বছর পার হলেও চালুর কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিগত সরকার। বন্ধ চিনিকলগুলো চালুর জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে প্রস্তাবনা পাঠালেও সে সময় কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার বন্ধ কলগুলো চালু করতে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। সে অনুযায়ী চিনিকল এলাকায় আখ চাষের অনুমতি দেওয়া হয়। এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। শ্যামপুরের আখচাষি সামছুজ্জামানের ভাষ্য, ‘সরকার চিনিকল এলাকায় আখ রোপণের সিদ্ধান্ত দিয়েছে শুনে শ্যামপুর এলাকার আখচাষিদের মধ্যে আশার আলো জেগেছিল। দীর্ঘদিনেও বীজ-সারসহ আনুষঙ্গিক বিষয়ে কোনো অগ্রগতি না থাকায় আমরা হতাশ।’
শ্যামপুর চিনিকল এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, আখ চাষের আশায় অনেক জমি ফেলে রেখেছেন কৃষক। তারা চারা রোপণের অপেক্ষায় রয়েছেন। অনেকে নিজ উদ্যোগে কিছু জমিতে চারা রোপণও করেছেন। কৃষকরা বলছেন, বাপ-দাদার আমল থেকে আখ চাষ করছেন। বিগত সরকার চিনিকল বন্ধ করে দেওয়ায় তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। পাঁচ বছর ধরে বিকল্প ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করেও লোকসান গুনতে হয়েছে। এখন নতুন করে অনুমতির খবরে তারা জমি ফেলে রেখেছেন। 
স্থানীয়ভাবে বড় আখচাষি হিসেবে পরিচিত আব্দুস সোবহান ও সাহেব আলী। তারা বলছিলেন, আগে চিনিকল এলাকায় ৭০টি ইক্ষু উন্নয়ন সহকারী পদ ছিল। তারা চাষিদের আখ চাষে উদ্বুদ্ধসহ বিভিন্ন পরামর্শ দিতেন। এবার তাদের এখনও মাঠ পর্যায়ে দেখা যায়নি। ছয়টি সাবজোন ছিল, যেখান থেকে চাষিদের বীজ-সার সরবরাহ করা হতো। এখনও সাবজোন গঠন করা হয়নি। 
আব্দুল কুদ্দুস, রওশন আলীসহ অন্য কৃষকরা জানান, আখের জমিতে অন্য ফসল ভালো হয় না। তারপরও বেঁচে থাকার তাগিদে বিগত পাঁচ বছর বিকল্প ফসল উৎপাদনের চেষ্টা করেছেন। লাভ হয়নি। কয়েকদিন পরে আখ রোপণের মৌসুম শুরু হবে। এখন পর্যন্ত বীজ-সার সহায়তার বিষয়ে কেউ যোগাযোগ করেনি। মিল চালু থাকাকালে ছয় হাজারের বেশি আখচাষি থাকলেও এখন সে সংখ্যা প্রায় শূন্যের কোঠায়। 
আওয়ামী লীগ সরকারের জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্তের ফলে শ্যামপুর চিনিকল পাঁচ বছর ধরে বন্ধ আছে বলে অভিযোগ করেছেন আখচাষি ও চিনিকল রক্ষা সংগ্রাম পরিষদ রংপুর জেলার আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন বাবলু। তিনি বলেন, এ চিনিকল হাজারো আখচাষি, শ্রমিক এবং শ্যামপুর এলাকার বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের বেঁচে থাকার অবলম্বন ছিল। এটি বন্ধ হওয়ায় এ অঞ্চলের অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। অবিলম্বে চিনিকল চালুসহ চাষিদের আখ চাষের পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
জানা গেছে, চিনিকল চালু রাখতে ৬০ হাজার টন আখের প্রয়োজন। পর্যাপ্ত আখ পাওয়া যাবে কিনা, এ নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিনে দেখা গেছে, বন্ধ থাকা শ্যামপুর চিনিকল জনমানবহীন ভূতুড়ে অবস্থায় রয়েছে। যন্ত্রপাতি-যানবাহন পাহারা দেওয়ার জন্য রয়েছেন হাতেগোনা কয়েকজন গার্ড। সঙ্গে রয়েছেন দুই-একজন কর্মকর্তা। বন্ধ হওয়ার আগে ৪৪৭ জন শ্রমিক কাজ করতেন। একজন এমডিসহ অন্তত ৪০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। তাদের অন্য চিনিকলে বদলি করা হয়েছে। 
কেউ কেউ স্বেচ্ছায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। বর্তমানে ১৬ থেকে ১৭ জন গার্ড রয়েছেন পাহারা দেওয়ার জন্য। টাস্কফোর্স সূত্র জানায়, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শ্যামপুর চিনিকল এলাকায় আড়াই হাজার একর জমিতে আখ চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। পরের বছর চার হাজার একরে চাষ হবে। এ সিদ্ধান্ত শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে নেওয়া হয়েছে।
এ তথ্য নিশ্চিত করে বন্ধ ছয় চিনিকল চালু করতে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটির সদস্য আলতাফ হোসেন বলেন, শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা, সচিবসহ কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠকের পর আখ চাষের অনুমতি দেওয়া হয়। চাষ করতে যেসব প্রস্তুতি গ্রহণ করা দরকার, তার কিছুই হয়নি। বন্ধ চিনিকল চালু করতে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে একটি বাজেট অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ ছাড় দিলে চাষ শুরু হবে।
 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ ন কল চ ন কল চ ল কর ছ ন চ বছর সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

পরাবাস্তবতার আবেদন কি ফুরিয়েছে

অবচেতনের মানচিত্র ধরে এক অন্তহীন অভিযাত্রা কবি–সাহিত্যিকেরা যুগ যুগ ধরে করে আসছেন। সাহিত্যের দীর্ঘ যাত্রাপথে এমন কিছু বাঁক আসে, যা তার গতিপথকে চিরতরে বদলে দেয়। পরাবাস্তবতা বা সুররিয়ালিজম ছিল এমনই এক যুগান্তকারী আন্দোলন, যা কেবল শিল্পের আঙ্গিক নয়; বরং শিল্পীর বিশ্ববীক্ষা এবং আত্মবীক্ষণকে সম্পূর্ণ নতুন এক দর্শন দান করেছিল। এটি ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ। এর মূল লক্ষ্য ছিল মানব মনের সেই গভীরে প্রবেশ করা, যেখানে যুক্তির আলো পৌঁছায় না; সেই অবচেতনের অন্ধকার মহাসাগর থেকে তুলে আনা বিস্মৃত স্বপ্ন, অবদমিত ইচ্ছা আর আদিম প্রবৃত্তির মণি–মুক্তা। পরাবাস্তবতা তাই কেবল একটি শিল্পরীতি নয়, এটি চেতনার শৃঙ্খলমুক্তির এক দুঃসাহসী ইশতেহার।

১৯২৪ সালে ফরাসি কবি ও লেখক আঁদ্রে ব্রেটন তাঁর ‘পরাবাস্তবতার প্রথম ইশতেহার’ (ম্যানিফেস্টো অব সুররিয়ালিজম) প্রকাশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা করেন। ব্রেটনের সংজ্ঞায়, পরাবাস্তবতা হলো, ‘বিশুদ্ধ মানসিক স্বয়ংক্রিয়তা, যার মাধ্যমে মুখ বা লেখনী দিয়ে অথবা অন্য যেকোনো উপায়ে চিন্তার আসল কার্যকারিতাকে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করা হয়। এটি যুক্তির সমস্ত নিয়ন্ত্রণ থেকে এবং সকল প্রকার নান্দনিক ও নৈতিক উদ্দেশ্য থেকে বিযুক্ত চিন্তার এক শ্রুতলিখন।’

এই দর্শনের প্রধান পাথেয় ছিল ভিয়েনার মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েডের যুগান্তকারী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্ব। ফ্রয়েড দেখিয়েছিলেন যে মানুষের সচেতন মনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক বিশাল অবচেতন জগৎ, যা তার আচরণ, স্বপ্ন ও ব্যক্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে। পরাবাস্তববাদীরা ফ্রয়েডের এই তত্ত্বকে লুফে নিয়েছিলেন। তাঁদের কাছে শিল্পসৃষ্টির উদ্দেশ্যই ছিল যুক্তির সেন্সরশিপকে ফাঁকি দিয়ে অবচেতন মনের এই লুকানো জগৎকে উন্মোচিত করা। তাঁরা চেয়েছিলেন, স্বপ্ন ও বাস্তবতাকে একীভূত করে এক ‘পরম বাস্তবতা’ বা ‘সুররিয়ালিটি’ তৈরি করতে।

পরাবাস্তবতা ছিল বিংশ শতাব্দীর ইউরোপের এক ক্ষতবিক্ষত সময়ের সন্তান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞ, ভিক্টোরীয় যুগের শুষ্ক নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের অতিনিয়ন্ত্রিত যুক্তিবাদ—এই সবকিছুর বিরুদ্ধে পরাবাস্তবতা ছিল এক শৈল্পিক ও দার্শনিক বিদ্রোহ।

পরাবাস্তবতার পদযাত্রা প্যারিসের শৈল্পিক পরিমণ্ডল থেকে শুরু হলেও এর ঢেউ খুব দ্রুতই বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। আঁদ্রে ব্রেটন ছিলেন এই আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা, কিন্তু তাঁর ছত্রচ্ছায়ায় সমবেত হয়েছিলেন বহু প্রতিভাবান স্রষ্টা, যাঁরা নিজ নিজ ভাষায় ও সংস্কৃতিতে পরাবাস্তবতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন।

আঁদ্রে ব্রেটন (জন্ম: ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৬—মৃত্যু: ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৬৬)

সম্পর্কিত নিবন্ধ