‘ছেলেরে সাজায়-গোছায় স্কুলে দিয়ে আসছিলাম। এক ঘণ্টা পরই স্কুল থেকে ফোন করে বলে, এখুনি আসেন। দৌড়ায় স্কুলে গিয়ে দেখি, চারদিকে নিস্তব্ধ। স্কুল ছুটি দিয়ে দিছে। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। একজন এসে বলল, রোহান চোখে ব্যথা পাইছে, প্রিন্সিপালের রুমে। সেখানে গিয়ে দেখি, আমার ছেলের চোখে ব্যান্ডেজ করে শোয়ায় রাখছে।’

২৮ এপ্রিল কুমিল্লার তিতাস উপজেলার নিজ বাড়িতে বসে এ কথাগুলো বলছিলেন ফারহান ইসলাম রোহানের (৭) মা মায়া আক্তার। প্রথম আলোর সঙ্গে কথাগুলো বলার সময় তাঁর চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছিল।

মায়া আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, গত বছরের ৩ সেপ্টেম্বর স্কুলশিক্ষকের স্কেলের আঘাতে তাঁর ছেলের ডান চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চিকিৎসার জন্য আট মাস ধরে ছেলেকে নিয়ে ছোটাছুটি করছেন তাঁরা। ছেলের চোখে দুবার অস্ত্রোপচার হয়েছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন, আঘাতে তার ডান চোখের দৃষ্টিশক্তি চলে গেছে।

শিশুটির বাবা রবিউল ইসলাম, তিনি ওমানপ্রবাসী। রবিউল-মায়া দম্পতির সন্তান ফারহান ঘটনার সময় উপজেলার বাতাকান্দি এলাকার সেবা মাল্টিমিডিয়া স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। এই তথ্য জানিয়ে মায়া বলেন, স্কুলটির সহকারী শিক্ষক রাহাতুল ইসলাম সৌরভ (২৫) ফারহানের দিকে স্কেল ছুড়ে মেরেছিলেন।

মায়া তাঁর তিন সন্তান নিয়ে স্বামীর পৈতৃক বাড়ি কুমিল্লার তিতাস উপজেলার বলরামপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ আকালিয়া গ্রামে থাকেন। ফারহানের যমজ বোন রয়েছে। এই বোন মাদ্রাসায় পড়ে। আর বড় বোন দশম শ্রেণির ছাত্রী।

ঘটনার বিষয়ে ফারহানের চাচা মোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা জানতে পেরেছেন, শিক্ষক রাহাতুল ক্লাসে মুঠোফোনে কথা বলছিলেন। ফারহানসহ ক্লাসের শিশুশিক্ষার্থীরা হইচই করলে শিক্ষক প্রচণ্ড রেগে যান। তিনি প্রথমে স্কেল দিয়ে ফারহানের পিঠে বাড়ি দেন। এতে স্কেল ভেঙে যায়। শিক্ষক নিজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার পরও হইচই বন্ধ হচ্ছিল না। তখন তিনি আরও রেগে যান। শিক্ষক ভাঙা স্কেলটি ফারহানের দিকে ছুড়ে মারেন। স্কেলটি ফারহানের ডান চোখে গিয়ে লাগে।

এ ঘটনায় গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর শিক্ষক রাহাতুলের বিরুদ্ধে তিতাস থানায় অভিযোগ করেন ফারহানের মা। অভিযোগে গুরুতর আঘাত করে চোখ নষ্ট করার কথা বলা হয়। অভিযোগটি মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধ করেছে তিতাস থানার পুলিশ। দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩২৬ ধারায় করা এই মামলায় সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করা-সংক্রান্ত নীতিমালা ২০১১’ জারি রয়েছে। এই নীতিমালা যথাযথভাবে অনুসরণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় তাগাদাও দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের চড়-থাপ্পড় দেওয়া, চুল টানা, কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা, ‘নিল ডাউন’ করে রাখা, দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে রাখা, স্কেল বা বেত দিয়ে মারার মতো শারীরিক শাস্তি দেওয়ার ঘটনা ঘটে। আর ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে সবার সামনে হাস্যাস্পদ করাসহ নানান মানসিক শাস্তি তো হরহামেশাই চলে।

রাজধানীর পুরান ঢাকার একটি ঐতিহ্যবাহী স্কুলে শিশুসন্তানেরা পড়ে জানিয়ে এক মা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর সন্তানেরা প্রায়ই অভিযোগ করে যে শিক্ষক বকা দেন। তারা একদিন স্কুলেও যেতে চাইছিল না। তিনি শিক্ষকের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শিক্ষক উল্টো ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখান।

রাজধানীর খ্যাতনামা একটি স্কুলে মেয়েরা চুল ঠিকভাবে বেঁধে না গেলে বড় ক্লাসের শিক্ষার্থীদের দিয়ে মাথায় তেল ঢেলে দেওয়ার ‘রেওয়াজ’ আছে বলে অভিযোগ করেন আরেক অভিভাবক। অন্যদিকে মাদ্রাসার শিক্ষকেরা শাসনের নামে ছাত্রদের ভয়াবহভাবে মারধর করছেন—এমন ভিডিও প্রায়ই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হতে দেখা যায়।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ ৩০ এপ্রিল পালিত হচ্ছে শিশুদের শারীরিক শাস্তি বিলোপের আন্তর্জাতিক দিবস। শিশুদের প্রতি সব ধরনের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলাই দিবসটির লক্ষ্য।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘের শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বাংলাদেশ পরিচালিত মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ অনুসারে, জরিপের সময়ের মাসখানেক আগে ২ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় ৮৯ শতাংশ শিশু পরিবারের সদস্যদের হাতে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। ৩০ শতাংশের শাস্তি গুরুতর ছিল। মা ও শিশুর লালন–পালনকারীদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ মনে করেন, শিশুদের শারীরিক শাস্তি দেওয়ার দরকার আছে। জরিপে ৭০ হাজারের বেশি শিশু এবং সাড়ে ৫৩ হাজারের বেশি মা ও শিশু লালন–পালনকারী অংশ নিয়েছিলেন।

‘পুতের ভবিষ্যৎ-স্বপ্ন সব গেল’

ছেলে ফারহানের ঘটনা শুনে বাবা রবিউল দেশে এসেছিলেন। তিন মাস তিনি দেশে থেকে ছেলের চিকিৎসার জন্য ছোটাছুটি করেন।

শিশুদের পেটানো হয়—এমন স্কুলে কেন ছেলেকে ভর্তি করেছিলেন, এ নিয়ে এখন আফসোস মা মায়া আক্তারের। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার পুতের এত বড় ক্ষতি কইরা দিল। আমার পুতেরে শেষ কইরা ফালাইল। পুতের ভবিষ্যৎ, স্বপ্ন সব গেল।’

কথাগুলো বলতে গিয়ে কান্না থামাতে পারছিলেন না মায়া আক্তার। ছেলের চিকিৎসা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বড় আশা নিয়ে ভারত গেছিলাম। ডাক্তাররা বলছে, এই চোখ আর ভালো হবে না।’

পরিবারটি বলছে, ঘটনার পর এলাকার একজন চিকিৎসকের কাছে ফারহানকে নিয়ে গিয়েছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। ওই চিকিৎসক শিশুর অবস্থা ভালো না জানিয়ে ঢাকা নিয়ে যেতে বলেন। এরপর তাঁরা প্রথমে কুমিল্লায়, পরে ঢাকার ইস্পাহানী ইসলামিয়া চক্ষু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল নিয়ে যান। সেখানে অস্ত্রোপচার হয়। পরে ঢাকার আরও দুটি হাসপাতালসহ চট্টগ্রামে তার চিকিৎসা করানো হয়। ভারতের হায়দরাবাদ ও চেন্নাইয়ের দুটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারসহ দেড় মাস চিকিৎসা শেষে গত ফেব্রুয়ারিতে ফারহানকে নিয়ে দেশে ফেরেন মা। এখন দেশে চিকিৎসক দেখাচ্ছেন।

ফারহানের চিকিৎসার পেছনে এখন পর্যন্ত ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানায় পরিবারটি। ফারহানকে গত ফেব্রুয়ারি মাসে উপজেলার দক্ষিণ আকালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। কিন্তু সে এখন এক চোখে কিছু দেখছে না। পড়তে গেলে তার মাথাব্যথা করে। তাই চিকিৎসকেরা তাকে পড়াশোনায় চাপ না দিতে বলেছেন।

ফারহানের মা মায়া আক্তার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এখন পর্যন্ত আসামি গ্রেপ্তার হলো না। তিনি এই ঘটনার বিচার চান।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা তিতাস থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মো.

কাউছার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আসামি পলাতক। আমরা তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি।’

স্কুল কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষকের পরিবার যা বলছে

স্কুলটির প্রতিষ্ঠাতা মো. শামীম সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা মিটমাটের জন্য বলেছিলাম। চিকিৎসা আমরা করাব বলেছিলাম। কিন্তু ফারহানের পরিবার কোনো আলোচনায় বসতে রাজি নন। তাঁরা বলেছেন, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা করাবেন। তো চিকিৎসা করাক।’

এটা কি মিটমাট করার বিষয়—এই প্রশ্ন করলে শামীম সরকার বলেন, ‘ছেলেটার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। সে ক্ষতি তো আর পূরণ করা সম্ভব নয়।’

স্কুলের শিক্ষকেরা এভাবে শিক্ষার্থীদের মারধর করেন কি না জানতে চাইলে শামীম সরকার বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের মারধর করা সম্পূর্ণ নিষেধ। এরপরও ওই শিক্ষক কেন এই কাজ করলেন, জানি না। ঘটনার পর তাঁকে বরখাস্ত করা হয়েছে।’

শিক্ষক রাহাতুলের মুঠোফোনে কল করলে এক নারী ধরেন। তিনি নিজের নাম বলেন শিল্পী আক্তার। পরিচয় দেন রাহাতুলের মা বলে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলে ইচ্ছা করে তো কাজটা করে নাই। বাচ্চারা চিল্লাচিল্লি করছিল, রাগের মাথায় স্কেল ছুড়ে মারছে।’

শিল্পী আক্তার জানান, রাহাতুল কুমিল্লার হোমনা ডিগ্রি কলেজের ডিগ্রি শেষ বর্ষের ছাত্র। ঘটনার ১০ মাস আগে রাহাতুল ওই স্কুলে চাকরি নিয়েছিলেন। রাহাতুলের বাবা মো. মোতাকাব্বির স্থানীয় একটি উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক।

ফারহানের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রসঙ্গে শিল্পী আক্তার বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য খরচ লাগলে দেব। আমরা চাই, ঘটনাটির একটি মীমাংসা হোক। কিন্তু ওই পরিবার (ফারহানের) কোনো আলোচনাতেই বসতে চায় না।’

‘কোনো শিক্ষার্থীকে আঘাত করতে পারেন না শিক্ষক’

বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ‘দ্য গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ টু এন্ড অল করপোরাল পানিশমেন্ট অব চিলড্রেন (জিআই)’ শিশুদের শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে ২০০১ সালে প্রচারাভিযান শুরু করে। ২০২০ সাল থেকে এই প্ল্যাটফর্ম ‘এন্ড করপোরাল পানিশমেন্ট’ নামে কাজ করে। এই প্ল্যাটফর্মের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ নিয়ে ২০২৪ সালের হালনাগাদ তথ্যে বলা হয়, স্কুলে শারীরিক শাস্তির বিরুদ্ধে জারি হওয়া নীতিমালাকে আইনে রূপ দেওয়া দরকার। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া বাংলাদেশে বাড়ি, দিবাযত্নকেন্দ্র, অভিযুক্তদের রাখার প্রতিষ্ঠানে (শিশু উন্নয়ন কেন্দ্র) এখনো শারীরিক শাস্তি নিষিদ্ধ হয়নি।

তিতাস উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সুমাইয়া মমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফারহানের ঘটনাটির পর প্রশাসনের তরফ থেকে তদন্ত কমিটি করে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল বলে প্রশাসনের এখানে সরাসরি হস্তক্ষেপের সুযোগ কম। অভিযুক্ত শিক্ষক ও তাঁর পরিবারকে ডাকা হয়েছিল। শিক্ষক আসেননি। কোনো শিক্ষক কোনো শিক্ষার্থীকে আঘাত করতে পারেন না।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রথম আল ক চ ক ৎসক উপজ ল র য গ কর র জন য পর ব র ইসল ম ঘটন র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

পাল্টা শুল্কের কারণে ক্রয়াদেশ কম

তৃতীয় দফা আনুষ্ঠানিক আলোচনা চলমান থাকা অবস্থায় আজ শুক্রবার থেকে বাংলাদেশি পণ্যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের আরোপ করা ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক কার্যকর হচ্ছে। বাড়তি শুল্কহার শেষ পর্যন্ত কত শতাংশে স্থির হয় সেটি ফয়সালা না হওয়ায় মার্কিন ক্রেতা প্রতিষ্ঠান আগামী মৌসুমে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ ২০ শতাংশ পর্যন্ত কম দিচ্ছে। আবার কিছু ক্রেতা প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত ক্রয়াদেশ না দিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে।

পাল্টা শুল্ক কার্যকরের সময় চলে এলেও তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা আগের মতো উদ্বিগ্ন নন। কারণ, দুই-তিন দিন ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও মার্কিন বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের কাছ থেকে যে ইঙ্গিত পাচ্ছেন তাতে বাংলাদেশের পাল্টা শুল্ক ভিয়েতনামের কাছাকাছি চলে আসতে পারে। এ ছাড়া প্রতিযোগী দেশ ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

তৈরি পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তারা বলছেন, বর্তমানে বসন্ত ও গ্রীষ্মের ক্রয়াদেশ আসার মৌসুম। তবে পাল্টা শুল্কের কারণে পণ্যের দাম বাড়বে। তাতে তৈরি পোশাকের বিক্রি কমবে। সেটি অনুমান করে মার্কিন বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিশ্রুতির চেয়ে ১০-২০ শতাংশ কম ক্রয়াদেশ দিচ্ছে। অনেক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান চূড়ান্ত ক্রয়াদেশ দিতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার কথা জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান ও ইন্দোনেশিয়ার কাছাকাছি নামিয়ে আনা গেলে বাংলাদেশের ভালো সম্ভাবনা তৈরি হবে। তার কারণ চীন থেকে ব্যাপক হারে ক্রয়াদেশ সরবে।

নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘পাল্টা শুল্ক নিয়ে আমরা খুব বেশি ভয় পাচ্ছি না এখন। তবে বাড়তি শুল্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পণ্যের চাহিদা কমবে। তাতে স্বাভাবিকভাবেই ক্রয়াদেশও কিছুটা কমতে পারে। বাড়তি শুল্ক কার্যকর ও শুল্কহার নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকলে আগামী ৩-৪ মাস হয়তো ক্রয়াদেশ কম থাকতে পারে। শেষ পর্যন্ত পাল্টা শুল্ক ভিয়েতনামের কাছাকাছি নামিয়ে আনতে পারলে ক্রয়াদেশ বাড়বে।’

যুক্তরাষ্ট্র যেসব দেশ থেকে পণ্য আমদানি করে, সেসব দেশের ওপর গত ২ এপ্রিল পাল্টা শুল্ক বা রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ আরোপ করেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের ৫৭টি দেশের ওপর বিভিন্ন হারে বাড়তি পাল্টা শুল্ক বসানো হয়। তখন বাংলাদেশের পণ্যের ওপর বাড়তি শুল্ক ছিল ৩৭ শতাংশ। তিন মাসের জন্য এ সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখার পর ডোনাল্ড ট্রাম্প ৮ জুলাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, বাংলাদেশের জন্য পাল্টা শুল্ক হবে ৩৫ শতাংশ, যা কার্যকর হবে ১ আগস্ট থেকে। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানিকারকেরা বর্তমানে গড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করেন। নতুন হার কার্যকর হলে তা ৫০ শতাংশে দাঁড়াবে।

যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা পাল্টা শুল্কহার কমাতে তৃতীয় দফার আলোচনা করতে বর্তমানে ওয়াশিংটনে রয়েছে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল। এই দলটি যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির (ইউএসটিআর) কর্মকর্তাদের সঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের আলোচনা শেষ করেছে। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।

দেশের তৈরি পোশাক খাতের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী ইভিন্স গ্রুপ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানি করে। তাদের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ২৫ শতাংশের গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।

জানতে চাইলে ইভিন্স গ্রুপের পরিচালক শাহ রাঈদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয়াদেশ আসার গতি বর্তমানে কিছুটা ধীর। পাল্টা শুল্ক শেষ পর্যন্ত কত দাঁড়ায় তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। তবে বাড়তি এই শুল্ক শেষ পর্যন্ত মার্কিন ক্রেতাদের দিতে হবে। ফলে বাড়তি শুল্ক কার্যকর হলে দেশটিতে বেসিক বা নিত্য ব্যবহার্য তৈরি পোশাকের বিক্রি কমবে। আমরা এসব সস্তা পোশাকই বেশি রপ্তানি করি। ফলে আমাদের রপ্তানি কমতে পারে।’

দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। ১৯৮৪ সালে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে রপ্তানি করে ৩০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক। তার একটি বড় অংশই যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে।

স্প্যারো গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শোভন ইসলাম বলেন, ‘মার্কিন বড় ব্র্যান্ড বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক সোর্সিং অপরিবর্তিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রতিশ্রুত ক্রয়াদেশ ১০-২০ শতাংশ কমিয়ে দিচ্ছে। এপ্রিলে আমরা যেসব ক্রেতা প্রতিষ্ঠানকে ৫ শতাংশের মতো মূল্যছাড় দিয়েছিলাম, সেটি বসন্ত ও গ্রীষ্ম মৌসুম পর্যন্ত অব্যাহত রাখতে অনুরোধ করছে।’

যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক শীর্ষ বড় বাজার। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ ৮৬৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ১৮ শতাংশের কিছু বেশি। যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হওয়া বাংলাদেশি পণ্যের ৮৫ শতাংশের বেশি তৈরি পোশাক। এ ছাড়া মাথার টুপি বা ক্যাপ, চামড়ার জুতা, হোম টেক্সটাইল, পরচুলা ইত্যাদি বেশি রপ্তানি হয়।

জানতে চাইলে তৈরি পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুল্ক নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় বর্তমানে ক্রয়াদেশ কিছুটা কম। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের প্রতিযোগী দেশের পণ্যে শুল্ক কত দাঁড়াচ্ছে তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এ ছাড়া আমাদের পাল্টা শুল্ক কমবে বলে আমরা আশাবাদী।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ