গাজাবাসীর ঈদ: ‘কোরবানি দেওয়ার মতো কিছু নেই শুধু নিজেদের ছাড়া’
Published: 6th, June 2025 GMT
গত ঈদের আগে আল-জাজিরা একটি ভিডিও প্রচার করে। সেখানে দেখা যায়, গাজার এক মা তাঁর ছয় বছর বয়সী মেয়ের কবরের পাশে বসে আছেন। মেয়েটি মারা গেছে ঈদের তিন দিন আগে এক বিমান হামলায়। মা তার জন্য যে লাল জামাটি কিনেছিলেন, সেটিই কবরের মাটির ওপর রেখে দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঈদে ওকে এটা পরিয়ে দিতাম। এখন ওর কবরের ওপর রেখে গেলাম। জামাটা ওর সঙ্গে যেন থাকে।’
লাখো মুসলমান যখন ঈদুল আজহার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত, তখন ফিলিস্তিনের গাজা এক মরুভূমির নিস্তব্ধতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে ঈদ নেই। আছে কেবল খালিপেটে দীর্ঘশ্বাস, ধ্বংসস্তূপে শিশুদের কান্না আর আশাহীন এক অপেক্ষা। একটু যদি কেউ রাজি হন নিজের আনন্দের মধে৵ ভাবতে, তাহলে মনে আসবেই—এই ঈদের উৎসব কি কেবল তাঁদের জন্য, যাঁদের ঘরবাড়ি আছে, রান্নাঘরে খাবার আছে; আর আছে নতুন জামার আনন্দে হাসতে জানা শিশু?
রাফা, খান ইউনিস ও গাজার শহর—সবখানেই মসজিদ ধ্বংস হয়ে গেছে। ঈদের নামাজ পড়া হয় খোলা মাঠে, কখনো কখনো ধ্বংসপ্রাপ্ত মসজিদের পাশে। বহু জায়গায় কোনো জামাতই হয় না। কারণ, নেই নিরাপদ জায়গা, নেই ইমাম, নেই মাইক্রোফোন।
নামাজের পরপরই কেউ কেউ কবর জিয়ারত করেন। কেউ আবার চোখের জলে হারানো স্বজনকে স্মরণ করেন। ২০২৪ সালের ঈদের দিনেও থামেনি বোমা হামলা। গাজার আল-মাঘাজি ক্যাম্পে চালানো হয় বিমান হামলা। এতে অন্তত ১১ জন নিহত হন, যাঁদের মধ্যে সাতজনই শিশু। ঈদের নামাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন যাঁরা, তাঁরা নতুন করে কবর খোঁড়ার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
‘কোরবানি দেওয়ার মতো আর কিছু নেই শুধু নিজেদের ছাড়া।’ কথাটি বলছিলেন নুহা আল নাজ্জার, গাজার এক মা। তাঁর পরিবারের ঈদ মানে প্রতিদিনের ক্ষুধা, বোমাবর্ষণের আওয়াজ আর শিশুদের কান্না। দুই বছরের আলমা দিনভর কাঁদছে শুধু এক বোতল দুধের জন্য। মাসের পর মাস একফোঁটা দুধ মেলেনি। একসময়ের ঈদ এখানে ছিল কাবাব, কিশোর-কিশোরীদের হাসি আর আত্মীয়স্বজনের আনাগোনা। এখন সেখানে কেবল ধ্বংসস্তূপ, ক্ষুধার্ত শরীর আর আতঙ্কে ভয়ে কাঁপতে থাকা মুখ।
রাফা সীমান্ত দিয়ে কিছু সাহায্যবাহী ট্রাক প্রবেশ করছিল গত ঈদের সময়। খাবারের জন্য হাহাকার এত তীব্র ছিল যে মানুষ একে অপরকে ধাক্কা দিয়ে উঠে পড়ে খাদ্যের গাড়িতে। চ্যানেল ফোর নিউজ জানায়, গমবাহী একটি ট্রাকে ধাক্কাধাক্কির ফলে ১২ জনের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে তিনজন ছিল শিশু।
গাজার ঈদ আর আমাদের ঈদ এক নয়। আমাদের জন্য এই পার্থক্য শুধু আবেগের প্রশ্ন নয়, নৈতিকতারও। আমাদের ঈদের আনন্দের সামনে গাজার শিশুদের ক্ষুধার্ত মুখগুলো যেন অদৃশ্য আয়না হয়ে ওঠে। যারা বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে, তাদের গল্পে ঈদ মানে এক নামহীন প্রার্থনা। এই প্রার্থনা শুধু গাজার নয়, আমাদের সবার হোক।নুহা বলেন, ‘আমি এক দিনে একটি শসা আর দুটি টমেটো কিনে তা ছোট ছোট টুকরায় ভাগ করি। সেটিই আমাদের দিনের একমাত্র খাবার।’ তাঁর এ কথায় কেউ ঈদের কোনো আমেজ পাবেন? না, এখানে আছে শুধু টিকে থাকার যুদ্ধ। ‘আমার একমাত্র ছোট ছেলেকে মিসরে পাঠানো হয়েছে চিকিৎসার জন্য। সে আমাকে ফোনে বলে, ‘মা, আমি সেই পুরোনো ঈদগুলোকে ফিরিয়ে আনতে চাই।’ আমি ওর কথা শুনে কাঁদি না। নিজের মুখ চাপা দিয়ে রাখি। যাতে ও না বুঝতে পারে আমি কতটা ভেঙে পড়েছি।’
নুহার ছোট মেয়ে মায়ার বয়স ১২। একসময় ঈদে তার আনন্দ দেখে চোখ জুড়িয়ে যেত। এখন সে চুপচাপ থাকে। ‘আমি জিজ্ঞাসা করি—কী রে, খিদে পেয়েছে? ও বলে, না। কিন্তু আমি জানি, ওর পেট খালি। ও জানে, ঘরে কিছু নেই। তাই অভিযোগ করে না।’
ঈদ মানেই শুধু এই দোয়া—আজ যেন কেউ ইসরায়েলিদের গুলি বা বোমায় মারা না যায়। ঘরবাড়ি নেই, বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই। ঈদের নতুন জামার তো প্রশ্নই ওঠে না। শুধু আছে এক বেলা কোনোভাবে বাঁচার খাবার খুঁজে পাওয়া; আর পরের বোমা কখন কোথায় পড়বে, সেই অপেক্ষা।
গাজার বাইরে থাকা মানুষেরাও সুখে নেই। নুহার বোন সামার এলউফ। ওরা এখন দোহায় আশ্রয়ে আছেন। তিনি একজন খ্যাতিমান ফটোসাংবাদিক। একসময় গাজার ঈদ উদ্যাপনের ছবি তুলতে বিভিন্ন জায়গা থেকে ওর ডাক পড়ত। আজ তাঁর ক্যামেরা কেবল শিশুদের মৃতদেহের ছবি তুলে রাখে। ‘প্রতিটা ছবি যেন আমার বুকে ছুরি চালায়’ বলেন সামার।
সামার বলেন, ‘আমি কিছুই করতে পারি না। কেবল চোখের পানি ফেলি আর বারবার খোঁজ নিই—আমার বোন, ওর সন্তানেরা এখনো বেঁচে আছে তো?’
তার পরও এই পরিবারের সদস্যরা ভালোবাসা আর স্মৃতিতে টিকে আছেন। ‘ঈদ এখন আমাদের হৃদয়ে একটি ক্ষত। সুখের স্মৃতি দুঃখের চেয়ে বেশি কষ্ট দেয়। তবু আমরা বিশ্বাস হারাই না। কারণ, ঘরে ফেরার স্বপ্ন আমরা এখনো দেখি’ বলেন নুহা।
অন্যদিকে পরিবার ছাড়া তৃতীয় ঈদ কাটাচ্ছেন লেখক শাদি সালেম। তিনি লিখেছেন, ‘গাজার ঈদ এখন আর উৎসব নয়, এটি প্রতিরোধের প্রতীক। ঈদ মানে শুধু একাকিত্ব নয়, এটি স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকার আর্তি।’
শাদি সালেমের মা ফোনে বলেন, ‘আমরা যতটা পারি, ততটাই করি। আমি আজ যাব আমার ভাইদের শহীদ পরিবারের কাছে, ঈদের শুভেচ্ছা দিতে।’ এই একটি বাক্য যেন গাজার হাজারো মায়ের মনের দৃঢ়তার কথা বলে।
‘আমরা চাই না কেউ আমাদের মতো কষ্টে থাকুক। সবাই যেন সুখে থাকে, শান্তিতে থাকে। শুধু দোয়া করি, সারা পৃথিবীর আর কেউ যেন এই বেদনার ভাগীদার না হয়।’ শেষে এই কথাটা বলছিলেন নুহা। কথাটায় কি অভিমান মিশে ছিল?
গাজার ঈদ আর আমাদের ঈদ এক নয়। আমাদের জন্য এই পার্থক্য শুধু আবেগের প্রশ্ন নয়, নৈতিকতারও। আমাদের ঈদের আনন্দের সামনে গাজার শিশুদের ক্ষুধার্ত মুখগুলো যেন অদৃশ্য আয়না হয়ে ওঠে। যারা বেঁচে থাকার জন্য লড়ছে, তাদের গল্পে ঈদ মানে এক নামহীন প্রার্থনা। এই প্রার্থনা শুধু গাজার নয়, আমাদের সবার হোক।
জাভেদ হুসেন প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী
(আলজাজিরা, আরব নিউজ, ডন, হিন্দুস্তান টাইমসের বিভিন্ন লেখা অবলম্বনে)
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: গ জ র ঈদ র আনন দ র জন য ঈদ ম ন এই প র পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬০ দিন পর শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীরা, উৎসবের আমেজ
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) দীর্ঘ ১৬০ দিন পর একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে টানা বৃষ্টি উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসেছেন। সকাল থেকেই ক্যাম্পাসে বইছে উৎসবের আমেজ।
সকালে কুয়েট ক্যাম্পাসে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস। ছাতা মাথায় দল বেঁধে ছুটছেন ক্লাসরুমের দিকে। কখনো এক ছাতার নিচে দু-তিনজন। কারও সঙ্গে অভিভাবকও এসেছেন। সকাল নয়টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি শিক্ষাবর্ষের প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী ক্লাসে যোগ দেন। নতুন উপাচার্য অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী বিভিন্ন বিভাগ ঘুরে শ্রেণি কর্মসূচি পর্যবেক্ষণ করেন।
ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড কমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং (ইসিই) বিভাগের ২২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী দীপ্ত বলেন, ‘আমাদের প্রায় এক সেমিস্টার নষ্ট হয়ে গেছে। এই সময়টা খুব অস্বস্তিতে কেটেছে। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েছে, তবে এখন আবার ক্লাস শুরু হওয়াটা ইতিবাচক দিক। আমরা আশাবাদী।’ একই ব্যাচের শিক্ষার্থী আম্মান বলেন, ‘অনেক দিন জীবনটা থেমে ছিল। আজকের দিনটা বিশেষ মনে হচ্ছে। ঠিক যেন স্কুলজীবনের প্রথম দিনের মতো। সব হতাশা কাটিয়ে আমরা অনেকটা নতুন করে শুরু করছি।’
হুমায়ুন কবির নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে বিল্ডিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়ে। পাঁচ মাস ধরে ক্লাস বন্ধ থাকায় ও মানসিকভাবে খুব চাপের মধ্যে ছিল। একসময় অসুস্থও হয়ে পড়ে। কুয়েটে এমন পরিস্থিতি আগে দেখিনি। কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব ঠিকভাবে পালন করলে হয়তো আগেই খুলে যেত। তারপরও এখন অন্তত খুলেছে, এটা বড় স্বস্তি।’
কুয়েটের ছাত্র পরিচালক আবদুল্লাহ ইলিয়াস আক্তার বলেন, আজ থেকে কুয়েটে ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে এখনো সব শিক্ষার্থী আসেননি। যাঁদের কেবল ক্লাস রয়েছে, তাঁরা অংশ নিচ্ছেন। যাঁদের পরীক্ষা ছিল, তাঁরা প্রস্তুতির জন্য কিছুটা সময় চেয়েছে। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন হবে ১৪ আগস্ট, ক্লাস শুরু ১৭ আগস্ট।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। ওই রাতেই তৎকালীন উপাচার্য ও কয়েকজন শিক্ষককে লাঞ্ছিত করার অভিযোগ ওঠে। এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ২৬ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ মাছুদ ও সহ-উপাচার্য অধ্যাপক শরিফুল আলমকে অব্যাহতি দেয়। ১ মে চুয়েটের অধ্যাপক হজরত আলীকে অন্তর্বর্তীকালীন উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনার বিচার দাবিতে ৪ মে থেকে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম বর্জনের ঘোষণা দেয় শিক্ষক সমিতি। এরপর কোনো শিক্ষকই ক্লাসে ফেরেননি। শিক্ষক সমিতির বিরোধিতার মুখে হজরত আলী দায়িত্ব পালন করতে না পেরে ২২ মে পদত্যাগ করেন।
এরপর ১০ জুন নতুন উপাচার্য নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয় সরকার। সেই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার কুয়েটের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মাকসুদ হেলালী। পরদিন শুক্রবার তিনি খুলনায় এসে দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল শিক্ষক সমিতির সাধারণ সভায় আন্দোলন কর্মসূচি তিন সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে গতকাল সোমবার ক্লাস শুরুর নোটিশ জারি করা হয়।