‘আমি ভুইলা গেছি তাগো কথা, তারা আমার কাছে মৃত’
Published: 9th, June 2025 GMT
বছর ঘুরে ঈদ আসে, ঈদের উৎসব শেষও হয়। পূজা আসে পূজা যায়। কিন্তু এমন বিশেষ দিনেও স্বজনদের দেখা পান না ফরিদপুরের শান্তি নিবাসের (বৃদ্ধাশ্রম) বাসিন্দারা। ফলে নিঃসঙ্গ অবস্থায় ঈদ পালন করেন তাঁরা। শান্তি নিবাসের চার দেয়ালের মধ্যে কখনো কখনো প্রিয় সন্তান-স্বজনদের কথা ভেবে মুখ লুকিয়ে নীরবে কাঁদেন। অতীতের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার দিনগুলো স্মরণ করে বুকে পাথর চেপে ঈদ কাটিয়ে দেন।
গত শনিবার (৭ জুন) উদ্যাপিত হয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা। এ উপলক্ষে গতকাল রোববার ফরিদপুর শহরের পূর্ব প্রান্তে টেপাখোলা লেকের পাড়ে অবস্থিত বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে জানা গেল, ঈদের দিনেও বাসিন্দাদের খোঁজখবর নিতে কারও কোনো সন্তান–স্বজন আসেননি। কারণ জানতে চাইলে বাসিন্দাদের কেউ কেউ বলছেন, ‘আমার কথা তারা ভুলে গেছে।’ ক্ষোভ প্রকাশ করে কেউ বলছেন, ‘আমার কাছে তারা মৃত।’ কেউবা কৌশলে এড়িয়ে গিয়ে বলছেন, ‘আজ তো সবাই ব্যস্ত, তাই হয়তো সময় করে উঠতে পারেনি।’
নড়াইলের বাসিন্দা লতিফ শিকদারের (৬০) এক বছর ধরে আশ্রয় হয়েছে শান্তি নিবাসে। এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা তিনি। স্ট্রোক করার কারণে এখন কথা বলতে পারেন না। দরজির কাজ করে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন। হঠাৎ করেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ হন। আবার স্ট্রোক করেন। ওই সময় থেকে তিনি কথা বলতে পারেন না। ছেলে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়, কিন্তু এরপর আর কোনো খবর নেয়নি। কিছুটা সুস্থ হয়ে প্রতিবেশীর মাধ্যমে এই শান্তি নিবাসে এসে আশ্রয় নেন।
লতিফ শিকদার বলেন, ‘অসুস্থ হইয়া পড়লে ছোয়ালডা আমারে হাসপাতালে রাইখা চইলা যায়। আর আমার খোঁজ নেয় নাই। আমি বাঁচলাম না মরলাম, সে খবরও নেয় নাই। আমিও আর তাগো কাছে ফিরা যাই নাই। আমি ভুইলা গেছি তাগো কথা। তারা আমার কাছে মৃত।’
দুজন এসেছেন দুই জায়গা থেকে। তবে হেলেনা ও ময়না বেগমের গল্পটা একই। বৃদ্ধাশ্রমে এসে হয়ে উঠেছেন একে অপরের সুহৃদ। গতকাল রোববার ফরিদপুর শহরের শান্তি নিবাসে (বৃদ্ধাশ্রম).উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আম র ক
এছাড়াও পড়ুন:
ঈদ আনন্দের রীতি ও পদ্ধতি
ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা মুসলমানদের প্রধান দুই ধর্মীয় উৎসব। ইসলামে উৎসব ও আনন্দের উপলক্ষ হিসেবেই দুই ঈদের প্রবর্তন ঘটেছে। আনাস বিন মালিক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় এসে দেখেন মদিনাবাসী নির্দিষ্ট দুটি দিনে খেলাধুলা ও আনন্দ করে থাকে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, এ দুটি দিন কিসের? সবাই বলল, জাহেলি যুগে আমরা এই দুই দিন খেলাধুলা করতাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, মহান আল্লাহ তোমাদের এ দুই দিনের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন। তা হলো, ঈদুল আজহা ও ঈদুল ফিতরের দিন। (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ১১৩৪)
দুই ঈদের ভেতর ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদ বিশেষ গুরুত্ব ও তাৎপর্য বহন করে থাকে। কেননা আদম (আ.) থেকে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সব নবী-রাসুলের শরিয়তে কোরবানির প্রচলন ছিল। যেমন-আদম (আ.)-এর দুই ছেলের ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে, “যখন তারা উভয়ে কোরবানি করেছিল, তখন একজনের কোরবানি কবুল হলো এবং অন্যজনের কবুল হলো না।” (সুরা মায়িদা, আয়াত : ২৭)
তবে কোরবানির ক্ষেত্রে মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহিম (আ.)-এর ত্যাগ ও স্মৃতির সবচেয়ে প্রজ্জ্বোল। কেননা তিনি নিজের কলিজার টুকরা সন্তানকে পর্যন্ত কোরবানি করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তার সন্তান ইসমাইল (আ.)-কে রক্ষা করেন এবং বিপরীতে পশু কোরবানির বিধান করেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আমি তাকে মুক্ত করলাম এক কোরবানির বিনিময়ে।” (সুরা সাফফাত, আয়াত : ১০৭)
আরো পড়ুন:
কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের ঈদ জামাত
শোলাকিয়ায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় ঈদের নামাজ আদায়
আত্মোৎসর্গ ও আত্মত্যাগের এই নির্মল সুখকে আল্লাহ উৎসবের মর্যাদা দিয়ে তার সঙ্গে ‘ঈদ’ যুক্ত করেছেন। ফলে মুসলমান ঈদ উদযাপন করে থাকে আল্লাহর আনুগত্য ও নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অনুসরণের মাধ্যমে।
ঈদে আনন্দের রীতি ও পদ্ধতি
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিম্নোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে ঈদে আনন্দ প্রকাশের নির্দেশ ও নির্দেশনা দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে-
১. তাকবির পাঠ করা : ঈদের দিন তাকবির পাঠ করার মাধ্যমে মুসলিমরা আনন্দ প্রকাশ করবে। ঈদুল আজহার সময় ৯ জিলহজ ফজর থেকে ১৩ জিলহজ আসর পর্যন্ত পাঠ করবে। সন্তান ইসমাইল (আ.)-এর জীবন রক্ষা পেলে ইবরাহিম (আ.) তাকবিরে তাশরিক পাঠ করেছিলেন। তা হলো,‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু, আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’
২. গোসল ও পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা : ঈদের আনন্দ প্রকাশের একটি মাধ্যম হলো গোসল করা এবং অন্যান্য শারীরিক বিষয় থেকে পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা। বিষয়টি বিপুল সংখ্যক সাহাবির আমলের মাধ্যমে প্রমাণিত। যেমন-আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) সম্পর্কে বলা হয়, তিনি এই দুই দিনে গোসল করতেন। (মুয়াত্তায়ে মালিক : ১/১৪৬)
৩. উত্তম পোশাক পরিধান করা : নিজের সামর্থ্য ও শরিয়তের সীমার মধ্যে থেকে ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করা উচিত। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘বাজারে বিক্রি হচ্ছিল এমন একটি রেশমি জুব্বা নিয়ে ওমর (রা.) আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আপনি এটি ক্রয় করে নিন। ঈদের সময় এবং প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় এটি দিয়ে নিজেকে সজ্জিত করবেন। তখন আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, এটি তো তার পোশাক যার পরকালে কল্যাণের কোনো অংশ নেই।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯৪৮)
এই হাদিসের মাধ্যমে বোঝা যায়, পোশাক গ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি নিজের সামর্থ্য ও শরিয়তের বিধি-বিধান অনুসরণ করবে।
৪. সুগন্ধি ব্যবহার করা : সুগন্ধি এবং সাজসজ্জা গ্রহণ করা মুস্তাহাব। ইমাম মালিক (রহ.) বলেন, ‘আমি জ্ঞানীদের বলতে শুনেছি, প্রত্যেক ঈদে সুগন্ধি ও সাজসজ্জা গ্রহণ করা মুস্তাহাব।’(আল মুগনি : ৫/২৫৮)
৫. পরস্পরকে অভিনন্দন জানানো : ঈদের দিন সাহাবায়ে কেরাম (রা.) পরস্পরকে এভাবে অভিনন্দন জানাতেন-, ‘আল্লাহ আমাদের ও তোমাদের পক্ষ থেকে গ্রহণ করুন।’ (ফাতহুল কাদির : ২/৫১৭)
৬. আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করা : এটি সারা বছরের সুন্নত। তবে এই দিনে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে। মুসলিম সমাজে এর সাধারণ প্রচলন আছে।
৭. ভালো খাবার গ্রহণ করা : ঈদ উৎসবের অনুষঙ্গ হলেও ইসলাম খাদ্যের কোনো সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রদান করেনি। বরং উত্তম খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করেছে, যেন প্রত্যেক মুসলমান নিজের সামর্থ্য, স্থানীয় রীতি-সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের আলোকে তা গ্রহণ করতে পারে। তবে শর্ত হলো, এসব খাবার হালাল ও স্বাস্থ্যকর হতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘আরাফার দিন, কোরবানির দিন ও আইয়ামে তাশরিক মুসলমানের ঈদের দিন। এগুলো খাওয়া ও পান করার দিন।’ (সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৩০০৪)
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অভ্যাস ছিল তিনি কোরবানির দিন সর্বপ্রথম কোরবানির পশুর গোশত খেতেন।
৮. বৈধ খেলাধুলা : ঈদের দিন বৈধ খেলাধূলা করা জায়েজ। হাদিসে এসেছে, ঈদের দিন মসজিদে নববীর আঙিনায় হাবশি বালকরা তীর নিক্ষেপের প্রতিযোগিতা করছিল এবং আয়েশা (রা.)-এর ঘরে বালিকারা গান গাইছিল। (সহিহ বুখারি)
৯. কোরবানি করা : কোরবানির দিন সামর্থ্যবান ব্যক্তিরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য অর্থ-সম্পদ ও পশুর মায়া ত্যাগ করার মাধ্যমে আত্মত্যাগের উৎসবে শামিল হয়। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় ১০ বছর অবস্থান করেন। তিনি প্রত্যেক বছর কোরবানি করেন।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ১৫০৭)
১০. গোশত খাওয়া ও অন্যকে খাওয়ানো : আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, ‘রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার পরিবারকে কোরবানির এক-তৃতীয়াংশ আহার করাতেন, প্রতিবেশীদের এক-তৃতীয়াংশ আহার করাতেন আর ভিক্ষুকদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ সদকা করতেন।’ (আল-মুগনি : ৯/৪৪৯)
আল্লাহ সবাইকে সঠিকভাবে দ্বীন পালনের তাওফিক দিন। আমিন।
লেখক: মুহাদ্দিস, সাঈদিয়া উম্মেহানী মহিলা মাদরাসা, ভাটারা, ঢাকা
ঢাকা/শাহেদ