কুষ্টিয়ায় তৈরি হচ্ছে নামিদামি ব্যান্ডের নকল সিগারেট
Published: 18th, June 2025 GMT
কুষ্টিয়ায় একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট নতুন কৌশলে তামাক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যবসার আড়ালে তারা জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারখানা নির্মাণ করে বিশ্বের নামিদামি ব্যান্ডের নকল সিগারেট তৈরি করছে। এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্বে রয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তার ব্যবসায়িক পার্টনার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্যানেল মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুস সবুর লিটন।
গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর পালিয়ে গেছেন নওফেল ও লিটন। আত্মগোপনে থেকেও তারা ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন। পরিবর্তন করেছেন কোম্পানির নাম। আওয়ামী লীগের পরিবর্তে অবৈধ ব্যবসার শেল্টার দিচ্ছেন বিএনপি নেতারা। স্থানীয় বিএনপি নেতাদের ছত্রছায়ায় কুষ্টিয়ার তিন উপজেলায় নওফেল সিন্ডিকেটের একাধিক অফিস ও কারখানা চালু হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে বিদেশি নামিদামি কোম্পানির নকল সিগারেট তৈরি ও নকল ব্যান্ডরোল লাগিয়ে বাজারে সরবরাহ করে আসছে নওফেল-লিটন সিন্ডিকেট। লিটন ২৫নং চট্টগ্রাম রামপুর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও খালিশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য।
‘বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো’ ও ‘তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর’ মাধ্যমে নওফেল ও লিটন রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে লোপাট করেছেন হাজার কোটি টাকা। ৫ আগস্টের পর ঢাকায় তাদের একাধিক কারখানায় অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ এই রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড।
গণ-অভ্যুত্থানের পর নওফেল ও লিটন পালিয়ে গেলেও কুষ্টিয়ায় থেমে নেই তাদের অবৈধ ব্যবসা। কৌশলের অংশ হিসাবে ওই দুই কোম্পানির নাম পালটে রাখা হয়েছে ‘জেনুইন লিফ টোব্যাকো’। অফিস-কারখানায় ঝোলানো হয়েছে নতুন নামের সাইন বোর্ড। তবে নতুন নামে কার্যক্রম শুরু হলেও একই অফিসে একই কর্মকর্তারা রয়েছেন।
একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, বর্তমানে কুষ্টিয়া অঞ্চলে নওফেল-লিটন সিন্ডিকেটের সব কার্যক্রম পারিচালনা করছেন তিনজন কর্মকর্তা। তারা হলেন সিইও জাহিদ, জিএম বেলাল হোসেন ও নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান।
কুষ্টিয়ার ত্রিমোহনী এলাকায় জেনুইন লিফ টোব্যাকোর অফিসে সরেজমিন দেখা যায়, অফিসে কোনো কর্মকর্তা নেই। নিরাপত্তাকর্মীসহ কয়েকজন কর্মচারী রয়েছেন। তারা জানান, বেশ কিছু দিন কোনো স্যার অফিসে আসছেন না। এর বেশি কিছু তারা বলতে রাজি হননি। তাদের চোখে-মুখে ছিল আতঙ্কের ছাপ।
স্থানীয় যুবক মিলনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভবনটি ভাড়া নিয়ে কয়েক বছর ধরে অফিসের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো। ৫ আগস্টের পর নাম পালটে ফেলা হয়েছে। তবে অফিসের আসবাবপত্র পরিবর্তন করা হয়নি এবং যারা এখানে কর্মরত ছিলেন তারাই রয়েছেন।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর ও ভেড়ামারা উপজেলায় একাধিক গোপন কারখানায় নামিদামি ব্যান্ডের নকল সিগারেট তৈরি করছে ‘জেনুইন লিফ টোব্যাকো’।
দৌলতপুর উপজেলার খলিসাকুন্ডি ইউনিয়নের নাজিবপুর ও প্রতাপপুরে এবং আড়িয়া ইউনিয়নের বড়গাংদিয়ার জহুরাগঞ্জ মাঠে নকল সিগারেট তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়েছে।
উপজেলা বিএনপির দুই প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় কারখানার মধ্যে অনেকটা প্রকাশ্যে তৈরি হচ্ছে নকল সিগারেট। বিএনপি নেতাদের হুমকিতে এসব বিষয়ে স্থানীয় কেউ মুখ খুলতে সাহস পায় না।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান হাবলু মোল্লা বলেন, “তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকোর সঙ্গে আমার কোনো ব্যবসায়িক সম্পর্ক নেই। তবে আমার জমিতে তারা ইন্টারন্যাশনাল ওয়্যার হাউজ নির্মাণ করে তামাক ক্রয় করে। আমি নিজেও তাদের কাছে তামাক বিক্রয় করি। পরে মজুতকৃত তামাক তারা বিদেশে রপ্তানি করে। তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নাম পরিবর্তন করে কিছু দিন আগে জেনুইন টোব্যাকো কোম্পানি নামকরণ করা হয়েছে।”
এদিকে ১০ জুন রাতে কুষ্টিয়া শহরের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে সাফিনা টাওয়ারের গ্যারেজ থেকে ভারতে নিহত সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনারের কোটি টাকা দামের ল্যান্ড ক্রুজার প্রাডো ব্র্যান্ডের গাড়িটি উদ্ধার করে পুলিশ। গ্যারেজটি ভাড়া নিয়েছিল ‘জেনুইন লিফ টোব্যাকো’।
টাওয়ারের মালিকের সঙ্গে ভাড়ার চুক্তিপত্রে জেনুইন লিফ টোব্যাকোর পক্ষে স্বাক্ষর করেন মেহেরপুর জেলার গাংনী পৌরসভার বাঁশবাড়িয়া দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমান খোকন। আনারের গাড়িটি খোকনের ভাড়া করা পার্কিং স্পেসেই ছিল।
এই খোকন গাংনী পৌর বিএনপির সাবেক সভাপতি। গাড়িটি নওফেলের মাধ্যমে কোম্পানির লোকজন এখানে নিয়ে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনার পর থেকে কোম্পানির সিইও জাহিদ, জিএম বেলাল হোসেন ও নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান গা-ঢাকা দিয়েছেন। তাদের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও পাওয়া যায়নি। তাদের অফিসে গিয়েও কেয়ারটেকার দারোয়ানকে ছাড়া কাউকে পাওয়া যায়নি।
জেনুইন লিফ টোব্যাকো কোম্পানির পাবলিক রিলেশন অফিসার এ এম সালেহীন তৌহিদ বলেন, “কোম্পানির বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমি নতুন যোগদান করেছি, কিছুই জানি না। স্যাররা কোথায় আছেন তাও বলতে পারব না।”
পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সামনের ভবনের নিরাপত্তাকর্মী আশিকুর রহমান বলেন, “গত বছরের ১ জুলাই খোকন নামের এক ব্যক্তি ভবনের তিনটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেন। তিনি তামাক কোম্পানিতে বড় পদে রয়েছেন।”
দৌলতপুরের বিএনপি নেতা ও তামাক ব্যবসায়ী আসাদুজ্জান আসাদ বলেন, “আমি তারা কোম্পানির সঙ্গে কোনো ব্যবসা করি না। গত বছর করেছিলাম। কিন্তু লেনদেন ভালো না হওয়ায় এবার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছি। এ বছর বিএনপির অন্য নেতা তাদের সঙ্গে ব্যবসা করছেন।”
কুষ্টিয়া পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অর্থ ও প্রশাসন) ফয়সাল মাহমুদ বলেন, “এ ধরনের কোনো সিন্ডিকেটের সুনির্দিষ্ট তথ্য পুলিশের কাছে নেই। তবে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে কাজ করছে পুলিশ। গাড়িটি কারা কীভাবে এখানে এনেছে, এসব মাথায় নিয়েই পুলিশ কাজ করছে।”
ঢাকা/কাঞ্চন/এস
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর জ ন ইন ল ফ ট ব য ক নকল স গ র ট ত র র নকল স গ র ট কর মকর ত ব এনপ র নওফ ল ও র রহম ন দ লতপ র এক ধ ক আওয় ম উপজ ল ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগে যশোর আইনজীবী সমিতির চার সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার
অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে যশোর আইনজীবী সমিতির চার সদস্যকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বিকেলে সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় ওই চারজনের কারণ দর্শানো নোটিশের জবাবের শুনানি শেষে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
বহিষ্কৃত সদস্যরা হলেন আইনজীবী আবদুর রাজ্জাক, সৈয়দ কবির হোসেন, রফিকুল ইসলাম রফিক ও তরফদার আবদুল মুকিত। তাঁদের বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আদালতের সব কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।
এ সমিতির সাধারণ সম্পাদক এম এ গফুর বলেন, ‘অভিযোগ প্রমাণিত হওয়াতে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেউ সমিতির নিয়মনীতির ঊর্ধ্বে নন। বৃহস্পতিবার ওই চার সদস্যকে বহিষ্কারের বিষয়টি নোটিশ দিয়ে জানানো হবে।’
সমিতি সূত্রে জানা গেছে, যশোর জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য সৈয়দ কবির হোসেনের (জনি) কাছে ৩৫ লাখ টাকায় শহরের বারান্দীপাড়া কদমতলা এলাকায় জমি বিক্রি করেন ইমরান হাসান। জমি রেজিস্ট্রির আগে সব টাকা পরিশোধের কথা থাকলেও সৈয়দ কবির হোসেন ১০ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। বাকি ২৫ লাখ টাকা না দিয়ে টালবাহানা করতে থাকেন। পরে তিনি আরও ১৭ লাখ টাকা দেন। বাকি ৮ লাখ টাকা চাইলে হুমকি দিতে থাকেন কবির হোসেন। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে ইমরান হাসান আইনজীবী সমিতি বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন।
সমিতির নির্বাহী কমিটির সভায় তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর শুনানি শেষে কবির হোসেনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় সমিতির সুনাম ক্ষুণ্ন করায় গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কবির হোসেনকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।
এ বিষয়ে আইনজীবী কবির হোসেন বলেন, ‘বহিষ্কারের বিষয়টি আমি শুনেছি। তবে যে বিষয়ে আমাকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সেই বিষয়ে অভিযুক্ত আমি নই। তারপরও আইনজীবী সমিতি আমার অভিভাবক; তারা যে ব্যবস্থা নিয়েছে, তার বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।’
অন্যদিকে অভয়নগরের নওয়াপাড়ার জয়েন্ট ট্রেডিং করপোরেশন পাওনা টাকা আদায়ে আবদুর রাজ্জাককে মামলার আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত আবদুর রাজ্জাক আটটি চেকের মামলা পরিচালনা করেন। এসব মামলার রায় ও আপিল বাদীর অনুকূলে যাওয়ার পর আটটি চেকের ৪১ লাখ ১২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে নেন আবদুর রাজ্জাক। এ টাকা জয়েন্ট ট্রেডিং কর্তৃপক্ষকে না দিয়ে তিনি ঘোরাতে থাকেন। চলতি বছরের ৪ জুন তিনি ১৫ লাখ টাকার একটি চেক দেন। চেকটি ব্যাংকে জমা দিলে পর্যাপ্ত টাকা না থাকায় নগদায়ন করা যায়নি। টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে জয়েন্ট ট্রেডিং করপোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল ওহাব গত ২৮ জুলাই আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে যশোর আইনজীবী সমিতি বরাবর অভিযোগ করেন।
এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আবদুর রাজ্জাককে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় যশোর আইনজীবী সমিতি। নোটিশের জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় আবদুর রাজ্জাককে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সাময়িক বহিষ্কার করা হয়। এ ছাড়া রফিকুল ইসলাম রফিক তাঁর সহকর্মীর সঙ্গে অসদাচরণ ও মামলা করতে টাকা ও কাগজপত্র নিয়ে মামলা না করায় সমিতির সুনাম ক্ষুণ্ন করায় সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আইনজীবী তরফদার আবদুল মুকিতের বিরুদ্ধেও নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তাঁকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।