“তিনটা সন্তান, অসুস্থ স্বামী আর মা... সংসার চালাই কেমনে, আল্লাহই জানেন”- জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে রোদ-বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় এসব কথা বলছিলেন এক নারী।

তিনি ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পের একজন তথ্যসেবা সহকারী। কাজ করেন দরজায় দরজায় গিয়ে নারীদের ডিজিটাল সেবা, পরামর্শ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে। মাস শেষে পান মাত্র ১৫ হাজার ৬৫০ টাকা; তাও গত ৫ মাস ধরে বকেয়া।

এই নারীর মতো আরো প্রায় ২ হাজার তথ্য আপা হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। ১৪ বছরের পুরনো নারী ক্ষমতায়নের সফল সরকারি প্রকল্প ‘তথ্য আপা: তথ্যযোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন’ চলছে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ৩০ জুন শেষ হচ্ছে প্রকল্পের মেয়াদ। ফলে তাদের ভবিষ্যৎ সম্পূর্ণ অজানা।

আরো পড়ুন:

আশুলিয়া প্রেস ক্লাবের সভাপতি মোজাফফর, সম্পাদক নিপু

’৬৪ বছর সাংবাদিকতার আদর্শ ধরে আছে পাবনা প্রেস ক্লাব’

অনিশ্চয়তার মুখে এক সফল উদ্যোগ

২০১১ সালে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া ‘তথ্য আপা’ প্রকল্পটি দ্বিতীয় পর্যায়ে বিস্তৃত হয় দেশের ৪৯২টি উপজেলায়। সরকারি অর্থায়নে গড়ে ওঠা তথ্যসেবা কেন্দ্রগুলো নারীদের জন্য হয়ে উঠেছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, ব্যবসা, আইন ও অনলাইন সেবা সম্পর্কে জানার এক নির্ভরযোগ্য মাধ্যম।

তিনজন করে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রতিটি কেন্দ্রে নিয়োজিত হয়েছিলেন ২ হাজার ৪৮৪ জন। এদের অনেকেই শিক্ষকতা বা বেসরকারি চাকরির সুযোগ ছাড়েন রাজস্বখাতে অন্তর্ভুক্তির আশায়।

বেতন নেই ৫ মাস, নেই আশ্বাসও

২০২৪ সালের জুলাই থেকে একে একে বন্ধ হতে থাকে প্রকল্পের অর্থায়ন। ডিসেম্বর পর্যন্ত কোনো বেতন পাননি কর্মীরা। এরপরও কেবল ১ মাসের বেতন দেওয়া হয়, তাও ধার করে। এখনো ৫ মাসের বেতন বাকি।

২০২৫ সালের ২ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালক শাহনাজ বেগম স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে জানানো হয়, ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তাই অফিস ও কেন্দ্র খালি করে দিতে হবে। এরপর থেকে আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন কর্মীরা।

বেতন চেয়ে লজ্জা পান তথ্য আপারা

প্রতিদিন দোকানে বাকি বাড়ছে, সন্তানদের স্কুল ফি দেওয়া যাচ্ছে না, হাসপাতালে যাওয়ার টাকা নেই। এমন পরিস্থিতিতে দিন কাটাচ্ছেন নারী কর্মীরা। অথচ এরা বদলে দিয়েছিলেন প্রান্তিক নারী জীবনের চিত্র।

প্রতিমাসে দুইটি উঠান বৈঠকে নারীদের প্রশিক্ষণ, স্বাস্থ্য পরামর্শ, অনলাইন সেবা ও ব্যবসায়িক সহায়তা দেওয়া হত। গ্রামের অনেক নারী শিখেছিলেন নিজের সমস্যা নিজেই চিহ্নিত করতে এবং তার সমাধান খুঁজে পেতে।

আইপি টিভি, লালসবুজ ডটকম, ই-কমার্স, ফেসবুক লাইভ প্রশিক্ষণ এসব প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যমেই নারী জীবনে এসেছিল পরিবর্তন। অথচ এখন সেই নারীরাই জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

বুধবার জাতীয় প্রেসেক্লাবের মামনে সালেহা নামে একজন বলেন, “মানুষ হাসে। বলে, সরকারি চাকরিজীবী হয়ে বেতন চেয়ে ঘুরেন ক্যান?”

আরেকজন বলেন, “তিনমাসে একটাও উঠান বৈঠক হয়নি। নারী উদ্যোক্তাদের ফোন ধরাও কষ্টকর হয়ে গেছে।”

রাজস্বখাতে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি শুধু কাগজে

প্রকল্প শুরুর সময় বারবার বলা হয়েছিল, ‘সফল হলে কর্মীদের রাজস্বখাতে স্থানান্তর করা হবে’। এ আশায় অনেকে স্থায়ী চাকরি ছেড়েছিলেন। আজ তারা শুনছেন তৃতীয় ডিপিপি সংশোধনের সম্ভাবনা নেই, বরাদ্দও আসছে না।

জাতীয় মহিলা সংস্থার যুগ্ম-সচিব ও প্রকল্প পরিচালক শাহনাজ বেগম বলেন, “আমরা দুই কিস্তিতে বেতন দেওয়ার চেষ্টা করছি। নতুন প্রকল্পে এ জনবল কীভাবে নেওয়া যায়, দেখা যেতে পারে।”

নারীর ক্ষমতায়ন কি শুধুই প্রচারণার মুখবন্ধ?

গত ১৬ জুন থেকে প্রেসক্লাবের সামনে অনশন কর্মসূচি শুরু করেন তথ্য আপারা। তারা বলছেন, আমরা চাই না দয়া, আমরা চাই আমাদের কাজের স্বীকৃতি।

রাজনৈতিক দলগুলো এই আন্দোলনে সংহতি জানিয়েছে। গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি বলেন, “নারীকে বাদ দিয়ে, অভিজ্ঞদের সরিয়ে নতুন করে নিয়োগ দেওয়া হলে সেটি হবে রাজনৈতিক প্রতিশোধ।”

আমার বাংলাদেশ পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, “সরকার যদি মানবিক হত, এত নারীর কান্না দেখে নিশ্চয়ই বিবেক জাগ্রত হত।”

আন্দোলনকারী  মুনিরা বেগম বলেন, “তথ্য আপা এখন কেবল একটি সরকারি প্রকল্প নয়, এটি হাজার হাজার নারীর আত্মপরিচয়, কর্মসংস্থান, সামাজিক সম্মান ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রতীক। তাদের বাদ দিয়ে ‘নারীর ক্ষমতায়ন’ শব্দটি উচ্চারণ মানেই হবে এক নির্মম ব্যঙ্গ।”

আন্দোলন পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও ঝালকাঠি তথ্যসেবা কর্মকর্তা সঙ্গীতা সরকার জানান, পরীক্ষার মাধ্যমে তারা নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। কারো সুপারিশে নয়। নিয়োগের সময় প্রকল্প শেষে নতুন পদ সৃষ্টি করে জনবলকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হবে- এমন কথা বলা হয়েছিল। উচ্চশিক্ষিত নারীরা সেসব দেখেই প্রকল্পের চাকরিতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে রাজস্ব খাতে নিতে সুবিধা হবে জানিয়ে তাদের যা বেতন ধরা হয়েছিল, তা থেকে টাকা কেটে নেওয়া হয়। সেই পাওনাও তারা পাচ্ছেন না।

২০১১ সালে পাইলট আকারে ১৩টি উপজেলায় তথ্য আপা প্রকল্প শুরু হয়। পরে ২০১৮ সালের শেষ দিকে ৪৯২টি উপজেলায় প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয়। ২০২২ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়। পরে তা দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়। গত বছর আরো ১ বছর বাড়িয়ে ২০২৫ সালের ৩০ জুন করা হয়। সে হিসেবে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হতে আর ১৪ দিন বাকি।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘জাতীয় মহিলা সংস্থা’র বাস্তবায়ন করা এ প্রকল্পের পুরো নাম ছিল ‘তথ্য আপা: ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে মহিলাদের ক্ষমতায়ন’। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে ‘তথ্য আপা: তথ্য-যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়) (২য় সংশোধিত)’।

ঢাকা/মেহেদী

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর উদ য ক ত প রকল প র ম য় দ ন প রকল প হয় ছ ল ৩০ জ ন সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ পূর্তি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক

পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের ‘কবর’ কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। ১৯২৫ সালে লেখা অমর এ কবিতার শতবর্ষ এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ‘কবর’ কবিতা তৎকালীন সময়ের সমাজের চিত্রকে তুলে ধরেছে।

‘কবর’ কবিতার শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত ‘শতবর্ষে কবর’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে এ কথা বলেন বক্তারা। শনিবার বিকেলে রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

‘শতবর্ষে কবর’ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন মফিজ ইমাম মিলন। ৪৮ জন লেখকের লেখা নিয়ে প্রকাশিত এই গ্রন্থ প্রকাশ করেছে নয়নজুলি প্রকাশনাী।

অনুষ্ঠানে অতিথিদের বক্তব্যে উঠে আসে জসীমউদ্‌দীনের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি ‘কবর’ কবিতার নানান প্রসঙ্গ। কবিতাটি ১৯২৫ সালে ‘গ্রাম্য কবিতা’ পরিচয়ে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায়।

আলোচকেরা বলেন, ‘কবর’ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বিপুল সাড়া জাগিয়েছিল। কবিতাটি দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। এমনকি ‘কবর’ পড়ে দীনেশচন্দ্র সেন ‘অ্যান ইয়াং মোহামেডান পোয়েট’ শিরোনামে একটি আলোচনাও লিখেছিলেন ফরওয়ার্ড পত্রিকায়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির বক্তৃতায় শিক্ষা উপদেষ্টা চৌধুরী রফিকুল (সি আর) আববার বলেন, ‘কবর’ কবিতার শত বছর পূর্তির ঘটনা একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। কবিতাটির শতবর্ষ নিয়ে বই প্রকাশ ব্যতিক্রমী প্রয়াস।

এ সময় শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, প্রতিটি শহরে ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের মতো সংগঠন থাকা উচিত। একটা বৃহত্তর পরিবারের মতো কাজ করে তারা। তিনি বলেন, এ ধরনের নাগরিক সমাজ রাষ্ট্রের বাইরে থেকে দেশ ও সমাজ সম্পর্কে ভাবে। এটা বিশাল শক্তি।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ফরিদপুর ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জালাল আহমেদ। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক আন্দালিব রাশদী, পক্ষিবিশারদ ইনাম আল হক, কথাসাহিত্যিক ফারুক মঈন উদ্দীন। গবেষক, সাংবাদিক ও ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মফিজ ইমাম মিলনের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন নয়নজুলি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আলী খান, অধ্যাপক এম এ সামাদ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ কাকলী মুখোপাধ্যায়, ডেইলি স্টারের সাহিত্য সম্পাদক ইমরান মাহফুজ প্রমুখ।

‘শতবর্ষে কবর’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান শুরু হয় ‘কবর’ কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে। স্বাগত বক্তব্য দেন ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আলতাফ হোসেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ