প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমানোর বিপক্ষে বিএনপিসহ ৬ দল পক্ষে জামায়াত-এনসিপি
Published: 19th, June 2025 GMT
সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা কমাতে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের পক্ষপাতী নয় বিএনপিসহ ছয়টি দল। বিএনপির প্রস্তাব– বিদ্যমান নিয়োগ আইনগুলো সংস্কার করা হোক। জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপিসহ অন্যান্য দল এ কাউন্সিল গঠনের পক্ষে। ঐকমত্যে এনসিসি গঠন সম্ভব না হলে গণভোট চায় জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা না কমালে জুলাই সনদে সই না করার হুঁশিয়ারি দিয়েছে এনসিপি।
গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় দফা সংলাপের তৃতীয় দিনে ৩০ রাজনৈতিক দল এবং জোট সংস্কার আলোচনায় অংশ নেয়। এনসিসি ছাড়াও রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত দেয় দলগুলো।
গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড.
সংলাপে উত্তপ্ত বাদানুবাদ হলেও মধ্যহ্ন বিরতিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের এবং এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম পরস্পর হাত ধরে হাসিমুখে সংবাদমাধ্যমে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান; কুশল বিনিময় করেন।
সংলাপে সভাপতিত্ব করা ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ সাংবাদিকদের বলেন, অধিকাংশ দল মনে করে, এনসিসি হওয়া উচিত। কিছু দলের আপত্তি রয়েছে। তারা চাইলে বিকল্প প্রস্তাব দিতে পারেন। আজ (গতকাল) খানিক অগ্রগতি হয়েছে।
এনসিসির কোনো জবাবদিহি থাকবে না– বিএনপির এ অভিযোগের জবাবে আলী রীয়াজ বলেন, প্রধান বিচারপতি ছাড়া এনসিসির বাকি সদস্যরা নির্বাচিত। তাদের নির্বাচকমণ্ডলীর কাছেই জবাবদিহি রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসে পক্ষে-বিপক্ষে মত
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মানবাধিকার কমিশন এবং প্রস্তাবিত স্থানীয় সরকার কমিশনকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) ও সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) মতো সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের সুপারিশ করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন। এই পাঁচ প্রতিষ্ঠান ছাড়াও অ্যাটর্নি জেনারেল এবং প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান পদে এনসিসির মাধ্যমে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছিল। পৃথক আইনে এতদিন নিয়োগ হলেও সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদের কারণে আদতে প্রধানমন্ত্রীই এসব নিয়োগ দিয়ে থাকেন।
সরকারপ্রধানের এই ক্ষমতা কমাতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, প্রধান বিচারপতি, সংসদের উভয় কক্ষের স্পিকার, দুই বিরোধীদলীয় ডেপুটি স্পিকার এবং সরকারি ও প্রধান বিরোধী দলের বাইরে থেকে একজন নির্বাচিত এমপি নিয়ে এনসিসি গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। ৯ সদস্যের এই কাউন্সিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেবে বলে প্রস্তাব করেছে।
বিএনপি শুরু থেকেই এনসিসি গঠনের বিরোধী। গতকালের সংলাপ শেষে সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এনসিসি গঠনে নির্বাহী বিভাগের (সরকার) ক্ষমতা কমে যাবে। জবাবদিহি নেই, এমন কোনো প্রতিষ্ঠানের প্রতি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বিএনপি সমর্থন জানাতে পারে না। এনসিসিকে সাংবিধানিকভাবে অনেক ক্ষমতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তাদের জবাবদিহি নেই। যদি কারও কর্তৃত্ব থাকে, তবে জবাবদিহিও থাকতে হবে।
২০২২ সালের জুলাইয়ে নির্বাচন কমিশন গঠনে করা আইনের সমালোচক ছিল বিএনপি। প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগ করা নির্বাচন কমিশনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কিনা প্রশ্নে সালাহউদ্দিন বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকলে অতীতের নির্বাচনগুলো এভাবে হতো না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে পূর্ণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যদি নির্বাচন কমিশনকে প্রকৃতভাবে, স্বাধীনভাবে, আইনিভাবে কার্যকর করতে দিই, তাহলে নির্বাহী বিভাগ ও সংসদ স্বৈরাচার হবে না।
এনসিসি নিয়ে পুনর্মূল্যায়ন করবেন কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিকল্প কোনো প্রস্তাব যদি আসে দলীয়ভাবে আলোচনা করব। তা নিয়ে আমাদের আবার চিন্তা করতে হবে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবমুক্ত করতে বিদ্যমান নিয়োগ আইনগুলোকে শক্তিশালী করতে চায় তার দল। যেসব আইন আছে, বিএনপি সেগুলোর সমালোচক। আইন শক্তিশালী করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছ নিয়োগ সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাসে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি করে ভারসাম্য তৈরি করা হবে। আগামী সংসদে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে তা করা হবে।
সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, এলডিপি, ১২ দলীয় জোটও এনসিসি গঠনের বিরোধিতা করেছে। যদিও সিপিবি বলছে, তারা সাংবিধানিক নিয়োগ প্রধানমন্ত্রীর প্রভাবমুক্ত করার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত। দলটির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেছেন, এখন প্রয়োজন সুষ্ঠু নির্বাচন।
বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, এই মুহূর্তে এনসিসি গঠনের জন্য সময়ক্ষেপণ করা অপ্রয়োজনীয়।
জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি, গণঅধিকার, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলনসহ বাকিগুলো এনসিসি গঠনের পক্ষে থাকলেও ভিন্নমত রয়েছে। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন এনসিসিতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে চায় না। এনসিপির প্রস্তাব, প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানদের নিয়োগের ক্ষমতা সরকার তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছেই থাকুক। জামায়াতও তাই চায়। দলটির অবস্থান অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগের ক্ষমতাও সরকারের কাছে থাকুক। শুধু সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ করা হবে এনসিসির মাধ্যমে।
জামায়াতের ডা. তাহের বলেন, ক্ষমতার ভারসাম্যের জন্য এসসিসি প্রয়োজন। তিন-চতুর্থাংশ দল এনসিসি গঠনের পক্ষে। ৩০ দলই কোনো প্রস্তাবের বিষয়ে একমত হবে না। তাই যেসব বিষয়ে ভিন্নমত থাকবে, সেগুলো বাস্তবায়নে গণভোট চায় জামায়াত।
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, যারা এনসিসি গঠনের বিপক্ষে, তারা মূলত ফ্যাসিবাদী কাঠামোয় থেকে যেতে চান। কিছু দল প্রথমধাপে সংস্কারে এনসিসির পক্ষে ছিল। আজ তারা অবস্থান বদল করেছেন। কেন করেছেন ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। যারা এনসিসি চায় না, তাদের কাছেও বিকল্প প্রস্তাব নেই। আজকের দিনটি হতাশার। প্রতিরক্ষা বাহিনী সরকারের কাছে রাখাসহ অন্য বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু এনসিসি গঠন মৌলিক সংস্কারের অংশ। এনসিসি গঠন না হলে গণঅভ্যুত্থান ও সংস্কার কমিশন ব্যর্থ হবে। তাহলে জুলাই সনদে থাকবে না এনসিপি।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ইসি, দুদক, মানবাধিকার কমিশন বিগত সময়ে দলীয়করণ হয়েছে। বিরোধী দলমত দমনে ও ভোটাধিকার হরণেও তারা ভূমিকা রেখেছে। এখনও আশা করছি, এসব প্রতিষ্ঠানে নিরপেক্ষ নিয়োগের জন্য ঐকমত্য হবে।
ঐকমত্য না হলে এনসিসির বিষয়ে গণভোটের আহ্বান জানান ইসলামী আন্দোলনের মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান। তিনি বলেন, যারা দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে অনাগ্রহী, তারাই এনসিসি গঠনের বিরুদ্ধে। আলোচনা শেষে এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, আমরা এনসিসি চাই।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে পক্ষে-বিপক্ষে
দলীয় অনুগত ব্যক্তি যাতে রাষ্ট্রপতি হতে না পারেন– সে জন্য কমিশন প্রস্তাব করেছে ৬৪ জেলা এবং ১২ সিটি করপোরেশনও হবে ‘ইলেকটোরাল কলেজ’। এ পদ্ধতিতে জেলার সব প্রতিনিধি রাষ্ট্রপতি ভোট দেবেন। প্রতিটি জেলার ভোটের সংখ্যা হবে।
এই পদ্ধতিতে নির্বাচনেও বিরোধিতা করেছে বিএনপি। একই অবস্থান এলডিপি, সিপিবি, বাসদ, গণফোরাম, ১২ দলীয় জোটের। সালাহউদ্দিন বলেছেন, বিএনপি বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচন চায়। সংসদ দ্বিকক্ষের হলে উভয় কক্ষের সদস্যরা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট দেবেন। আওয়ামী লীগ আমলে গঠিত জেলা পরিষদে নির্বাচন দূষিত হয়েছে। কমিশন বলছে, স্থানীয় সরকারের ৭০ হাজার সদস্য, চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান, মেয়র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ভোটার হবেন। পাকিস্তান আমলে এ রকম বেসিক ডেমোক্রেসি ছিল। বিএনপি তাতে ফিরতে চায় না।
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেছেন, তারা ইলেকটোরাল কলেজের ধারণার বিরোধী নয়। তবে ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের ভোটার করার পক্ষে নয়। সর্বনিম্ন ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা ভোটার হতে পারেন। দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না। তাই ইলেকটোরাল কলেজ করতে হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে হবে।
বিএনপির প্রতি ইঙ্গিত করে নাহিদ ইসলাম বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট আমলে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন নিয়ে ব্যাপক বিরোধিতা দেখিয়েছিল এবং ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতায় গেলে এ বিষয়গুলো সংস্কার করবে বলে প্রস্তাবনা রেখেছিল। এখন তা দেখা যাচ্ছে না।
জামায়াতের ফেরা, সিপিবির ওয়াক আউট
গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তারেক রহমানের বৈঠকের প্রতিবাদে মঙ্গলবারের সংলাপ বয়কট করা জামায়াত গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আসে। দলটি অভিযোগ করে, যৌথ বিবৃতির মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টার নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
সংলাপের মধ্যাহ্ন বিরতিতে ডা. তাহের জানান, মঙ্গলবার দুপুরে প্রধান উপদেষ্টা টেলিফোন করেছিলেন জামায়াত আমির শফিকুর রহমানকে। প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতের আমিরকে সরকারের নিরপেক্ষতার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন।
জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আমাদের অবস্থান অনুধাবন করতে পেরেছেন। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, সরকার কোনো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর প্রতি ঝুঁকে নেই। আগামীতে এসব ব্যাপারে স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে যত্নবান হবেন।
নির্বাচনের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিয়ে অনিশ্চয়তা নেই– স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর এ বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করেছে জামায়াত। ডা. তাহের বলেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড কী সেটাই তিনি বোঝেন না।
নগর ভবন তালাবদ্ধ করে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেছেন, যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এক মাসেও একটি ভবনের তালা খুলতে পারেন না, তিনি কী করে ৩০০ সংসদীয় আসনের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবেন।
প্রধান উপদেষ্টা জামায়াতকে ফোন করার মাধ্যমে নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. মিজানুর রহমান। সংলাপে জামায়াতকে বেশি কথা বলতে দেওয়া হয়– অভিযোগে ওয়াক আউট করেন সিপিবি ও গণফোরাম।
রুহিন হোসেন প্রিন্স সভাকক্ষ থেকে ছেড়ে নিচতলায় এসে বলেন, এখানে বৈষম্য হচ্ছে, জামায়াতের তিনজনকে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে। আমাদের একজন বক্তব্য দিলেও বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।
পরে ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার এসে ওয়াক আউট করা নেতাদের বৈঠকে ফিরিয়ে নেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র ন হ দ ইসল ম স ল হউদ দ ন র ষ ট রপত ঐকমত য ক প রস ত ব ল ম বল ন গণফ র ম এনস স র ব এনপ র র সদস য সরক র র গঠন র ব র রহম ন অবস থ ন বল ছ ন কর ছ ন র বল ন গতক ল এনস প
এছাড়াও পড়ুন:
‘আল–কাহহার’: অপরাজিত প্রভুত্ব শুধু আল্লাহর
যখন আকাশের বিশালতা থরথর করে কাঁপে, পাহাড়ের গর্বিত শিখর নত হয়, তখন একটি নাম হৃদয়ের গভীরে শিহরণ জাগায়, সেটি হলো আল–কাহহার। তিনি আল্লাহ, যিনি সৃষ্টির প্রতিটি কণাকে তাঁর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর সামনে কোনো শক্তি টিকে না, কোনো অহংকার টেকে না।
তিনি সেই সত্তা, যিনি অত্যাচারীদের ধূলিসাৎ করেন, মৃত্যুর মাধ্যমে সবাইকে নতজানু করেন এবং তাঁর ইচ্ছায় বিশ্বচরাচর পরিচালিত হয়। আল–কাহহার নামটি শুধু তাঁর শক্তির প্রকাশ নয়; বরং আমাদের জীবনকে আলোকিত করার এক আধ্যাত্মিক পথনির্দেশ। আসুন, এই নামের গভীর তাৎপর্যে ডুব দিই, যা আমাদের হৃদয়ে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঞ্চার করে।
আল–কাহহার আল্লাহর সেই গুণ, যা তাঁর সর্বোচ্চ প্রভুত্ব ও অপরিমেয় ক্ষমতার কথা বলে। তিনি সেই সত্তা, যাঁর হাতে সমগ্র সৃষ্টি নিয়ন্ত্রিত।
বলো, বিভিন্ন ইলাহ ভালো, না একক, অপ্রতিরোধ্য আল্লাহ?সুরা রাদ, আয়াত: ১৬পবিত্র কোরআনে এ নামটি ছয়বার উল্লেখিত হয়েছে এবং প্রতিবারই এটি তাঁর আল–ওয়াহিদ নামের সঙ্গে জুড়ে এসেছে। সুরা আর–রাদে বলা হয়েছে, ‘বলো, বিভিন্ন ইলাহ ভালো, না একক, অপ্রতিরোধ্য আল্লাহ?’ (আয়াত: ১৬)
আবার সুরা ইবরাহিমে বলা হয়েছে, ‘এবং তারা সবাই একক, অপ্রতিরোধ্য আল্লাহর সামনে উপস্থিত হবে।’ (আয়াত: ৪৮)
এই আয়াতগুলো আমাদের হৃদয়ে গেঁথে দেয় যে তিনি একক এবং তাঁর ক্ষমতার সামনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তিনি সেই সত্তা, যাঁর ইচ্ছার বাইরে কিছুই ঘটে না।
আরও পড়ুন‘আল-ওয়াহিদ’ আল্লাহর অনন্য নাম২৩ জুন ২০২৫ইমাম খাত্তাবি (রহ.) বলেন, ‘আল–কাহহার তিনি, যিনি অহংকারীদের শাস্তির মাধ্যমে নত করেন এবং মৃত্যুর মাধ্যমে সব সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর মহিমার সামনে সবকিছু অসহায়।’ (আল–সালাবি, কিসসাতু বাদ’ইল খালক, পৃ. ১১৩৬)
তিনি সেই সত্তা, যাঁর ক্ষমতা কোনো সীমার মধ্যে বাঁধা নয়। পবিত্র কোরআন বলে, ‘কোনো প্রাণী নেই, যার কপাল তাঁর হাতে নেই। তাঁর হুকুম তাতে চলে এবং তাঁর ফয়সালা তাতে ন্যায়পরায়ণ।’ (সুরা হুদ, আয়াত: ৫৬)
এই আয়াত আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে কিছুই নেই—না আমাদের জীবন, না আমাদের মৃত্যু।
আল–কাহহার ও আল–ওয়াহিদ নামের সংযোগ একটি অপূর্ব সত্য উন্মোচন করে। আল্লাহর একত্ব তাঁর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘যিনি সবকিছুর ওপর অপ্রতিরোধ্য, তিনিই একক। ক্ষমতা ও একত্ব একে অপরের পরিপূরক। দুটি সমান ক্ষমতাশালী সত্তা কখনোই থাকতে পারে না।’ (তারীকুল হিজরাতাইন, পৃ. ২৩৩)
আল–কাহহার তিনি, যিনি অহংকারীদের শাস্তির মাধ্যমে নত করেন এবং মৃত্যুর মাধ্যমে সব সৃষ্টিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর মহিমার সামনে সবকিছু অসহায়।ইমাম খাত্তাবি (রহ.), কিসসাতু বাদ’ইল খালক, পৃ. ১১৩৬পৃথিবীর রাজারা তাদের সেনাবাহিনী ও সমর্থকদের দ্বারা ক্ষমতা প্রয়োগ করে, কিন্তু আল্লাহ তাঁর একক সত্তায়, কারও সাহায্য ছাড়াই সমগ্র বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি সেই সত্তা, যাঁর কাছে সবাই নতজানু, যিনি কোনো সাহায্যকারীর মুখাপেক্ষী নন।
আল্লাহর এই ক্ষমতা শুধু শাস্তি বা ধ্বংসের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যে একটি অপূর্ব ভারসাম্য স্থাপন করেছেন। ইবনুল কাইয়্যিম (রহ.) বলেন, ‘তিনি বাতাস সৃষ্টি করেছেন, যা একে অপরকে নিয়ন্ত্রণ করে। তিনি পানি সৃষ্টি করেছেন, যাকে বাতাস প্রভাবিত করে। তিনি আগুন সৃষ্টি করেছেন, যাকে পানি নিভিয়ে দেয়। তিনি লোহা সৃষ্টি করেছেন, যাকে আগুন গলিয়ে দেয়। তিনি পাথর সৃষ্টি করেছেন, যাকে লোহা ভেঙে দেয়।’ (তারীকুল হিজরাতাইন, পৃ. ২৩৩)
এই ভারসাম্য তাঁর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার প্রমাণ। তিনি সৃষ্টির প্রতিটি উপাদানকে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন, যেন প্রতিটি তাঁর ইচ্ছার অধীনে থাকে।
আরও পড়ুনআল্লাহর ‘আল মুমিন’ নামের মহিমা১৮ জুন ২০২৫তবে আল্লাহর এই অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা মানুষের স্বাধীন ইচ্ছাকে অস্বীকার করে না। তিনি আমাদের পছন্দের স্বাধীনতা দিয়েছেন, যার জন্য আমরা জবাবদিহি করব। আমরা যখন কোনো কাজ করি, যেমন ভ্রমণের পরিকল্পনা, খাওয়া বা বিশ্রাম, তখন আমরা তা নিজেদের ইচ্ছায় করি। এই স্বাধীনতা আমাদের দায়িত্বশীল করে। ‘তিনি অপ্রতিরোধ্য, কিন্তু তিনি আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন। আমাদের কাজ আমাদের পছন্দের ফল।’ (মা’আল্লাহ, সালমান আওদাহ, পৃ. ১০৭)
এই সত্য আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে, আমাদেরকে আল্লাহর সামনে জবাবদিহির প্রতি সচেতন করে।
পবিত্র কোরআনে এ নামটি ছয়বার উল্লেখিত হয়েছে এবং প্রতিবারই এটি তাঁর আল–ওয়াহিদ নামের সঙ্গে জুড়ে এসেছে।আল–কাহহার নামটি আমাদের হৃদয়ে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভীতি জাগায়। যখন আমরা জীবনের ঝড়ে হতাশ হই, তখন এ নামটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে তিনিই আমাদের একমাত্র আশ্রয়। তাঁর অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা আমাদের শেখায় যে আমাদের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত তাঁর ইচ্ছার অধীনে। আমরা যখন তাঁর এই নামের প্রতি চিন্তা করি, তখন আমাদের হৃদয়ে তাঁর প্রতি ভালোবাসা ও বিনয় আরও গভীর হয়। তিনি আমাদের স্রষ্টা ও নিয়ন্ত্রক এবং আমাদের একমাত্র উপাস্য।
এ নামটি আমাদের জীবনে একটি আলোকবর্তিকা। তিনি আমাদের শেখান যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁর ওপর নির্ভর করা আমাদের কর্তব্য। তাঁর ক্ষমতার সামনে আমরা নতজানু হই, তাঁর প্রভুত্বের সাক্ষ্য দিই। তিনি আল–কাহহার, যিনি অপ্রতিরোধ্য, একক ও অতুলনীয়। তাঁর মহিমার কাছে আমাদের হৃদয় নুয়ে পড়ে এবং আমরা তাঁর প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পণের মাধ্যমে শান্তি খুঁজে পাই।
সূত্র: আল–জাজিরা ডট নেট। অনুবাদ: মনযূরুল হক
আরও পড়ুনইসমে আজমের শক্তি ও রহস্য৩০ জুন ২০২৫