সেন্টমার্টিন আমাদের জন্য আশীর্বাদ। কারণ বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বঙ্গোপসাগরের কোলে এমন সুন্দর একটা দ্বীপ এই জায়গাতেই আছে। টেকনাফ থেকে অনেকবার এই দ্বীপে ফিশিং ট্রলার এবং জাহাজে আসার অভিজ্ঞতা হয়েছে। তবে ২০২৩-এ টেকনাফের শাহ্‌পরীর দ্বীপ থেকে সেন্টমার্টিন সাঁতার কেটে আসার রোমাঞ্চকর এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এবার এলাম কোস্টাল ক্লিনআপ করতে। এই ছোট্ট সুন্দর দ্বীপে আমরা বেড়াতে এসে যেসব আবর্জনা ফেলে আসি তা কিছুটা হলেও অপসারণ করতে পারলে এই দ্বীপ রক্ষা করার প্রয়াস হলো তাই বা কম কি! 

কেওক্রাডং বাংলাদেশ নামে স্বেচ্ছাসেবী একটি দল গত ১৮ বছর থেকে নিরলসভাবে এ কাজ করছে। সমুদ্র রক্ষায় আন্তর্জাতিক সংগঠন ওশেন কনজারভেন্সি প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে ইন্টারন্যশনাল কোস্টাল ক্লিনআপ ডে পালন করে। তারই অংশ হিসেবে কেওক্রাডং বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের সৈকতজুড়ে এই পরিষ্কার অভিযান পরিচালনা করছে। এর পিছনে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছে তরুণদের প্রতিনিধি মুনতাসির মামুন। তার কথা একটু পরে বলছি। তার আগে বঙ্গোপসাগরে আসলে কী আছে তার উপর আলোকপাত করি। 

বঙ্গোপসাগরের আঙিনায়, নদীমাতৃক বাংলাদেশ এক জীবন্ত সম্ভার। প্রকৃতির এক অনন্য আশীর্বাদ। বিশ্বের বৃহত্তম ব-দ্বীপ, ৭১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখা এবং ২০০ নটিক্যাল মাইল  বিস্তৃত একচেটিয়া অর্থনৈতিক অঞ্চলে পুষ্টিতে সমৃদ্ধ এই দেশ প্রকৃত অর্থেই মৎস্য বৈচিত্র্য ও সম্পদের এক স্বর্গরাজ্য। বাংলাদেশের সামুদ্রিক অঞ্চল শুধু বিশাল লবণাক্ত উপকূলীয় অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি তার ভূখণ্ডের চেয়ে বড় এক বিস্তৃত পরিসীমা ধারণ করে। বঙ্গোপসাগরের জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সম্পদ এই দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা যেমন বাড়িয়েছে, তেমনি বিজ্ঞানীদের জন্য জৈবিক গবেষণার এক মহাসমুদ্র উন্মুক্ত করেছে।

আরো পড়ুন:

ট্রলার ডুবি: রাতভর সমুদ্রে ভাসছিল ৩ জেলে

জেলের জালে ২৩ কেজির কোরাল, ২৪ হাজার টাকায় বিক্রি

এ জন্য আমাদের সমুদ্রকে আমাদেরই বাঁচাতে হবে। আন্তর্জাতিক উপকূলীয় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা হলো সমুদ্র সংরক্ষণ ব্যবস্থার একটি মাত্র উপায়, যার মাধ্যমে সামুদ্রিক ধ্বংসাবশেষ এবং প্লাস্টিক দূষণ সমস্যা মোকাবেলা করা যায়। ওশেন কনজারভেন্সি সংস্থা থেকে জানা যায়, তাদের কর্মী বিজ্ঞানীরা সমুদ্র দূষণের অভিনব গবেষণা পরিচালনা করেন এবং আমাদের পরিবেশে প্লাস্টিকের প্রভাব এবং প্রভাবগুলি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য এই ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করেন। গবেষণায় পাওয়া যায়, আমরা খাবারের সঙ্গে যে প্রোটিন খাই তাতে মাইক্রোপ্লাস্টিক আছে। বর্তমানে পৃথিবীর প্রতিটি বাস্তুতন্ত্রে এখন মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ পাওয়া যায়। আমরা যে বাতাসে শ্বাস নিই এবং যে খাবার খাই তাতেও মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া গেছে, যার অর্থ মানুষ প্রতিদিন মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে। 

“তুমি যা খাও, তাই হও”—এই কথাটি যেন আরও গভীর অর্থ পেল। কারণ মানুষের শরীর, যেমন রক্ত, ফুসফুস ও প্লাসেন্টাতেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি সনাক্ত করা হয়েছে। এই তথ্য আমাদের ভীত করে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এটি আমাদের স্বাস্থ্যের ওপর কী প্রভাব ফেলতে পারে? এর উত্তর খুঁজতে এবং ঝুঁকির সঠিক মূল্যায়ন করতে হলে আমাদের আগে বুঝতে হবে যে বিভিন্ন খাদ্য উৎস থেকে আমরা কতটা মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করছি।

আজ পর্যন্ত, খাবারে মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণা করা হয়েছে সামুদ্রিক খাবারের  ওপর। তবে স্থলভিত্তিক মাংস যেমন গরুর মাংস, শূঁকরের মাংস ও মুরগি নিয়ে খুব কমই গবেষণা হয়েছে, যদিও গড় আমেরিকান খাদ্যের ৯০ শতাংশের বেশি অংশজুড়ে থাকে মাংসজাত পণ্য। এই ঘাটতি পূরণ করতে, ওশান কনজারভেন্সি টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের রোচম্যান ল্যাবের গবেষকদের সঙ্গে অংশীদারিত্বে ১৬টি সাধারণভাবে ব্যবহৃত প্রোটিন পণ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ পরীক্ষা করেছে।

এই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাজা ধরা মাছ থেকে শুরু করে উদ্ভিদভিত্তিক বার্গার পর্যন্ত নানা পণ্য। গবেষকরা সরাসরি মাছ ধরার নৌকা থেকে পণ্য সংগ্রহ করছেন, পাশাপাশি জৈব ও প্রচলিত মুদি দোকান থেকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য কিনেছেন, যাতে এই কারণগুলো কীভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণকে প্রভাবিত করে তা মূল্যায়ন করা যায়। পরীক্ষা করা ১৬টি পণ্যের মধ্যে ৮৮ শতাংশ নমুনায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি সনাক্ত হয়েছে। এই গবেষণার ফল আমাদের খাবারে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রভাব ও বিস্তার সম্পর্কে গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়।
বঙ্গোপসাগর কেবল আমাদের ভূগোলের অংশ নয়, বরং এটি যুগ যুগ ধরে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এক মহাসড়কের মতো কাজ করেছে। একসময় এই সাগরের তীরে জমেছিল বাণিজ্যের কোলাহল, মানুষের স্বপ্ন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সেই গতি থেমে যায়, দেশগুলো নিজেদের গণ্ডিতে বন্দি হয়ে পড়ে।

বঙ্গোপসাগর শুধু আমাদের প্রকৃতির গর্ব নয়, এটি আমাদের জীবনের গল্পের অংশ। হিমালয় থেকে ছুটে আসা নদীগুলো এখানে এসে মেশে। এ সাগরের জলরাশি আমাদের মাটিকে যেমন উর্বর করেছে, তেমনই আমাদের জীবনে বয়ে এনেছে জীবিকা ও সমৃদ্ধি। তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। জলবায়ু পরিবর্তন, সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, দূষণ আর মাছের মজুদের ক্ষতি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। তবু আমরা আশাবাদী। নতুন নতুন পরিকল্পনা, সংরক্ষণ উদ্যোগ, আর আন্তঃআঞ্চলিক সহযোগিতার মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর আবারও হয়ে উঠতে পারে আমাদের সমৃদ্ধি আর ঐক্যের প্রতীক।

যেসব দেশে কোস্টলাইন থাকে সেখানে সৈকতে বেড়াতে যাওয়া পর্যটকরা সাবান, বিস্কিট, চকোলেট, চিপস, পানির বোতল ইত্যাদি জিনিসপত্র ব্যবহারের পর অবচেতন মনে সৈকতে ফেলে আসেন। আর এভাবেই ময়লা-আবর্জনা ফেলতে ফেলতে সাগরের পরিবেশ দূষিত হতে থাকে। পরিবেশে এ ক্ষতির কথা বুঝতে পেরে প্রথম পদক্ষেপ নেয় ১৯৮৬ সালে দি ওশেন কনজারভেন্সি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। কোস্টলাইন পরিষ্কার করার ধারণাটা আসে এদেশ থেকেই। ধীরে ধীরে এই কাজটি বড় আকার ধারণ করে এবং যেসব দেশে সমুদ্র বন্দর বা সৈকত আছে সে দেশগুলোতে এ ধরনের কার্যক্রম শুরু হয়। কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর দেখা গেল এটি হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং পুরনো স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রম। এত ব্যাপক আকারে কার্যক্রমটি পরিচালিত হলো যে, পৃথিবীতেই তা ছড়িয়ে পড়ল। ১৯৭২ সালে ওশেন কনজারভেন্সি প্রতিষ্ঠিত হয়। যাদের মূল লক্ষ্য সাগরের পরিবেশকে ক্ষতিকারক দ্রব্যাদি থেকে রক্ষা এবং পৃথিবীব্যাপী বৈচিত্র্যপূর্ণ সামুদ্রিক প্রাণীদের পর্যাপ্তভাবে সংরক্ষণ করা।

মূলত এ প্রতিষ্ঠান তাদের পরামর্শ, শিক্ষামূলক কার্যক্রম, উদ্বুদ্ধকরণ এবং গবেষণার দ্বারা মানুষকে সমুদ্রের পরিবেশ রক্ষার্থে সচেতন করে। ১৯৮৬ সালের পর থেকে তারা এ পর্যন্ত ১২৩টি দেশে ১৮ মিলিয়ন স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে কোস্টাল ক্লিনআপের কাজ করেছে। প্রায় ৩৮৫ মিলিয়ন পাউন্ড আবর্জনা সারা পৃথিবীর সৈকত এবং জলপথ থেকে সংগ্রহ করেছে। গত বছরও তারা অর্ধ মিলিয়ন স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে পৃথিবীজুড়ে ১৪ মিলিয়ন আবর্জনা সংগ্রহ করেছে। এমনকি পানির তলদেশেও প্রায় ৪ হাজার মাইল ১০ হাজার ডুবুরি মিলে পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়েছে। এই স্থানটুকুর ব্যবধান নিউইয়র্ক থেকে প্যারিসের দূরত্বের চেয়েও বেশি। আবার, টেক্সাসে ১৯৮৬ সালে প্রথম শুরু হওয়া এই কার্যক্রমে ২ হাজার ৮০০ টেক্সান প্রায় ১২২ মাইল সমুদ্র উপকূল পরিষ্কার করেন। একই বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ২৫টি অঙ্গরাজ্যেও শুরু হয় অভ্যন্তরীণ জলপথে পরিচ্ছন্নতা অভিযান। প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় শনিবার কোস্টাল ক্লিনআপ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। ১৯৯২ সালে ৩৩টি দেশ এ দিবসটি পালন করে। ৯৩ সালে যোগ দেয় ৭৫টি দেশ। বর্তমান পর্যন্ত ১৬ হাজার  ৩০৮ মাইল উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ জলপথ পরিষ্কার করেছে ওশেন কনজারভেন্সি।

বাংলাদেশের সৈকতে কোস্টাল ক্লিনআপ করার আইডিয়াটা আসে কোস্টাল ক্লিনআপ আয়োজনের কোঅর্ডিনেটর পর্বতারোহী ও লেখক মুনতাসির মামুনের কাছ থেকে। সময়টা ২০০৬ সাল। দেখতে দেখতে বাংলাদেশেও এর কার্যক্রমের বয়স হয়ে গেলো প্রায় ১৮ বছর। ২০০৫ সালে তিনি জাপানে গিয়ে জানতে পারেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সমুদ্র সৈকত নিয়ে এ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। ওখানকার মানুষেরা বলেন, তোমার দেশেও এমন কিছু করা যায় কিনা চেষ্টা করে দেখ। তখন তিনি যোগাযোগ করেন ওশেন কনজারভেন্সির সঙ্গে। তারাও বলল, বাংলাদেশের সৈকতে এখন কোনো কর্মসূচি হয়নি। তারা কিছু পেপার ডকুমেন্ট পাঠান। মুনতাসির ও তার সঙ্গীরা সে মোতাবেক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ২০০৬ সালে তারা সবাইকে জানালেন এবং দি ওশেন কনজারভেন্সি থেকে অনুমতিও পেলেন কর্মসূচিটি পরিচালনার জন্য। এরপর থেকে আর থেমে থাকেননি। ২০০৭ সালেই প্রায় ৫০০ স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে এই কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। প্রতি বছর কেওক্রাডং বাংলাদেশের সেচ্ছাসেবী দল, বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির ছাত্র-ছাত্রী ও স্থানীয় স্কুলের শ’খানেক ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে এই সচেতনতামূলক কার্যক্রম হয়ে আসছে। শুরুর দিকে একদম নিজ উদ্যোগে সব কিছু করা হতো, এখন দিনে দিনে স্পন্সররা আগ্রহী হচ্ছে এই কার্যক্রমে অংশ নিতে। 

২০২৪ সালে প্রথম কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতে কেওক্রাডং বাংলাদেশ কোস্টাল ক্লিনআপ করেছে। সহযোগিতায় ছিল কোকাকোলা বেভারেজ। প্রায় ২৫০ কেজি প্লাস্টিকের নানা পার্টিকেল সংগৃহীত হয়েছে। এক সপ্তাহ পরেই সেন্টমার্টিনে এই কার্যক্রম হলো। সেখানেও প্রায় ১২০০ কেজি আবর্জনা সংগ্রহ করা হয়েছে। সহযোগিতায় ছিল ইউনিলিভার বাংলাদেশ। মূলত সংগ্রহ করা হয়েছে সিগারেটের ফিল্টার, পলিথিনের ব্যগ, খাবারের মোড়ক, ফিসিং নেট, রাবার সোল, প্লাস্টিক স্ট্র, সায়রো ফোম, হার্ড প্লাস্টিক, বেভারেজ বোতল, কনস্ট্রাকশন প্লাস্টিক ব্যাগ আরো নানা প্লাস্টিক পার্টিকেল। 

পরিবেশ রক্ষার্থে সেন্টমার্টিনে এখন অনেক বিধিনিষেধ এসেছে। টেকনাফ থেকে জাহাজ বন্ধ রয়েছে এবং কিছু সময়ের জন্য পর্যটকও সিমীত করা হয়েছে। সুতরাং কক্সবাজার থেকে বারো আউলিয়া জাহাজে চড়ে বসলাম। উঠতে আর নামতে ২ ঘণ্টা আর যাত্রা ৬ ঘণ্টা মাথায় রেখে এখন সেন্টমার্টিন যেতে হয়। আমি সাঁতার কেটে চলে গিয়েছিলাম শাহ্‌পরীর দ্বীপ থেকে ৫ ঘণ্টা ৭ মিনিতে। কেউ কেউ শুনে একটু থ বনে গেলো! আমাদের অনুষ্ঠানের জন্য নানা উপকরণ বস্তাবন্দি করা হয়েছে, সংখ্যায় ১৩টি। সবাই হাতে হাতে করে বস্তা তুলতে থাকলাম এবং যথারীতি জনগণ একটা বিস্ময় নজর দিলো আমাদের দিকে। এরা বেড়াতে যায় না কি অন্য কোনো ধান্ধায়! 

‘ফিল্ম নইর’ থেকে এসেছে তন্ময়, সনেট আর মেহেদি। তারা ক্যামেরার সব গিয়ার বের করেছে শুট করার জন্য। তখন কেউ কেউ বুঝতেপারলো বস্তার বিড়ালের খবর। ঢাকা থেকে আমরা এলাম ১২ জন আর কক্সবাজার থেকে ২৪ জন সার্ফার যোগ দিয়েছে। কামরুল আর নয়ন আমাদের পুরানো বন্ধু তারাই সবার সাথে সমন্বয় করেছে। নিসর্গ কুটিরে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলো। রাতে মাইকিং করতে বের হলাম সকাল ৮ ঘটিকায় বিএন স্কুল এন্ড কলেজের মাঠে যেনো সকলে জড়ো হয়। গেঞ্জি আর ক্যাপ দেওয়া হবে আর কাজ শেষে দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। সেন্টমার্টিনের সকাল বেশ মনোরম। সবাই রেডি হয়ে স্কুলে চলে গেলাম। যার যার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হলো। বাচ্চাদের টি-শার্ট আর ক্যাপ পরিয়ে আমরা বিচের পাড়ে লাইন ধরে নিয়ে গেলাম। সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তুলে ছোট ছোট গ্রুপ হয়ে চটের ব্যাগ নিয়ে কাজে নেমে পড়লাম। 

সবার হাতে একটি করে গ্লাভস পরিয়ে দেওয়া হলো। সবাই খুব উৎসাহ নিয়ে প্লাস্টিক তুলতে শুরু করলো। দুপুর পর্যন্ত চলল আবর্জনা পরিষ্কার কার্যক্রম। এরপর শুরু হলো কী কী আমরা কুড়িয়ে পেলাম তার তালিকা নির্ণয়। সালমা আপা এই কাজে বেশ দক্ষ। তিনিই সবার আগে হাত লাগালেন সঙ্গে আমরা কয়েকজন। চঞ্চল একটু ফাঁকিবাজ তাই সে ডাটা লিখতে কাগজ কলম হাতে নিলো। আমরা কাজের ফাঁকেও অনেক আনন্দ আর অনুপ্রেরণা নেই সবার থেকে। মুনতাসির ভাই আমাদের চোখে চোখে রাখে। কাজের ব্যাপারে সে সবসময় সিরিয়াস। হাবিব আর পাভেল বাল্যবন্ধু, তাদের আলাদা করা যায় না। তাদের সাথে আমার নতুন পরিচয়ে ভাব জমে গেলো। কাজ প্রায় শেষের পথে। কিছু সহোযোগী নেওয়া হয়েছিল কাজের সুবিধার্থে তারা বাজার আর গ্রামের আশপাশের রাস্তায় প্লাস্টিক সংগ্রহ করেছে। পরে বড় বড় বস্তাগুলো আমরা ভ্যান দিয়ে জেটিঘাটে নিয়ে এসেছি। প্রায় ১৫০০ কেজি আবর্জনা বোটে করে টেকনাফ পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বিডিনিউজের টেকনাফ প্রতিনিধি জসিম ভাই আমাদের সহোযোগিতা করেছেন। 

সমুদ্রের পাড়ে বসে সালমা আপা আর আমি মুস্তাফিজ মামুন ভাইয়ের ইউরোপ ভ্রমণের মজার মজার গল্প শুনছিলাম। কি দারুণ সব অভিজ্ঞতা হয়েছে জার্মানির বন শহরে! ডয়েচে ভেলেতে ফেলোশিপের সুবাদে মামুন ভাই ঘুরে বেড়িয়েছেন আর্মস্টাডার্ম, ইতালি, ফ্রান্স আরো নানা শহরে। এইসব দেশের জাদুঘরগুলিতে ঘোরায় মন ছিল তার সবচেয়ে বেশি। কিভাবে কম খরচে বেশি জায়গায় ঘুরতে পারবে তার ফন্দি ফিকির করেছেন। পথে পথে বন্ধু বানিয়েছেন আর দারুণ সব ছবি তুলেছেন। অনেকগুলো ইন্টারন্যাশনাল ফটোগ্রাফি এক্সিবিশনে মামুন ভাইয়ের ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। বিচারক হিসেবেও অনেক দেশে কাজ করেছেন। গুণী মানুষের বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা শুনতে বেশ ভালোই লাগে। জীবনে কখনো এসব জায়গায় যাওয়ার বড় লোভ তৈরি হয়। 

দারুণ একটা সন্ধ্যা কাটালাম সেদিন। আকাশে যেন কেউ রংতুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে। মৃত কোরালের গায়ে আছড়ে পড়ছে নীল জল, সেই নীলে আকাশ ছেয়ে গেছে, অস্তমিত লাল আভায় মিলেমিশে একাকার হয়েছে ব্রহ্মান্ড। সকালে জহির আর তার সার্ফ বোর্ড সঙ্গী করে সমুদ্রে নেমে পড়লাম। আমার কোমরে বয়া বেঁধে সাঁতার শুরু করলাম উঁচু ঢেউ উতরে। প্রায় ১ কিলোমিটার দূরত্ব সাঁতার কেটে পাড়ে ভিড়লাম। কিছুদিন পরেই সমুদ্রের এই ১৬ কিলোমিটারের চ্যানেল পাড়ি দেব। তাই প্র্যাকটিস হয়ে গেলো। ইউনিলিভারের ফয়সাল ভাই আমার সাঁতার দূর থেকে দেখছিলেন মুগ্ধ হয়ে। উঠে আসার পর তার নানা কৌতূহলী প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। তিনি ভাবতেই পারছিলেন না গভীর সমুদ্রে কি করে এমন অবলীলায় সাঁতার কাটা যায়। অ্যাডভেঞ্চারের নেশা একবার কাউকে পেয়ে বসলে, তা যেন রক্তে মিশে যায়। প্রতিটি নতুন চ্যালেঞ্জ, অজানা পথে হাঁটা, কিংবা ভয়কে জয় করার চেষ্টা—এসবই যেন হৃদয়ের স্পন্দন বাড়িয়ে দেয়। সেই এড্রেনালিনের উচ্ছ্বাস থামানো তখন কঠিন হয়ে পড়ে। এ যেন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে নতুন করে উপভোগ করার নেশা। 

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স ন টম র ট ন পর ষ ক র ক র পর ব শ আম দ র স ম নত স র পর চ ল র কর ছ ক র কর র র পর র স কত কর ছ ন ক জ কর র জন য উপক ল

এছাড়াও পড়ুন:

সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে জমায় উল্লম্ফন

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। বৃহস্পতিবার সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক (এসএনবি) বিশ্বের সব দেশের সঙ্গে ২০২৪ সালে তাদের দেশের ব্যাংকগুলোর দায় ও সম্পদের পরিসংখ্যান প্রকাশ করেছে।

প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে বাংলাদেশের নামে পাওনা রয়েছে ৫৯ কোটি ৮২ লাখ সুইস ফ্রাঁ। বাংলাদেশি মুদ্রায় ( প্রতি ফ্রাঁ ১৫০ টাকা ধরে ) যার পরিমাণ ৮ হাজার ৯৭২ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে যার পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৬৪ লাখ ফ্রাঁ। এখনকার বিনিময় হার ধরলে যার পরিমাণ ৩৯৬ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশের নামে থাকা অর্থের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২৩ গুণ। ২০২২ সাল শেষে বাংলাদেশের কাছে সুইজারল্যান্ডের দায় ছিল ৫ কোটি ৮৪ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা প্রায় ৮৭৬ কোটি টাকা।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে দায়ের মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পাওনা, আমনাতকারীদের পাওনা এবং পুঁজিবাজারে বাংলাদেশের নামে বিনিয়োগের অর্থ রয়েছে। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশের বেশি বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর পাওনা, যা বাণিজ্য কেন্দ্রিক অর্থ বলে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকে থাকা অর্থের একটি অংশ পাচার করা সম্পদ হতে পারে বলে ধারণা রয়েছে। তবে এ বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কয়েক বছর ধরে সুইজারল্যান্ড বার্ষিক ব্যাংকিং পরিসংখ্যান প্রকাশ করছে।  বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বা বিএফআইইউ সুইজারল্যান্ডের এফআইইউর সঙ্গে কয়েক দফা যোগাযোগও  করেছিল। কিন্তু ব্যক্তির তালিকা সম্বলিত কোনো তথ্য তারা দেয়নি। 

সুইজারল্যান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, অবৈধভাবে কেউ অর্থ নিয়ে গেছে এমন প্রমাণ সরবরাহ করলে তারা তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে পারে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশের কোনো নাগরিক বা প্রতিষ্ঠান যদি নিজের বদলে অন্য দেশের নামে অর্থ গচ্ছিত রাখে তাহলে তা সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের নামে থাকা পরিসংখ্যানের মধ্যে আসেনি। একইভাবে সুইস ব্যাংকে গচ্ছিত রাখা মূল্যবান শিল্পকর্ম, স্বর্ণ বা দুর্লভ সামগ্রীর আর্থিক মূল্যমান হিসাব করে এখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অনেক দেশের নাগরিকই মূল্যবান সামগ্রী সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকের ভল্টে রেখে থাকেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ