‘ফিকহ’ শব্দটি এসেছে আরবি মূল শব্দ ‘ফাকিহা’ থেকে, যার অর্থ ‘বোঝা’, বিশেষত গভীরভাবে কোনো বিষয় অনুধাবন করা। অর্থাৎ, ফিকহ মানে হচ্ছে, ইসলামি শরিয়তের বিধানগুলো গভীরভাবে অনুধাবন ও সেগুলোর ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করা।
ইমাম আবু হানিফা (রহ.) ফিকহকে সংজ্ঞায়িত করেছেন এভাবে, “ফিকহ হল মানুষের জন্য কোনটি হালাল আর কোনটি হারাম, তা জানা।” (আল-জাসাস, ইলমুল ফিকহ, পৃ.
ইসলাম শুধু আধ্যাত্মিক ধর্ম নয়, বরং এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। এই জীবনব্যবস্থার আইনি কাঠামো বা বাস্তব রূপই হলো ফিকহ শাস্ত্র।
সুতরাং ফিকহ বলতে বোঝায়, কোরআন, হাদিস, ইজমা (মতৈক্য) ও কিয়াস (যুক্তি)-এর আলোকে ইসলামি আইন ও তার প্রয়োগবিধি বোঝার বিজ্ঞান।
সহজভাবে বলা যায়, ফিকহ হচ্ছে ইসলামি আইনশাস্ত্র, যা মুসলমানকে শেখায়, কোন কাজ বৈধ, কোনটি নিষিদ্ধ, আর কোনটি উত্তম।
আরও পড়ুনইসলামে ‘নফস’ কাকে বলে১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ফিকহ শাস্ত্রের উৎসফিকহের চারটি মৌলিক উৎস রয়েছে, যেগুলোকে বলা হয় “উসূলে ফিকহ” বা ইসলামি আইন প্রণয়নের ভিত্তি:
১. কোরআন – ইসলামের মূল আইনভিত্তি।
২. হাদিস – নবীজির (স.) কথা, কাজ ও অনুমোদন।
৩. ইজমা – সাহাবা ও আলেমদের সর্বসম্মত মত।
৪. কিয়াস – কোরআন-হাদিসে না থাকা বিষয়ের জন্য যুক্তিসঙ্গত তুলনা ও ব্যাখ্যা।
(ইমাম গাজ্জালি, আল-মুস্তাসফা, ১/৩৬, দারুল মাআরিফ, কায়রো, ১৯৬১ খ্রি.)
ফিকহ শাস্ত্রের শাখাফিকহের বিষয়বস্তু খুব বিস্তৃত। তা সাধারণত চারটি প্রধান বিভাগে ভাগ করা হয়—
১. ইবাদাত: নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত ইত্যাদি ইবাদতের নিয়মাবলি।
২. মুয়ামালাত: ব্যবসা-বাণিজ্য, চুক্তি, দেনাপাওনা, সম্পত্তি-বণ্টন ইত্যাদি সামাজিক সম্পর্ক।
৩. উকুবাত: অপরাধ ও তার শাস্তি সম্পর্কিত আইন।
৪. আখলাক: নৈতিক আচরণ, সমাজে চলার আদব ও শিষ্টাচার।
(ইমাম নববী, রওযাতুত ত্বলিবিন, ১/১২, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৯৬ খ্রি.)
আরও পড়ুনমুসাফির কাকে বলে: শরিয়তের আলোকে সফরের বিধান০৯ জুলাই ২০২৫প্রধান ফিকহি মাজহাবইসলামের ইতিহাসে ফিকহ চর্চার মাধ্যমে চারটি সুপ্রসিদ্ধ মাজহাব গড়ে ওঠে—
১. হানাফি মাজহাব – ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইরাক।
২. মালিকি মাজহাব – ইমাম মালিক ইবন আনাস (রহ.), মদিনা।
৩. শাফেয়ি মাজহাব – ইমাম মুহাম্মদ ইবন ইদরিস শাফেয়ি (রহ.), মিসর।
৪. হাম্বলি মাজহাব – ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (রহ.), বাগদাদ।
(ইবনে খালদুন, আল-মুকাদ্দিমাহ, পৃষ্ঠা ৩৩৮, দারুল ফিকর, বৈরুত, ২০০৫ খ্রি.)
ফিকহ শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা১. মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের দিকনির্দেশনা দেয়: খাওয়া, ঘুম, ব্যবসা, বিবাহ, আদালত—সব ক্ষেত্রেই ফিকহ নির্দেশনা দেয় কীভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়।
২. আইন ও ন্যায়বিচারের ভিত্তি গড়ে তোলে: ফিকহ এমন এক শাস্ত্র যা সামাজিক ন্যায়বিচারের ভারসাম্য রক্ষা করে—কেউ যেন অবিচারের শিকার না হয়।
৩. আত্মশুদ্ধি ও আখিরাতের প্রস্তুতি দেয়: ফিকহ শুধু আইনের বই নয়, বরং আত্মাকে পরিশুদ্ধ করারও মাধ্যম।
ইমাম মালিক (রহ.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি ফিকহ শিখে কিন্তু তাসাউফ শেখেনি, সে কঠোর হয়; আর যে তাসাউফ শিখে কিন্তু ফিকহ শেখেনি, সে বিভ্রান্ত হয়।” (ইমাম কুরতুবি, আত-তাজ, ১/২৪, কায়রো, ১৯৯৮ খ্রি.)
ফিকহ ও আধুনিক বিশ্ববর্তমান যুগে ফিকহ শুধু ধর্মীয় বিধান নয়; এটি আইন, অর্থনীতি, চিকিৎসা, প্রযুক্তি ও পরিবেশ সবক্ষেত্রে প্রযোজ্য। যেমন:
ইসলামি ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্স ফিকহের মুয়ামালাত অধ্যায়ের আধুনিক প্রয়োগ।
মেডিকেল এথিক্স, অঙ্গদানের নিয়ম, পরিবেশ সংরক্ষণ—সব ক্ষেত্রেই ফিকহ আজ বাস্তব সমাধান দিচ্ছে। (মুহাম্মদ মুস্তাফা আল-যারকা, আল-মাদখাল আল-ফিকহি আল-আম্ম, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, দামেস্ক, ১৯৬৮ খ্রি.)
ফিকহ শাস্ত্র ইসলামি জ্ঞানের হৃদয়। এটি শুধু “কী করব” বা “কী করব না”—এই প্রশ্নের উত্তর নয়, বরং শেখায় “কেন” এবং “কীভাবে” আল্লাহর বিধান অনুযায়ী জীবন যাপন করতে হয়।
আজকের সমাজে ফিকহকে নতুন প্রজন্মের কাছে সহজ, প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োগযোগ্যভাবে উপস্থাপন করা অপরিহার্য। কারণ, ফিকহ শেখা মানে কেবল ধর্ম জানা নয়, বরং আল্লাহর নির্দেশে সুন্দর, ভারসাম্যপূর্ণ জীবন গড়ে তোলা।
আরও পড়ুনরিজিক কাকে বলে০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
একঝলক (১৭ নভেম্বর ২০২৫)
ছবি: সাদ্দাম হোসেন