একটি ফুটবল ম্যাচ কত ‘ভুল’ই না ভাঙিয়ে দিল
Published: 19th, June 2025 GMT
তিল ধারণের ঠাঁই নেই। কার্যত পরিস্থিতি ছিল সে রকমই। বিদ্যালয়ের মাঠটি মোটেও ছোট নয়। মাঝে খেলার জন্য নির্ধারিত জায়গা বাদে চারদিকে অনেকখানি ফাঁকা। সেখানে গিজগিজে মানুষ। মাঠের দুই পাশে বিদ্যালয়ের ভবনের বারান্দাতেও খালি নেই চুল পরিমাণ জায়গা। এত মানুষের একসঙ্গে জড়ো হওয়ার কারণ একটি ফুটবল ম্যাচ।
১৫-২০ বছর আগেও যেকোনো খেলা বা প্রতিযোগিতামূলক আসর কিংবা বিনোদনমূলক কোনো আয়োজন উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট এলাকায় উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়া ছিল রোদ-হাওয়ার মতো স্বাভাবিক। হইহই রইরই করে সবাই জড়ো হতো তার হিস্যা হতে। কিন্তু এই ২০২৫ সালে এসে এমন ঘটনায় অনেকেরই চোখ আক্ষরিক অর্থেই ছানাবড়া হয়ে ওঠে! গলায় রীতিমতো অবিশ্বাসের সুর ঝরে পড়ল শফিকুল ইসলামের। তিনি বললেন, ‘নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না! ছেলেপুলেরা নাকি এখন সবাই মোবাইলে আসক্ত। কিন্তু আজ তো এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো!’
যে ফুটবল ম্যাচ ফিরিয়ে আনল পুরোনো সেই উচ্ছ্বাস, ছড়াল উৎসবের রং আর হয়ে উঠল সামাজিক সম্মিলনের উপলক্ষ, সেটির আয়োজন করা হয়েছিল সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার চৌবাড়ী ইসলামিয়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। দিনটি ছিল ১১ জুন, ঈদুল আজহার তিন দিন পর।
একই উপজেলার জামতৈল গ্রামের বাসিন্দা শফিকুল কর্মসূত্রে ঢাকায় থাকেন। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছিলেন। নিজের খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ আছে। একমাত্র ছেলে দশম শ্রেণির ছাত্র রাকিবুল ইসলাম নিয়মিত ফুটবল খেলে। তাই বেলকুচি ও উল্লাপাড়া উপজেলার মধ্যকার ফুটবল ম্যাচের খবরে তিনি ছয় কিলোমিটার দূরে চৌবাড়িতে ছুটে এসেছিলেন।
গ্রামের বাড়িতে ঈদ উদ্যাপনে আসা তাইজুল রহমানও এসেছিলেন খেলা দেখতে। তাঁর বাড়ি কামারখন্দের কর্ণসূতি গ্রামে। আসলে তরুণ প্রজন্মকে যতটা ডিভাইসে আসক্ত বলা হয়, বাস্তবে বোধ হয় তা নয়, বললেন তাইজুল। তিনি মাঠে উপস্থিত তরুণদের সংখ্যার দিকে ইঙ্গিত করলেন। সব বয়সী মানুষ জড়ো হয়েছিলেন বটে, তবে তরুণ-যুবাদের সংখ্যাই ছিল চোখে পড়ার মতো। তাইসুরের পরিষ্কার কথা, খেলাধুলার সুযোগ থাকলে, উদ্যোগ থাকলে ছেলেপুলেরা মাঠে যাবে, আজকের ফুটবল ম্যাচই তার প্রমাণ।
ঢাকাসহ বড় বড় শহরের কথা কমবেশি সবারই জানা। সবই পাবেন, কিন্তু একটা খেলার মাঠ, একটু খোলা জায়গা পাওয়া যেন সোনার হরিণের সমনাম! গ্রামাঞ্চলেও কি খেলাধুলার জায়গার অভাব? আগে স্কুল-কলেজের মাঠে হররোজ খেলাধুলা হতো।ঢাকাসহ বড় বড় শহরের কথা কমবেশি সবারই জানা। সবই পাবেন, কিন্তু একটা খেলার মাঠ, একটু খোলা জায়গা পাওয়া যেন সোনার হরিণের সমনাম! গ্রামাঞ্চলেও কি খেলাধুলার জায়গার অভাব? আগে স্কুল-কলেজের মাঠে হররোজ খেলাধুলা হতো। ফসল কাটার পর ন্যাড়া মাঠেও চলত ফুটবল-ক্রিকেটের আয়োজন। হাডুডু, গোল্লাছুট, ডাংগুলি, এক্কাদোক্কা আরও কত খেলাই না ছিল শিশু-কিশোরদের নির্মল আনন্দের উৎস। গাঁওগেরাম থেকে এসব খেলা হারিয়ে যাচ্ছে। আবার সব মাঠও নাকি খেলাধুলার জন্য উন্মুক্ত রাখা হয় না।
জামতৈলের একাধিক বাসিন্দা জানালেন, তাঁদের গ্রামের কলেজের মাঠটি অনেক বড়। আগে সেখানে প্রায় সারা দিনই শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে তরুণেরা খেলাধুলা করত। বিকেল হলে তো কথাই ছিল না। এলাকার বেশির ভাগ তরুণ-যুবার গন্তব্য ছিল ওই মাঠ। বয়স্করাও হাঁটাহাঁটির জন্য মাঠে যেতেন। হাওয়া খেতেন। অথচ মাঠটি বহু বছর ধরে বন্ধ। বাকি থাকে এক হাইস্কুলের মাঠ। তবে সেটি বেশ ছোট; তাই চাইলেও সবাই সেখানে খেলার সুযোগ পায় না।
হ্যাঁ, দ্বিমত করার উপায় নেই যে সময় এখন প্রযুক্তির করতলগত। স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট, সোশ্যাল মিডিয়া, গেমিং কনসোল এমনকি এআই জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই প্রয়োজন যখন সীমার বাইরে গিয়ে ‘অভ্যাসে’ পরিণত হয়, তখনই জন্ম নেয় নতুন সমস্যা—‘আসক্তি’। একসময় তরুণ প্রজন্মের বড় অংশই খেলাধুলা করত, নানা সামাজিক কর্মকাণ্ডে শরিক হতো, পুরো গ্রামবাসীর সঙ্গে ছিল ওঠা-বসা, উৎসব-পার্বণে নানা প্রতিযোগিতামূলক আসরের আয়োজনের প্রাণভোমরা ছিলেন তাঁরা; সেই তাঁদেরই সময় কাটে এখন মোবাইলের পর্দায় চোখ রেখে। ঘরে বসে ভিডিও দেখা, গেম খেলা, চ্যাট করা তাঁদের জন্য ‘নতুন স্বাভাবিক’।
কিন্তু এই নতুন স্বাভাবিকতা অনেক নতুন নতুন ‘অস্বাভাবিকতা’রও জন্ম দিচ্ছে। ডিভাইস-আসক্তির নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে তাঁদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে। এ-সংক্রান্ত হাজারো গবেষণা হয়েছে বিশ্বব্যাপী। অনলাইনে অতিরিক্ত সময় কাটানোর কারণে কিশোর-তরুণেরা সামাজিক সম্পর্ক থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। মানসিক চাপ, বিষণ্নতা, অনিদ্রা—এসব সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই খেলাধুলা শুধু শরীরচর্চার মাধ্যম নয়, বরং এটি একটি সামাজিক, মানসিক ও নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রও বটে। প্রযুক্তির ব্যবহার পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়, তার দরকারও নেই; বরং নিশ্চিত করতে হবে তার সঠিক ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার।
বেলকুচির আদাচাকী গ্রামের জাকির হোসেন একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষক। তিনি বলছিলেন, নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের প্রযুক্তি–আসক্তি নিয়ে দুকথা শোনাতে কেউ কসুর করেন না। কিন্তু পরিস্থিতি পরিবর্তনে কারও নজর নেই। তিনি পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সম্মিলিত উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জাকির তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি হাতড়ে বললেন, আগে ঈদ-পার্বণের ছুটিতে গ্রামের ফসলের মাঠেই ফুটবল খেলার আয়োজন করা হতো। বিবাহিত ব্যক্তিরা থাকতেন এক দলে, অপর দলে অবিবাহিত তরুণেরা। এলাকায় এটি ‘বিয়াত্ব-অবিয়াত্ব’ ফুটবল ম্যাচ নামে পরিচিত। কিন্তু সেসব কবেই ঘুচে গেছে।
১১ জুনের ফুটবল ম্যাচ শেষে চৌবাড়ী এলাকায় যানবাহন–সংকট দেখা দেয়। গ্রামের সড়কে তো হাতে গোনো রিকশা-ভ্যান ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলে। তাই অনেকেই হেঁটে গন্তব্যে রওনা হতে হয়। তাঁদের একজন জামতৈল গ্রামের নিমাই চন্দ্র শীল। চোখাচোখি হতেই ইঙ্গিতে বোঝালেন, ‘যানবাহন নেই। কী আর করা!’ ছয় কিলোমিটার রাস্তা তাঁকে হেঁটে ফিরতে হবে, অথচ তাঁর মুখে লেগেছিল হাসি।
হাসান ইমাম জেষ্ঠ্য সহসম্পাদক
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ফ টবল ম য চ র জন য কল জ র আসক ত
এছাড়াও পড়ুন:
গিলের জয়ের আনন্দ, স্টোকসের আফসোস
ম্যাচ জিততে পারবেন, এই আত্মবিশ্বাস কি ছিল? ভারতের অধিনায়ক শুবমান গিলের উত্তর, হ্যাঁ ছিল।
হ্যারি ব্রুকেরও একই বিশ্বাস ছিল। পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে মাইকেল আথারটনকে বলেন, ‘আত্মবিশ্বাস ছিল আজকের দিনে। দুজন ভালো ব্যাটসম্যান ছিল (ক্রিজে)। ভেবেছিলাম, সহজেই জিতব।’
আরও পড়ুনওভালে অবিশ্বাস্য নাটক, ভারতের অসাধারণ জয়৫ ঘণ্টা আগেআত্মবিশ্বাস তো তাঁর থাকতেই হবে। ওভাল টেস্ট জিততে আজ শেষ দিনে হাতে ৪ উইকেট রেখে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ৩৫ রান। ক্রিজে জেমি স্মিথের মতো স্বীকৃত ব্যাটসম্যার এবং জেমি ওভারটনের মতো অলরাউন্ডার, যিনি কিনা ব্যাটিংটাও ভালো করেন। এ অবস্থায় ব্রুকদের জয়ের আত্মবিশ্বাস না থাকাটাই বরং অস্বাভাবিক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড ৬ রানে হারার পর এই টেস্ট না খেলা দলটির মূল অধিনায়ক বেন স্টোকস বলতে বাধ্য হলেন, ‘আমরা পারলাম না!’
ওভাল টেস্টে জয়ের পর ভারতের খেলোয়াড়দের উদ্যাপন