এমডি নিয়োগে এবারই প্রথম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ
Published: 25th, July 2025 GMT
২০১১ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসায় ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) পদ তৈরি করা হয়েছিল। পুনর্গঠন করা হয়েছিল ওয়াসা বোর্ডও। তখন এমডি পদে নিয়োগ পান বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান এ কে এম ফজলুল্লাহ। এরপর দীর্ঘ ১৪ বছর তিনি একটানা দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে এবার এমডি নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার এ কে এম ফজলুল্লাহকে আট দফায় নিয়োগ দেয়। এ পদে কখনো প্রতিযোগিতা হয়নি। কোনো বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশিত হয়নি। সরকারের ইচ্ছায় নিয়োগ হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ‘বিতর্কিত’ এ কে এম ফজলুল্লাহকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। গত বছরের ৩০ অক্টোবর তাঁকে অপসারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে এমডি পদে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে যোগ্য লোক খোঁজা শুরু করে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গঠিত কর্মসম্পাদন সহায়তা কমিটি। অর্থাৎ ওয়াসার ইতিহাসে এবারই প্রথম এ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো।
জানা গেছে, চলতি বছরের ২৪ মার্চ প্রথমবারের মতো বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। ২৫ মার্চ আবার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট কমিটি। এরপর ৭ এপ্রিল সংশোধিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তবে সব বিজ্ঞপ্তি বাতিল করে এখন নতুন করে আবার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে নতুন আকারে বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের বিষয়টি প্রথম আলোকে নিশ্চিত করেছেন ওয়াসার জনসংযোগ কর্মকর্তা কাজী নূরজাহান শীলা।
এ কে এম ফজলুল্লাহর নানা কর্মকাণ্ড বিতর্ক তৈরি করেছিল। তিনি কোনো প্রকল্পের কাজই নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেননি। প্রায় প্রতিবছরই পানির দাম বাড়িয়েছেন। নিজের বেতন-ভাতা প্রায় দেড় শ শতাংশ বাড়ানোর আবদারও করেন।এ কে এম ফজলুল্লাহর বিদায়ের পর চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির দায়িত্ব পালন করেছেন স্থানীয় সরকার বিভাগ চট্টগ্রামের পরিচালক মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা। গত ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে বদলি করা হয়। বর্তমানে স্থানীয় সরকার বিভাগ চট্টগ্রামের দায়িত্ব পালন করছেন মনোয়ারা বেগম। পাশাপাশি তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসার এমডির দায়িত্বও পালন করছেন।
১৯৬৩ সালে মাত্র তিনটি গভীর নলকূপ নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল চট্টগ্রাম ওয়াসা। শুরুতে সংস্থার প্রধানের পদ ছিল চেয়ারম্যান। এরপর ২০১১ সালে এসে এমডি পদটি সৃজন করা হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমডির পদটি সংস্থাটির জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তদারকি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই পদ। দায়িত্বে যিনি থাকেন, তিনি পুরো সংস্থার নকশা, উন্নয়ন, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর নজরদারি করেন। গ্রাহকের কাছে প্রাথমিকভাবে এমডিই দায়বদ্ধ থাকেন। ফলে এ পদে কে নিয়োগ পাচ্ছেন, তা নিয়ে এখন ওয়াসায় আলোচনা চলছে।
সংস্থাটির ইতিহাসে একমাত্র এমডি এ কে এম ফজলুল্লাহ তাঁর আমলে অন্তত ১০টি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৯টি প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে। একটির কাজ চলছে। সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেন। তবে একের পর এক প্রকল্প নিলেও নগরে পানির সংকট কাটেনি। প্রকল্পের সুফল নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।
এ কে এম ফজলুল্লাহর নানা কর্মকাণ্ড বিতর্ক তৈরি করেছিল। তিনি কোনো প্রকল্পের কাজই নির্ধারিত সময়ে শেষ করতে পারেননি। প্রায় প্রতিবছরই পানির দাম বাড়িয়েছেন। নিজের বেতন-ভাতা প্রায় দেড় শ শতাংশ বাড়ানোর আবদারও করেন। তবে বিদেশ সফর নিয়ে আলোচনা ছিল বেশি। তাঁর আমলেই ৪১ কর্মকর্তা-কর্মচারী উগান্ডায় প্রশিক্ষণের জন্য গিয়েছিলেন।
এমডি পদে ১৪ বছর ধরে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এক ব্যক্তিকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ইচ্ছায় এ কে এম ফজলুল্লাহ দফায় দফায় নিয়োগ পেয়েছেন। অবশেষে এ পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। আশা করা যায়, বর্তমান সরকার স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যোগ্য প্রার্থীকে এমডি পদে নিয়োগ দেবে।এস এম নাজের হোসাইন, সহসভাপতি, ক্যাবএখানেই শেষ নয়, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও উঠেছিল। ২০২০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর নামে দুদক চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক বরাবর দুর্নীতি, অনিয়ম ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ করেছিলেন চট্টগ্রামের বাসিন্দা হাসান আলী। পরে ২৩ সেপ্টেম্বর অভিযোগের বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তা জানতে চেয়েছিলেন হাইকোর্ট। আদালতের ওই পদক্ষেপের পর ওয়াসা ভবনের একটি কক্ষে রহস্যজনকভাবে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। আগুনে কম্পিউটার, গুরুত্বপূর্ণ নথি পুড়ে যায়।
বর্তমানে ওয়াসায় পয়োনিষ্কাশন প্রকল্পের কাজ চলমান। হালিশহর অঞ্চলে নির্মাণ করা হচ্ছে পয়ঃশোধনাগার। নগরজুড়ে বসানো হচ্ছে পয়ো–পাইপ সংযোগ। এর বাইরে নতুন দুটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে সরকার। একটি হলো উত্তর কাট্টলী অঞ্চলে (ক্যাচমেন্ট-৫) পয়োনিষ্কাশন প্রকল্প। আরেকটি পানি সরবরাহ উন্নয়ন প্রকল্প। দুই প্রকল্পে প্রায় ৬ হাজার ৭১৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্রুত এ পদে নিয়োগপ্রক্রিয়া শেষ করা উচিত বলে মনে করেন নগরের গ্রাহক ও বিশেষজ্ঞরা।
বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ এই পদে নিয়োগ হবে বলে আশা করেন ক্রেতা-ভোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণকারী জাতীয় প্রতিষ্ঠান কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এমডি পদে ১৪ বছর ধরে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় এক ব্যক্তিকেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ইচ্ছায় এ কে এম ফজলুল্লাহ দফায় দফায় নিয়োগ পেয়েছেন। অবশেষে এ পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। আশা করা যায়, বর্তমান সরকার স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় যোগ্য প্রার্থীকে এমডি পদে নিয়োগ দেবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স থ ন য় সরক র প রকল প র ক জ র জন য ব কর ছ ল র এমড প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলতে চান রিকশাচালক শফিকুল
বাঁশির সঙ্গে সখ্য সেই শৈশবে। গ্রামে যাত্রাপালায় গান করতেন আর বাঁশির সুরে ছড়াতেন মুগ্ধতা। জীবন-জীবিকার তাগিদে একসময় বেছে নেন রিকশাচালকের পেশা। গ্রাম ছেড়ে থিতু হন ব্যস্ত শহরে। তবে বাঁশের বাঁশিকে হাতছাড়া করেননি শফিকুল ইসলাম (৪৫)।
যানজটে গতি থামতেই রিকশার হ্যান্ডেল ছেড়ে শফিকুল কোমর থেকে হাতে নেন প্রিয় বাঁশি। হর্নের কর্কশ ধ্বনি এড়িয়ে তখন বাতাসে ভাসে সুরের মূর্ছনা। বেখেয়ালি যাত্রী আর পথচারীরা হঠাৎ মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকেন বাঁশিওয়ালার দিকে।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। সেই বাঁশির সুরেই যেন তাঁর জীবন বাঁধা। অভাব, দুর্দশা আর দারিদ্র্যও এ বন্ধন থেকে তাঁকে আলাদা করতে পারেনি। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।
শফিকুলের পৈতৃক ভিটা বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার শালিখা গ্রামে। তবে জীবিকার তাগিদে থাকেন বগুড়া শহরের মালতীনগর এলাকার একটি গ্যারেজে। গত রোববার বিকেলে তাঁর দেখা মেলে বগুড়া শহরের কোর্ট হাউস স্ট্রিটের ব্যস্ত সড়কে। শেষ বিকেলে যানজটে যখন পথচারীরা বিরক্ত, তখন বাতাসে ভেসে আসে ‘ওকি গাড়িয়াল ভাই’ ভাওয়াইয়া গানটির সুর।
দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে বাঁশির সঙ্গে মিতালি গড়েছেন শফিকুল। রিকশার প্যাডেলের ছন্দে তাঁর ঠোঁটে বিমূর্ত হয়ে বাঁশির করুণ সুর। বগুড়া শহরের পথচারীদের কাছে তিনি ‘বাঁশিওয়ালা রিকশাওয়ালা’ হিসেবে পরিচিত।এরই একফাঁকে আলাপ হয় শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। কথায় কথায় তিনি জানান, দারিদ্র্যের কারণে পঞ্চম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই পড়ালেখা বন্ধ করতে হয়। এরপর জড়িয়ে পড়েন গ্রামের একটি যাত্রাপালার দলে। ‘কাজলরেখা’, ‘সাগরভাসা’, ‘গুনাইবিবি’, ‘রাখালবন্ধু’, ‘রূপবান’সহ নানা লোককাহিনিনির্ভর যাত্রাপালায় অভিনয় ও গান করেছেন। শুধু তা–ই নয়, গানের সুরে হারমোনিয়ামও বাজাতেন। এসবের ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক রিকশা চালাতেন তখন।
পরিবারের বিষয়ে জানতে চাইলে শফিকুল বলেন, ২০০০ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রী মোর্শেদা গৃহিণী। তাঁদের তিন মেয়ে—শরীফা, শম্পা ও শাকিলা। এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী ও দুই মেয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকেন। মাসে দুবার তিনি বাড়িতে যান। শফিকুলের দাবি, বগুড়া শহরে রিকশা চালিয়ে দিনে পান ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। থাকা-খাওয়া ও রিকশার জমা খরচ ছাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা থেকে যায়। সেই টাকায় চলে সংসার।
শুরুতে শহুরে জীবন শফিকুলের একদম ভালো লাগত না, মন পড়ে থাকত সেই গ্রামে। মন ভালো রাখতে রিকশা চালানোর সময় গুনগুন করে গাইতেন। এর মধ্যে শহরের রাস্তায় একদিন এক বাঁশিওয়ালার সঙ্গে তাঁর দেখা। তাঁর কাছ থেকে উপার্জনের ৮০ টাকা দিয়ে একটি বাঁশি কেনেন তিনি। এরপর রাতে গ্যারেজে শুয়ে সেই বাঁশিতে সুর তোলেন। এখন বাঁশি তাঁর নিত্যসঙ্গী।
বাঁশি বাজাতে বাজাতে রিকশা চালানো অভ্যাস হয়ে গেছে জানিয়ে শফিকুল বলেন, যানজটে আটকা পড়লে বাঁশিতে সুর তোলেন। যাত্রী না পেলে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে একমনে বাঁশি বাজান। সুর শুনে যাত্রীরা ১০-২০ টাকা বেশি ভাড়া দেন কখনো কখনো।
গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী।শফিকুল ইসলামস্মৃতি হাতড়ে শফিকুল বলেন, একবার ঢাকায় রিকশা চালাতে গিয়েছিলেন। দৈনিক বাংলার মোড়ে রিকশা থামিয়ে একমনে বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটি ২০ তলা ভবন থেকে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তির চিৎকার শুনতে পান। ওপরে তাকাতেই ৫০ টাকার একটা নোট নিচে ফেলে দেন ওই ব্যক্তি। প্রশংসা করেন বাঁশির সুরের।
আলাপচারিতা একসময় আনমনে হয়ে পড়েন শফিকুল। বলেন, ‘মন তো (মনে) না পাওয়ার কষ্ট আচে। ১৬ বছর বয়সে এলাকার এক মেয়ের প্রেমে পড়চিনু। ৬ মাস ভালোই চলিচ্চিল সেই প্রেম। গরিব হওয়ার কারণে মেয়ের পরিবারের লোকজন প্রেমে বাধা হয়। বড়লোকের ছলের লগে বিয়ে হয় মেয়েটার। সেই থাকে গান আর সুর সঙ্গী। আরও পরে সঙ্গী হয় বাঁশি। এহন বাঁশির সুরে বিরহের কষ্ট ভুলে থাকপার চেষ্টা করি।’