‘সকালে ওই মোড়ে আমাদের দায়িত্ব ছিল। হঠাৎ কনস্টেবল এসে বলল, ‘‘স্যার রাস্তায় বাবু হয়েছে।” তাঁর কথা শুনে দৌড়ে গিয়ে দেখি সড়কেই নবজাতকের জন্ম দিয়েছেন মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী। এরপর ওয়াকিটকিতে সাহায্যের জন্য বলি। সে সময় জেলা পুলিশের একটি অ্যাম্বুলেন্স ওই সড়ক দিয়ে যাচ্ছিল। সেটিকে থামিয়ে পরে মা ও নবজাতককে হাসপাতালে পৌঁছাই।’

মুঠোফোনে কথাগুলো বলছিলেন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট জাহিদুর রহমান। আজ শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম নগরের দেওয়ানহাট মোড়ে সড়কের পাশে সন্তান জন্ম দেওয়া ওই নারী ও তাঁর সদ্য ভূমিষ্ঠ সন্তানকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পৌঁছে দেন তিনি।  

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছে, দুপুর ১২টার দিকে দেওয়ানহাট মোড়ে পুলিশ বক্সের বিপরীত পাশ থেকে তাদের উদ্ধার করা হয়। বর্তমানে মা ও নবজাতক দুজনেই সুস্থ আছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ওই ভারসাম্যহীন নারী প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। একসময় সড়কেই তিনি সন্তানের জন্ম দেন। তবে পথচারীদের কেউ এগিয়ে আসেনি। তাঁর চিৎকার শুনে এক পুলিশ সদস্য এগিয়ে যান। পরে আরও কয়েকজন এসে তাঁদের অ্যাম্বুলেন্সে করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় ওই নারীকে। অ্যাম্বুলেন্সে একজন সার্জেন্ট ছিলেন।

সার্জেন্ট জাহিদুর রহমান বলেন, ‘সেখানে আমি, সার্জেন্ট আবদুল্লাহ আল মুজাহিদ ও কনস্টেবল মহিউদ্দিন ছিলাম। বাচ্চাটা সড়কে পড়ে ছিল। আমরা আশপাশে নারী পথচারীদের অনুরোধ করছিলাম ওই নারীকে ঢেকে দেওয়ার জন্য। অনেক অনুরোধের পর দুজন এগিয়ে আসেন। তাঁদের সহায়তায় মা ও সন্তানকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলি।’

আরও পড়ুনসড়কের ধারে সন্তানের জন্ম দিলেন নারী, হাসপাতালে নিল পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস০৪ জুন ২০২২.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: জন ম দ

এছাড়াও পড়ুন:

রবীন্দ্রনাথ ও বাংলাদেশ

পিতৃ-আদেশে রবীন্দ্রনাথ উনিশ শতকের শেষ পর্বে যখন জমিদারিকাজ তদারকের জন্য তৎকালীন পূর্ববঙ্গে (বর্তমান বাংলাদেশে) এলেন, তখন সত্যিকার অর্থে রবীন্দ্রনাথের পুনর্জন্ম ঘটল। তাঁর জন্ম ভারতের রাজধানী কলকাতায়, সেখান থেকে বাবার সঙ্গে গিয়েছেন উত্তর ভারতে, হিমালয়ে; গিয়েছেন মেজ ভাইয়ের কর্মস্থল মধ্য-দক্ষিণ ভারতে আর ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডনে। যখন শিলাইদহ, শাহজাদপুর আর পতিসরে এলেন, পূর্ববঙ্গের পলিমাটিপ্রধান নদীবিধৌত প্রকৃতিলালিত সহজ–সরল মানুষের সংস্পর্শে রবীন্দ্রচেতনায় বিরাট-বিশাল পরিবর্তন সাধিত হলো। গঙ্গার তীরে জন্ম হলেও গঙ্গাজলের পবিত্রতায় আস্থা ছিল না তাঁর। শিলাইদহে এসে ভালোবাসলেন পদ্মাকে, পদ্মাতীরবর্তী মানুষদের। অধিকাংশ সময়ই থাকতেন পদ্মায়, বোটে। এই অকৃত্রিম ভালোবাসা তাঁর সাহিত্যে—বিশেষত ছোটগল্প, কবিতা ও গানের সৃষ্টিতে আমূল পরিবর্তন সঞ্চার করল। পদ্মায় বসবাস, পূর্ববঙ্গের প্রকৃতিলালিত মানুষের বৈশিষ্ট্য দর্শন ও এসবের প্রতি নিবিড় অনুরাগ তাঁর সৃষ্টিতে, চিন্তায় আর জীবনদর্শনে সার্বিক পরিবর্তন সাধন করল। একালে ভ্রাতুষ্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে লেখা চিঠি ‘ছিন্নপত্রে’র লাইনে লাইনে এর প্রত্যক্ষ প্রমাণ রয়েছে।

বিশ শতকের শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য বীরভূমের শান্তিনিকেতনে অনেকটা সময় ব্যয় করা শুরু করলেন। পূর্ববঙ্গে আসা কমতে থাকল, বাড়তে থাকল শান্তিনিকেতনে বাসের সময়। কিন্তু তিনি ভুলতে পারেননি পদ্মা ও পূর্ববঙ্গের মানুষের আকর্ষণ। মাঝখানে অনেক দিন কেটে গেল, সে কথা পরে বলব। তার আগে বলে নিই দীর্ঘকাল পরও পূর্ববঙ্গীয় অনুরাগের কথা। ১৯২৫ সাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার আমন্ত্রণ পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন। আসার ব্যাপারটা ঘটল ১৯২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে। প্রথমে কথা ছিল শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই আসবেন, কিন্তু জনগণের দাবি মেটাতে আগমনকাল এগিয়ে এনে তাদেরও সমান সময় দিলেন। ঢাকা থেকে গেলেন ময়মনসিংহে, সেখান থেকে কুমিল্লা হয়ে আগরতলা। তারপর জনতার দাবিতে চাঁদপুর এবং সবশেষে নারায়ণগঞ্জ হয়ে ফিরে গেলেন। এর মধ্যে অনেক ভাষণ তিনি দিলেন। তা থেকে দুটি ভাষণের বক্তব্য আমি এখানে উদ্ধৃত করব, যেখানে পূর্ববঙ্গ সম্বন্ধে তাঁর সুনির্দিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ও নিগূঢ় উপলব্ধির কথা আছে।

পূর্ববঙ্গের লোক নিষ্ঠাবান, দৃঢ়সংকল্প, সরলচিত্ত—তাঁরা বুদ্ধির অহংকারে বিদ্রূপ করে বড় কথাকে তুচ্ছ করেন না, তাই পূর্ববঙ্গ বাংলাদেশের অন্যতম কর্মক্ষেত্র।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

১৯২৬-এর ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে কুমিল্লার অভয়াশ্রমের তৃতীয় বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, ‘পূর্ববঙ্গের লোক নিষ্ঠাবান, দৃঢ়সংকল্প, সরলচিত্ত—তাঁরা বুদ্ধির অহংকারে বিদ্রূপ করে বড় কথাকে তুচ্ছ করেন না, তাই পূর্ববঙ্গ বাংলাদেশের অন্যতম কর্মক্ষেত্র, যার একটি রূপ অভয়াশ্রমে প্রত্যক্ষ করে তাঁর মনে আশার অঙ্কুরোদ্‌গম হয়েছে। মানবদেহে হৃৎপিণ্ডের মতো এই প্রতিষ্ঠানগুলোই দেশের মর্মস্থান, যেখান থেকে পল্লিসমূহে প্রাণ সঞ্চারিত হবে।’

দ্বিতীয় বক্তৃতাটি করেন নারায়ণগঞ্জে ২৭ ফেব্রুয়ারি সেখানকার ছাত্রসঙ্ঘ–প্রদত্ত মানপত্রের উত্তরে। রবীন্দ্রনাথ বলেন, তিনি যখন শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় গড়ে তোলেন, তখন ‘প্রথম দিকে সেখানকার অধিকাংশ ছাত্রই ছিল পূর্ববঙ্গের—চরিত্রের দৃঢ়তা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সরলতা প্রভৃতি যে গুণগুলি থাকলে কর্ম সফল হয়, তাদের মধ্যে সেই গুণ ছিল। এবারও নানা অনুষ্ঠান দেখে তাঁর মনে হয়েছে, পূর্ববঙ্গ কর্মী সংগ্রহের স্থান—এঁরা যে কর্মে প্রবৃত্ত হবেন, নিষ্ঠা ও সরলতা দ্বারা তাতে সফলতা লাভ করবেন। তাঁর বয়স থাকলে এখানেই তিনি কর্মে প্রবৃত্ত হতেন—এখানকার ভূমি যেমন উর্বর, মানুষের চিন্তাশক্তিও তেমনি উর্বর—কিন্তু নূতন কর্মক্ষেত্রে প্রবিষ্ট হওয়ার শক্তি তাঁর নেই। পশ্চিমবঙ্গের এক প্রান্তে বীরভূম তাঁর কর্মক্ষেত্র, সেখানকার ভূমি অনুর্বর, দারিদ্র্য ও ব্যাধি-ক্লিষ্ট অধিবাসীদের মনও কতকটা উদ্যমহীন।’ (রবিজীবনী, প্রশান্তকুমার পাল, নবম খণ্ড, পৃ. ২৯১)

রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণশক্তির প্রগাঢ়তা ছিল অসাধারণ; তাঁর পূর্ববঙ্গ তথা বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে যে অভিব্যক্তি ওপরে ব্যক্ত হয়েছে, তার যথার্থতা প্রশ্নাতীত।

রবীন্দ্রনাথ বলেন, তিনি যখন শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় গড়ে তোলেন, তখন প্রথম দিকে সেখানকার অধিকাংশ ছাত্রই ছিল পূর্ববঙ্গের—চরিত্রের দৃঢ়তা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও সরলতা প্রভৃতি যে গুণগুলি থাকলে কর্ম সফল হয়, তাদের মধ্যে সেই গুণ ছিল। এবারও নানা অনুষ্ঠান দেখে তাঁর মনে হয়েছে, পূর্ববঙ্গ কর্মী সংগ্রহের স্থান।প্রশান্তকুমার পাল

বিষয়: বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন

আমরা এরপরে আবার পেছনে ফিরে দেখব, সেটি বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন (১৯০৫-১১)। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এ দেশে শুরুতেই তাদের শাসন-শোষণ নিরঙ্কুশ করার স্বার্থে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি পরিচালনা করে। এ দেশের প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিন্দু জনগোষ্ঠীকে প্রথমে তারা কাছে টেনে নিয়ে তাদের ফুলেফেঁপে ওঠার নানা বন্দোবস্ত করে। ফলে এই সম্প্রদায় থেকেই একটি বৃহদাকারের জমিদার শ্রেণি, ধনাঢ্য শ্রেণি, প্রশাসনিক শ্রেণি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠে। শতাধিক কাল পরে উনিশ শতকের শেষ দিকে এই শ্রেণির মধ্যে শাসকদের নিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিসংক্রান্ত বিরোধ তীব্র হয়ে উঠলে শাসকশক্তি বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে একধরনের সমাধানের পথ খোঁজে। দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণে অবহেলিত পশ্চাৎপদ মুসলিমপ্রধান পূর্ববঙ্গীয় সমাজকে নিয়ে আলাদা প্রদেশ গঠনের পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে শাসককুল তাদের পুরোনো নীতির নতুন প্রেক্ষাপট রচনা করে। নতুন ব্রিটিশ নীতি-কৌশলে দীর্ঘকালের বঞ্চনাক্লিষ্ট অধিকাংশ মুসলমানের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটানো হয়। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত এত দিনকার সুবিধাপ্রাপ্ত জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশের স্বার্থে আঘাত করেছিল সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে এ–ও সত্য যে বঙ্গভঙ্গ অখণ্ড বাংলার জনমানসে প্রবলভাবে জাগিয়ে তুলেছিল অকৃত্রিম দেশাত্মবোধ।

রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে থেকে তিনি পূর্ববঙ্গের মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, এটি ভুল। তিনি বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে শুরুতে যুক্ত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর মধ্যে মূলত তীব্র ছিল স্বাদেশিকতার চেতনা।

রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হয়, বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে থেকে তিনি পূর্ববঙ্গের মুসলিম স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন, এটি ভুল। তিনি বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে শুরুতে যুক্ত হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাঁর মধ্যে মূলত তীব্র ছিল স্বাদেশিকতার চেতনা। দ্বিতীয়ত, তিনি বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করলেও এর বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন মাত্র কয়েক মাস, তা–ও আন্দোলনের মূল কার্যক্রম বর্জন নীতির প্রতি তীব্র অপছন্দ নিয়ে। অথচ আন্দোলন চলে ছয় বছরব্যাপী। বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হয় ১৯০৫-এর ১৬ অক্টোবর। সরকার আগে থেকেই বিষয়টি ঘোষণা করলে এর বিরুদ্ধে যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়, তাতে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে বিলাতি দ্রব্য বর্জন, তথা বর্জন প্রস্তাব গৃহীত হয়ে দেশব্যাপী আন্দোলন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ এ রূপ বয়কট বা বর্জন নীতির মতো নেতিবাচকতার সমর্থক ছিলেন না। তবে এ সময়ে (শ্রাবণ-আশ্বিন) তিনি স্বাদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লিখেছেন অনেকগুলো দেশাত্মবোধক গান। যেমন ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’, ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘আমার সোনার বাংলা’, ‘আজ বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে’, ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক’, ‘ওদের বাঁধন যতই শক্ত হবে’, ‘বিধির বাঁধন কাটবে তুমি’, ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’, ‘আমি ভয় করব না’ প্রভৃতি। এ গানগুলোর বৈশিষ্ট্য হলো, এগুলো বাংলার নিজস্ব সুরে বাঁধা। এতে রয়েছে বাউল, কীর্তন, রামপ্রসাদী, ভাটিয়ালি, সারিগান প্রভৃতির সুর। সাধারণ মানুষের কাছে এর বাণী যেমন সহজে পৌঁছায়, তেমনি এর সুরও সহজে তাঁদের মর্মে প্রবেশ করে। এ সময় থেকেই দেশীয় সুরের প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়, আর এসব গানের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর মনে যেমন তিনি ভাবের জোয়ার বইয়ে দেন, তেমনি শক্তি-চেতনারও বিপুল উজ্জীবন ঘটান।

রবীন্দ্রনাথের কাছে বর্জন নীতির পরিবর্তে প্রথম থেকেই মনে হয়, বাংলার প্রধান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যসাধন সবচেয়ে জরুরি। সে কারণে বঙ্গভঙ্গ কার্যকর হওয়ার দিনটিতে (১৬ অক্টোবর) তাঁরই প্রস্তাবে ‘রাখিবন্ধন’ উৎসব পালিত হয়। তাতে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নিজে মসজিদে প্রবেশ করে ইমামের হাতে রাখি বেঁধে দেন। বর্জন আন্দোলনে যে উন্মাদনা ও উন্মত্ততাই প্রবল, অচিরেই সেই উপলব্ধি রবীন্দ্রমনকে অস্বস্তিতে ফেলে। ১৯০৫-এর ১০ ডিসেম্বর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লেখেন, ‘উন্মাদনায় যোগ দিলে কিয়ৎপরিমাণে লক্ষ্যভ্রষ্ট হইতেই হয় এবং তাহার পরিণামে অবসাদ ভোগ করিতেই হয়। আমি তাই ঠিক করিয়াছি যে, অগ্নিকাণ্ডের আয়োজনে উন্মত্ত না হইয়া যতদিন আয়ু আছে, আমার এই প্রদীপটিকে জ্বালিয়া পথের ধারে বসিয়া থাকিব।’ এভাবে তিনি আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেন। ১৯০৬ থেকে ১৯০৮ সালের মধ্যে তিনি অনেক প্রবন্ধ লেখেন, তার মধ্যে ‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ (১৯০৭), ‘পথ ও পাথেয়’ (১৯০৮) ও ‘সমস্যা’ (১৯০৮) নামের তিনটি প্রবন্ধ থেকে কিছু বক্তব্য উদ্ধৃত করব, যা থেকে রবীন্দ্রনাথের একালের মনোভঙ্গির মূলভাবটি বোঝা সহজ হবে। এর প্রতিটি প্রবন্ধেই তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের দমননীতির সমালোচনা করেন, কিন্তু পাশাপাশি বাঙালির ঐক্যের প্রসঙ্গে যা বলেন, সেটিই অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।

‘ইংরেজ মুসলমানদের গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছে’—এ কথা যদি সত্যও হয়, তবু ইংরেজদের এমন সুযোগসন্ধানী কার্যক্রমে রাগ করে তো লাভ নেই; বরং ভাবা দরকার, ছিদ্র না জেনে শনি তো প্রবেশ করতে পারে না। তাই শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই বেশি সাবধান হওয়া দরকার।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

‘ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধে বলেন, ‘ইংরেজ মুসলমানদের গোপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করছে’—এ কথা যদি সত্যও হয়, তবু ইংরেজদের এমন সুযোগসন্ধানী কার্যক্রমে রাগ করে তো লাভ নেই; বরং ভাবা দরকার, ছিদ্র না জেনে শনি তো প্রবেশ করতে পারে না। তাই শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই বেশি সাবধান হওয়া দরকার। বলেন, হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ নিয়ে আমাদের দেশে অনেক দিন ধরে চলে-আসা একটা পাপ আছে। দুই সম্প্রদায়ের ভেতরকার কলুষতার দিকটি বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে এমন বীভৎস আকারে দেখা না দিলে হিন্দু সমাজ একে স্বীকার করতই না। বহুশত বছর পাশে পাশে থাকলেও প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত ধর্মবিহিত তা আমাদের মধ্যে হয়নি। এক ফরাসে হিন্দু-মুসলমানের না বসা, মুসলমানের জন্য হুঁকার জল ফেলে দেওয়া, মুসলমানের প্রতি ঘৃণা প্রভৃতিকে তিনি পাপ হিসেবে দেখেছেন। আমাদের ভেতরকার এই পাপই ইংরেজের শক্তি। ইংরেজরা চলে গেলেই দেশ যে আমাদের স্বদেশ হয়ে উঠবে, তা নয়। আমরা মানুষ হিসেবে যদি এক না হতে পারি, সেটা লজ্জা, সেটা অধর্ম।

‘পথ ও পাথেয়’ প্রবন্ধে বলেন, ইংরেজের প্রতি সর্বসাধারণের বিদ্বেষই যে আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে তুলবে, তা–ও না। শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দেশের মঙ্গলসাধনের জন্য ঐক্যের বিকল্প নেই। সে জন্য তিনি দেশের উচ্চ-নীচ, হিন্দু-মুসলমান-খ্রিষ্টান সবার মধ্যে হৃদয়ের যোগ সৃষ্টির আহ্বান জানান। ‘সমস্যা’ প্রবন্ধে বলেন, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যকার অনৈক্যের দুর্বলতা দেশের কল্যাণসাধনের অন্তরায়। তাঁর ভাষায়, ‘আমরা পরস্পরকে শ্রদ্ধা করি নাই, সহায়তা করি নাই, আমরা যে পরস্পরকে চিনিবার মাত্রও চেষ্টা করি নাই... সেই ঔদাসীন্য অবজ্ঞা সেই বিরোধ আমাদের একান্তই ঘুচাইতে হইবে...।’ এটা না হলে ধর্ম পীড়িত হবে, মনুষ্যত্ব সংকুচিত হবে। নির্ভীক নির্বাধ বিপুল মনুষ্যত্বের অধিকারী হওয়ার জন্যই আমাদের পরস্পরকে ধর্মের বন্ধনে বাঁধতে হবে। ভারতবর্ষে যারা আছে আর যারা এসেছে, সবাইকে নিয়েই সম্পূর্ণতা অর্জন করতে হবে। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন নিয়ে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে যে ধারণা প্রচলিত আছে, তা যে কী পরিমাণে ভুলে ভরা, তা ওপরের বক্তব্য থেকে পরিষ্কার।

আমাদের সংগ্রামশীল জীবনধারায় আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করলাম, তিনি পশ্চিমবঙ্গীয় রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা। পশ্চিমবঙ্গীয় রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি বিশেষ ধর্মীয় সূত্রে গাঁথা। আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে পেলাম, তিনি অনেক বেশি মনুষ্যধর্মের রবীন্দ্রনাথ।

প্রসঙ্গ: বাংলাদেশ-আন্দোলন

এবার আসি বাংলাদেশ প্রসঙ্গে। আগেই বলেছি, জমিদারিকাজের সূত্রে এলেও পূর্ববঙ্গের স্পর্শে রবীন্দ্রনাথের একধরনের পুনর্জন্ম ঘটেছিল। তাঁর লেখার বিষয় ও চেতনায় এক বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছিলেন। পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশে না এলে এ পূর্ণায়ত রবীন্দ্রনাথকে আমরা পেতাম না। এর পরে ১৯৪৭-উত্তরকালে পূর্ব বাংলা যখন আলাদা দেশ হয়ে উঠল, তখন রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে নতুনভাবে আবিষ্কৃত হলেন। আমাদের নতুন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে রবীন্দ্রনাথ ভিন্নরূপে আবির্ভূত হলেন। আমাদের ভাষার সংগ্রামে, শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংগ্রামে, স্বাধিকারের সংগ্রামে, সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ আমাদের আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠলেন। আমাদের সংগ্রামশীল জীবনধারায় আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কার করলাম, তিনি পশ্চিমবঙ্গীয় রবীন্দ্রনাথ থেকে আলাদা। পশ্চিমবঙ্গীয় রবীন্দ্রনাথ অনেক বেশি বিশেষ ধর্মীয় সূত্রে গাঁথা। আমরা যে রবীন্দ্রনাথকে পেলাম, তিনি অনেক বেশি মনুষ্যধর্মের রবীন্দ্রনাথ। এমনকি আমাদের জাতীয় সংগীতের কথাই যদি বলি, তাহলেও এই পার্থক্যটা স্পষ্ট হবে। আমরা আমাদের জাতীয় সংগীত যে সুরে গাই, যে সুরটা একান্তভাবে বাংলাদেশের, আর সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে যে ‘আমার সোনার বাংলা’ তার স্বরলিপি ভিন্ন। আমাদের সোনার বাংলার উপলব্ধি আর পশ্চিমবঙ্গের সোনার বাংলা এক না। ওটা ওদের কাছে রবীন্দ্রনাথের যেকোনো একটা গানের মতো সাধারণ, আর আমাদের জাতীয় সংগীতের বাণীসহ সমগ্র ভাবমণ্ডল আমাদের বাংলাদেশের পুরো জাতির আত্মিক অনুভূতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত।

সম্পর্কিত নিবন্ধ