গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানায় সরকারের অংশ ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির বাকি ৭৫ শতাংশ মালিকানা ঋণগ্রহীতাদের।

গ্রামীণ ব্যাংকই মালিকানায় সরকারের অংশ কমানোর প্রস্তাবটি দিয়েছে। সরকারের হাতে পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যানসহ যে তিনজন পরিচালক নিয়োগ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে তা–ও কমিয়ে আনতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। গ্রামীণ ব্যাংক চায়, সরকার শুধু একজন পরিচালক নিয়োগ করবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ও গ্রামীণ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দুই সপ্তাহ পর গত ২০ আগস্ট গ্রামীণ ব্যাংকের তৎকালীন চেয়ারম্যান এ কে এম সাইফুল মজিদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। তাঁর পরিবর্তে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের শিক্ষক আবদুল হান্নান চৌধুরীকে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান নিয়োগ করা হয়।

আবদুল হান্নান চৌধুরী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেয়েই গ্রামীণ ব্যাংক আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেন, যা অধ্যাদেশ আকারে জারি হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ ইতিমধ্যে অধ্যাদেশের একটি খসড়া তৈরি করে মতামতের জন্য গত ২৬ নভেম্বর থেকে ওয়েবসাইটে দিয়ে রেখেছে। তবে গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এর ওপর কোনো মতামত পাওয়া যায়নি বলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।

বিষয়টি এখন কী পর্যায়ে আছে- তা জানতে চাইলে গতকাল শনিবার আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে বিভাগটির বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে নিয়ে এরই মধ্যে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়েছে। আগামী সপ্তাহে আরেকটি বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে। সেটি হওয়ার পর চূড়ান্ত খসড়া দাঁড় করানো হবে। এর পর উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে অনুমোদিত হলে তা যাবে আইন মন্ত্রণালয়ে। আইন মন্ত্রণালয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে পাঠানোর পর অধ্যাদেশ জারির জন্য তা পাঠানো হবে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে।

প্রচলিত ব্যাংকের তুলনায় গ্রামীণ ব্যাংক একেবারেই আলাদা। প্রায় ২৪ হাজার কর্মচারীকে বছরে ৯০ কোটি টাকার বোনাসই দেয় গ্রামীণ ব্যাংক। আমরা প্রস্তাব করেছি, এ ব্যাংকের পর্ষদে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়ুক এবং তাঁরা আরও বেশি সুবিধা পানআবদুল হান্নান চৌধুরী, চেয়ারম্যান, গ্রামীণ ব্যাংক।

অধ্যাদেশ হলে ঋণগ্রহীতারাই ধীরে ধীরে গ্রামীণ ব্যাংকের মূলধনে অবদান বাড়াবেন। গ্রামীণ ব্যাংকের ১২ সদস্যের পরিচালনা পর্ষদে বর্তমানে চেয়ারম্যানসহ সরকারের মনোনীত তিনজন পরিচালক এবং ঋণগ্রহীতাদের নির্বাচিত নয়জন পরিচালক রয়েছেন। নতুন প্রস্তাব পাস হলে ঋণগ্রহীতাদের পক্ষে পরিচালকের সংখ্যা ৯ থেকে বেড়ে ১১ জনে উন্নীত হবে। আর মালিকানায় ঋণগ্রহীতাদের হিস্যা ৭৫ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়াবে ৯৫ শতাংশ। বর্তমান আইনে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নিয়োগের ক্ষমতা সরকারের হাতে থাকলেও নতুন অধ্যাদেশ পাস হওয়ার পর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবেন পর্ষদ সদস্যদের মধ্য থেকে।

বর্তমান আইনে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে বা তিনি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হলে সরকার তার মনোনীত দুই পরিচালকের মধ্যে একজনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। কিন্তু খসড়া প্রস্তাবে এ বিধান বাদ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, চেয়ারম্যান অক্ষম হলে পর্ষদ সদস্যরাই অন্য কোনো পরিচালককে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের অনুমোদন দিতে পারবেন।

বিদ্যমান আইনে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সর্বোচ্চ ৬০ বছর বয়স পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করতে পারেন। প্রস্তাবিত খসড়ায় এ বিধান বহাল রেখেও পর্ষদের অনুমোদনের ভিত্তিতে এমডির মেয়াদ সর্বোচ্চ ৬৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।

বর্তমান আইনে পরিচালকদের মেয়াদ তিন বছর, খসড়া অধ্যাদেশেও তাই রাখার কথা বলা হয়েছে। সংযোজন আকারে এও বলা হয়েছে, নবনির্বাচিত পরিচালকেরা তাঁদের দায়িত্ব গ্রহণ না করার আগে পর্যন্ত নির্বাচিত পরিচালকেরা পদে থাকবেন। বর্তমানে গ্রামীণ ব্যাংকের নতুন আঞ্চলিক অফিস খোলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক। অধ্যাদেশের খসড়ায় তা বাদ দেওয়া হয়েছে।

বর্তমান আইনে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে জোবরা গ্রামে মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের কোনো উল্লেখ নেই। খসড়া অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, গ্রামীণ ব্যাংক প্রকল্প বলতে ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধীন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার জোবরা গ্রামে পরিচালিত ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে বোঝায়। এ প্রকল্প পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন পায় এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকসহ (বিকেবি) অন্যান্য ব্যাংক এতে অংশগ্রহণ করে।

জানতে চাইলে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান আবদুল হান্নান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রচলিত ব্যাংকের তুলনায় গ্রামীণ ব্যাংক একেবারেই আলাদা। প্রায় ২৪ হাজার কর্মচারীকে বছরে ৯০ কোটি টাকার বোনাসই দেয় গ্রামীণ ব্যাংক। আমরা প্রস্তাব করেছি, এ ব্যাংকের পর্ষদে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়ুক এবং তাঁরা আরও বেশি সুবিধা পান।’

প্রস্তাবিত খসড়া অনুমোদন হলে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য তথা নারীরাই বেশি উপকৃত হবেন বলে মনে করেন আবদুল হান্নান চৌধুরী।

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম, এখানে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা নেই: জেড আই খান পান্না

মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর দিয়েই বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে মন্তব্য করে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেছেন, এই দেশে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।

আজ শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট বারের হলরুমে ‘বাংলাদেশে মানবাধিকার সংকট ও আইনি প্রতিকার পাওয়ার পথ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন জেড আই খান পান্না। সেমিনারটির আয়োজন করে আন্তর্জাতিক সংস্থা হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিস (এইচআরসিবিএম), বাংলাদেশ চ্যাপ্টার।

বক্তব্যে জেড আই খান পান্না বলেন, ‘এখানে সংখ্যালঘুর কথা বলা হচ্ছে। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এখন আমি সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু। আজ মুক্তিযোদ্ধার গলায় জুতার মালা দেখি, জুতা দিয়ে বাড়ি দিতে দেখি, কিন্তু কিছু করতে পারি না। তাই আমি সবচেয়ে বড় অসহায়।’

এসব কথা বলতে বলতে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না কেঁদে ফেলেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, জীবনে কখনো জেনে-বুঝে অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। যাঁরা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেন, তাঁদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।

জেড আই খান পান্না আরও বলেন, ৩০ লাখ শহীদ আর ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, কারও সঙ্গে এর তুলনা চলে না। এটা সাম্প্রদায়িকতার দেশ না। সংবিধানে যেন কেউ হাত না দেয়। সরকারের অনেকেই বিদেশি হয়েও স্বদেশি ভাব দেখাচ্ছেন।

সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের মৌলিক অধিকার ও মানবাধিকার যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। সমাজে ন্যায়বিচার বা সুবিচার পাওয়ার কথা থাকলেও তা মিলছে না। সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিচার হয় না। কেউ কেউ ধরা পড়লেও পরে বেরিয়ে যায়।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুমন কুমার রায় বলেন, সব সরকারের আমলেই বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত। বর্তমান নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সবচেয়ে বেশি উপেক্ষিত সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। সংস্কার কমিশনে সংখ্যালঘুদের কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় হামলা হলেও সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া আসে না, এমনকি দুঃখও প্রকাশ করে না।

গত বছরের ৫ আগস্টের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রেক্ষিতে প্রতিবাদ শুরু হলে তা দমন করতেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে উল্লেখ করে সুমন কুমার দাবি করেন, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সনাতনী সম্প্রদায়ের বাক্‌স্বাধীনতা বন্ধ করতে, নেতৃত্ব দমন করতে এসব করা হচ্ছে।

সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জে কে পাল। সঞ্চালনায় ছিলেন এইচআরসিবিএমের বাংলাদেশ চ্যাপটারের আহ্বায়ক লাকি বাছাড়। সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরশেদ ও মো. গোলাম মোস্তফা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ