চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ভাতারা খালের তীরে এক বাড়িতে ৭০০  পরিবারে ১০ হাজার লোক বসবাস করছে। তাদের ভোটে একটি ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়। গ্রামের নাম মেহারন। এটি উপজেলার নায়েরগাও দক্ষিণ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডে অবস্থিত।  

সোমবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে মেহারন গ্রামে গেলে পরিবারটির বিষয়ে জানা যায়।

স্থানীয়রা জানান, ধনাগোদা নদী থেকে আসা বোয়ালজুরী খালের শাখা ভাতারা খাল। এর তীর ঘেঁষে মেহারন বিলের সঙ্গে মিশে দুটি প্রাচীন জমিদার বাড়ি ঘিরে গড়ে উঠেছে মেহারন দালাল বাড়ি। যেখানে ভোটার ৩ হাজারেরও বেশি।

সেখানকার বাসিন্দা সুবল দাস জানান, মেহারন দালাল বাড়ির সঠিক ইতিহাস নিয়ে নানামুখী বক্তব্য থাকলেও আনুমানিক ৪০০ বছর আগে মতলবের কাশিমপুর এলাকার জমিদার ও কুমিল্লার গৌরীপুর এলাকার জমিদারের মধ্যে বিবাদ থেকে রণক্ষেত্র তৈরি হয়। সেই রণক্ষেত্র শব্দটি ‘মহারণ’ নামেও পরিচিত। আর এই মহারণ থেকে মেহারন নামের উৎপত্তি।

তিনি আরও জানান, এক সময় কুমিল্লার লাকসামের জমিদার এসে মতলবের আলীয়ারা গ্রামে বসে খাজনা আদায় করতেন। তবে অনেকটা দূরের হওয়ায় ওই জমিদারদের এখানকার চাষিরা খাজনা দিতে চাইতেন না। তখন লাকসামের জমিদার কালীবাবু মেহারন গ্রামের জমিদার দ্বারিকানাথ দাস ও বৈকুণ্ঠ দাসকে খাজনা তোলার দায়িত্ব দেন। এরপর থেকে মেহারনের জমিদাররা আলীয়ারা ও নারায়ণপুর গ্রামের খাজনা উঠাতেন। এর ভাগ লাকসামের জমিদারকেও দিতেন। জমিদারদের ব্রিটিশরা উপাধি দেয় ‘দালাল’ বলে। এ জন্য এ বাড়ির নাম ‘মেহারন দালাল বাড়ি’। কথিত রয়েছে, জমিদার দ্বারিকানাথ দাস, বৈকুণ্ঠ দাস ও গিরিশচন্দ্র দাস যখন খাজনা আদায় করতেন, তখন স্থানীয় লোকজন তাদের ‘দালাল’ বলে ডাকতেন। সেই থেকে মেহারনের জমিদারদের নামের সঙ্গে ‘দালাল’ তকমাটি যুক্ত হয়। বর্তমানে মেহারনবাসীর অনেকে সেই জমিদারদের বংশধর।

রিপন দাস জানান, দ্বারিকানাথ দাসরা চার ভাই হলেও বুদ্ধি ও মেধার দাপটে ক্ষমতাধর ব্যক্তি হয়ে উঠে ছিলেন দ্বারিকানাথ দাস। তিনি তার চার ছেলের জন্য দুটি ভবন নির্মাণ করেন ১২৭ বছর আগে। দুইতলা ওই দুটি ভবনের প্রতি তলায় একজন করে মোট চার ভাইয়ের পরিবার থাকতেন। এর একটি ১৩৩৫ বঙ্গাব্দে এবং অপরটি ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে নির্মিত হয়েছিল। দালালদের ৪র্থ প্রজন্ম এখনও বাড়িটিতে বসবাস করছেন।

দ্বারিকানাথ দাসের নাতির বৌ লাকি রানী দাস বলেন, ‘‘পরিবারের পুরুষ লোকেরা ঢাকায় মাছের কাজে জড়িত। মহিলারা এখানে বসবাস করছি। লোকজন নানা সময় এসে দালাল বাড়ির ইতিহাস জানতে চায় এবং জমিদার ভবনের ছাদে যেতে চাইলে আমরা দেখাই। আমাদের কাছে ভালোই লাগে।’’ 

মতলব উপজেলা যুব ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব চন্দন বিশ্বাস জানান, কালের সাক্ষী হয়ে দুটি ভবনকে ঘিরে প্রায় দেড় কিলোমিটার জুড়ে ছোট ছোট টিনের ঘর, আধা পাকা টিনের ঘর ও বেশ কিছু দালানও গড়ে উঠেছে। এছাড়াও বাড়িটিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি জুনিয়র উচ্চ বিদ্যালয়, ছোট-বড় মিলিয়ে আটটি মন্দির এবং ৬০টির মতো টিউবওয়েল আছে। দিনরাত ২৪ ঘণ্টায় ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে শান্তিপূর্ণভাবে মন্দিরে পূজার্চনায় ব্যস্ত থাকেন মেহারনের দালাল বাড়ির বাসিন্দারা। 

মতলব উপজেলা যুব ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক সমীর ভট্টাচার্য জানান, দালাল বাড়ির সবাই সনাতন হিন্দু ধর্মালম্বী এবং এরা অধিকাংশই জেলে। তবে চাহিদা মেটাতে এখানে মুদি দোকান হতে শুরু করে সবজি বাজার গড়ে উঠেছে। যেখানের ক্রেতা-বিক্রেতা সব এখানকার মানুষ। এ বাড়ির সড়ক অত্যন্ত সরু এবং এক ঘরের ভিতর দিয়ে অন্য ঘরে যাওয়ার চলাচলের পথ। শান্ত নিরিবিলি এ গ্রামের প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সঙ্গে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এখানকার ছেলেদের বিয়ে হয়।

মেহারন উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মাধব চন্দ্র দাস জানান, জরাজীর্ণ অবস্থাতেও স্কুলটিতে পড়ালেখা চলছে। বিজ্ঞান বিভাগে শিক্ষার্থীদের জন্য মাল্টিমিডিয়ায় ক্লাস নেওয়ার ইচ্ছা থেকেও তা হচ্ছে না। ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণীর ১১০ জন শিক্ষার্থীর জন্য এখানে শিক্ষক মাত্র ৫ জন। খেলার মাঠ এবং ভবনটি সংস্কার প্রয়োজন। স্কুল ভবনের জমি মন্দিরের নামে হওয়ায় স্কুলটি এমপিওভুক্তিও করা যাচ্ছে না। 

নায়েরগাও দক্ষিণ ইউনিয়নের ৯নং ওয়ার্ডের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ভরত চন্দ্র দাস বলেন, মেহারন দালাল বাড়ির নানামুখী সমস্যা রয়েছে। এরমধ্যে সেনিটাইজেশন ব্যবস্থা, টিউবওয়েল, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, উন্নত রাস্তা, মন্দির সংস্কারসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি। 

নায়েরগাও দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস ছালাম মৃধা মামুন বলেন, ‘‘রাস্তা মেরামতসহ যাবতীয় সমস্যা সমাধানে প্রশাসনের সহায়তা চাই। আমি দায়িত্ব নিয়ে বেশ কয়েকবার রাস্তা মেরামতের উদ্যোগ নিয়েও নানা প্রতিবন্ধকতায় করা হয়ে ওঠেনি। স্কুলটির সমস্যার কথাও প্রশাসনকে অবগত করেছি।’’ 

এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন জানান, দ্রুতই মেহারন গ্রাম পরিদর্শন করে তাদের স্কুলের সমস্যা এবং সব সমস্যা সমাধানে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে উদ্যোগ নেবেন। 
 

ঢাকা/জয়/বকুল

.

উৎস: Risingbd

এছাড়াও পড়ুন:

ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিরোধ, চাচার মারধরে ভাতিজার মৃত্যুর অভিযোগ

চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ব্রাহ্মণচক গ্রামে চাচার কিল–ঘুষি ও মারধরে ভাতিজার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। আজ বুধবার সকাল সাড়ে সাতটার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

নিহত মাইনউদ্দিন সরকার (৪৫) উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের ব্রাহ্মণচক গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ওই গ্রামের রুহুল আমিন সরকারের ছেলে। তিনি পেশায় বিদ্যুৎমিস্ত্রি ছিলেন। অভিযুক্ত মো. ফারুক (৫০) তাঁর চাচা। ঘটনার পর পুলিশ ফারুকের স্ত্রী মাফিয়া বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে।

পুলিশ ও পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একটি বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) থেকে যৌথভাবে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা নিয়ে চাচা–ভাতিজার মধ্যে বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটে।

একই সূত্রে জানা গেছে, স্থানীয় একটি এনজিও থেকে কয়েক মাস আগে ফারুক ও মাইনউদ্দিন যৌথভাবে এক লাখ টাকা ঋণ নেন। ঋণের কিস্তি সমানভাবে পরিশোধের সিদ্ধান্ত হয়। চলতি মাসের কিস্তির ১৫ হাজার টাকা ফারুকের মাধ্যমে জমা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু মাইনউদ্দিন নিজেই ওই টাকা জমা দেন। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে কথা–কাটাকাটি হয়েছিল। আগেও তাঁদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে বিরোধ ছিল। আজ সকালে কিস্তি পরিশোধ নিয়ে দুজনের মধ্যে আবারও কথা–কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে ফারুক ভাতিজা মাইনউদ্দিনের মাথা, মুখ ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে কিল–ঘুষি মারেন। এতে মাইনউদ্দিন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অচেতন হয়ে যান। আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলে ফারুক পালিয়ে যান।

পরে গুরুতর আহত অবস্থায় মাইনউদ্দিনকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। সকাল ১০টার দিকে পুলিশ তাঁর মরদেহ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়।

নিহত মাইনউদ্দিনের চাচাতো ভাই মোহাম্মদ লিয়াকত হোসেন বলেন, মো. ফারুকের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলা আছে। তিনি নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত। ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ ও পূর্বশত্রুতার জেরে পরিকল্পিতভাবে কিল–ঘুষি মেরে ও মারধর করে তাঁর চাচাতো ভাইকে খুন করেন ফারুক।

অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্যের জন্য ফারুকের মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে, তা বন্ধ পাওয়া যায়।

মতলব উত্তর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রবিউল হক বলেন, ওই ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের মর্গে পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা দায়ের প্রক্রিয়াধীন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রী মাফিয়া বেগমকে আটক করা হয়েছে। এটি হত্যাকাণ্ড বলেই প্রাথমিকভাবে মনে করা হচ্ছে। ঋণের কিস্তির টাকা পরিশোধ বা জমা দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটকের চেষ্টা চলছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঋণের কিস্তি পরিশোধ নিয়ে বিরোধ, চাচার মারধরে ভাতিজার মৃত্যুর অভিযোগ