হাত বদলে দাপট দেখাচ্ছে মাটিখেকো চক্র
Published: 30th, January 2025 GMT
গত সরকারের আমলে ক্ষমতাসীন দলের অনুসারীরা প্রকৃতি ও পরিবেশ খুবলে খাওয়ার যে ভয়াবহ চক্র গড়ে তুলেছিল, তা এখনও চলমান। ক্ষমতার পালাবদলে পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। বরং এসব চক্রের চালকের আসনে এসেছে নতুন মুখ। তাদের হাত ধরে হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে চলছে বালু ও মাটিখেকোদের বেপরোয়া কর্মকাণ্ড।
জেলাজুড়ে মাটিখেকো চক্রের সদস্যরা অব্যাহত রেখেছে কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি কেটে বিক্রির তৎপরতা। কৃষি বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার নির্দেশনা দেওয়ার পরেও থামছে না এই যজ্ঞ।
টপ সয়েল হলো মাটির ওপরের স্তর। মাটির এই স্তরে জৈব পদার্থ এবং অণুজীবের সর্বাধিক ঘনত্ব বিদ্যমান; যেখানে প্রকৃতির অধিকাংশ জৈবিক কার্যকলাপ ঘটে। প্রাকৃতিকভাবে মাটির উপরিভাগের এই স্তরের উর্বরতা ও ফসল উৎপাদনের সক্ষমতা সর্বোচ্চ। তাই কৃষি বা ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি ক্ষয় হলে বা হ্রাস পেলে ফসল উৎপাদন ভয়াবহ ব্যাহত হয়; যা সামগ্রিকভাবে একটি অঞ্চলে তীব্র খাদ্য সংকট সৃষ্টির অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে।
কৃষি অফিসের তথ্যমতে, জমির উপরিভাগের ছয় থেকে দশ ইঞ্চিতে জৈব পদার্থ বিদ্যমান। এই অংশটিই টপসয়েল। এই স্তরের মাটি কাটার ফলে জমির ফসল উৎপাদনের ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই কৃষিজমির এই স্তরের মাটি কাটা ও বিক্রি করা আইনত নিষিদ্ধ। তবে মাটিখেকো চক্রের সদস্যরা স্থানীয় কৃষকদের নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে ফাঁদে ফেলছে। প্রান্তিক কৃষক ভবিষ্যতের ভয়াবহতা অনুমান করতে না পেরে অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দিচ্ছে নিজেদের জমির টপসয়েল।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ (সংশোধিত ২০১২ এর ৬ ধারা) অনুযায়ী, প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট টিলা ও পাহাড় নিধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্যদিকে ১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত ২০০১) অনুযায়ী, কৃষিজমির টপসয়েল বা উপরিভাগের মাটি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করাও সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।
সাধারণ কৃষকরা জানান, কিছু জমি পলিমাটি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। যার কারণে সেসব জমির উপরিভাগের মাটি কাটতে দিচ্ছেন তারা। স্থানীয়রা জানান, টপ সয়েল কেটে নিয়ে শুধু যে ফসলি জমি ধ্বংস করা হচ্ছে তা নয়, এই মাটি পরিবহনের কাজে যেসব ভারী যানবাহন ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলোর কারণে স্থানীয় সড়ক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি রক্ষায় প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সচেতন মহল।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলা, নবীগঞ্জ, চুনারুঘাট, শায়েস্তাগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, বানিয়াচং, বাহুবল, লাখাই, মাধবপুরসহ প্রতিটি উপজেলায় চলছে এই টপসয়েল কেটে নেওয়ার কাজ। অসচেতন কৃষক আর ধূর্ত মাটিখেকো চক্রের সদস্যদের কারণে প্রাণশক্তি হারাচ্ছে এই অঞ্চলের উর্বর ফসলের প্রান্তর। প্রতিদিন হাওরের বিভিন্ন ফসলি জমিতে এক্সক্যাভেটর লাগিয়ে মাটি কাটা শুরু হয়। স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি ট্রাক্টর মাটি মাত্র ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় কিনে নিয়ে ভাটায় বিক্রি করা হচ্ছে দ্বিগুণ দামে।
হবিগঞ্জ সদর উপজেলার সুলতানশী এলাকার বাসিন্দা অনিক জানান, কয়েক বছর ধরেই কৃষিজমি থেকে মাটি কাটার প্রবণতা বেড়ে চলেছে। পরিস্থিতির পরিবর্তনের কারণে এ ক্ষেত্রে স্বস্তি মিলবে বলে আশা ছিল। তবে সেটি হয়নি। মাটিখেকো চক্রের নিয়ন্ত্রণে শুধু হাত বদল হয়েছে। কৃষকদের সামান্য কিছু টাকা দিয়ে তাদের জমি থেকে অমূল্য এই মাটি কেটে নেওয়া হচ্ছে। আঞ্চলিক খাদ্যভান্ডারে এরই মধ্যে এর প্রভাব দৃশ্যমান। এ বিষয়ে প্রশাসনকে আরও কঠোর নজরদারি করতে হবে।
লাখাইয়ের বুল্লা গ্রামের বাসিন্দা আরিফ আহমেদ জানান, কৃষিজমি থেকে কেটে নেওয়া মাটি পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক্ট ও ট্রাক্টরের কারণে এলাকার রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত। স্থানীয়দের যে ভোগান্তি হচ্ছে তা বর্ণনাতীত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তৎপরতার কথা বলা হলেও বাস্তবতা বলছে, সেটি যথেষ্ট নয়।
আজমিরীগঞ্জের বাসিন্দা রুজেল মিয়া জানান, বর্ধিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, মাটির সবচেয়ে উর্বর ও জৈবিক গুণে ভরপুর স্তরকে রক্ষা করা। প্রকৃতির দেওয়া শক্তি নষ্ট করে কৃত্রিম সার আর রাসায়নিকে তা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা অবান্তর। টপসয়েল টিকলে ফসল উৎপাদনে কৃষকের সার ও কীটনাশক ব্যয়ও হ্রাস পাবে। তাদের এটা বুঝতে হবে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জুল সোহেল জানান, কৃষিজমির উপরিভাগের মাটি সৃষ্টির জন্য আশীর্বাদ। ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে এই প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। এই স্তরের মাটি কেটে নিলে ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কৃষকের জীবন কাটে মাটি নিয়ে। মাটির প্রতি এটুকু দায়িত্বশীল তাদের হতে হবে। কৃষক বিক্রি না করলে চক্রকে দমন করার কাজটি সহজ হবে।
জেলা প্রশাসক ফরিদুর রহমান জানান, কৃষিজমি থেকে উপরিভাগের মাটি কাটা বন্ধে প্রশাসন তৎপর রয়েছে। জেলাজুড়ে অভিযান চালিয়ে ৯টি মামলা দেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক জরিমানাও করা হয়েছে অভিযুক্তদের। এ তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
পরিস্থিতির উন্নতির জন্য নির্বাচন হতেই হবে
বাংলাদেশে নির্বাচনপূর্ব সময়ে সব সময় কিছু বিশৃঙ্খলা বা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড হয়। তবে এবারের পরিস্থিতি অন্যবারের চেয়ে বেশি নাজুক। এর কারণ বিপ্লব–পরবর্তী সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যে পর্যায়ে নেমেছে, সেখান থেকে বর্তমান সরকার দেড় বছর সময় পেলেও খুব দৃশ্যমান কোনো উন্নতি ঘটাতে পারেনি।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এবং এর আগে থেকে পরিস্থিতির ওপর যে ধরনের পর্যালোচনা বা অনুধাবনের প্রয়োজন ছিল, সেখানে ঘাটতি ছিল। কাজেই প্রস্তুতিও সেভাবে নেওয়া হয়নি। বিপুলসংখ্যক অস্ত্র এর আগে খোয়া গিয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল। সেগুলো উদ্ধার করার জন্য জোর তৎপরতা চালানোর মতো দৃশ্যমান কিছু দেখা যায়নি। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানোর জন্য যে পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত ছিল, সেখানে বড় ধরনের ঘাটতি আমরা দেখতে পেয়েছি।
আমরা এটাও জানি যে আওয়ামী লীগ (এখন কার্যক্রম নিষিদ্ধ), বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেত্রী এবং অন্য যে নেতারা ভারতে পালিয়ে গেছেন, তাঁরা সেখান থেকে বিভিন্ন উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে আসছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে উসকানি দিয়েছেন। এগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর আগাম প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন ছিল। সে ধরনের কোনো প্রস্তুতি যদি তারা নিয়ে থাকে, তাহলে অবস্থার অবনতি হতো না বা হওয়ার কথা নয়।
যেসব বাহিনী দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হবে, সেই বাহিনীগুলোর কর্মদক্ষতায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে। বিশেষ করে পুলিশ সম্পূর্ণভাবে পুনর্গঠিত হয়নি। এই বাহিনীকে সরকার সম্পূর্ণভাবে আগের জায়গাতে ফিরিয়ে নিতে পারেনি বা তৈরি করতে পারেনি।
বিশেষ করে অস্ত্র উদ্ধারের ক্ষেত্রে অনেক ঘাটতি রয়ে গেছে। এ ব্যাপারে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে আমরা কোনো কিছু দেখতে পাইনি। একই সঙ্গে যে ধরনের গোয়েন্দা তৎপরতা বা আগাম তথ্য থাকা উচিত, সেখানে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তারা আগাম তথ্য পাচ্ছে না। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তাদের তৎপরতা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আগাম তথ্য ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে পরিস্থিতির ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ রাখাটা দুরূহ হয়ে পড়ে।
তবে আমরা নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। নির্বাচন যেকোনো মূল্যে হতে হবে। নির্বাচন ছাড়া কোনোভাবেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে না। নির্বাচনই একমাত্র পন্থা, যার মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের স্বপ্ন, যার জন্য হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন, সেই লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারব। কাজেই নির্বাচন হতে হবে।
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে, শান্তিপূর্ণভাবে করার জন্য সরকার ও নির্বাচন কমিশনের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা থাকতে হবে, যাতে পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে। এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যতটুকু অবনতি হয়েছে, সেটিকে প্রারম্ভিক পর্যায় বলা যায়। তবে এটা একটা অশনিসংকেত। উচিত হবে এখনই এটাকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। পুরো পরিস্থিতির ওপর সঠিক নিয়ন্ত্রণ রাখা এবং যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলার লক্ষণকে একেবারে নির্মূল করে দেওয়া।
আমরা আশা করব, আইনশৃঙ্খলার সঙ্গে যেসব দায়িত্বশীল ব্যক্তি আছেন, বিশেষ করে যাঁরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন, যাঁরা পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁরা নিজেদের সঠিক ভূমিকাটা রাখবেন। কোনোভাবেই যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না ঘটে এবং দেশের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচনে ভোট দিতে পারেন, এটি অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত হবে ঝুঁকিপূর্ণ প্রার্থীদের চিহ্নিত করা এবং তাঁদের জন্য এখন থেকেই বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা।
মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ