বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাহাজ ‘ক্রুজ জাহাজ’। এগুলো ১৮ তলা বিল্ডিং এর চেয়েও বড় হয়। একসঙ্গে ৯ হাজারের বেশি যাত্রী একইসঙ্গে এই জাহাজে চড়তে পারে। প্রতিটি জাহাজের দাম ১.৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি হয়। এক একটি ক্রজ জাহাজ যেন সমুদ্রের ওপর একটি ভাসমান শহর। এই ধরনের জাহাজের নকশা, নির্মাণ এবং চালুর প্রক্রিয়াটি বেশ দীর্ঘ হয়ে থাকে। ক্রুজ জাহাজ তৈরি করতে প্রায় ১২ থেকে ১৮ মাস সময় লাগে। প্রতিটি ক্রুজ জাহাজে ওয়াটার পার্ক থেকে শুরু করে অসংখ্য বিলাসবহুল রেস্তোরাসহ অবিশ্বাস্য সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। 

প্রতিটি ক্রুজ জাহাজকে শিপইয়ার্ডে নির্মাণের আগে কোম্পানি টেন্ডার বা অর্ডার নিয়ে থাকে। মূলত ক্রুজ লাইনের মালিক যিনি অর্ডার দিয়ে থাকেন। এর নকশা তৈরি হয়ে গেলে সেই অনুযায়ী জাহাজের এক একটি খণ্ড আলাদা আলাদাভাবে তৈরি করা হয়। এরপর পাজেল আকারে একের পর এক সাজানো হয়। যেমন মনে করুন ক্রুজ শিপ কেবিন এবং স্টিলের হোল প্লেট যা আলাদাভাবে তৈরি করা হয়। যেহেতু অনেক বড় প্রজেক্ট তাই এই জাহাজে প্রায় ৫০০জন সাব কন্টাক্টর ও সাপ্লাইয়ার থাকে।

জাহাজের বাইরের কাঠামোটি তৈরি করতে প্রায় ছয় মাস সময় লাগে। বাকি সময় যাত্রী কেবিন, রেস্তোরা, বাথরুম, শত শত মাইল বৈদ্যুতিক তার ও সাজসজ্জার কাজ চলে। বাইরের সাজসজ্জা ছাড়াও এই ধরনের জাহাজের জন্য প্রয়োজন হয় একটি শক্তিশালী ইঞ্জিন। বিশেষ ক্ষেত্রে ইঞ্জিন রুমে পাঁচ থেকে ছয়টি ইঞ্জিন লাগানো থাকতে পারে। ক্রুজ জাহাজের প্রপেলার বিশাল আকৃতির হয়ে থাকে। একটি বিশাল জাহাজে কুড়ি ফুট দৈর্ঘ্যের প্রপেলার থাকে এবং প্রতিটি জাহাজে তিনটি করে প্রপেলার লাগানো হয়। পানির মধ্যে দিয়ে চালানোর জন্য এই বিশাল আকৃতির প্রপেলারগুলি প্রতি মিনিটে ২৫০টি ঘুর্ণন দেয় যা জাহাজকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। 

বিশ্বের বেশ কয়েকটি বড় ধরনের ক্রুজ জাহাজ রয়েছে এর মধ্যে অন্যতম ‘ওয়ান্ডার অফ দ্য সি’। এর দৈর্ঘ্য ১১৮৭ ফুট এবং এটি ৬৯৮৮ জন যাত্রীকে একত্রে জায়গা দিতে পারে। ‘আইকন অফ দ্য সি’ নামে একটি ক্রুজ জাহাজ এখনো যাত্রা শুরু করেনি তবে এর উচ্চতা হবে ১১৯৮ ফুট এটি প্রায় ১০ হাজার জন যাত্রীকে জায়গা দিতে পারবে। 

আল্লুর অফ দ্য সিস নামে ১১৮৭ ফুট লম্বা ক্রুজ জাহাজ যখন ২০০৯ সালে চালু হয় তখন এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় যাত্রীবাহী জাহাজ ছিল । যার নির্মাণ প্রকল্পে ১.

৪ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছিল। ২৫ টি ডাইনিং ও ১৩০৮ টি বসার কক্ষ সম্পন্ন একটি থিয়েটার হল ওই জাহাজে। এতসব সুবিধার জন্যই এই ধরনের অবিশ্বাস্য খরচ হয়ে থাকে। এই ধরনের জাহাজে ভ্রমণ করতে ব্যয় করতে হয় মোটা অংকের টাকা। এই ধরনের জাহাজের সুযোগ সুবিধার ওপর নির্ভর করে একটি ভ্রমণ টিকিটের মূল্য ২৫ হাজার ডলার থেকে ১ মিলিয়ন  ডলার হয়ে থাকে। 

এখন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল ক্রুজ জাহাজ হল ‘7c এক্সপ্লোরার’। যার টিকেট মূল্য প্রায় এক দশমিক তিন মিলিয়ন ডলার। যে টিকিটের মাধ্যমে আপনি ১২৩ দিনে ১১ টি দেশের ৪১ টি পোর্ট ভ্রমণ করতে পারবেন। যার মূল্য দিন হিসেবে প্রায় ৯৩৯৮ ডলার। এই যাত্রায় সিডনি, টোকিও, হংকং এর মত শহরে পাঁচটি বিলাসবহুল হোটেলে থাকার পাশাপাশি শহরে ব্যক্তিগতভাবে ভ্রমণ অন্তর্ভুক্ত আছে। যদিও ওই টিকেটের খরচ সবসময় এক থাকে না। কখনো কখনো সেটি পরিবর্তন হয়ে থাকে। 

যেসব ক্রুজ জাহাজ তৈরি হয়েছে তার মধ্যে ‘আইকন অব দ্য সিস’ অন্যতম। নামের মত জাহাজটি অত্যাধুনিক বৃহৎ ও আইকনিক। এটি রয়েল ক্যারিয়ার ইন্টারন্যাশনাল দ্বারা নির্মিত সর্বশেষ জাহাজ। জাহাজটি প্রায় ১২০০ ফুট লম্বা এবং পাঁচ হাজার দুইশ অতিথিসহ ২৩৫০ জন ক্রু সদস্যকে জায়গা দিতে পারে। জাহাজের প্রত্যেকটি ডেকে রয়েছে অসাধারণ সুযোগ সুবিধা। আধুনিক পুল, থিয়েটারসহ বিশাল জানালা রয়েছে। 

অন্যতম একটি ক্রুজ হলো, ‘রয়েল ম্যান হারমনি অফ দ্য সিস’ জাহাজটি ৫৪৭৯ জন অতিথিকে একসাথে বহন করতে পারে। পৃথিবীতে যত ব্যয়বহুল ক্রুজ জাহাজ নির্মাণ হয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম। এটি ১১৮৭ ফুট দুর্গের যে আইফেল টাওয়ারের উচ্চতার চেয়ে ১৬৪ ফুট লম্বা। এখানে রয়েছে মিউজিক্যাল আসরসহ একটি থিয়েটার ও রোবট দ্বারা পরিবেশিত বার। 

যেহেতু এসব জাহাজ বিভিন্ন ভেন্যু থেকে লোক তুলে থাকে। তাই তাদের খাবার, ওয়েলকাম ড্রিংকসহ বিভিন্ন কাজের জন্য লোক প্রয়োজন হয়। জাহাজ যাত্রা করার আগে ক্রুদের বিশেষভাবে সবকিছু দেখে নিতে হয়। পর্যাপ্ত খাবার এবং জিনিসপত্র নিয়ে ক্রুদের যাত্রা শুরু করতে হয়। যদি মাঝপথে কখনো ক্রুজ জাহাজের খাবার শেষ হয়ে যায় তখন ক্রুরা অন্য জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং অন্য জাহাজ খাবার পৌঁছে দেয়। 

ক্রুজ জাহাজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সবচেয়ে আধুনিক উপায়ে জাহাজগুলোকে তৈরি করা হয়। তবুও অনেকে অনেক ক্ষেত্রেই ক্রুজ জাহাজের দুর্ঘটনার খবর পাওয়া যায়। গত ১০০ বছরেও ২২টি ক্রুজ জাহাজ দুর্ঘটনা শিকার হয়েছে। ক্রুজ জাহাজগুলোতে মর্গও রয়েছে। যদি কেউ মারা যায় তাহলে তাকে  মর্গে রাখা হয়। এরপর জাহাজের পক্ষ ডেথ সার্টিফিকেটও প্রদান করা হয়। মৃতের পরিবারকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য রাখা হয় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্রু। 

ঢাকা/লিপি

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র জন য ভ রমণ

এছাড়াও পড়ুন:

পর্যটন শিল্প বিকাশে আইকন গ্লোবাল ট্যুর অপারেটর আল মামুন

পর্যটকদের লাগেজ বহন করা থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বিশ্বাসযোগ্য তুরস্ক ট্যুর ব্র্যান্ডের নেতৃত্ব দেওয়া মো. আল মামুনের গল্প অধ্যাবসায়, সাহস ও দূরদর্শিতার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।

২০০৮ সালে রসায়নে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য মামুন বাংলাদেশ থেকে তুরস্কে পাড়ি জমান। তাঁর একাডেমিক যাত্রা শুরু হয় তুরস্কের মনোরম শহর ইজমিরে। তৃতীয় বর্ষে তিনি চলে আসেন ইস্তানবুলে আর সেখানেই নিঃশব্দে শুরু হয় তাঁর জীবনের নতুন অধ্যায়।

পড়াশোনার পাশাপাশি মামুন খণ্ডকালীনভাবে পর্যটন খাতে কাজ শুরু করেন। প্রথম চাকরি ছিল ট্রলি বয়ের হোটেল ও বিমানবন্দরে ভ্রমণকারীদের লাগেজ বহন করা। কাজটি ছিল কঠিন, কিন্তু এখানেই তিনি অর্থের চেয়ে অনেক মূল্যবান কিছু শিখেছিলেন পর্যটন শিল্পের প্রকৃত চিত্র।

স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, “আমি দেখতাম, তুরস্কে এসে মানুষ কতটা খুশি হয়। তখনই স্বপ্ন দেখেছিলাম, একদিন আমিও নিজে মানুষকে এই দেশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে সাহায্য করব।”

শিক্ষা শেষ করে মামুন সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশ ও তুরস্কের পর্যটন খাতের মধ্যে এক সেতুবন্ধন তৈরি করবেন। তিনি প্রতিষ্ঠা করেন একটি ভ্রমণ সংস্থা, যা বাংলাদেশের পর্যটকদের জন্য তুরস্ক ট্যুর প্যাকেজ এবং ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর জন্য সেবা প্রদান করে। তবে শুরুর পথটা ছিল মোটেও সহজ নয়।

তিনি বলেন, “প্রথম বছর আমি বাংলাদেশের বহু ট্রাভেল এজেন্সি পরিদর্শন করেছিলাম। কেউ বিশ্বাস করত না। অনেক পরিশ্রম করেছি, কিন্তু ফল পাইনি। তবুও হাল ছাড়িনি।”

সবকিছু বদলে যায় যখন তিনি ঢাকায় একটি ট্রাভেল ফেয়ারের খবর পান। সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি একটি স্টল বুক করেন নিজের কোম্পানি ও তুরস্ক ট্যুর প্রচারের জন্য। বিশ্বাস অর্জনের লক্ষ্যে তিনি নিজের তুর্কি ব্যবসায়িক অংশীদারকেও আমন্ত্রণ জানান মেলায় অংশ নিতে।

তিনি বলেন, “যখন মানুষ দেখল আমাদের স্টলে তুর্কি প্রতিনিধিরা উপস্থিত, তখন তাদের আগ্রহ আরো বেড়ে গেল। সেই ট্রাভেল ফেয়ারই ছিল আমার ক্যারিয়ারের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত।”

মেলার পর মামুন ও তাঁর অংশীদার এক মাস ধরে বাংলাদেশের বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি ঘুরে ঘুরে নিজেদের সেবা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেন, সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং ধীরে ধীরে বিশ্বাস অর্জন করেন। কয়েক মাসের মধ্যেই কয়েকটি বাংলাদেশি এজেন্সি তাদের সঙ্গে কাজ শুরু করে।

অংশীদার তুরস্কে ফিরে গেলেও মামুন থেকে যান বাংলাদেশে। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন এই বাজারের বিশাল সম্ভাবনায়। পরবর্তী দুই বছর তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। বন্ধুদের প্রশিক্ষণ দেন, তৈরি করেন একটি নিবেদিত টিম। শেষ পর্যন্ত তাঁর পরিশ্রম সফল হয়। বহু এজেন্সি তাঁর প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা রাখে ও সহযোগিতা শুরু করে।

বর্তমানে মামুনের প্রতিষ্ঠানটি একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে তিনি ৫৬ সদস্যের একটি দল পরিচালনা করেন, যাদের সহায়তা করছে ইস্তানবুলের ৮ সদস্যের অপারেশন টিম। তুরস্কে রয়েছে কোম্পানির প্রধান কার্যালয় এবং বাংলাদেশের গাজীপুরে আঞ্চলিক অফিস।

এখন পর্যন্ত ১৫০টিরও বেশি বাংলাদেশি ট্রাভেল এজেন্সি তাঁর প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অংশীদারিত্বে কাজ করছে এবং সবাই সন্তুষ্ট। শুধু বাংলাদেশ নয় ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, মাল্টা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ফিলিপাইনের মতো ৩৫টিরও বেশি দেশের ট্রাভেল এজেন্সি তাদের ক্লায়েন্ট পাঠাচ্ছে তুরস্কে মামুনের বিজনেস টু বিজনেস নেটওয়ার্কের মাধ্যমে।

ডিজিটাল মার্কেটিং, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রচারণা এবং সেলিব্রিটি স্পনসরশিপের মাধ্যমে মামুনের প্রতিষ্ঠানটি এখন অন্যতম পরিচিত তুরস্ক ট্যুর ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। আজ পর্যন্ত সারা বিশ্বের ৮০ হাজারেরও বেশি পর্যটক তাঁর কোম্পানির মাধ্যমে তুরস্ক ভ্রমণ করেছেন সবাই পেয়েছেন পেশাদার সেবা ও স্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

মামুন বলেন, “আমাদের পথ সহজ ছিল না। কিন্তু প্রতিটি চ্যালেঞ্জ আমাদের আরো শক্ত করেছে। আমরা প্রমাণ করেছি বিশ্বাস, দলগত কাজ ও মানসম্মত সেবাই গ্লোবাল সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।”

কোম্পানির অব্যাহত সাফল্যের মধ্যেও মামুন নিজের ভবিষ্যৎ লক্ষ্য নিয়ে স্পষ্ট বলেন, “আমার লক্ষ্য হলো আমার প্রতিষ্ঠানকে তুরস্কের সেরা ট্যুর অপারেটর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। এমন একটি ব্র্যান্ড, যা বিশ্বাস, উৎকর্ষতা ও অনন্য ভ্রমণ অভিজ্ঞতার প্রতীক হবে।”

রসায়ন ছাত্র থেকে বৈশ্বিক পর্যটন শিল্পের নেতৃত্বে পৌঁছে যাওয়া মো. আল মামুনের গল্প তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য এক অনুপ্রেরণার উৎস। যা প্রমাণ করে, সততা, নিষ্ঠা ও নিজের স্বপ্নের প্রতি বিশ্বাস থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়।

ঢাকা/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পর্যটন শিল্প বিকাশে আইকন গ্লোবাল ট্যুর অপারেটর আল মামুন