লিওনেল মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বীতা ছিল চরমে। মাঠের লড়াইয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর দু’জন গোলের জন্য, শিরোপার জন্য ও পুরস্কারের জন্য একে অপরের সঙ্গে লড়াই করেছেন। তবে দু’জনের মধ্যে সম্মানবোধ অক্ষুন্ন ছিল। এক সাক্ষাৎকারে এমনই দাবি করেছেন রোনালদো।
দু’জন একসঙ্গে ১৫বার ব্যালন ডি’অরের মঞ্চ ভাগাভাগি করেছেন। অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসেছেন। টুকটাক কথা বলেছেন। সেই স্মৃতি হাতড়ে রোনালদো জানিয়েছেন, ইংরেজি না জানা মেসির অনুবাদকের ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।
রোনালদো বলেন, ‘মেসির সঙ্গে স্বাস্থ্যকর দৌরাত্ম্য ছিল। কখনোই তার সঙ্গে খারাপ সম্পর্ক ছিল না। আমরা ১৫ বছর পুরস্কারের মঞ্চ ভাগাভাগি করেছি। সবসময় সৌহার্দ্য বজায় রেখে চলেছি। আমার মনে পড়ে, তার জন্য ইংরেজি অনুবাদও করে দিয়েছি। এটা সত্যিই মজার স্মৃতি।’
রোনালদো তার সাক্ষাৎকারে আরও জানিয়েছেন, দু’জন সবসময়ই দু’জনার ক্লাব, জাতীয় দলকে সবচেয়ে আপন ভেবে খেলেছেন। এটা তাদের দু’জনকেই আরও শানিত হতে সহায়তা করেছে। এমন অনেক বছর ছিল, যেখানে সে সব ম্যাচ খেলতে চেয়েছে, অনেক গোল করতে চেয়েছে, সবকিছু জিততে চেয়েছি। আবার আমিও একই কাজ করেছি। ক্যাম্প ন্যুতে আমাকে তিরস্কার করা হতো, তারপরও আমি সেখানে খেলতে পছন্দ করতাম।’
রোনালদো তার দীর্ঘ ফুটবল ক্যারিয়ারে স্পোর্টিং সিপি, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে দুই মেয়াদে, জুভেন্টাস, রিয়াল মাদ্রিদ ও আল নাসরে খেলেছেন। তবে রিয়াল মাদ্রিদকে হৃদয়ের ক্লাব বলে উল্লেখ করেছেন, ‘রিয়াল মাদ্রিদ সবসময় আমার হৃদয়ে থাকবে। আমি রিয়ালেই সবচেয়ে ভালো ছিলাম। দারুণ মুহূর্ত সেখানে কাটিয়েছি, যে কারণে ভক্তরা আমাকে মনে রাখবে।’
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
নোবেলজয়ী লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের সাক্ষাৎকার
সাহিত্যে নোবেল পেলেন হাঙ্গেরীর কল্পলেখক, কথাসাহিত্যিক এবং চিত্রনাট্যকার লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। গভীর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি, মনোমুগ্ধকর বর্ণনাশৈলী এবং দূরদর্শী সাহিত্যকর্মের জন্য তাঁকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। বলা হয়ে থাকে, তাঁর সাহিত্যকর্ম আবেগপ্রবণ, বিভ্রান্তিকর এবং বিয়োগান্তক। তবে অধিকাংশ পন্ডিত এবং সমালোচক একমত যে, ‘তীব্র’ বিশেষণের মাধ্যমে তাঁর উপন্যাস সবচেয়ে ভালোভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে। তাঁর অবসেশন গোপন জিনিসের প্রতি, যেগুলো মানুষের জীবনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিক। ডিসটোপিয়ান এবং বিষণ্ন বিষয়বস্তুর জন্য প্রায়শই তাঁর রচনাদি উত্তর-আধুনিক সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এখানে লাসলো ক্রাসনাহোরকাইয়ের দুটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো। প্রথমটি নিয়েছেন ‘গুয়ের্নিকা’ ম্যাগাজিনের সম্পাদকীয় বিভাগের অন্তর্বর্তী কর্মকর্তা সেবাস্টিয়ান কাস্তিলো। এটি প্রকাশিত হয় ২০১২ সালের ২৬ এপ্রিল। এখানে লেখক কাল্পনিক সাহিত্যে ভয়-ভীতি, দীর্ঘ বাক্য ব্যবহারের কারণ ও নান্দনিকতা এবং বিখ্যাত মার্কিন কবি ও লেখক অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে পরিচয় ও পরস্পর সহযোগিতার বিষয়ে কথা বলেছেন।
অন্যদিকে দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন লেখকের অন্যতম ইংরেজি অনুবাদক, কবি জর্জ শির্তেস। এ সাক্ষাৎকারে তিনি অনুবাদের সুবিধা ও অসুবিধা, এমনকী অনুবাদ কাজের বিপদের আশঙ্কা ও তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। এই সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছে ‘দ্য হোয়াইট রিভিউ’ অনলাইনে সেপ্টেম্বর, ২০১৩ সালে।
সাক্ষাৎকার-১
অভ্যাসের পাগলামি
গুয়ের্নিকা: প্রায়ই মন্তব্য করা হয় (আপনার বই নিয়ে বিভিন্ন আলোচনায় এবং সাক্ষাৎকারে) যে, আপনার লেখায় আপনি অ্যাপোক্যালিপটিক বিষয়বস্তুর গুরুত্বে প্রভাবিত হন। বেশির ভাগ সময় আপনার চরিত্ররা বিপর্যয় এবং বিপর্যয়ের আশঙ্কার সীমানার মধ্যে অজানা কিংবা অবাস্তব ভয়ের মুখোমুখি হয়। আপনি কি এই পার্থক্যটি মানুষের ভয়ের হুমকির সঙ্গে মোকাবেলা করার প্রধান মনস্তাত্ত্বিক উপায়গুলোর একটি হিসেবে দেখেন? আপনি কী মনে করেন যে, এই অজানা ভয়ের হুমকি কোনোভাবে নিজেই এসে সেই ভয়কে প্রতিস্থাপন করে?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: প্রতিস্থাপন? ওহ, না। আমি তা মনে করি না। অবশ্যই কোনো গ্রন্থে কিংবা কোনো সৃজনশীল সাহিত্যের বা কাল্পনিক রচনার (ফিকশনের) ভয় কিন্তু বাস্তবের ভয়ের মতো নয়। সৃজনশীল সাহিত্য এবং বাস্তবতার মধ্যে শক্তিশালী বিভাজন রয়েছে। আমার বিভিন্ন লেখায় আমি যে সন্ত্রাসের কথা বলি, তা আমার চরিত্রদের জন্য খুবই বাস্তবিক। এ ছাড়া সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসের আশঙ্কার মধ্যে সীমারেখা আসলেই তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার সব সাহিত্য রচনা নিয়ন্ত্রিত পাগলামিতে ঘটে এবং সেই নিয়ন্ত্রিত পাগলামিই সাহিত্যকর্মের স্বাভাবিক বিষয়। নিয়ন্ত্রিত পাগলামির নিজস্ব গতি রয়েছে এবং এই গতি আমার চরিত্রদের সন্ত্রাসের আশঙ্কা থেকে সরাসরি সন্ত্রাসের প্রান্তে নিয়ে যায়।
গুয়ের্নিকা: অ্যাপোক্যালিপটিক বিষয়বস্তু ছাড়া, আপনার সৃজনশীল সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করার সময় অন্য আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা হয় এবং তা হলো আপনার বাক্যের দৈর্ঘ্য। সম্প্রতি দীর্ঘ বাক্য কিছুটা পুনর্জীবিত হয়েছে এবং আমি বিশেষভাবে বার্নহার্ড, সেবাল্ড, সারামাগো, মারিয়াস, ওয়ালেসকে মনে করছি―যদিও এসব লেখকদের মধ্যে কেউ আপনার মতো ‘দীর্ঘ বাক্য’ লেখে না। এই যে দীর্ঘ বাক্যে লেখেন, তা আপনার কাছে কোথা থেকে আসে? আপনি কী এটি একটি বিশেষ শৈল্পিক পাঠের অংশ হিসেবে দেখেন, নাকি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র নান্দনিক কাজ হিসেবে মনে করেন?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমার সব গ্রন্থে কেউ একজনকে কোনো এক চরিত্রের নেপথ্যে কথা বলতে দেখা যায়, কিন্তু সে আমি নই। সেই লুকিয়ে থাকা মানুষটি, যে কি না আমার গ্রন্থ ব্যবহার করে তার চরিত্রের মাধ্যমে কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করে, গল্পের আগে এবং প্রতিটি সুসংগঠিত ভাবনার আগে, উন্মত্ত এবং প্ররোচনামূলকভাবে কথা বলে―এমন ধরনের কথোপকথনে কখনো বিরাম চিহ্নের প্রয়োজন হয় না। সেই একজন কিন্তু কোনো বিরাম ছাড়া, কোনো ব্যাঘাত ছাড়া উন্মত্ত ত্বরিত গতিতে কথা বলে। যদি আপনি দৈনন্দিন বাস্তব জীবনের যে কোনো উদ্বিগ্নতা পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে দেখবেন লোকজন সবসময় সেই উন্মত্ত আকাক্সক্ষায় একে অপরকে বোঝানোর জন্য যতি চিহ্ন ছাড়া কথা বলে, তাই না? আমার তথাকথিত দীর্ঘ বাক্যগুলো কোনো ধারণা কিংবা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত থেকে আসে না, বরং কথ্য ভাষা থেকে আসে। আপনি জানেন, আমার কাছে ছোট বাক্য কিছুটা মেকী এবং প্রভাবিত মনে হয়। আসলে আমরা ছোট বাক্য ব্যবহারে খুব বেশি অভ্যস্ত নই। যখন আমরা কথা বলি, তখন কিন্তু আমরা অনর্গল, অবিচ্ছিন্ন বাক্য বলি এবং এই ধরনের ভাষায় কোনো সময় যতি চিহ্নের প্রয়োজন হয় না। কেবল ঈশ্বরেরই যতি চিহ্নের প্রয়োজন হয় এবং আমি নিশ্চিত যে, পরিশেষে তিনি তা ব্যবহার করবেন।
গুয়ের্নিকা: আপনার ‘দ্য মেল্যানক্যালি অব রিজিস্ট্যান্স’ উপন্যাসে একটা চিত্র আছে, যা সবসময় আমাকে নাড়া দেয়। ভালুস্কা এবং মিস্টার এস্তের হাঁটছিলেন। ভালুস্কা আগে কিছু একটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন, যা তিনি বিশ্বাস করেন যে, সংরক্ষিত তিমির সঙ্গে তার সেই সাক্ষাত ছিল এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। হাঁটার সময় যেই ভালুস্কা কোনো ক্ষণস্থায়ী-আধ্যাত্মিক দোলনায় দুলছিলেন, মিস্টার এস্তের তখন মাটিতে ছড়ানো আবর্জনার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি প্রতিটি জায়গায় ছড়ানো আবর্জনার স্তূপ দেখে চমকে যান এবং মানব বর্জ্যের অপরিসীম ও অপূরণীয় ক্ষতির জন্য আফসোস করেন। আমার কাছে দৃশ্যটি আপনার কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের জীবন্ত সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে মনে হয়: আপনার চরিত্রগুলো সবসময় কিছু প্রারম্ভিক অভিজ্ঞতা লাভের সম্ভাবনার মধ্যে দোদুল্যমান থাকে, তবে একই সময়ে তারা বিশ্বের বস্তুগত অবমাননাকে বিরক্ত করে। আপনি যে আপনার কাজের চরিত্রগুলো বিভিন্ন রূপে প্রকাশ করতে চান, বোঝার ক্ষেত্রে এই পার্থক্যটি কীভাবে কাজ করে? আমি আরও যা কিছু অনুসন্ধান করতে চাই, সেই ধরনের প্রকাশভঙ্গি কী আপনার উপলব্ধির বিভ্রান্তি? সেই জীবনধারার পদ্ধতি কি অতীতে সীমাবদ্ধ ছিল?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমি মহাবিশ্বের উদ্ভাবনী দিক এবং মানব অসভ্যতার কারণে আন্দোলিত কিংবা পুলকিত হই না। অসভ্যতা আমার পাকস্থলি খারাপ করে দেয়। আর তাই সুন্দর জিনিসের সঙ্গে আমার নিবীড় সম্পর্ক। আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার চরিত্রগুলো মাঝেমধ্যে সম্পূর্ণ অস্তিত্বের এই দুই চরম মেরুকে প্রতিনিধিত্ব করে। এ মুহূর্তে আমার মনের মধ্যে জাগ্রত প্রশ্নের উত্তর দিতে ভয় হচ্ছে: আমার সমস্ত গ্রন্থে যে সব লুকনো ব্যক্তি কথা বলেন, তারা আমার কোন পাশে আছে?
গুয়ের্নিকা: কীভাবে অ্যালেন গিন্সবার্গের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে? আপনারা দু’জন কী কখনো একসঙ্গে কাজ করেছেন কিংবা নিজেদের স্বতন্ত্র কাজের জন্য একজন অন্যজনকে সহযোগিতা করেছেন? অ্যালেনের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কেমন?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: যখন আমি প্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছি এবং নিউ ইয়র্কে ছিলাম, তখন আমি মিস্টার গিন্সবার্গের অতিথি ছিলাম। তিনি আমাকে লেখালেখির এক অভিনব কৌশল খুঁজে বের করতে সাহায্য করেন। সেই কৌশলটি ছিল ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ উপন্যাসের জন্য একটি নিরপেক্ষ পটভূমি তৈরি করার পদ্ধতি, বিশেষ করে নিরপেক্ষ নিউ ইয়র্ক শহরের জন্য। উপন্যাসের নায়ক খুবই অদ্ভুত প্রকৃতির, এমনকী তার কাহিনিও। তাই আমার জন্য আসল শহরের পরিবর্তে একটি নিরপেক্ষ শহর প্রয়োজন ছিল―এমন এক নিউ ইয়র্ক শহর, যেখানে কোনো রঙ নেই, অপ্রত্যাশিত কিছু নেই, গতি নেই। আর যেহেতু নিউ ইয়র্ক শহর মোটেও নিরপেক্ষ নয়, বিশেষ করে যখন আপনি প্রথমবার শহরটি দেখেন, তাই আমি নিউ ইয়র্ক শহরকে নিরপেক্ষ শহর করা নিয়ে ভীষণ সমস্যায় পড়েছিলাম। আমার সেই ভ্রমণের সময় আমি এ বিষয়ে অ্যালেনের সঙ্গে রাতের পর রাত আলাপ করেছি এবং তিনি আমাকে খুবই আকর্ষণীয় এবং গ্রহণযোগ্য পরামর্শ দিয়েছেন। তবে তা কিন্তু শুধু ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ উপন্যাসের জন্য ছিল না; তিনি দার্শনিক বিষয়, বৌদ্ধধর্ম অবশ্যই এবং গত চার দশকের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের কথা বলেছেন। তিনি আমার ইউরোপিয় অভিজ্ঞতা জানতে খুবই আগ্রহী ছিলেন। আমি যে সময় অ্যালেন এবং তাঁর অন্য বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়েছি, তা আমার জন্য সত্যিই চমৎকার ছিল।
সাক্ষাৎকার-২
অনূদিত কাজ অনুবাদকের, লেখকের নয়
হোয়াইট রিভিউ: অনুবাদের সুবিধা, অসুবিধা কিংবা বিপদ সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমি অনুবাদের সুবিধা এবং অসুবিধা সম্পর্কে কিছুই বলব না, তবে অনুবাদ কাজের বিপদসমূহ সম্পর্কিত প্রশ্নটি উল্লেখ করব, কারণ আসলেই সেগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। আমার মতে অন্য কোনো ভাষায় অনূদিত কাজকে মূল কাজের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। বিষয়টি এক ধরনের অযৌক্তিকতা। অনূদিত কাজ অনুবাদকের, লেখকের নয়। লেখকের কাজ হলো সেই কাহিনি রচনা করা, যা মূল ভাষায় লেখা হয়েছে। অনূদিত কাজ হলো অনুবাদকের একটি নতুন কাজ, যেখানে তিনি অন্য ভাষা ব্যবহার করেন এবং যার সৃষ্টিকর্তা তিনি নিজেই। তবে এ কথা সত্যি যে, প্রায় সবসময় অনূদিত কাজটি দেখতে অনেকটা মূল কাজের মতো হয়, যেমন একই পরিবারের সদস্যরা কম-বেশি একজন আরেকজনের মতো দেখতে হয়। লেখক শুধু দেখেন এবং পড়েন: তাঁর কাছে অনূদিত কাজটি পরিচিত মনে হয়, মাঝেমধ্যে খুবই পরিচিত লাগে। যখন অনূদিত কাজটি সুন্দর দেখায়, তখন তিনি আনন্দিত হন, আর যখন খারাপ দেখায়, তখন তাঁর রাগ হয়। একমাত্র একবারই আমার রাগ হয়েছিল, যখন আমি জার্মান ভাষায় অনূদিত ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ উপন্যাসটি দেখেছিলাম। সেই অনূদিত উপন্যাসটি এতই বাজে হয়েছিল যে, তা পাঠ যোগ্য করা প্রায় অসম্ভব ছিল। সাহস করে কে নিতেন নতুনভাবে অনুবাদ করার উদ্যোগ? সেই কাজ খুবই কঠিন ছিল। কিন্তু সেই অনুবাদ ছাড়া আমার কাজের প্রতিটি অনুবাদ আমাকে দারুণভাবে বিস্মিত করেছে, আমি বিমোহিত হয়েছি! আমার সব অনুবাদকরাই অত্যন্ত চমৎকার।
হোয়াইট রিভিউ: কেন আপনি বার্লিনে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: সেই ১৯৮৭ সালে প্রথমবার আমি যখন শহরে, তৎকালীন পশ্চিম বার্লিনে, দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি, সেই সময় থেকেই আমি শহরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছি। তখন শহরের সেই অংশ ছিল আহত আত্মার মানুষের জন্য এক আশ্রয়স্থল। সব ধরনের শিল্পী, এমনকী যারা আশা করতেন যে, তারাও শিল্পী হয়ে উঠবেন, তারা সেখানে নির্ভয়ে নিজেদের কাজ করার জন্য আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সত্যিই, জেনে ভালো লেগেছিল যে, আমি একই পানশালায়, এমনকী একই টেবিলে, তাদের সঙ্গে বসতে পারার সুযোগ পেয়েছিলাম―সেসব মহৎ শিল্পীদের মাঝে, যাদের সঙ্গে আমি একই পরিবারের অংশ হিসেবে সম্পর্কিত হতে পেরেছি। আজও আমাদের সেই সম্পর্ক টিকে আছে। যদিও আমি এখন বেশিরভাগ সময় শহরের অন্য জায়গায় বাস করছি, তাই আমি আর পানশালা নিয়ে ভালো কিছু অনুভব করি না। আজকাল বিষয়টি মূলত সেই শিল্পীদের কাছে আকর্ষণীয়, যারা তাদের কাজ বিক্রি করতে চায়, কিন্তু সৃষ্টি করতে নয়। আর পরিস্থিতি যদি এমন হয়, তবে এখানে কিংবা সেখানে বসবাস করার মধ্যে পার্থক্য কী?
হোয়াইট রিভিউ: আপনার লেখালেখির অভ্যাস কেমন?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমি কাজের জায়গায় বসি না, অর্থাৎ লেখালেখির টেবিলে, এবং মাথায় লেখার ভাবনা আসার অপেক্ষায় আমি ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকি না। সাহিত্যই আমার কাজ―এই ধারণা থেকেই আমি লেখার বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করি। ব্যক্তিগত কারণগুলোকে মাথা থেকে সরিয়ে দিলেই আমার জন্য সবকিছু ঠিক হয়ে যায়। সত্যি কথা হলো, যখন লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তখন আমি অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতিতে জীবন কাটিয়েছি: আমার কাছে কোনো লেখার টেবিল ছিল না এবং আমি কখনো একা ছিলাম না। তাই তখন থেকেই আমি বাক্যগুলো ভাবার বিষয়টি শিখে গিয়েছিলাম। যদি আমার কাছে সেসব চিন্তা-ভাবনা প্রতিশ্রুতিশীল মনে হতো, তবে আমি তাতে শব্দ যুক্ত করতাম, যতক্ষণ না বাক্যটি স্বাভাবিকভাবে পূর্ণতা লাভ করে। তারপর আমি লিখে ফেলতাম। এমনকী এখনো আমি এ পদ্ধতি অনুসরণ করি, সবচেয়ে অসম্ভাব্য জায়গায়, সবচেয়ে অসম্ভাব্য সময়ে―অন্য কথায়, আমি সবসময় লেখালেখির মধ্যে আছি। অবশেষে আমি সবকিছু লিখে রাখি। আমি সাধারণভাবে আমার কোনো লেখা সংশোধন করি না, কারণ আমি সব কাজ আগেভাগেই আমার মাথার মধ্যে করে ফেলি।
হোয়াইট রিভিউ: আপনি চিরায়ত সাহিত্য, যেমন কাফ্কা, ছাড়া আর কী পড়েন?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: যখন আমি কাফ্কার বই পড়ি না, তখন তাঁকে নিয়ে ভাবি। যখন আমি কাফকা নিয়ে ভাবি না, তখন আমি তাঁকে নিয়ে না-ভাবার বিষয়টি ভীষণভাবে উপলব্ধি করি। কিছু সময় তাঁকে নিয়ে ভাবার অনুপস্থিতি উপলব্ধি করার পর, আমি তাঁর গ্রন্থ বের করি এবং আবার পড়া শুরু করি। এভাবেই আমার মধ্যে বিষয়টি কাজ করে। হোমার, দান্তে, দস্তয়েভস্কি, প্রুস্ত, এজরা পাউন্ড, বেকেট, থমাস বার্নহার্ড, আতিলা ইয়োসেফ, স্যান্ডর ওয়োএরেস এবং পিলিনস্কির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
হোয়াইট রিভিউ: আপনি কেন মনে করেন যে, ‘সাতানট্যাঙ্গো’ এখনো এত সফল উপন্যাস? বিশ্বে কিংবা সাহিত্যে কী কিছু ঘটেছে, যা এই উপন্যাসের জন্য পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: আমি মনে করি, ইতোমধ্যেই যারা ‘সাতানট্যাঙ্গো’ চলচ্চিত্র সম্পর্কে জানেন বা দেখেছেন, এবং যারা ‘দ্য মেল্যানক্যালি অব রিজিস্ট্যান্স’, ‘ওয়ার অ্যান্ড ওয়ার’ এবং ‘অ্যানিমালইনসাইড’ উপন্যাসগুলো পড়েছেন, অবশ্যই তারা ‘সাতানট্যাঙ্গো’ পড়ার জন্য অপেক্ষা করেছেন। এ ছাড়া উপন্যাসটি প্রকাশনার সময় মনে হয়েছিল যে, অনেকেরই পছন্দ হবে এবং ভালো লাগবে, যে ধরনের বই তারা চেয়েছিলেন। এমন সব মানুষ, যারা পালিয়ে গিয়ে অত্যন্ত লৌকিকতা এবং ক্লান্তিকর নতুনত্বের মধ্যবর্তী স্থানে বাঁচতে চেয়েছিল; যারা এমন একটি বইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে, যা বিশ্বের সম্পর্কে কথা বলে; যারা বিনোদন ছাড়া অন্য কিছু চায়, যারা জীবন থেকে পালাতে চায় না বরং পুনরায় বাস করতে চায়, যারা জানতে চায় যে, তাদের একটি জীবন আছে এবং তারা সেই জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, এবং যাদের বেদনাদায়ক সুন্দরের প্রতি দুর্বলতা রয়েছে। আমার ব্যাখ্যা হলো আমাদের কোনো মহৎ সাহিত্য নেই। কিন্তু পাঠকরা মহৎ সাহিত্য পড়তে চায়, তবে ওষুধ হিসেবে নয়, মায়াজাল হিসেবে নয়, বরং তারা চায় কেউ যেন তাদের বলে যে, এখানে কোনো ওষুধ নেই।
হোয়াইট রিভিউ: আপনার কাছে সব কিছু এমন পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তোলার বিষয়টি এত জরুরি কেন? সঠিক অবস্থান নির্ধারণ করা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: কেননা কোথায় কোন জিনিস আছে, তা জানা সবসময় গুরুত্বপূর্ণ। আর যে কোনো জিনিস নিঁখুতভাবে সেখানেই থাকতে পারে, যেখানে তা আছে।
হোয়াইট রিভিউ: একজন লেখক হিসেবে আপনি যেখান থেকে শুরু করেছিলেন, সেই জগতটি হয়তো পুরোপুরি শুরু করা হয়নি, অর্থাৎ যখন সাতানট্যাঙ্গো উপন্যাস প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল; ২০১৩ সালের জগতের সঙ্গে কতটুকু এবং কীভাবে মিল আছে?
লাসলো ক্রাসনাহোরকাই: দু’টি জগতের মধ্যে বিস্ময়কর মিল রয়েছে। সবকিছুর পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হলেও আসলে সবকিছুই মূলত একই আছে। ত্বরিৎ গতিতে প্রবাহিত গর্জনরত কোনো স্রোতের উপরের দিকের কথা ভাবুন―ফেনার মধ্যে একক বুদবুদ ঘূর্ণায়মান হয়ে ভেঙে যায়, ছোট ছোট আলাদা ফোঁটা তৈরি করে এবং পুনরায় মিলিত হয়ে ক্ষুদ্র স্রোত সৃষ্টি করে, আর তারপর আপন পথে চলতে থাকে। আমি ফোঁটাগুলো দেখি এবং একটি নির্দিষ্ট ফোঁটায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু তা অসম্ভব। কেননা আসলে সেখানে কোনো ফোঁটা নেই। যে কোনো ভাবেই হোক, সেখানে কেবল পূর্ণতা আছে, যা প্রতিটি মুহূর্তে আলাদা এবং তবুও একই থাকে। কিন্তু পূর্ণতার কোনো অস্তিত্ব নেই, এমনকী কোনো অংশও নেই। তাহলে কী আছে? পরিবর্তনশীলতা আছে, যা সবসময় পরিবর্তন হয়। এটি ধরাছোঁয়ার বাইরে।
ঢাকা/তারা//