আলুর দামে নাকাল, এবার হিমাগারের গ্যাঁড়াকল
Published: 9th, February 2025 GMT
এক কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১৪ থেকে ১৬ টাকা। ক্ষেত থেকে তা বেচা হচ্ছে ১০ থেকে ১২ টাকায়। এক কেজি আলুতে লোকসান ৫ টাকার কাছাকাছি। লোকসান থেকে বাঁচতে উৎপাদন মৌসুমে আলু না বেচে কৃষকরা সাধারণত হিমাগারে রাখেন। এবার তা রাখতে পারছেন না। গত বছরের তুলনায় কেজিতে ১ টাকা বাড়িয়ে এবার হিমাগার ভাড়া ৮ টাকা করা হয়েছে। এতে কৃষককে বাড়তি গুনতে হবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। কৃষক ও আলু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা গেছে, দেশে বর্তমানে ৩৫০টি হিমাগার চালু রয়েছে। এসব হিমাগারে আলুর ধারণক্ষমতা ৩০ লাখ টন (৩০০ কোটি কেজি)। ৮ টাকা কেজি ভাড়া হলে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের মোট দিতে হবে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। এ কারণে সংশ্লিষ্টরা হিমাগারে আলু রাখতে অনীহা প্রকাশ করছেন। এ ছাড়া হিমাগার মালিকরা অংশীজনের সঙ্গে আলোচনা না করে একতরফা ভাড়া বাড়িয়েছেন বলে অভিযোগ করছেন কৃষকরা।
চিঠি দিয়ে ভাড়া বাড়ানো
রংপুর হিমাগার মালিক সমিতির সভাপতি মোসাদ্দেক হোসেন বাবলু বলেন, ২০২১ সালে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে ভাড়া ছিল ৫ টাকা। ২০২২ সালে সাড়ে ৫ টাকা, ২০২৩ সালে ৬ টাকা এবং গত বছর ৭ টাকা ছিল।
চলতি বছর বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়ে এরই মধ্যে জেলায় জেলায় চিঠি পাঠিয়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সুশান্ত কুমার প্রামাণিকের সই করা চিঠিতে বলা হয়, হিমাগারের বিপরীতে নেওয়া ঋণের সুদ, বিদ্যুৎ খরচ, লোডিং-আনলোডিং ও পাল্টানোর খরচ, কর্মচারীদের বেতন, বোনাস, বীমা খরচ, গ্যাস বিল, মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণসহ অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বিশ্লেষণ করে প্রতি কেজি আলুর সংরক্ষণ ব্যয় দাঁড়ায় ৯ টাকা ৬২ পয়সা। তার পরও ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে কেজিপ্রতি ৮ টাকা।
একই সঙ্গে তারা বলেছে, গত বছর ব্যাংক সুদের হার ছিল ৯-১০ শতাংশ। এ বছর তা বেড়ে ১৬-১৭ শতাংশ হয়েছে। যদিও বিদ্যুতের বিল অপরিবর্তিত রয়েছে।
কৃষকদের দাবি, আগে আলু রাখা হতো বস্তা হিসেবে, কেজি হিসেবে নয়। এবার বস্তা হিসেবে রাখতে দিচ্ছে না হিমাগার। আগে প্রতি বস্তা ভাড়া ছিল ৩২০-৩৫০ টাকা। এক বস্তায় ৭০ থেকে ৮০ কেজি পর্যন্ত রাখা যেত। এবার প্রতি বস্তায় ৫০ কেজির বেশি রাখা যাবে না। ভাড়া পড়বে ৮ টাকা হিসেবে ৪০০ টাকা।
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, ‘সব সময় হিমাগারের ভাড়া কেজিতে নির্ধারিত ছিল, বস্তাপ্রতি নয়। সংরক্ষণকারীরা এটা মানতেন না। তারা প্রতি বস্তায় ২০ থেকে ৩০ কেজি বাড়তি আলু রাখতেন। এতে কৃষকের লাভ হলেও লোকসান হতো হিমাগার মালিকের। তাই এবার কঠোর হয়েছি আমরা।’
বগুড়া ও জয়পুরহাটে ৫৫ হিমাগার, চাহিদার এক-চতুর্থাংশ
হিমাগার মালিকরা জানান, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলায় ৫৫টি হিমাগার রয়েছে। এগুলোর সম্মিলিত ধারণক্ষমতা প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারির পর থেকে আলু সংরক্ষণ শুরু হবে। মৌসুমে ১০-১২ দিনে একটি হিমাগার আলুতে ভরে যায়। এত অল্প সময়ে ২ লাখ টন আলু মাপা সম্ভব নয়। কিন্তু বের করা হয় আস্তে আস্তে। কোনো কোনো হিমাগার থেকে আলু বের হতে ছয় থেকে আট মাস লাগে। তাই এবার হিমাগারের ভাড়া নেওয়া হবে আলু বের করার সময়। গত বছরও আলু রাখার সময় ভাড়া নেওয়া হয়েছে।
এ দুই জেলায় এবার আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২১ লাখ ৩১ হাজার ৫০০ টন (২১৩ কোটি ১৫ লাখ কেজি)। এর মধ্যে হিমাগারের ধারণক্ষমতা ৭ লাখ ৫০ হাজার টন (৭৫ কোটি কেজি)। ভাড়া বাড়ানোয় শুধু এ দুই জেলায় বাড়তি গুনতে হবে ৭৫ কোটি টাকা।
বগুড়ার শেরপুর উপজেলার কৃষক আব্দুল কাদের বলেন, এক বিঘা জমিতে ৮০ থেকে ৯০ মণ আলু হয়। যদি প্রতি কেজি ১০-১২ টাকা দরে বেচি, তাহলে লাভ তো দূরের কথা খরচ উঠবে না। আবার ক্ষেতে না বেচে যে হিমাগারে রাখব, সেই সুযোগ বন্ধ।
জয়পুরহাটের কৃষক আকরাম হোসেন বলেন, হিমাগার মালিকরা জোটবদ্ধ হয়ে প্রতি বছর ভাড়া বাড়াচ্ছেন। এবারও বাড়িয়েছেন। আমরা মাঠে ঘাম, শ্রম ঝরিয়ে ফসল ফলিয়ে লোকসান করব, আর তারা বসে থেকে সেই ফসলের ফায়দা লুটবেন– এটি সিন্ডিকেট ছাড়া আর কিছু নয়।
বটতলী বাজারের ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন বলেন, হিমাগার ভাড়া যত বাড়বে, ব্যবসায়ীরা তত বেপরোয়া হয়ে উঠবেন। আর এর চাপ পড়বে ভোক্তাদের ওপর। প্রশাসনের এখনই হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আর এ দুই জেলায় প্রয়োজনের তুলনায় হিমাগার সংখ্যা কম। এ কারণে মালিকরা সিন্ডিকেট করার সুযোগ পাচ্ছে।
জয়পুরহাটের কৃষক কামাল হোসেন বলেন, যখন আমরা আলু বিক্রি করি, তখন দাম থাকে না। পরে যখন দাম বাড়ে, তখন মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভ করে। এখন হিমাগারেও রাখতে পারছি না, কারণ ঘোষিত ভাড়ায় আলু রাখা সম্ভব নয়।
বগুড়ার শিবগঞ্জের কৃষক রহিম উদ্দিন বলেন, এত টাকা দিয়ে আলু রেখে পরে বেচলেও লাভ হবে না। তাহলে কী করব?
কৃষকরা দাবি করছেন, সরকার যদি সরাসরি তাদের কাছ থেকে আলু কিনে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করত এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ করত, তাহলে সংকট কিছুটা কমত।
রংপুরে বেকায়দায় কৃষক
রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলায় এ বছর এক লাখ হেক্টরের বেশি জমিতে আলু চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৫ লাখ টন। কৃষি বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সাতমাথার ক্ষুব্ধ চাষি আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘দাম না পাওয়ায় আলু আবাদ করি এবার হামার কোমর পড়ি গেইচে বাহে। লাভের আশায় হিমাগারোত থোমো তারও বুদ্দি নাই। ওমরা ভাড়া বাড়াইচে। মরণ ছাড়া হামার কৃষকের কোনো পথ নাই।’
রংপুরের আলু ব্যবসায়ী আরমান আলী অভিযোগ করে বলেন, বর্তমানে দাম না থাকলেও এবারে আলুর উৎপাদন ভালো হয়েছে। এ কারণে হিমাগার মালিকরা ভাড়া বাড়িয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
বগুড়া জেলা কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহসভাপতি তোফাজ্জল হোসেন জানান, হিমাগারে আলু রাখার ভাড়া নির্ধারণ করে বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন। শ্রমিক খরচ ও বিদ্যুৎ খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। এতে কৃষকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা নেই। কারণ বাজারে এখন কম দাম হলেও পরে দাম বাড়ে।
জয়পুরহাট কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মেহেদী হাসান বলেন, সংরক্ষণ ভাড়া বাড়লে এর চাপ ভোক্তা পর্যায়ে পড়বে। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা আলুর দাম বাড়িয়ে দেবেন। আমরা এ নিয়ে কাজ শুরু করেছি। সব পক্ষের সঙ্গে এ ব্যাপারে কথা বলা হবে।
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, এ বছর শুধু ব্যাংকের সুদহার বাড়ার কারণে প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে ব্যয় বেড়ে ৫ দশমিক ৮ টাকা দাঁড়িয়েছে। বিদ্যুতে ব্যয় হয় ১ দশমিক ১০ টাকা। অথচ গত বছর সব খরচ মিলিয়ে ব্যয় ছিল কেজিতে ৬ টাকা।
জেলা প্রশাসনের বাণিজ্য শাখার শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগ হিমাগার বা কোল্ডস্টোরেজের লাইসেন্স দেওয়া ও নবায়ন করে থাকে। আর পরিচালনা নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশন ও কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। জানতে চাইলে বগুড়া জেলা প্রশাসক হোসনা আফরোজা বলেন, ‘হিমাগার মালিকদের সঙ্গে কথা বলব। এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করার দরকার ছিল।’
প্রতিবাদ কর্মসূচি
এদিকে, ভাড়া কমানো এবং বস্তা হিসাবে আলু রাখার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর ও কৃষক সংগঠন। তারা আগামী সোমবার রংপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করবে। তাদের দাবি, অগ্রিম বুকিংয়ের জন্য ১০০ টাকা আদায় বন্ধ, প্রতি কেজি আলুর ভাড়া দেড় টাকা নির্ধারণ, অবিলম্বে সরকারি উদ্যোগে প্রতি উপজেলায় বিশেষায়িত হিমাগার নির্মাণ এবং হিমাগারে প্রকৃত কৃষকের জন্য ৬০ ভাগ জায়গা বরাদ্দ বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষেতমজুর ও কৃষক সংগঠন রংপুরের আহ্বায়ক আনোয়ার হোসেন বাবলু বলেন, ‘আলু চাষ করে যে সময় চাষিরা বিশাল অঙ্কের লোকসান গুনছে, ঠিক সে সময় হিমাগার ভাড়া বাড়ানো কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। এতে ঠিক আগের মতোই হিমাগার মালিকসহ ব্যবসায়ীরা লাভবান হবেন ঠিকই; চাষিরা বঞ্চিতই থাকবেন।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আল হ ম গ র ম ল কর হ স ন বল ন ব যবস য় গত বছর
এছাড়াও পড়ুন:
আঠারো শতকের সুফি কবি ও সংগীতজ্ঞ সৈয়দ খাজা মীর দর্দ
আবদালি মারাঠিদের উৎপাত ও অত্যাচারে অন্য কবিরা যখন একে একে দিল্লি ছেড়ে লক্ষ্ণৌ চলে গিয়েছিলেন, তখনো প্রিয় শহর দিল্লি ছাড়েননি সৈয়দ খাজা মীর দর্দ (১৭২০-১৭৮৪ খ্রি.), বরং আমৃত্যু সেখানেই থেকে গিয়েছিলেন। লক্ষ্ণৌয়ে অবস্থানকারী কবিদের কাব্যবৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তাঁর কবিতার যে পার্থক্য ছিল, শুধু সে কারণেই তিনি সেই জায়গায় যাননি তা নয়, তাঁর আত্মমর্যাদাবোধ ছিল প্রখর, কারও তারিফ করে কখনো কসিদা লিখেছেন বলে শোনা যায়নি, সর্বোপরি তাঁর জীবনদর্শনও ছিল সমকালিক অন্য কবিদের থেকে আলাদা। মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন। মির্জা রফী সওদার চেয়েও সাত বছরের অগ্রজ মীর দর্দ এই সবকিছুই নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, পারস্য ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডার থেকে অনেক কিছু গ্রহণও করেছেন, তবু আমাদের ধারণা, পারিবারিক বংশধারার প্রভাবেই তাঁর জীবনদর্শন ও কাব্যচিন্তা শুরু থেকেই ভিন্ন ছিল।
মধ্যযুগের যে সময়টায় মীর দর্দের জন্ম, সেই সময় উর্দু সাহিত্যে ‘মীর-সওদার যুগ’ বলে পরিচিত—এই দুই কবি পারস্য কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজ সিরাজি ও শেখ মোসলেহ উদ্দিন সাদির পথ অনুসরণ করে ফারসি কবিতার একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ধারাকে উর্দু কবিতার ধারায় যুক্ত করেন এবং সফল হন।মাহমুদ আলী খান জামী তাঁর ‘দর্দ কে সো শের’ (প্রকাশকাল: ১৯৫৫ খ্রি., দিল্লি) গ্রন্থে লিখেছেন, খাজা মীর দর্দের দাদা বাদশাহ আলমগীরের শাসনামলে বুখারা থেকে এ দেশে এসেছিলেন, আর বাবা খাজা মাহমুদ নাসির আন্দালিব ছিলেন ‘শায়েরে উর্দু’ এবং ব্যক্তিগত জীবনে একজন সুফি। ভিন্ন মতে, তাঁর বাবার নাম (মাহমুদ নাসির নয়) মুহাম্মদ, আর তিনি উর্দু ভাষার কবি ছিলেন না, ছিলেন ফারসি ভাষার কবি। এঁরা ছিলেন নকশবন্দী ঘরানার পথিকৃৎ খাজা বাহাউদ্দিনের বংশধর ও অনুসারী। সুফি পরম্পরার মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন বলেই মাত্র বাইশ বছর—ভিন্ন মতে, সাতাশ বছর বয়সে জাগতিক মোহ ত্যাগ করে সুফি শুদ্ধাচারী হয়ে ওঠেন দর্দ এবং সুফি তত্ত্বসংক্রান্ত একাধিক বই লেখেন। ফলে তিনি যখন শের ও গজল লেখেন, তখন সেগুলোতে স্বভাবগত কারণেই সুফি মরমি কবিতার সহজগভীর ভাবের ছায়া পড়েছে। নিচে দর্দ কে সো শের বই থেকে—অন্যত্র গজলরূপে গণ্য এবং গীত—প্রথম ৩টি শের পড়লে এ কথার সত্যতা মিলতে পারে :
তোহমতে চন্দ অপনে জিম্মে ধর চলে
জিস লিয়ে আয়ে থে হম সো কর চলে
জিন্দেগি হ্যয় য়া কোই তোফান হ্যয়
হম তো ইস জিনে কে হাথোঁ মে মর চলে
শমা কে মানিন্দ হম ইস বজম মে
চশম নম আয়ে থে দামন তর চলে
অর্থাৎ :
কত অপবাদ বয়ে নিয়ে আমি চলছি
অথচ যে কারণে এসেছি তা–ই করে গেছি
এ কোনো জীবন, নাকি তুফান
তার হাতেই তো আমি মারা যাব
এই সভার প্রদীপ ছিলাম আমি
এখন আমার চোখের জলে আঁচল ভিজে যায়
[অনুবাদ: লেখক]
অল্প বয়স থেকে যিনি এমন ভাবনায় তাড়িত, তাঁর গজলে এই প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক। সুফি কবি ও সাধক হিসেবে স্বীকৃত হলেও গজলকার হিসেবে যেরকম গণ্য হননি খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি, ঠিক একই কারণেই গজলকার হিসেবে কেউ কেউ তাঁর নাম সমকালের মীর তকী মীর ও মির্জা রফী সওদার কাতারে রাখতে কুণ্ঠিত। অবশ্য এ ক্ষেত্রে খোদ মীর তকী মীরের একটি মন্তব্য আছে, যা অনেকেই উদ্ধৃত করেন, তা হলো: তিনি নাকি আড়াইজন কবিকে সবিশেষ গুরুত্ব দিতেন, যার মধ্যে একজন তিনি নিজে, অন্যজন মির্জা রফী সওদা আর অর্ধজন হলেন খাজা মীর দর্দ।
তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।শের ও গজলের ক্ষেত্রে মীর তকি মীর শেষমেশ যে উচ্চতায় পৌঁছেছিলেন সেই জায়গা থেকে বিচার করে তাঁর এই কথাটিকে সদর্থে ধরে নিলে কবিতায় খাজা মীর দর্দের অবদানকে বিশেষভাবে মূল্যায়ন না করে উপায় নেই। আসলে পারস্য কবিতার ঐতিহ্য ধারণ করে উর্দু গজলে যখন পরবর্তীকালের জনপ্রিয় বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নারীর সঙ্গে আলাপের আবহ তৈরি হচ্ছে, খাজা দর্দ তখন একই উৎস থেকে গ্রহণ করেছিলেন সুফি ঐতিহ্য। সমালোচকদের মতে, তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘দিওয়ান-এ উর্দু’, কিন্তু তাঁর ‘শমা-এ মহফিল’, ‘আহ-এ দর্দ’, ‘দর্দ-এ দিল’ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থের প্রাঞ্জল ভাষা ও সুফিহৃদয়ের ভাব সেই সময় ও পরবর্তীকালের কবিদেরকেও প্রভাবিত করেছে। তাঁর একটি অনবদ্য শের হলো: ‘তমান্না তেরি হ্যাঁয় অগর হ্যাঁয় তমান্না/ তেরি আরজু হ্যায় অগর আরজু হ্যায়’ অর্থাৎ, আকাঙ্ক্ষা যদি থাকে, তা তোমারই আকাঙ্ক্ষা/ আশা তোমার জন্য, আদৌ আশা বলে যদি কিছু থাকে’। প্রেমের এমন একনিষ্ঠ নিবেদন খাজা দর্দের শেরেই পাওয়া সম্ভব। নিচে পড়ে নিতে পারি তাঁর আরও একটি জনপ্রিয় শের:
হাজারোঁ খওয়াহিশেঁ অ্যায়সি কে হর খওয়াহিশ পে দম নিকলে
বহুত নিকলে ম্যারে আরমান ল্যাকিন পির ভি কম নিকলে
অর্থাৎ :
এমন হাজার বাসনা আমার, যার প্রতিটি বাসনার জন্য প্রাণ ওষ্ঠাগত
কিছু আকাঙ্ক্ষা পূরণ হলো বটে; কিন্তু তা খুবই সামান্য
তাঁর এমন সহজগভীর ভাষার জন্য বোধ হয় বেশ কিছু অনুসারী তৈরি হয়েছিল, যাঁরা নিয়মিত তাঁর মাহফিলে আসতেন। শুধু ভাবশিষ্যরাই নন, সংগীতশাস্ত্রে পারদর্শী খাজা মীর দর্দ মর্যাদার ক্ষেত্রে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন যে তাঁর পাক্ষিক আসরে অনুরাগী হিসেবে কখনো কখনো বাদশাহ শাহ আলমও আসতেন।
আরও পড়ুনএকাদশ শতকের সুফি কবি হাকিম সানায়ি গজনভি২৮ আগস্ট ২০২৫মীর দর্দের এমন উচ্চাসনে পৌঁছার অন্য একটি কারণ হলো, তাঁর জন্মের বহু আগে থেকেই গান শোনা ও তার চর্চা বিষয়ে যে তর্ক-বিতর্ক চলে আসছিল, সে বিষয়ে তাঁর সবিস্তার আলোচনা এবং গানবিষয়ক গান লেখার উদাহরণ। আমাদের অজানা নয়, গান বিষয়ে কওয়ালির প্রতিষ্ঠাতা আমির খসরুর একাধিক বাণী আছে, যেমন: ‘গান হলো আত্মার খোরাক’, ‘দরবেশের কাছে গান হলো ঐশ্বরিক জ্যোতির সমতুল’ ইত্যাদি, আর দর্দ লিখেছেন: ‘অগর ঘিনা নফস কো বড়্কায়ে তো হারাম, অগর দিল কো ইলাহ কি তরফ নরম করে তো হালাল’ অর্থাৎ গান যদি মনকে প্রবৃত্তিতাড়িত হতে উসকে দেয় তাহলে হারাম, আর স্রষ্টামুখী করলে হালাল’। এ বিষয়ে দর্দের যে শের রয়েছে, সেটি আরও সুন্দর :
সামা’ আহলে দিল কো হ্যা সোদমন্দ দর্দ
কে ইস সে নরম হোতা হ্যা পাত্থর কা দিল ভি
অর্থাৎ :
হৃদয়বান মানুষের জন্য গান উপকারী, হে দর্দ
কারণ পাথরের মতো হৃদয়ও তাতে গলে যায়।
উল্লেখ্য যে, গান বিষয়ে আলোচনা করবার সময় এ অঞ্চলের গবেষক ও সুফি-বাউল-ফকিরেরা ইমাম গাজ্জালি, মাওলানা জালাল উদ্দিন রুমি ও আমির খসরুর বইয়ের তথ্যের উল্লেখ করেন, কিন্তু প্রকাশ ও প্রচারের অভাবে কোথাও সৈয়দ খাজা মীর দর্দের কথা পাওয়া যায় না। জাভেদ হুসেন দর্দের কয়েকটি গজল অনুবাদ করতে গিয়ে তার ভূমিকায় লিখেছেন: ‘দর্দ ছিলেন একজন বড় সংগীতজ্ঞ। সুফি সাধনায় সংগীতের ভূমিকা নিয়ে হুরমতে ঘিনা নামে পুস্তিকা লিখেছেন। উর্দু গজলের গীতিময়তা আজ দেখা যায় তাতে দর্দের ভূমিকা ব্যাপক ও গভীর।’ এই পুস্তিকাটি দুর্লভ, ভবিষ্যতে এটি অনূদিত হলে শায়ের ও গজলকার মীর দর্দের পাশাপাশি সংগীতচিন্তক হিসেবে তাঁর পরিচয়টাও আমরা জানতে পারব।
অন্য আলো–য় লিখতে পারেন আপনিও। গল্প, কবিতা, প্রবন্ধসহ আপনার সৃজনশীল, মননশীল যেকোনো ধরনের লেখা পাঠিয়ে দিন। পাঠাতে পারেন প্রকাশিত লেখার ব্যাপারে মন্তব্য ও প্রতিক্রিয়া।ই–মেইল: [email protected]