ঠিকানাহীনদের ‘স্থায়ী ঠিকানা’ দিন আগে
Published: 9th, February 2025 GMT
সম্প্রতি পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টা বরাবর দাখিল করেছে। এতে মোট ১৫টি ক্ষেত্রে ১১৩টি সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রধারী চাকরিপ্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা রহিত করা যেতে পারে।’
সুপারিশটা নিয়ে ভাবতে ভালোই লাগছে। যারা চাকরি করছেন বা করেছেন তারা ভাবছেন, কথিত পুলিশ ভেরিফিকেশনে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আর যারা ভবিষ্যতে চাকরিতে আসবেন তারা পুলকিত হচ্ছেন পুলিশ ভেরিফিকেশনের কথিত ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি ঘটছে বলে। সুপারিশটার ভালোমন্দ একটু তল্লাশি করা যাক।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন মূলত দানা বেঁধেছিল সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপুতিদের বরাদ্দকৃত ৩০% কোটাকে যুক্তিসংগত পর্যায়ে নামিয়ে আনা বিষয়ে। ২০১৮ সালে এই কোটা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি উত্থাপিত হলে তৎকালীন সরকারপ্রধান গোস্বা করে সব ধরনের কোটা বিলুপ্তির অনুশাসন দেন। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর ৯ম গ্রেড (আগের ১ম শ্রেণি) ও ১০ম-১২তম গ্রেড (আগের ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগে সব ধরনের কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, এতিমখানা নিবাসী, নৃগোষ্ঠী, আনসার-ভিডিপি, জেলাসহ সব কোটা বাতিল হয়ে যায়।
সরকারের প্রজ্ঞাপন চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা হলে সে পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ গত বছরের ৫ জুন আলোচিত প্রজ্ঞাপনটি অবৈধ ঘোষণা করেন। এই রায়ের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটে বিশাল পরিবর্তন। উত্তাল ছাত্র-জনতার কোটাবিরোধী আন্দোলনের ফলে ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করেন। যুগান্তকারী রায়টিতে বলা হয়– সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১ শতাংশ নৃগোষ্ঠী, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী-তৃতীয় লিঙ্গ কোটা হিসেবে থাকবে। এই রায়ের আলোকে ২৩ জুলাই কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সেই প্রজ্ঞাপনের বলে এখন দেশে জেলা কোটা নেই। জেলা কোটা না থাকায় সরকারি চাকরিতে স্থায়ী ঠিকানার গুরুত্ব হারিয়েছে। কারণ, আগে নিজের জেলায় কোটার প্রাপ্যতা না থাকায় ভিন্ন জেলার ঠিকানা ব্যবহার করে কেউ কেউ সরকারি চাকরিতে আবেদন করত বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন আর ভিন্ন জেলার ঠিকানা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ার কথা নয়। তবে গ্রেড ১৩-১৮ (সাবেক ৩য় শ্রেণি) ও গ্রেড ১৯-২০ (সাবেক ৪র্থ শ্রেণি) ভুক্ত কিছু চাকরি জেলায় সীমিত থাকায় সংশ্লিষ্ট জেলার প্রার্থীরাই আবেদন করতে পারত। গত কছর ২১ জুলাইয়ের ঐতিহাসিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিধানও উঠে গেলে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের গ্রেড ১৩-২০ পদে নিয়োগে ঢাকা জেলার স্থায়ী বাসিন্দার কোনো বাধা থাকবে না। ফলে মনে হতে পারে, কোনো প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা যাচাইয়ের কোনো ধরনের আবশ্যকতা আর নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করা হয়? সরকারি চাকরির অনেক পদের সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, আর্থিক সংশ্লিষ্টতা জড়িত। আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ কোনো পদও যে কোনো সময় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ধারক-বাহক হতে পারে। সে কারণেই যোগদানকারীর শিকড়ের খোঁজ নিতে হয়।
ব্রিটিশ আমলে নিয়োগের আগে প্রার্থীর আত্মীয়স্বজনের অপরাধপ্রবণতা এবং ফৌজদারি অপরাধের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধান হতো। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পিতার অপরাধে সন্তান দণ্ডিত না হলেও প্রার্থীর নিজের গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের ইতিহাস যাচাই করা হয়। আর সেটা যাচাইয়ের জন্য স্থায়ী ঠিকানাই প্রধান উৎস। চাকরিকালে তহবিল তছরুপ, রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচারের মতো অপরাধের পর নিরুদ্দেশ কর্মচারীকে স্থায়ী ঠিকানায় বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে হদিস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধান না করা হলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
সরল মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, জাতীয় পরিচয়পত্রেই তো স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ থাকে; চাকরিপ্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা যাচাইয়ের আবশ্যিকতা কী? জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয় জন্মনিবন্ধন সনদের ভিত্তিতে। কাঠামোগত দুর্বলতার সুযোগে জন্মনিবন্ধন সনদে স্থায়ী ঠিকানা ভিন্ন দেখানো কঠিন কিছু নয়। বস্তুত ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেই অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের পাসপোর্ট বাগিয়েছে।
রোহিঙ্গাদের মতো আরও কেউ একই কায়দায় ভুয়া পরিচয়পত্র হাসিল করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে পারে। আবার জেলায় সীমিত চাকরির আবেদনেও স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধান না হওয়ার সুযোগে ভিন্ন জেলার লোকেরা আবেদন করতে পারে। ফলে পুলিশ কমিশনের এই সুপারিশ হিতে বিপরীত হতে পারে।
আমাদের দেশে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৭ ছাড়া অন্য কোনো আইন বা বিধিতে স্থায়ী ঠিকানার সংজ্ঞা নিরূপিত আছে কিনা, জানা নেই। বিধিমালার ২ (২৪) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘স্থায়ী ঠিকানা অর্থ ব্যক্তির নিজের, পিতা বা পিতামহের স্থাবর সম্পত্তিসহ বসবাসের ঠিকানা অথবা নদীভাঙন বা অন্য কোনো কারণে ইতোপূর্বের স্থায়ী ঠিকানা বিলুপ্ত হওয়ায় বা ত্যাগ করায় নতুন কোনো স্থানে কোনো স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করিয়া ৩ (তিন) বছরের অধিক সময়ের জন্য উক্ত স্থানে বসবাস করিতেছেন বা বসবাসের উদ্দেশ্যে অবস্থান করিতেছেন এবং উক্ত ঠিকানার বিপরীতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে বা সরকারের ভূমি রাজস্ব দপ্তরে কর পরিশোধ করিতেছেন।’ এই সংজ্ঞার ফলে স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করে কোথায়ও বসবাস না করা অগণন নাগরিক জন্মনিবন্ধন সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র করতে পারছে না এবং একই সূত্রে পাসপোর্ট গ্রহণসহ নাগরিক অনেক সুবিধা ভোগ করতে পারছে না।
যেমন সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নের নদীভাঙনকবলিত হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘদিন টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলায় বসবাস করলেও তারা স্থায়ী ঠিকানা চৌহালীই বলে, যা নদীতে বিলীন। তারা নাগরপুর উপজেলার ভূখণ্ডে বসবাস করেও চৌহালীর বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করে চলেন। চৌহালী ছাড়াও দেশের অনেক এলাকারই নদীভাঙনকবলিত মানুষ দুই তিন পুরুষ ধরে খাস জমি, ভাড়া বাড়ি, বস্তি, রেললাইনের পাশে বসবাস করছেন। স্থায়ী ঠিকানার অভাবে তারা নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারেন না।
জাতীয় পরিচয়পত্রধারী চাকরিপ্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা রহিত করার পরিবর্তে স্থায়ী ঠিকানাবিহীন মানুষদের জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টসহ নাগরিক অধিকারপ্রাপ্তিতে স্থায়ী ঠিকানা জটিলতা দূর করা দরকার আগে। ঠিকানাবিহীনদের স্থায়ী ঠিকানা দিতে না পারলেও স্থায়ী ঠিকানার নতুন সংজ্ঞায়ন হোক যাতে নাগরিক সুবিধা পেতে বঞ্চনার শিকার না হয়।
আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব
.উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
শেরপুর নির্বাচন অফিসে রোহিঙ্গা আটক
শেরপুর ভুয়া নাম-পরিচয় ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) করতে গিয়ে এক রোহিঙ্গা আটক হয়েছেন। সোমবার (১৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আটকের পর তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছেন জেলা নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারা।
আটক ব্যক্তির নাম মো. আমিন। তিনি কক্সবাজারের উখিয়ার টাংহালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা। তার বাবার নাম জাহিদ হোসেন।
আরো পড়ুন:
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের স্থায়ী প্রত্যাবাসনে ‘বাস্তব পদক্ষেপ’ চায় ওআইসি
৪০ দেশের প্রতিনিধিদের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন
জেলা নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা যায়, আলম মিয়া নাম ব্যবহার করে উখিয়ার টাংহালি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক ব্যক্তি এনআইডি করতে শেরপুর জেলা নির্বাচন অফিসে আবেদন করেন। সেখানে তিনি বাবার নাম আলী হোসেন উল্লেখ করেন এবং শেরপুর পৌরসভার কসবা মোল্লাপাড়া ও শিবুত্তর এলাকার বাসিন্দা হিসেবে দাবি করেন। কথাবার্তা ও নথিপত্র যাচাইয়ের সময় সন্দেহ হলে কর্মকর্তারা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় ওই ব্যক্তি নিজেকে রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করেন।
শেরপুরের অতিরিক্ত জেলা নির্বাচন অফিসার মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, “তার কাগজপত্র দেখে আমাদের সন্দেহ হয়। তার ভাষাগত বিষয়টি আমাদের নজরে আসে। জিজ্ঞাসাবাদ করলে তিনি নিজেকে রোহিঙ্গা বলে স্বীকার করেন।”
আটক মো. আমিন বলেন, “আমি কক্সবাজারের উখিয়ার টাংহালি ক্যাম্পে থাকি। এ দেশের নাগরিক হওয়ার আশায় ভোটার আইডি কার্ড করতে শেরপুরে এসেছিলাম। কাজের জন্য পরিচয়পত্র পেলে সুবিধা হবে ভেবেই আলম নামে আবেদন করেছি।”
শেরপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (তদন্ত) জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, “রোহিঙ্গা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার সঙ্গে স্থানীয় কেউ জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আইনগত ব্যবস্থা চলমান।”
ঢাকা/তারিকুল/মাসুদ