সম্প্রতি পুলিশ সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশমালা প্রধান উপদেষ্টা বরাবর দাখিল করেছে। এতে মোট ১৫টি ক্ষেত্রে ১১৩টি সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘জাতীয় পরিচয়পত্রধারী চাকরিপ্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা রহিত করা যেতে পারে।’

সুপারিশটা নিয়ে ভাবতে ভালোই লাগছে। যারা চাকরি করছেন বা করেছেন তারা ভাবছেন, কথিত পুলিশ ভেরিফিকেশনে কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। আর যারা ভবিষ্যতে চাকরিতে আসবেন তারা পুলকিত হচ্ছেন পুলিশ ভেরিফিকেশনের কথিত ভোগান্তি থেকে নিষ্কৃতি ঘটছে বলে। সুপারিশটার ভালোমন্দ একটু তল্লাশি করা যাক।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন মূলত দানা বেঁধেছিল সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতিপুতিদের বরাদ্দকৃত ৩০% কোটাকে যুক্তিসংগত পর্যায়ে নামিয়ে আনা বিষয়ে। ২০১৮ সালে এই কোটা ১০ শতাংশে নামিয়ে আনার দাবি উত্থাপিত হলে তৎকালীন সরকারপ্রধান গোস্বা করে সব ধরনের কোটা বিলুপ্তির অনুশাসন দেন। ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর ৯ম গ্রেড (আগের ১ম শ্রেণি) ও ১০ম-১২তম গ্রেড (আগের ২য় শ্রেণি) পদে সরাসরি নিয়োগে সব ধরনের কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়। মুক্তিযোদ্ধা, নারী, এতিমখানা নিবাসী, নৃগোষ্ঠী, আনসার-ভিডিপি, জেলাসহ সব কোটা বাতিল হয়ে যায়। 

সরকারের প্রজ্ঞাপন চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে মামলা হলে সে পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট বিভাগ গত বছরের ৫ জুন আলোচিত প্রজ্ঞাপনটি অবৈধ ঘোষণা করেন। এই রায়ের পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটে বিশাল পরিবর্তন। উত্তাল ছাত্র-জনতার কোটাবিরোধী আন্দোলনের ফলে ২১ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করেন। যুগান্তকারী রায়টিতে বলা হয়– সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ হবে মেধার ভিত্তিতে। ৫ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা, ১ শতাংশ নৃগোষ্ঠী, ১ শতাংশ প্রতিবন্ধী-তৃতীয় লিঙ্গ কোটা হিসেবে থাকবে। এই রায়ের আলোকে ২৩ জুলাই কোটা সংস্কার করে প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সেই প্রজ্ঞাপনের বলে এখন দেশে জেলা কোটা নেই। জেলা কোটা না থাকায় সরকারি চাকরিতে স্থায়ী ঠিকানার গুরুত্ব হারিয়েছে। কারণ, আগে নিজের জেলায় কোটার প্রাপ্যতা না থাকায় ভিন্ন জেলার ঠিকানা ব্যবহার করে কেউ কেউ সরকারি চাকরিতে আবেদন করত বলে অভিযোগ রয়েছে। এখন আর ভিন্ন জেলার ঠিকানা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ার কথা নয়। তবে গ্রেড ১৩-১৮ (সাবেক ৩য় শ্রেণি) ও গ্রেড ১৯-২০ (সাবেক ৪র্থ শ্রেণি) ভুক্ত কিছু চাকরি জেলায় সীমিত থাকায় সংশ্লিষ্ট জেলার প্রার্থীরাই আবেদন করতে পারত। গত কছর ২১ জুলাইয়ের ঐতিহাসিক রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সে বিধানও উঠে গেলে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসনের গ্রেড ১৩-২০ পদে নিয়োগে ঢাকা জেলার স্থায়ী বাসিন্দার কোনো বাধা থাকবে না। ফলে মনে হতে পারে, কোনো প্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা যাচাইয়ের কোনো ধরনের আবশ্যকতা আর নেই।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করা হয়? সরকারি চাকরির অনেক পদের সঙ্গেই রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, গোপনীয়তা, আর্থিক সংশ্লিষ্টতা জড়িত। আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ কোনো পদও যে কোনো সময় রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ধারক-বাহক হতে পারে। সে কারণেই  যোগদানকারীর শিকড়ের খোঁজ নিতে হয়। 

ব্রিটিশ আমলে নিয়োগের আগে প্রার্থীর আত্মীয়স্বজনের অপরাধপ্রবণতা এবং ফৌজদারি অপরাধের পারিবারিক ইতিহাস সম্পর্কে অনুসন্ধান হতো। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পিতার অপরাধে সন্তান দণ্ডিত না হলেও প্রার্থীর নিজের গুরুতর ফৌজদারি অপরাধের ইতিহাস যাচাই করা হয়। আর সেটা যাচাইয়ের জন্য স্থায়ী ঠিকানাই প্রধান উৎস। চাকরিকালে তহবিল তছরুপ, রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য পাচারের মতো অপরাধের পর নিরুদ্দেশ কর্মচারীকে স্থায়ী ঠিকানায় বা আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে হদিস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধান না করা হলে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকি বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে।
সরল মনে প্রশ্ন উঠতেই পারে, জাতীয় পরিচয়পত্রেই তো স্থায়ী ঠিকানা উল্লেখ থাকে; চাকরিপ্রার্থীর স্থায়ী ঠিকানা যাচাইয়ের আবশ্যিকতা কী? জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয় জন্মনিবন্ধন সনদের ভিত্তিতে। কাঠামোগত দুর্বলতার সুযোগে জন্মনিবন্ধন সনদে স্থায়ী ঠিকানা ভিন্ন দেখানো কঠিন কিছু নয়। বস্তুত ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করেই অনেক রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশের পাসপোর্ট বাগিয়েছে। 

রোহিঙ্গাদের মতো আরও কেউ একই কায়দায় ভুয়া পরিচয়পত্র হাসিল করে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসতে পারে। আবার জেলায় সীমিত চাকরির আবেদনেও স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধান না হওয়ার সুযোগে ভিন্ন জেলার লোকেরা আবেদন করতে পারে। ফলে পুলিশ কমিশনের এই সুপারিশ হিতে বিপরীত হতে পারে।
আমাদের দেশে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৭ ছাড়া অন্য কোনো আইন বা বিধিতে স্থায়ী ঠিকানার সংজ্ঞা নিরূপিত আছে কিনা, জানা নেই। বিধিমালার ২ (২৪) বিধিতে বলা হয়েছে, ‘স্থায়ী ঠিকানা অর্থ ব্যক্তির নিজের, পিতা বা পিতামহের স্থাবর সম্পত্তিসহ বসবাসের ঠিকানা অথবা নদীভাঙন বা অন্য কোনো কারণে ইতোপূর্বের স্থায়ী ঠিকানা বিলুপ্ত হওয়ায় বা ত্যাগ করায় নতুন কোনো স্থানে কোনো স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করিয়া ৩ (তিন) বছরের অধিক সময়ের জন্য উক্ত স্থানে বসবাস করিতেছেন বা বসবাসের উদ্দেশ্যে অবস্থান করিতেছেন এবং উক্ত ঠিকানার বিপরীতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে বা সরকারের ভূমি রাজস্ব দপ্তরে কর পরিশোধ করিতেছেন।’ এই সংজ্ঞার ফলে  স্থাবর সম্পত্তি ক্রয় করে কোথায়ও বসবাস না করা অগণন নাগরিক জন্মনিবন্ধন সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র করতে পারছে না এবং একই সূত্রে পাসপোর্ট গ্রহণসহ নাগরিক অনেক সুবিধা ভোগ করতে পারছে না। 

যেমন সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নের নদীভাঙনকবলিত হাজার হাজার মানুষ দীর্ঘদিন টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলায় বসবাস করলেও তারা স্থায়ী ঠিকানা চৌহালীই বলে, যা নদীতে বিলীন। তারা নাগরপুর উপজেলার ভূখণ্ডে বসবাস করেও চৌহালীর বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদ গঠন করে চলেন। চৌহালী ছাড়াও দেশের অনেক এলাকারই নদীভাঙনকবলিত মানুষ দুই তিন পুরুষ ধরে খাস জমি, ভাড়া বাড়ি, বস্তি, রেললাইনের পাশে বসবাস করছেন। স্থায়ী ঠিকানার অভাবে তারা নাগরিক সুবিধা ভোগ করতে পারেন না। 

জাতীয় পরিচয়পত্রধারী চাকরিপ্রার্থীদের স্থায়ী ঠিকানা অনুসন্ধানের বাধ্যবাধকতা রহিত করার পরিবর্তে স্থায়ী ঠিকানাবিহীন মানুষদের জন্মনিবন্ধন সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্টসহ নাগরিক অধিকারপ্রাপ্তিতে  স্থায়ী ঠিকানা জটিলতা দূর করা দরকার আগে। ঠিকানাবিহীনদের স্থায়ী ঠিকানা দিতে না পারলেও স্থায়ী ঠিকানার নতুন সংজ্ঞায়ন হোক যাতে নাগরিক সুবিধা পেতে বঞ্চনার শিকার না হয়। 

আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী: অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ কর ত অপর ধ সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রাম, জেএসসি ছাড়াও ভর্তি

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপেন স্কুল পরিচালিত এসএসসি প্রোগ্রামের মানবিক, ব্যবসায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান শাখায় ২০২৬-২০২৭ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ভর্তির যোগ্যতা জেএসসি পাস হতে হবে। জেএসসি ছাড়াদের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

ভর্তির দরকারি তারিখ—

১. অনলাইনে ভর্তি এবং আবেদনের তারিখ শেষ তারিখ: ৩১ জানুয়ারি ২০২৬।

২. অষ্টম শ্রেণি বা সমমানের সনদবিহীন ভর্তি-ইচ্ছুকদের ভর্তি পরীক্ষা : ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৬।

৩. ওরিয়েন্টেশন ও টিউটোরিয়াল ক্লাস শুরু : ১৫ মে ২০২৬।

ভর্তির যোগ্যতা—

১. জেএসসি বা জেডিসি বা অষ্টম শ্রেণি বা সরকার স্বীকৃত সমমানের পরীক্ষায় পাস বা উত্তীর্ণ হতে হবে। (ভর্তির তারিখ ০২/১১/২০২৫ থেকে ৩১/০১/২০২৬)।

২. সরাসরি অনলাইন ভর্তির জন্য: osapsnew.bou.ac.bd

ভর্তির যোগ্যতা(জেএসসি ছাড়া) —

১. যেসব শিক্ষার্থীর জেএসসি বা জেডিসি বা অষ্টম শ্রেণি বা সরকার স্বীকৃত সমমানের সনদপত্র নেই তারাও ভর্তির জন্য আবেদন করতে পারবেন, এ ক্ষেত্রে বয়স হতে হবে ন্যূনতম ১৪ বছর (৩১/১২/২০২৫ তারিখে)।

২. এসব আবেদনকারীকে যোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য বাউবি কর্তৃক নির্ধারিত ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে।

৩. এ জন্য ভর্তির প্রাথমিক আবেদন ফরম ফি বাবদ ৩০০ টাকা দিতে হবে।

৪. ভর্তি পরীক্ষার বিষয়, মানবণ্টন, তারিখ ও পরীক্ষা কেন্দ্র এবং প্রক্রিয়ার বিস্তারিত তথ্য বাউবি’র ওয়েবসাইট, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র এবং স্টাডি সেন্টার থেকে পাওয়া যাবে। (অনলাইনে আবেদনের তারিখ ০২/১১/২০২৫ থেকে ৩১/০১/২০২৬)।

প্রয়োজনীয় কাগজ যা লাগবে—

১. দুই কপি ছবি।

২. জেএসসি বা জেডিসি বা অষ্টম শ্রেণি বা সরকার স্বীকৃত সমমানের পরীক্ষায় পাস বা উত্তীর্ণের সনদ।

৩. জাতীয় পরিচয়পত্র বা অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদের সত্যায়িত ফটোকপি।

ভর্তি ও অন্যান্য ফি—

অনলাইন আবেদন ফি: ১০০ টাকা,

রেজিস্ট্রেশন ফি : ১০০ টাকা,

কোর্স ফি (প্রতি কোর্স ৫২৫ টাকা): ৩৬৭৫ টাকা,

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আবশ্যিক) ব্যবহারিক ফি: ১০০ টাকা,

একাডেমিক ক্যালেন্ডার ফি:৫ টাকা,

ডিজিটাল আইডি কার্ড ফি: ২০০ টাকা,

পরীক্ষা ফি (প্রতি কোর্স ৫০ টাকা) : ৩৫০ টাকা,

প্রথম বর্ষ নম্বরপত্র ফি : ৭০ টাকা,

মোট আবেদন ফি: ৪৬৯৬ টাকা।

বিজ্ঞান শাখার জন্য দুটি ব্যবহারিক কোর্সের জন্য অতিরিক্ত ২০০ টাকা জমা দিতে হবে।

দরকারি তথ্য—

১. অষ্টম শ্রেণি বা সমমান পাসের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর নাম, পিতা ও মাতার নাম এবং জন্ম তারিখ ইত্যাদি প্রদত্ত সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র বা অনলাইন জন্মনিবন্ধন অনুযায়ী একই রকম হতে হবে।

২. জেএসসি বা জেডিসি পাসের ক্ষেত্রে জেএসসি বা জেডিসি সনদ অনুযায়ী হতে হবে। ২০২০ সাল কিংবা তার পরবর্তীতে অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের অষ্টম শ্রেণি পাশ সনদে বা প্রমাণকে বোর্ড কর্তৃক ইস্যুকৃত রেজিস্ট্রেশন নম্বর উল্লেখ থাকতে হবে। সনদবিহীনদের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র বা অনলাইন জন্মনিবন্ধন সনদ অনুযায়ী হতে হবে।

৩. তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীরা কোর্স ফির শতকরা ৬০ ভাগ ছাড় পাবেন।

# বিস্তারিত তথ্যের জন্য ওয়েবসাইট

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএসসি প্রোগ্রাম, জেএসসি ছাড়াও ভর্তি
  • সঞ্চয়পত্র কেনার পর যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকবেন
  • চারঘাটে পদ্মার ভাঙন রোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দাবিতে মানববন্ধন
  • সঞ্চয়পত্র জালিয়াতির ঘটনায় মামলা, গ্রেপ্তার ১
  • সঞ্চয়পত্রে জালিয়াতির ঘটনায় ছাত্রদল নেতার নাম
  • সঞ্চয়পত্রের টাকা আত্মসাতের ঘটনায় সাবেক ছাত্রদল নেতার নাম