২৯ বছর আর ৫৬ আসর পর পাকিস্তানে আইসিসি টুর্নামেন্ট
Published: 19th, February 2025 GMT
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজন করে পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) আইসিসির কাছ থেকে কত টাকা পাবে, জানেন?
৬০ লাখ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭৩ কোটির কাছাকাছি। ৭ কোটি ডলার বাজেটের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে ৬০ লাখ মার্কিন ডলার এমন আহামরি কিছু নয়। প্রতিবছর আইসিসি থেকে লভ্যাংশ বাবদই এর দ্বিগুণের বেশি (প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ ডলার) পেয়ে থাকে পিসিবি।
বরং চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজনের জন্য কোনো টাকা না দিয়ে আইসিসি যদি উল্টো চেয়ে বসত, মনে হয় না পাকিস্তানের খুব একটা আপত্তি থাকত। একটা ‘টোকেন মানি’ পাওয়া না-পাওয়ার চেয়েও একটা আইসিসি টুর্নামেন্ট আয়োজনই যে পাকিস্তানের কাছে অনেক বড়!
‘কেন বড়’, তার উত্তর অনেক লম্বা। যে উত্তরে ক্রিকেট-জাতি হিসেবে গৌরব কিংবা সফল বড় আয়োজনের আত্মতৃপ্তির বিষয়টি তো আছেই, আছে আরও বড় হিসাব-নিকাশও।
ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি যতগুলো টুর্নামেন্ট আয়োজন করে, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ওয়ানডে সংস্করণের বিশ্বকাপ। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালে ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করেছিল পাকিস্তান। এরপর গত ২৯ বছরে আর কোনো ওয়ানডে বিশ্বকাপ তো বটেই, আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টই আয়োজন করতে পারেনি দেশটি।
এই তিন দশকে ছেলেদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ হয়েছে ৭ বার, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ৯ বার, ৯ বার চ্যাম্পিয়নস ট্রফিও। একই সময়ে মেয়েদের ক্রিকেটে ওয়ানডে বিশ্বকাপ হয়েছে ৭ বার, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ৯ বার। আর জাতীয় দলের বাইরে সবচেয়ে বড় যে আসর, ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ, সেটিও গত তিন দশকের মধ্যে হয়েছে ১৪ বার।
সব মিলিয়ে ২৯ বছরের মধ্যে পাঁচটি প্রতিযোগিতায় হয়েছে ৫৬টি আসর। ক্রিকেটের পুরোনো দেশগুলোর একটি হয়েও এতগুলো আইসিসি টুর্নামেন্টের একটিও আয়োজন করতে পারেনি পাকিস্তান। পারেনি; কারণ, যেকোনো টুর্নামেন্ট আয়োজনের যে পূর্বশর্ত—অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—সেটিতেই আশ্বস্ত করতে পারেনি পাকিস্তান।
২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে নাইন-ইলেভেনের হামলা এবং এরপর আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের সরাসরি প্রভাব ছিল পাকিস্তানে। ওই সেপ্টেম্বরেই পাকিস্তান সফরের কথা ছিল নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট দলের, সেটি তারা পিছিয়ে দেয় পরের বছরের এপ্রিল পর্যন্ত। বিলম্বিত সেই সফরে কিউইরা করাচিতে পৌঁছানোর পর আসে আরেক ধাক্কা।
নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটারদের অবস্থানরত হোটেলের কাছেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটলে সফরটি তাৎক্ষণিকভাবে বাতিল হয়ে যায়। একই বছরের অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়া দল তাদের পাকিস্তান সফরে যেতে অস্বীকৃতি জানালে পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে ওঠে। সেবার পাকিস্তান দল অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাদের হোম সিরিজটি খেলে শ্রীলঙ্কা ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে।
মাঝখানে ২০০৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত সব বিদেশি দলের সফর কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে উঠলেও ক্ষত রয়ে যায় ঠিকই। ২০০৮ সালে আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানে। কিন্তু নিরাপত্তা শঙ্কায় বিভিন্ন দল উদ্বেগ জানাতে শুরু করলে একপর্যায়ে দক্ষিণ আফ্রিকা তাদের দলই পাঠাবে না জানিয়ে দেয়। টুর্নামেন্ট সরে যায় পাকিস্তান থেকে। তবে পাকিস্তান বড় টুর্নামেন্ট আয়োজনে অলিখিত নিষেধাজ্ঞায় পড়ে ২০০৯ সালে লাহোরের ঘটনায়।
সে বছরের মার্চে গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের বাইরে শ্রীলঙ্কা দলের টিম বাসে সন্ত্রাসী হামলা হয়, যে হামলায় মারা যান ৬ পুলিশ সদস্য ও ২ পথচারী। এ ঘটনার পর কোনো দলই আর পাকিস্তানে যেতে রাজি হয়নি। ২০১১ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বকাপ আয়োজন করার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনো ম্যাচ রাখা হয়নি।
লাহোরে শ্রীলঙ্কা দলের ওপর হামলার পর পরবর্তী ৬ বছর আইসিসির কোনো পূর্ণ সদস্যদেশই আর পাকিস্তান সফরে যায়নি। চলতে থাকে অঘোষিত নির্বাসন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন থেকে পাকিস্তানের এই নির্বাসন কাটে ২০১৫ সালের মে মাসে জিম্বাবুয়ের সফরের মধ্য দিয়ে। অন্য দেশগুলো দ্বিপক্ষীয় সিরিজে সফর করতে শুরু করে ২০১৮ সাল থেকে।
এর মধ্যে ২০১৭ সাল থেকে ঘরের মাটিতে পিএসএল আয়োজন করে আইসিসির কাছে টুর্নামেন্ট আয়োজনের অনুমতি চাইতে শুরু করে পিসিবি। ২০২১ সালের শেষ দিকে ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজক স্বত্ব দেওয়া হয় পিসিবিকে, যা এখন ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে মাঠে গড়াতে চলেছে। কিন্তু এ আয়োজনেও শতভাগ তৃপ্তি কি আছে?
১৯৯৬ সালের পর প্রথমবার আইসিসি টুর্নামেন্ট আয়োজনের সুযোগ পেলেও সব ম্যাচ পাচ্ছে না পাকিস্তান। অংশগ্রহণকারী ৭ বিদেশি দলের ৬টি পাকিস্তানে যেতে সম্মতি দিলেও ভারত রাজি হয়নি। এমনকি টুর্নামেন্টটি নিরপেক্ষ ভেন্যুতে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা ছিল বিসিসিআইয়ের। এ নিয়ে প্রায় দুই মাস টানাটানি চলেছে পিসিবি, আইসিসি ও বিসিসিআইয়ের মধ্যে।
শেষ পর্যন্ত ভারতের সব ম্যাচ দুবাইয়ে হবে সিদ্ধান্তে অচলাবস্থা কেটেছে। তবে নিরাপত্তা নিয়ে সংশয় পুরোপুরি উবেছে, বলা যাবে না। ইসলামাবাদ-ভিত্তিক থিংকট্যাংক সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (সিআইএসএস) হিসাব অনুসারে, ২০২৪ সালে পাকিস্তানে ৭০০ নিরাপত্তাকর্মী, ৯০০ সশস্ত্র ব্যক্তিসহ আড়াই হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে। যদিও এর বেশির ভাগই উত্তর-পশ্চিমের খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেলুচিস্তান প্রদেশে।
অবশ্য পাকিস্তানে ভারতের না যেতে চাওয়ার পেছনে নিরাপত্তার চেয়ে ভূরাজনীতির প্রভাবই বেশি দেখছেন বিশ্লেষকেরা। ইএসপিএনক্রিকইনফোর লেখক ও ক্রিকেট বিশ্লেষক অ্যান্ড্রু ফিদেল ফার্নান্দো যেমন সরাসরিই বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অনেকগুলো দলই তো কোনো সমস্যা ছাড়া পাকিস্তানে সফর করেছে। এখানে ভারতের না যাওয়ার পেছনে নিরাপত্তা কোনো বিষয় নয়। এখানে ভূরাজনীতি ও এর প্রভাবই বেশি।’
কেন ভূরাজনীতির প্রসঙ্গ আসছে, আল-জাজিরার কাছে সেটির একটি ব্যাখ্যা দিয়েছেন ক্রিকেট ইন পাকিস্তান: নেশন, আইডেনটিটি অ্যান্ড পলিটিকস বইয়ের লেখক আলী খান, ‘নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন সরকার সম্ভবত পাকিস্তানকে সর্বক্ষেত্রে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।’
সম্ভাব্য এই ‘বিচ্ছিন্ন’ হওয়া রোধ করতেই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে অতি আগ্রহী পাকিস্তান। তিন দশক বড় টুর্নামেন্ট না দেখা পাকিস্তানের ক্রিকেটপ্রেমীদের একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট উপভোগের সুযোগ করে দেওয়ার বিষয়টি তো আছেই, সঙ্গে গড়ে ১৫ ক্রিকেটার নিয়ে ৬টি বিদেশি দলকে দুই সপ্তাহ বা তার বেশি সময় আতিথেয়তা দেওয়ার মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনের বাইরের বৈশ্বিক সম্মেলন আয়োজনের উদাহরণও তৈরি করতে চায় পাকিস্তান। মনে রাখতে হবে, পিসিবি চেয়ারম্যানের পাশাপাশি মহসিন নাকভির আরেকটি পরিচয় পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী!
করাচির ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে পাকিস্তান-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের টস তাই শুধু পাকিস্তানের জন্য আইসিসি টুর্নামেন্ট আয়োজন থেকে ২৯ বছরের বিরতিরই অবসান নয়, ভূরাজনীতির খেলায় এক ধাপ এগিয়ে যাওয়াও।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: আইস স র ক ভ র জন ত বছর র র একট ন করত
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্নীতির মামলায় শেখ হাসিনার পরিবারের ৭ সদস্যের বিচার শুরু, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের পৃথক ছয়টি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের ৭ সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেছেন আদালত।
ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক আবদুল্লাহ আল মামুন ও ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪ এর বিচারক মো. রবিউল আলম আজ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন।
প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মীর আহমেদ আলী সালাম ও সুলতান মাহমুদ।
আগামী ১১ ও ১৩ আগস্ট মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের ঠিক করা হয়েছে।
মামলায় অভিযুক্ত শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যরা হলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক (ববি)।
দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) তরিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের পৃথক ছয়টি মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের ৭ সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুদকের পক্ষ থেকে অভিযোগ গঠনের পক্ষে আদালতে যুক্তি তুলে ধরা হয়। শুনানি নিয়ে আদালত শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের আদেশ দেন আদালত।
এর আগে গত ২০ জুলাই পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের মামলায় শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের ৭ সদস্যসহ ২৩ জনের বিরুদ্ধে করা মামলাটি এই আদালতে বদলি হয়।
দুদকের পিপি মীর আহমেদ আলী সালাম প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগের ছয়টি মামলায় শেখ হাসিনাসহ অন্যদের আদালতে হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। পরে মামলাগুলো বিচারের জন্য অন্য আদালতে বদলির আদেশ দেন ঢাকা মহানগরের জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালত।
প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক তিন মামলায় গত এপ্রিলে শেখ হাসিনা, তাঁর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক তিনটি মামলায় তাঁদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় দুদক। তিনটি মামলায় তাঁদের ছাড়াও সাবেক গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদসহ ১৬ জন অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি।
২০২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের নামে বরাদ্দ নেওয়া প্লটের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করে দুদক।
পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে ছয়টি মামলায় শেখ হাসিনা ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে গত ১০ মার্চ অভিযোগপত্রের অনুমোদন দেয় দুদক।