ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের মতো কেরানীগঞ্জে রাজউকের ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পেও ‘অনুগত ও তোষামোদকারীদের’ মূল্যবান প্লট দিয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার। সরকারি চাকরি, জনসেবা ও সমজাতীয় খাতে জাতীয়ভাবে ‘অসামান্য অবদানের’ নামে ঝিলমিলে দেওয়া প্লট সংখ্যা অন্তত ২০৬।

অসামান্য অবদানের নামে প্লট পাওয়া ব্যক্তিদের একজন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এম আবদুস সোবহান। ২০১৩ সালে তাঁকে ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে সংরক্ষিত কোটায় তিন কাঠার একটি প্লট দেওয়া হয়। তিনি প্রথম মেয়াদে ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এবং দ্বিতীয় মেয়াদে ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন।

অসামান্য অবদান দেখিয়ে ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে ২০৬টি প্লট দেওয়া হয়। প্লট পাওয়া অনেকেই আওয়ামী লীগ সরকারঘনিষ্ঠ ও বিতর্কিত।

অধ্যাপক সোবহান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকাকালে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ২০২১ সালে নিজের মেয়াদের শেষ কার্যদিবসে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিভিন্ন পদে অবৈধ ও বিধিবহির্ভূতভাবে ১৩৭ জনকে নিয়োগ দেন। এ নিয়ে তখন ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়। পরে ওই নিয়োগকে ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

আবদুস সোবহানের মতো প্লট পেয়েছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ‘অনুগত ও ঘনিষ্ঠ’ অনেকে। শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ঝিলমিল প্রকল্পে সংরক্ষিত কোটায় ২০৬টির বাইরে আর কাউকে প্লট দেওয়া হয়েছে কি না, তা খুঁজে দেখছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

অসামান্য অবদানের নামে ঝিলমিলে প্লট পাওয়া ব্যক্তিদের তালিকায় রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও তার জোটভুক্ত দলের সাবেক সংসদ সদস্য, রাজনীতিবিদ, বিচারপতি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিল্পী-সাহিত্যিক, আইনজীবী, সরকারি চাকরিজীবী, প্রবাসী, সাংবাদিক, গৃহিণী, সমাজসেবক ও ব্যবসায়ীরা। কেউ তিন কাঠা, কেউ পাঁচ কাঠা আয়তনের প্লট পেয়েছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বেশির ভাগ প্লট দেওয়া হয়েছে আনুগত্য ও তোষামোদির উপহার হিসেবে। অল্প কিছু প্লট দেওয়া হয়েছে যোগ্য ব্যক্তিদের।

শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে ঝিলমিল প্রকল্পে সংরক্ষিত কোটায় ২০৬টির বাইরে আর কাউকে প্লট দেওয়া হয়েছে কি না, তা খুঁজে দেখছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)।

রাজউক চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.

) ছিদ্দিকুর রহমান ১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, রাজউকের কাজ হচ্ছে ওপর থেকে যেসব নির্দেশ আসে, তা প্রতিপালন করা। বিগত সরকার যাঁদের প্লট দিতে বলেছে, রাজউক তাদের প্লট দিয়েছে। সেখানে ভুলত্রুটি থাকতে পারে। তদন্ত হতে পারে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্লটগুলো কাদের দেওয়া হয়েছে, তা পর্যালোচনার জন্য আদালত তিন সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছেন। বিষয়টি কমিটি দেখছে।

‘অনুগত ও তোষামোদকারীদের ৮৩০ প্লট উপহার দেন হাসিনা’ শিরোনামে গত ২০ জানুয়ারি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম আলো। ওই প্রতিবেদনে উঠে আসে, বিগত সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে অসামান্য অবদানের নামে অন্তত ৮৩০ জনকে রাজউকের প্লট দেওয়া হয়। সবচেয়ে বেশি প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন বিগত তিন সংসদের (নবম, দশম ও একাদশ) সাবেক সংসদ সদস্যরা। তাঁদের সংখ্যা অন্তত ২৫৬। এ ছাড়া সাবেক অন্তত ২২ মন্ত্রী, ১২ প্রতিমন্ত্রী ও ৩৯ জন সচিব ‘অসামান্য অবদানের’ নামে প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তাঁর পরিবারের ছয় সদস্য ১০ কাঠা করে মোট ৬০ কাঠার প্লট পান রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের বাইরে ৩০ জন সাংবাদিক, ৩০ জন শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মী পেয়েছেন প্লট। তালিকায় আছেন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতা, ব্যবসায়ী, ঠিকাদার, বিচারপতি, প্রবাসী, আইনজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ অনেকে।

ঝিলমিল প্রকল্পে অসামান্য অবদান দেখিয়ে বরাদ্দ দেওয়া প্লটের তালিকায় দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি প্লট দেওয়া হয়েছে ব্যবসায়ী শ্রেণিতে। ৩৮ জন ব্যবসায়ী ঝিলমিলে প্লট পেয়েছেন। প্লট পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৩১ জন সরকারি চাকরিজীবী, ১৩ জন সাবেক সংসদ সদস্য, ১২ জন আইনজীবী এবং ১০ জন সাংবাদিক রয়েছেন। অসামান্য অবদানের নামে ঝিলমিলে প্লট দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গাড়িচালক এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদেরও। কেউ কেউ প্লট বিক্রি করে দিয়েছেন।

রাজউক দুভাবে প্লট দিয়ে থাকে। এক. লটারির মাধ্যমে। দুই. অ্যালটমেন্ট অব ল্যান্ডস রুলসের ১৩/এ ধারা অনুযায়ী। এ ধারায়‘অসামান্য অবদানের’ জন্য প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার ধারাটি বাতিল করেছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে পূর্বাচল, ঝিলমিল ও উত্তরা আবাসিক প্রকল্পে লটারির মাধ্যমে প্লট বরাদ্দের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী আবেদন করে অনেকে প্লট পেয়েছেন। অবশ্য এরপর আর লটারির মাধ্যমে প্লট দেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেয়নি রাজউক। এর বাইরে ১৩/এ ধারায় প্লট নিয়েছেন অনেকে।

৩৮ জন ব্যবসায়ী ঝিলমিলে প্লট পেয়েছেন। প্লট পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ৩১ জন সরকারি চাকরিজীবী, ১৩ জন সাবেক সংসদ সদস্য, ১২ জন আইনজীবী এবং ১০ জন সাংবাদিক রয়েছেন।

প্রথম আলোর এই প্রতিবেদন ১৩/এ ধারায় প্লট বরাদ্দ নিয়ে। অর্থাৎ লটারির বাইরে যাঁদের সরকারি চাকরি, জনসেবা ও সমজাতীয় খাতে জাতীয়ভাবে অসামান্য অবদান দেখিয়ে প্লট দেওয়া হয়েছে, তাঁদের নিয়ে। বিগত সময়ে লটারির মাধ্যমে যাঁরা প্লট পেয়েছেন, প্রতিবেদনে সে তালিকা যুক্ত করা হয়নি। গত ২০ জানুয়ারি প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনটিও ছিল শুধু ‘অসামান্য অবদান’ দেখিয়ে বরাদ্দ করা প্লট নিয়ে।

তখন দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সংরক্ষিত কোটা একটি বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়েছিল। প্লট তাঁদেরই দেওয়া হয়েছে, যাঁরা সরকারের অনুগত, তোষামোদকারী।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। নতুন সরকার অসামান্য অবদান দেখিয়ে বরাদ্দ করা প্লটের তালিকা করার নির্দেশ দেয়। রাজউক সূত্র বলছে, বিএনপি সরকারের সময়ও এভাবে প্লট দেওয়া হয়েছিল।

সংরক্ষিত কোটা একটি বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দিতে তৈরি করা হয়েছিল। প্লট তাঁদেরই দেওয়া হয়েছে, যাঁরা সরকারের অনুগত, তোষামোদকারী।টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান

সাবেক সংসদ সদস্য

কেরানীগঞ্জে বুড়িগঙ্গা নদীর পাশে ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্প। ৯১১ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এই প্রকল্পে প্লট রয়েছে ১ হাজার ৭৪০টি। সেখানে সাবেক সংসদ সদস্যদের মধ্যে আব্বাস আলী মণ্ডল, মোহাম্মদ জামাল হোসেন, কবিরুল হক মুক্তি, জয়নাল হাজারী (প্রয়াত), আশরাফুন নেছা, আফজাল হোসেন, গোলাম সারোয়ার হিরু, মো. মনিরুল ইসলাম, উম্মে রাজিয়া কাজল, হ্যাপী বড়াল, টিপু সুলতান, অপরাজিতা হক ও লুৎফুননেছা অসামান্য অবদান শ্রেণিতে প্লট পেয়েছেন।

আইনজীবী

আইনজীবীদের মধ্যে রয়েছেন আরিফ আহমেদ দুলাল, কাজী সফিউল আলম, মো. জাকির হোসেন, গাজী মো. শাহ আলম, মোহাম্মদ ফোরকান মিঞা, মো. শাহাবুদ্দিন মিয়া, আবদুর রহমান হাওলাদার, মো. আলী আকবর, মো. আখতার হোসেন, মো. জামাল উদ্দিন, এ বি এম মাহবুবুর রহমান ও মুরাদ রেজা (সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল)।

সরকারি চাকরিজীবী

প্লট পাওয়া সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে রয়েছেন এনামুল হক চৌধুরী, হাবিবুর রহমান হাবিব, সুনীল চন্দ্র দে, শাহাদাত হোসেন, এম সাইদুর রহমান, শহীদুল হক জীবন, তাপস আহমেদ, মো. মোশারফ হোসেন, মো. ইফতেখার বিন আজিজ, মো. আবুল বাশার, জিনাত হামিদ, শামীমা সুলতানা, মোহাম্মদ গোলাম সারোয়ার ভূঁঞা, মো. মাহফুজ উর রহমান, শ্যামলী নবী, মো. শাহাদাৎ হোসেন, তন্দ্রা সিকদার, মো. মামুন অর রশিদ, মো. জামাল উল্লাহ, সারা আরা মাহমুদ, সেলিম মাহমুদ, দুলাল কৃষ্ণ সাহা, মো. আকতার উজ জামান, হাবিবুল আজিজ, সায়ীদুল হক, মো. ইমরুল চৌধুরী প্রমুখ।

প্লট পাওয়া সরকারি চাকরিজীবীদের কেউ কেউ সে সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কর্মরত ও গাড়িচালক ছিলেন। গাড়িচালক ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সহকারীদের প্লট দেওয়া হয়েছে যৌথভাবে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শহীদুল হক জীবন, মো. সাইফুল ইসলাম গং (যৌথভাবে তিন কাঠা দুজনকে দেওয়া হয়), মো. মিজানুর রহমান গং, মো. নুরুল ইসলাম লিটন গং, মো. মতিউর রহমান গং, মো. মাহবুব হোসেন গং, মো. বোরহান উদ্দিন গং, লাহুত মিয়া গং, মো. আবদুর রহমান শেখ গং এবং মো. নুরুল আলম, নুরনবী ও মো. শাহীন।

সরকারের কাছে আমাদের বসার জায়গা চেয়েছি, লোকবল ও সম্মানী চেয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে কিছুই পাইনি। বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেলকেও জানিয়েছি। দেখা যাক সামনে কী হয়।হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী

ব্যবসায়ী

অসামান্য অবদানের নামে প্লট পাওয়া ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন মো. হাসানুজ্জামান, হুমায়ুন কবির, মো. সেলিম উল্লাহ, মুনির চৌধুরী, মো. মাহমুদুল হক, আবদুল লতিফ মোল্লা, লাভলী সুলতানা, আবদুল ওয়াহিদ, পারুল আক্তার, মো. বাসের উদ্দিন, মো. ফারুক আহমেদ, মো. ইকবাল হোসেন, মো. এইচ এম সেলিম, আবদুর রাশেদ, মো. জাহাঙ্গীর হোসেন, জসীম মাহমুদ, আবু বকর ছিদ্দিক, মো. নূর আলম, মো. মঞ্জুরুল আলম, মো. আনোয়ার হোসেন, খান মঈনুল ইসলাম, মো. রাসেদুল মাহমুদ, মো. সাইদুল ইসলাম, মৃধা মোহাম্মদ শাহজাহান ইসলাম, কাওছার উজ্জামান, কে বি এম মফিজুর রহমান, রুমেশা বেগম, মো. ইলিয়াস হোসেন, মো. লিয়াকত আলী, মো. মনির হোসেন, আনোয়ার হোসেন, শামসুন নাহার, গোলাম মোহাম্মদ মাহমুদ মিয়া, মাহামুদ সালাহউদ্দিন, সীমা রহমান, মঈনুল হোসেন, রোমান মিয়া ও মো. আবুল কায়সার।

সাংবাদিক ও অন্যান্য

অসামান্য অবদান দেখিয়ে সাংবাদিক শাকিল আহমেদ ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা রূপা, সোহেল হায়দার চৌধুরী, ইয়াছিন কবির, মাহবুবুর রহমান টিপু, অরূপ কুমার দত্ত, মশি শ্রাবণ, আফজাল হোসেন, আইনি ইলিয়াস ও শান্ত মিস্ত্রিকে প্লট দিয়েছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। এর বাইরে পূর্বাচলে প্লট পাওয়া (অসামান্য অবদান দেখিয়ে) আটজন সাংবাদিকের নাম জানা গেছে। তাঁরা হলেন মিথিলা ফারজানা, আবদুল্লাহ আল ফারুক (প্রয়াত), মাসুদা ভাট্টি, হারুনুর রশীদ, কার্তিক চ্যাটার্জি, নুরুল আমিন, শওকত জামিল খান ও দুলাল কৃষ্ণ আচার্য।

অসামান্য অবদানের নামে প্লট পাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে আরও রয়েছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মুকুল বোস, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শেখ আবদুস সালাম, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন চৌধুরী, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এ বি এম গোলাম কবির, ব্রিটিশ নাগরিক জালাল উদ্দিন, অভিনয়শিল্পী এস এম শাহরিয়ার নাজিম জয়, চন্দন সিনহা, ফ্যাশন ডিজাইনার মানতাসা আহমেদ, খুলনা মহানগর আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক শেখ ফারুক হাসান হিটলু প্রমুখ।

সাবেক উপাচার্য শেখ আবদুস সালাম ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, তিনি একজন শিক্ষক। ২০১৫ সালে জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার পেয়েছেন। ঢাকায় তাঁর কোনো প্লট ছিল না। এসব কারণে তাঁকে প্লট দেওয়া যৌক্তিক।

২০২৩ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে শেখ আবদুস সালামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তখন কয়েকটি ফোনালাপও ফাঁস হয়। তিনি তখন দাবি করেন, অডিও সঠিক নয়। যদিও পরে নিয়োগ বোর্ডের সভা স্থগিত করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) এক তদন্তে উঠে এসেছে, ঝিলমিলে নিজের প্লট তদারকিতে তিনজন নিরাপত্তা প্রহরীর পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ খরচ করেছিলেন শেখ আবদুস সালাম।

কমিটি কাজই শুরু করেনি

রাজউকের বরাদ্দ করা প্লট পর্যালোচনায় আদালতের গঠন করে দেওয়া কমিটি এখনো কাজই শুরু করেনি। গত ২৪ অক্টোবর হাইকোর্ট এই কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। কমিটির প্রধান হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মিফতাহ উদ্দিন চৌধুরী ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকারের কাছে আমাদের বসার জায়গা চেয়েছি, লোকবল ও সম্মানী চেয়েছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সরকারের কাছ থেকে কিছুই পাইনি। বিষয়টি অ্যাটর্নি জেনারেলকেও জানিয়েছি। দেখা যাক সামনে কী হয়।’

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: শ খ আবদ স স ল ম সরক র র ক ছ ল প রকল প সরক র র স ল গ সরক র চ কর জ ব স ব ক উপ উপ চ র য ল ইসল ম ত সরক র র রহম ন ব যবস য় র জউক র ব চ রপত ন সরক র আইনজ ব দ ল হক মন ত র হয় ছ ল আওয় ম আহম দ

এছাড়াও পড়ুন:

নেই নিয়োগপত্র, আইডি কার্ড ও ছুটি

নিয়োগপত্র নেই। এ কারণে চাকরির নিশ্চয়তাও নেই। দেওয়া হয় না পরিচয়পত্র। নেই কর্ম ঘণ্টার হিসাব। তবে রয়েছে মজুরিবৈষম্য ও জীবনের ঝুঁকি। এ চিত্র খুলনার বরফকলে কর্মরত বরফ শ্রমিকদের।

অবহেলিত ও অধিকার বঞ্চিত বরফকলের শ্রমিকেরা জানেন না মে দিবসের অর্থ। তারা শুধু এটুকু জানেন, কাজ থাকলে মজুরি পাবেন, অন্যথায় জুটবে না কিছু। খুলনার নতুন বাজার, রূপসা, শিপইয়ার্ড ও নিউমার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে বরফ শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে উঠে এসেছে ঝুঁকি ও বৈষম্যের এই চিত্র।

সরেজমিনে জানা গেছে, লবণ পানি এবং অ্যামোনিয়া গ্যাসের সংমিশ্রণে বরফের প্রতিটি ক্যান তৈরি হয়। এ কাজে প্রচণ্ড ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যুসহ বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা। এছাড়াও অধিকাংশ সময় হাত-পা ভিজে ঠান্ডা থাকায় ক্ষত থেকে ইনফেকশন হয়। এর বাইরে বুকে ঠান্ডা লেগে সর্দি-কাশি জ্বরসহ ঠান্ডাজনিত অসুস্থতায় ভোগেন এখানকার শ্রমিকেরা। পাতলা বরফে অনেক সময় হাত-পা কেটে যায়। কিন্তু মালিক বা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের জন্য কোন ধরনের অ্যাপ্রোন বা নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করেন না। তবে দুর্ঘটনায় কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

আরো পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

মহান মে দিবস: শ্রমিকের অধিকার রক্ষায় সংস্কারে জোর সরকারের

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, খুলনা মহানগরীর নতুন বাজার, নিউমার্কেট, শিপইয়ার্ড, রায়েরমহল এবং রূপসা উপজেলার পূর্ব রূপসা এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ১৫টি বরফকল রয়েছে। এর মধ্যে নতুন বাজার ও পূর্ব রূপসায় সর্বাধিক বরফকল রয়েছে। এসব কলে গড়ে দশ জন হিসেবে দেড় শতাধিক শ্রমিক-কর্মচারী কাজ করেন।

রূপসার নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত ‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করেন মোহাম্মদ রাসেল হোসেন। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার আশাশুনি হলেও পরিবার নিয়ে রূপসার জাবুসা এলাকায় বসবাস করেন। দীর্ঘ সাত বছর ধরে এই বরফকলে কাজ করছেন তিনি। রাসেল জানান, তাদের মাসিক বেতন নেই। নেই নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র। মূলত উৎপাদনের উপর প্রতি পিস বরফের ক্যান অনুযায়ী ১২ টাকা হারে মজুরি পান। নামমাত্র এ মজুরিতে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির বাজারে সংসার ঠিকমতো চলে না।

‘‘তিন বছর আগে নির্ধারণ করা মজুরি এখনো চলছে। লোকসানের অজুহাতে মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে চান না। তাদের মতো শ্রমিকদের কোন বেতন-বোনাস নেই। নো ওয়ার্ক, নো পে অর্থাৎ কাজ থাকলে মজুরি আছে কাজ না থাকলে নেই। মালিকদের এ সিদ্ধান্ত না মানলে চাকরিও থাকে না।’’ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন রাসেল হোসেন।

একই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন মোঃ জাকির হোসেন। তিনি বলেন, ‘‘গড়ে প্রতিমাসে ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা মজুরি পাই। কিন্তু মাসিক খাবার খরচ প্রায় ৩ হাজার টাকা। বাসা ভাড়া বাবদ ৩ হাজার টাকা চলে যায়।’’

তবে জাকির হোসেন ব্যাচেলর হওয়ায় কারখানার মধ্যেই থাকেন। বিয়ের পর এ কাজ করার ইচ্ছা নেই বলে জানান তিনি।

বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১-এ অপারেটর হিসেবে কর্মরত রয়েছেন মোঃ সেলিম শেখ। তার জন্ম নড়াইলের লক্ষ্মীপাশা হলেও কর্মসংস্থানের কারণে রুপসার বাগমারা গ্রামে বসবাস করছেন। তিনি জানান, বর্তমান বয়স ৮৪। ২০ বছর বয়স থেকেই বরফ কারখানার সঙ্গে জড়িত। প্রথমে হেলপার হিসেবে ২৫০০ টাকা বেতনে কাজ শুরু করেন। বর্তমানে অপারেটর হিসেবে মাসিক ১৫ হাজার টাকা পান। প্রতিদিন ভোর সাড়ে পাঁচটা থেকে কাজ শুরু করতে হয়। তবে সবসময় উৎপাদন না থাকলেও ২৪ ঘণ্টা কারখানায় থাকতে হয়। ছুটি পান না।

‘অ্যামোনিয়া গ্যাসের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার লিকেজ হলে মৃত্যু ঝুঁকি রয়েছে। তবে তিনি কখনো বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হননি বলে জানান তিনি।

‘মায়ের দোয়া আইস এন্ড কোল্ড স্টোরেজে’র শ্রমিক জাকারিয়া হাওলাদার বলেন, ‘‘চার বছর বরফকলে কাজ করছি। চাকরির ভবিষ্যৎ নেই। শ্রম দিতে পারলে মজুরি হয়, না হলে হয় না। নিয়োগপত্র ও পরিচয়পত্র দেন না মালিকপক্ষ। বেতন বাড়ানোর কথা বললে তারা আমলে নেন না।’’

একই এলাকার ‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’ কাজ করছেন মোঃ মুন্না গাজী ও মোঃ হাসান শেখ। তারা নগরীর জিন্নাপাড়া এলাকায় বসবাস করেন। তারা দুজনেই মাসিক ১০ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে তেমন কোন সুযোগ সুবিধা নেই।

‘ব্রাইট অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজে’র ম্যানেজার আশিকুর রহমান বিষয়টি স্বীকার করে জানান, কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের সুরক্ষায় উদাসীন। এখানে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সিলিন্ডার মাঝেমধ্যেই লিক হয়। তবে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। প্রতিষ্ঠানটিতে ৫৩২টি আইস উৎপাদনের ক্যানের প্লান্ট রয়েছে। তবে প্রতিদিন গড়ে ২৫০ ক্যান বরফ উৎপাদন হয়। ছয়জন শ্রমিক কাজ করে বলে জানান তিনি।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ- ২'র ম্যানেজার জামাল উদ্দিন বলেন, ‘‘বরফের মূল ক্রেতা চিংড়ি ও সাদা মাছের ব্যবসায়ীরা। এর বাইরে গ্রীষ্ম মৌসুমে ভ্রাম্যমাণ ও দোকানে শরবত বিক্রেতারাও কারখানা থেকে বরফ কিনে নেন। গ্রীষ্ম মৌসুমের ৬ মাস চাহিদা থাকে এবং কিছুটা লাভের মুখ দেখা যায়। তবে শীত মৌসুমের ছয় মাস বরফের চাহিদা কম থাকে। তখন কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন ও মজুরি দিয়ে লোকসান গুণতে হয়।’’

জামাল উদ্দিন স্বীকার করেন কারখানায় নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকলেও তা এড়াতে কোন সরঞ্জাম নেই। তবে অপারেটরদের অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঝুঁকি প্রতিরোধে মাক্স সরবরাহ করা হয়।

‘বেঙ্গল আইস অ্যান্ড কোল্ড স্টোরেজ-১'র মালিকপক্ষের প্রতিনিধি রিয়াদ-উল-জান্নাত সৈকত বলেন, ‘‘ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে না। কখনো লাভ, কখনো লোকসান এভাবেই চলছে। গত বছর কারখানা ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিলসহ অন্যান্য খরচ বাবদ ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।’’

তবে লাভ হলে শ্রমিক কর্মচারীদের মজুরি ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে শ্রমিকদের সংগঠন রূপসা বেড়িবাঁধ হ্যান্ডলিং শ্রমজীবী ইউনিয়নের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোঃ রিপন শেখ এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘‘নতুন বাজার এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি বরফকলের ৪০ জন শ্রমিক তাদের ইউনিয়নের সদস্য। বিগত দেড় বছর আগে মজুরির সমস্যা নিয়ে মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে দুই একজন শ্রমিক অভিযোগ করলে ইউনিয়নের মাধ্যমে সেটির সমাধান করে দেন তারা। কিন্তু বর্তমানে অভিযোগ নিয়ে কেউ আসে না।’’

বরফকলের শ্রমিকদের নিয়ে তারা মে দিবসের কর্মসূচি পালন করেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ