যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য কেন সরু সুতায় ঝুলছে
Published: 20th, February 2025 GMT
২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধের সূচনা এবং পরবর্তী গণহত্যা বিভিন্ন কারণে বিশ্বের অনেককে বিভ্রান্ত করেছিল। আরব বিশ্ব এবং অন্যত্রও কেউ কেউ এই ভেবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলেন যে এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রচেষ্টা চালানোর পরও ইসরায়েলকে থামাতে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন এমন ‘অসহায়’ ও ‘অক্ষম’ বলে মনে হয়েছে। উপসংহারটাকে এভাবে টানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করছে অথবা যুক্তরাষ্ট্র এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তারা আর ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।
কিন্তু ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তার শক্তির প্রকাশ ঘটাচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে ওয়াশিংটনের বৈশ্বিক আধিপত্য হ্রাস পাচ্ছে।
সামরিক সংঘাত, অর্থনৈতিক চাপ ও কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের কারণে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্বের অন্যখানেও ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনগুলো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক খেলোয়াড়দের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলছে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নতুন করে বিন্যস্ত করছে।
২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট, ইরাক ও আফগানিস্তানে পরাজয় এবং আমেরিকান অর্থনৈতিক ও সামরিক নীতির ওপর বৈশ্বিক প্রতিরোধ—এই সবকিছুই যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য হ্রাসের ধারাবাহিকতাকে প্রকাশ করে। শীতল যুদ্ধের কালে বৈশ্বিক জিডিপিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশে পৌঁছায়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেটা অর্ধেকে নেমে এসেছে। চীন সে সময় বৈশ্বিক জিডিপিতে মাত্র ২ শতাংশ অবদান রাখত। বর্তমানে সেটা বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। নিকট ভবিষ্যতে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাবে।
চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি বিধিনিষেধ আরোপ করার পরও দেশটি অগ্রসর প্রযুক্তির শিল্প দ্রুতগতিতে বিকাশ ঘটিয়ে চলছে। সেমিকন্ডাক্টর খাতে চীনের কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার চিপ-বাজারের ওপর সরাসরি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। চীনের প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মডেল উদ্ভাবন করেছে।
বিধিনিষেধের পরও চীন যে উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশে সক্ষম, এটা তারই প্রমাণ। অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের সঙ্গে চীনের সামরিক বাজেটের আকারও বড় হয়েছে। সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীনের অবস্থান।
ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের দেশগুলোতে সবচেয়ে জোরালো সামাজিক প্রতিবাদ হয়েছে। বৈশ্বিক উত্তরের লাখ লাখ মানুষ তাদের সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন। এই প্রতিবাদ শেষ বিচারে দেশগুলোর ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সংঘর্ষকে প্রকাশ করে।এ ছাড়া ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার সামরিক শক্তির পুনরুত্থান ঘটেছে। রাশিয়ার এই অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্র একদা বিশ্বে যে একক আধিপত্য উপভোগ করত, সেই ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। একই সময়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোও তাদের শক্তিকে নতুন পথে প্রকাশ করছে। ইরান, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর প্রভাব যেভাবে বাড়ছে, সেটা এই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায় যে আঞ্চলিক খেলোয়াড়েরা তাদের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে।
বিগত দশকগুলোতে এই রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগই মার্কিন আধিপত্য কাঠামোর মধ্যেই তাদের অবস্থান নিত। এখন তারা আরও বেশি স্বাধীন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরোধমূলক কৌশল অনুসরণ করছে।
এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শাসকদের অভিজাত অংশ (ডেমোক্র্যাট হোক আর রিপাবলিকান হোক) আরও কঠোর কূটনীতি, বাণিজ্যযুদ্ধ ও সামরিক হস্তক্ষেপের মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে, যাতে তাদের আধিপত্য ধরে রাখা যায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করা যায়। ফলে তারা আগে যেগুলোকে রেডলাইন (সতর্করেখা) বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেগুলো নিজেরাই লঙ্ঘন করছে। অতিমাত্রায় আগ্রাসনের পথ গ্রহণ করছে। এর একটি দৃষ্টান্ত হলো ইউক্রেন যুদ্ধ।
এই যুদ্ধে পুতিনকে মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একাই ১৮৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। গাজায় ইসরায়েলি ডানপন্থী সরকার অতিমাত্রার আগ্রাসন চালিয়েছে। তার কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে। গাজার ক্ষেত্রে এই চিত্র স্বল্প সময়ের বিচারে আরও অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে। গাজা খালি করার ইসরায়েলি পরিকল্পনায় শর্তহীন সমর্থন দিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফিলিস্তিনি ও লেবাননি প্রতিরোধ আন্দোলন বড় ধাক্কা খেয়েছে। আরব অঞ্চলের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো, বিশেষ করে মিসরের আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি পশ্চিমাদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়ে তার কার্ড খেলার সুযোগ পেয়েছে।
কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের দেশগুলোতে সবচেয়ে জোরালো সামাজিক প্রতিবাদ হয়েছে। বৈশ্বিক উত্তরের লাখ লাখ মানুষ তাদের সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন। এই প্রতিবাদ শেষ বিচারে দেশগুলোর ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সংঘর্ষকে প্রকাশ করে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে বৈশ্বিক সংহতি তৈরি হয়েছে, তাতে জেরুজালেমের স্বাধীনতা কায়রো, বৈরুত, আম্মান ও দামেস্ক এবং ওয়াশিংটন, লন্ডন, বার্লিন ও প্যারিসের রাস্তায় প্রতিবাদের সঙ্গে মিশে যাবে।
● হোসাম আল-হামালাউয়ি মিসরের সাংবাদিক
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ক ষমত সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ইসরায়েলের অংশগ্রহণের প্রতিবাদে ইউরোভিশনের ট্রফি ফেরত দিচ্ছেন সুইস সংগীতশিল্পী নেমো
আন্তর্জাতিক গানের প্রতিযোগিতা ইউরোভিশনে ইসরায়েলের অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে সুইজারল্যান্ডের সংগীতশিল্পী নেমো নিজের পুরস্কার ফেরত দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল অনবরত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরও দেশটিকে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়ায় ক্ষোভ জানিয়েছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার নেমো পুরস্কার ফিরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
নেমো তাঁর গাওয়া ‘দ্য কোড’ গানটির জন্য ২০২৪ সালে ইউরোভিশন পুরস্কার জিতেছেন। তাঁর মতে, ইউরোভিশন প্রতিযোগিতায় ইসরায়েলের অংশগ্রহণের বিষয়টি প্রতিযোগিতার আদর্শিক জায়গার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আর সে আদর্শিক জায়গাটি হলো সব মানুষের অন্তর্ভুক্তি ও সবার মর্যাদা বজায় রাখা।
ইউরোভিশনের আয়োজক সংস্থা ইউরোপিয়ান ব্রডকাস্টিং ইউনিয়ন (ইবিইউ)–এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদী পদক্ষেপের সর্বশেষ সংযোজন এটি। গত সপ্তাহে ইবিইউ ইসরায়েলকে আগামী বছর অস্ট্রিয়ায় অনুষ্ঠেয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার অনুমতি দেওয়ার পর পাঁচটি দেশ প্রতিযোগিতা থেকে সরে গেছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইনস্টাগ্রামে দেওয়া এক পোস্টে নেমো বলেন, ‘ইউরোভিশন বলে যে তারা ঐক্য, অন্তর্ভুক্তি ও সব মানুষের মর্যাদার পক্ষে দাঁড়ায়। এই মূল্যবোধগুলোর কারণেই এ প্রতিযোগিতাটি আমার কাছে এত অর্থবহ। কিন্তু যখন কিনা জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন ইসরায়েলের কর্মকাণ্ডকে (অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চল, পূর্ব জেরুজালেম ও ইসরায়েল বিষয়ক তদন্ত) গণহত্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছে, তখন বোঝা যায়, ওই আদর্শগুলোর সঙ্গে ইবিইউর নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো স্পষ্টত সাংঘর্ষিক।’
আরও পড়ুনগাজায় ইসরায়েলের জাতিহত্যামূলক যুদ্ধের প্রতিবাদে ইউরোপজুড়ে লাখো মানুষের বিক্ষোভ৩০ নভেম্বর ২০২৫ইসরায়েল বারবার গণহত্যার অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ইসরায়েলের দাবি, তারা আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে সীমান্ত পেরিয়ে হামাসের নেতৃত্বে হামলার পর নিজেদের আত্মরক্ষার অধিকার তাদের রয়েছে। ওই হামলার কারণেই এই যুদ্ধের সূচনা হয়েছে।
গত বুধবার আইসল্যান্ডের সরকারি সম্প্রচারমাধ্যম আরইউভির খবরে বলা হয়েছে, দেশটি ২০২৬ সালে অনুষ্ঠেয় ইউরোভিশন গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে না। গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি হামলার প্রতিবাদে এমন পদক্ষেপ নিয়েছে দেশটি। এর আগে স্পেন, নেদারল্যান্ডস, আয়ারল্যান্ড ও স্লোভেনিয়াও একই ধরনের ঘোষণা দেয়।
আরও পড়ুনইসরায়েলিদের বাধায় নিজেদের জমিতে যেতে পারেন না ফিলিস্তিনিরা, বিপর্যয়ে জলপাইশিল্প০৪ ডিসেম্বর ২০২৫