২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজা যুদ্ধের সূচনা এবং পরবর্তী গণহত্যা বিভিন্ন কারণে বিশ্বের অনেককে বিভ্রান্ত করেছিল। আরব বিশ্ব এবং অন্যত্রও কেউ কেউ এই ভেবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছিলেন যে এক বছরের বেশি সময় ধরে প্রচেষ্টা চালানোর পরও ইসরায়েলকে থামাতে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন এমন ‘অসহায়’ ও ‘অক্ষম’ বলে মনে হয়েছে। উপসংহারটাকে এভাবে টানা যায়, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করছে অথবা যুক্তরাষ্ট্র এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তারা আর ইসরায়েলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। 

কিন্তু ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে তার শক্তির প্রকাশ ঘটাচ্ছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে ওয়াশিংটনের বৈশ্বিক আধিপত্য হ্রাস পাচ্ছে।

সামরিক সংঘাত, অর্থনৈতিক চাপ ও কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের কারণে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, বিশ্বের অন্যখানেও ভূরাজনৈতিক দৃশ্যপটে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনগুলো আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক খেলোয়াড়দের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলছে এবং ক্ষমতার ভারসাম্য নতুন করে বিন্যস্ত করছে।

২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকট, ইরাক ও আফগানিস্তানে পরাজয় এবং আমেরিকান অর্থনৈতিক ও সামরিক নীতির ওপর বৈশ্বিক প্রতিরোধ—এই সবকিছুই যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য হ্রাসের ধারাবাহিকতাকে প্রকাশ করে। শীতল যুদ্ধের কালে বৈশ্বিক জিডিপিতে যুক্তরাষ্ট্রের অবদান সর্বোচ্চ ৪০ শতাংশে পৌঁছায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেটা অর্ধেকে নেমে এসেছে। চীন সে সময় বৈশ্বিক জিডিপিতে মাত্র ২ শতাংশ অবদান রাখত। বর্তমানে সেটা বেড়ে প্রায় ২০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছেছে। নিকট ভবিষ্যতে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকে ছাপিয়ে যাবে।

চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র রপ্তানি বিধিনিষেধ আরোপ করার পরও দেশটি অগ্রসর প্রযুক্তির শিল্প দ্রুতগতিতে বিকাশ ঘটিয়ে চলছে। সেমিকন্ডাক্টর খাতে চীনের কোম্পানিগুলো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার চিপ-বাজারের ওপর সরাসরি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। চীনের প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত ধরনের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) মডেল উদ্ভাবন করেছে।

বিধিনিষেধের পরও চীন যে উদ্ভাবনী ক্ষমতার বিকাশে সক্ষম, এটা তারই প্রমাণ। অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের সঙ্গে চীনের সামরিক বাজেটের আকারও বড় হয়েছে। সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পরেই চীনের অবস্থান।

ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের দেশগুলোতে সবচেয়ে জোরালো সামাজিক প্রতিবাদ হয়েছে। বৈশ্বিক উত্তরের লাখ লাখ মানুষ তাদের সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন। এই প্রতিবাদ শেষ বিচারে দেশগুলোর ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সংঘর্ষকে প্রকাশ করে।

এ ছাড়া ভ্লাদিমির পুতিনের নেতৃত্বে রাশিয়ার সামরিক শক্তির পুনরুত্থান ঘটেছে। রাশিয়ার এই অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্র একদা বিশ্বে যে একক আধিপত্য উপভোগ করত, সেই ভিত্তিকে দুর্বল করে দিয়েছে। একই সময়ে আঞ্চলিক শক্তিগুলোও তাদের শক্তিকে নতুন পথে প্রকাশ করছে। ইরান, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের মতো দেশগুলোর প্রভাব যেভাবে বাড়ছে, সেটা এই বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায় যে আঞ্চলিক খেলোয়াড়েরা তাদের ভূরাজনৈতিক লক্ষ্যকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার পথ খুঁজছে।

বিগত দশকগুলোতে এই রাষ্ট্রগুলোর বেশির ভাগই মার্কিন আধিপত্য কাঠামোর মধ্যেই তাদের অবস্থান নিত। এখন তারা আরও বেশি স্বাধীন এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরোধমূলক কৌশল অনুসরণ করছে।

এসব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের শাসকদের অভিজাত অংশ (ডেমোক্র্যাট হোক আর রিপাবলিকান হোক) আরও কঠোর কূটনীতি, বাণিজ্যযুদ্ধ ও সামরিক হস্তক্ষেপের মতো পদক্ষেপ নিচ্ছে, যাতে তাদের আধিপত্য ধরে রাখা যায় এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করা যায়। ফলে তারা আগে যেগুলোকে রেডলাইন (সতর্করেখা) বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল, সেগুলো নিজেরাই লঙ্ঘন করছে। অতিমাত্রায় আগ্রাসনের পথ গ্রহণ করছে। এর একটি দৃষ্টান্ত হলো ইউক্রেন যুদ্ধ। 

এই যুদ্ধে পুতিনকে মোকাবিলা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র একাই ১৮৩ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। গাজায় ইসরায়েলি ডানপন্থী সরকার অতিমাত্রার আগ্রাসন চালিয়েছে। তার কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র তাদের সমর্থন দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে, অস্ত্র দিয়েছে। গাজার ক্ষেত্রে এই চিত্র স্বল্প সময়ের বিচারে আরও অন্ধকার বলে মনে হচ্ছে। গাজা খালি করার ইসরায়েলি পরিকল্পনায় শর্তহীন সমর্থন দিচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফিলিস্তিনি ও লেবাননি প্রতিরোধ আন্দোলন বড় ধাক্কা খেয়েছে। আরব অঞ্চলের কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো, বিশেষ করে মিসরের আবদেল ফাত্তাহ আল–সিসি পশ্চিমাদের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধা পেয়ে তার কার্ড খেলার সুযোগ পেয়েছে।  

কিন্তু ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর গাজা যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের দেশগুলোতে সবচেয়ে জোরালো সামাজিক প্রতিবাদ হয়েছে। বৈশ্বিক উত্তরের লাখ লাখ মানুষ তাদের সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যায় সহযোগিতার অভিযোগে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছেন। এই প্রতিবাদ শেষ বিচারে দেশগুলোর ক্ষমতাকাঠামোর সঙ্গে সংঘর্ষকে প্রকাশ করে।

ফিলিস্তিনিদের প্রতি যে বৈশ্বিক সংহতি তৈরি হয়েছে, তাতে জেরুজালেমের স্বাধীনতা কায়রো, বৈরুত, আম্মান ও দামেস্ক এবং ওয়াশিংটন, লন্ডন, বার্লিন ও প্যারিসের রাস্তায় প্রতিবাদের সঙ্গে মিশে যাবে।

হোসাম আল-হামালাউয়ি মিসরের সাংবাদিক

মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ক ষমত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী

২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র‍্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।

সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহরটি দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।

পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ও সংঘাতের শুরু

১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় যে উত্তেজনা চলছিল, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।

বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটির মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।

এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।

আরএসএফ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।

জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (বামে) এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ডানে)

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সুদানের এল-ফাশের শহরে ‘চরম বিপদে’ বাসিন্দারা: ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস
  • সুদানে গণহত্যার প্রতিবাদে জাবি ও জবিতে মানববন্ধন
  • জুলাইবিরোধী শক্তির শাস্তি দাবিতে ইবিতে বিক্ষোভ
  • সুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন
  • সুদানে ‘গণহত্যা’ হয়েছে
  • একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল
  • সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী