শীত চলে গেলেও কুয়াশা কাটে না। কেননা ওরা বসন্ত আটকে দিতে চায়। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম ১০ ফেব্রুয়ারি সোমবার আইন নিজের হাতে তুলে না নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘কথিত আন্দোলন আর মবের মহড়া আমরা এখন থেকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করব। রাষ্ট্রকে অকার্যকর এবং ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টা করা হলে একবিন্দু ছাড় দেওয়া হবে না’ (সমকাল)। ‘তৌহিদি জনতার’ উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘অভ্যুত্থানের পক্ষে হলে মব করা বন্ধ করেন, আর যদি মব করেন, তাইলে আপনাদেরও ডেভিল (শয়তান) হিসেবে ট্রিট (গণ্য) করা হবে।’ তাঁর এ বিবৃতি যেন কথার কথা না হয়।
মব হলো একটি স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিক্রিয়া। আমার কাছে ঘটনাগুলো মব মনে হয় না, এটি আমার কাছে পরিকল্পিত প্রতিক্রিয়াই মনে হয়। প্রথম যেসব ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, তা সরকার নাই অবস্থায় হয়েছে, সত্য। তা কি শুধু শেখ মুজিব বা শেখ হাসিনার প্রতি ঘৃণা থেকে হয়েছে? মেহেরপুরে যাদের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, তারা শেখ মুজিব কিংবা শেখ হাসিনা ছিলেন না– এটা সবারই জানা। এই সেদিনও সুনামগঞ্জের ভাস্কর্য ভাঙা হয়েছে, কৃষক স্বৈরাচার বা শেখ হাসিনা নন, এটাও সবার জানা।
তাই আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি, যারা ভাঙছে তারা বৈষম্যে বিশ্বাসী। তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিতে অবিশ্বাসী। তারা সৌদি আরবসহ পৃথিবীর বহু ইসলামী পরিচয়ধারী দেশে ভাস্কর্য আছে, তা জানা সত্ত্বেও ভাস্কর্য ভাঙাকেই নিজেদের ধর্মীয় পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়াকেই নিজেদের পবিত্র দায়িত্ব মনে করে। অগ্রসর মানুষ তাদের ডেভিল মনে করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দাঁড়ায় ওই ডেভিলদের মোকাবিলা করা।
সরকার ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ক্রিয়াশীল থাকার সময়ই একের পর এক মাজারে হামলা হয়েছে। যারা হামলা করেছে তারা জানে মাজারে শেখ হাসিনা নেই বা কোনো স্বৈরাচারের দোসর সেখানে নেই। কোনো ব্যাংক লুটের টাকা সেখানে নেই। নির্মমভাবে পিটিয়ে সিলেটের মাজারে যে গরিব মানুষগুলোকে হত্যা করা হলো, তাদের বাড়িঘর পর্যন্ত নেই। চারদিন লাশ মর্গে পড়ে থাকল, তাদের দাফন করার কোনো লোক পর্যন্ত নেই। রাষ্ট্রশাসকদের চোখের সামনে এসব গরিব মানুষ হত্যা এবং উপর্যুপরি মাজারে হামলার পরেও তাদের গায়ে কোনো আঁচড় পড়ল না! আমাকে কেন বিশ্বাস করতে হবে রাষ্ট্র-সরকার ধর্মীয় বৈচিত্র্য রক্ষা করতে চায়? গণতান্ত্রিক মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে? বহুত্ববাদে বিশ্বাস করে?
নারী খেলোয়াড়দের ওপর আক্রমণ এবং তাদের খেলা প্রতিরোধ করা হলো। বাংলা একাডেমির একুশে বইমেলায় পুলিশের সামনে আক্রমণ এবং বইয়ের স্টল বন্ধের ঘটনা আমাকে স্তম্ভিত করেছে। আমাকে কেন বিশ্বাস করতে হবে এক স্বৈরাচারকে জনতা উচ্ছেদ করার পর যে সরকার তৈরি হলো, তাদের ছায়াপথে আমাদের নিকষ অন্ধকার গর্তে ঢুকে যেতে হবে না? গায়ের জোর দেখালে আপনাকে ডবল স্বৈরাচার ডবল ফ্যাসিবাদ মনে করব না কেন? পাহাড়ে এবং সমতলে সর্বত্র সংখ্যালঘু জাতিসত্তার ভাষার স্বাধীনতা নেই, ভূমির অধিকার নেই, জীবনের নিরাপত্তা নেই। কেন?
আগের স্বৈরাচারীরা ব্যাংক লুট করেছে, কারও বাড়িঘর লুটপাট করেনি। আজ তো বাড়িঘর লুটপাট চলছে। এটা মানব কেন? গাজীপুরের নেতা এবং সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অপরাধ দেখলে তাঁর নামে ৫০টি মামলা করতে পারে, তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারে, বিচার করে ফাঁসি দিতে পারে, কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু গভীর রাতে তাঁর বাড়ি লুট করতে পারে কি? তাঁর অপরাধের জন্য তাঁর পুত্র-পুত্রবধূর সঙ্গে প্রতিবেশীকে দায় দেওয়া, শাস্তি দেওয়া– কোন গণতন্ত্রে পড়ে? আবার সেখানে গণপ্রতিরোধের অপরাধে শত শত সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করে সেই আগের সরকারের মতোই পুলিশি রাজত্ব, পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য চালু মানা যায় কি?
আগের সরকার শ্রমিকরা পাওনা মজুরির জন্য আন্দোলন করলে তাকে বিদেশি চক্রান্ত বলে শ্রমিকদের গুলি করে হত্যা করেছে। এখনকার সরকারও হুবহু একই কাজ করছে। আজ পর্যন্ত বেতন দেয়নি বলে একজন মালিককেও কোথাও কোনো ধমক সরকার দিয়েছে বলে দেখিনি। অথচ এখনও মধ্যরাত পর্যন্ত শ্রমিকদের থানার পুলিশ, শিল্প পুলিশের যৌথ বাহিনী মোকাবিলা করতে হয়। তবুও কেন এই সরকারকেই সমর্থন করে যাব? শিক্ষকদের ওপর আগের সরকারও বর্বর কায়দায় জলকামান, রায়টকার ব্যবহার করত, এখনকার সরকারও তা-ই করছে। এই সরকার তৈরির প্রেক্ষাপটে গণতন্ত্রের জন্য দ্রোহযাত্রা করেছি। আজ চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে– গণতন্ত্র তুমি কোথায়? তুমি কেন প্রেস ক্লাবে আসো না? মত প্রকাশের স্বাধীনতা, তুমি কেন বইমেলায় আসো না?
বিধান জারি হলো, তারুণ্যকে ভালোবাসা দিবস উদযাপন করলে প্রতিহত করা হবে। বসন্ত বরণ করা যাবে না। ছেলেমেয়ে একসঙ্গে চলতে পারবে না। আমার চোখে আজও ভাসছে ৫ আগস্ট ছেলেমেয়ে একসঙ্গে বিশাল মিছিল করে শেখ হাসিনার পতন ঘটাচ্ছে। সেদিন বনানীর ওভারব্রিজে যারা ছিল তারা সাক্ষ্য দেবে, যুবক-যুবতী, বোরকা পরা অনেক মেয়ে, জিনস প্যান্ট পরা অনেক মেয়ে ছেলেদের সঙ্গেই মিছিল করে শেখ হাসিনাকে নামিয়েছে। আজ কেন একসঙ্গে বসন্তবরণ কিংবা ভালোবাসা দিবস উদযাপন কিংবা এরশাদ স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন দিবস পালন করতে পারবে না?
সরকারকে এসব বিষয়ে শুধু বক্তব্য স্পষ্ট নয়, দৃঢ় অবস্থান নিতেই হবে। নইলে আমরাও বলতে বাধ্য হবো– ‘এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার।’
জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত ভ স কর য ভ ঙ ব শ ব স কর র সরক র বসন ত
এছাড়াও পড়ুন:
এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়
নেতা–কর্মীদের সতর্ক করে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ না থাকি, আমরা যদি সতর্ক না থাকি তাহলে এক-এগারোর মতো ঘটনা ঘটা এখানে অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
আজ বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি মিলনায়তনে ‘ফ্যাসিবাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে আইনজীবীদের ভূমিকা: আলোচনা ও ডকুমেন্টারি প্রদর্শনী’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এই সতর্কবার্তা দিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব।
সভায় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘খুব সতর্ক থাকতে হবে। আমরা কিন্তু খুব একটা সূক্ষ্ম তারের ওপর দিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু চারদিকে আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন, চারদিকে একটু চোখ–কান খোলা রাখেন। দেখবেন কতগুলো ঘটনা ঘটছে, যে ঘটনাগুলোর আলামত ভালো না। এদিকে একটু লক্ষ রাখতে হবে।’
দেশের মানুষ সংখ্যানুপাতিক বা পিআর পদ্ধতির নির্বাচন কী, সেটি বোঝে না বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘আমরা অবশ্যই চাই সংস্কার হোক। সাধারণ মানুষ কিন্তু চায় যে একটা নির্বাচন হোক, সে নির্বাচন থেকে নতুন সরকার আসুক। যে সরকার তারা নির্বাচিত করতে পারবে, যে প্রতিনিধি তারা নির্বাচন করবে। তাদের কথা বলার লোক তারা পার্লামেন্টে (সংসদ) নিতে চায়। এটা খুব সহজ হিসাব।’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘এই যে বিষয়গুলো তৈরি করা হচ্ছে কেন? এই বিতর্কগুলো তৈরি করা হচ্ছে কেন? এর পেছনে আপনি যদি মনে করেন এমনি এমনি করা হচ্ছে, তা নয়। এর পেছনে একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্যটা সেই এক–এগারোতে ফিরে যাবেন, সেই উদ্দেশ্যটা, সেই একেবারে ফিরে চলে যাবেন এরশাদ সাহেবের ক্ষমতা দখল করা পর্যন্ত। এ দেশে গণতন্ত্রকে চলতে দিতে চায় না। একটা মহল আছে যারা বারবার গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরে। এমনকি শেখ মুজিবুর রহমানও এই কাজটা করেছেন একদলীয় শাসনব্যবস্থা (বাকশাল) প্রবর্তন করে।’
বিএনপি লিবারেল ডেমোক্রেসি (উদার গণতন্ত্র) চায় উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আমরা চাই, আমাদের দেশের জনগণ তার ভোটের অধিকার ফিরে পাক। সে ভোট দিক। ভোট দিয়ে তার প্রতিনিধি সে নির্বাচিত করুক। পার্লামেন্ট (সংসদ) তৈরি হোক, সরকার তৈরি হোক। তারা চালাবে পাঁচ বছর। সেই পাঁচ বছরে যদি তারা ব্যর্থ হয়, না পারে, আবার নির্বাচন হবে। নির্বাচনে জনতা তাদের বাদ দিয়ে দেবে, অন্য দলকে দেবে। তাই তো? এই জায়গাটায় যেতে এত তর্ক–বিতর্ক কেন?
নির্বাচনের জন্য আর দেরি করা অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের জন্য সঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারির শুরুতে যে ডেডলাইন (সময়সীমা), এর পরে হলে আপনি যে সম্মান নিয়ে এসেছেন, সমগ্র বিশ্বে আপনার যে সম্মান, সেই সম্মান ক্ষুণ্ন হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।’
সভায় প্রধান উপদেষ্টার সমালোচনা করে গণফোরামের সভাপতি সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা গত এক বছরে বাংলাদেশের জন–আকাঙ্ক্ষার যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছেন এবং পুরা জিনিসটাই আপনি সংস্কারের নামে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করে এত বিস্তৃতি ঘটিয়েছেন; শেষ পর্যন্ত আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটা আমার ব্যক্তিগত অপিনিয়ন (মতামত), সংস্কারের নামে অপসংস্কার কুসংস্কার তৈরি করে নিয়ে যাবেন। একটু থামেন, আপনার তো এত ম্যান্ডেট নাই। সবকিছু নিয়েই আপনি বসে পড়েছেন। জুলাই সনদ হবে, জুলাই ঘোষণা হবে, সবই ঠিক। আর কত সময় নেবেন?
তিনি বলেন, ‘আমাদের হাতে কিন্তু খুব বেশি সময় নাই। আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই বাংলাদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর কোনো ব্যত্যয় যেন না ঘটে। আইনজীবীসহ সারা দেশের সকল রাজনৈতিক দলকে আবার রাজপথের আন্দোলনে শরিক হওয়ার জন্য আমাদেরকে বাধ্য করবেন না।’
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ঐকমত্য দেখি না, নির্বাচনের রোডম্যাপ দেখি না। গণতন্ত্রের পথে হাঁটুন, আইনজীবীরা কালো কোট পরে মাঠে নামলে কেউ থাকতে পারে না। নির্বাচনের রোডম্যাপ দিয়ে বিদায়ের চিন্তা করুন।’ সরকারে থাকা দুই তরুণ উপদেষ্টাকে যেন তাঁদের পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, সেই আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার প্রতি জানান তিনি।
সভার শুরুতেই একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এরপর স্বাগত বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মিলন। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি জয়নুল আবেদীনের সভাপতিত্বে এবং ফোরামের মহাসচিব কায়সার কামালের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কুদ্দুস কাজল, সাংগঠনিক সম্পাদক গাজী কামরুল ইসলাম, যুগ্ম মহাসচিব মো. কামাল হোসেন, মোহাম্মদ আলী, ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট ইউনিটের সদস্যসচিব গাজী তৌহিদুল ইসলাম প্রমুখ।