ফকিহ আবুল লাইস সামারকান্দি রহ. তার বিখ্যাত গ্রন্থ তাম্বিহুল গাফেলিন-এ অতীতকালের কোনো এক ব্যক্তির ঘটনা বর্ণনা করেছেন। ওই ব্যক্তিটির খুব প্রিয় একটি ঘোড়া ছিল। একদিন সে ঘোড়ার কাছে এসে দেখে, কেউ ঘোড়াটির একটি পা কেটে ফেলেছে। পাশেই তার গোলাম দাঁড়ানো। লোকটি গোলামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমার ঘোড়ার এই অবস্থা কে করেছে? গোলাম বলল, আমি। মালিক প্রশ্ন করলেন, কেন এমনটি করেছ? সে বলল, এর মাধ্যমে আমি আপনাকে রাগাতে চেয়েছি। তিনি খুব স্বাভাবিকভাবে বললেন, “যে তোমাকে এই নির্দেশ দিয়েছে-অর্থাৎ শয়তান, আমিও তাকে উত্তেজিত করব। যাও, আজ থেকে তুমি স্বাধীন। আমি তোমাকে আজাদ করে দিলাম এবং এই ঘোড়াও তোমাকে দিয়ে দিলাম।”

রাগ বা ক্রোধ মানুষের সহজাত বিষয়। রাগ না থাকলে তাকে ভালোমানুষ বলা যায় না। রাগ বা ক্রোধের যেমন প্রয়োজন আছে, সাথে সাথে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটাও হলো মুমিনের বৈশিষ্ট্য। মাহে রামাজান আমাদেরকে রাগ নিয়ন্ত্রণের শিক্ষা দেয় চমৎকারভাবে। 

হাদিস শরিফে ইরশাদ হয়েছে: হযরত আবু হোরায়রা রা.

বর্ণনা করেন: রাসুল সা. বলেছেন, রোজা হলো ঢাল স্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন অশ্লীলতা না করে এবং মুর্খের মত কাজ না করে। যদি কেউ তার সাথে ঝগড়া করতে চায়, তাকে গালি দেয়, তবে সে যেন দু’বার বলে, আমি রোযা পালন করছি। ওই সত্তার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ, অবশ্যই রোজা পালনকারীর মুখের গন্ধ আল্লাহর নিকট মিসকের গন্ধের চাইতেও উৎকৃষ্ট, সে আমার জন্য আহার, পান ও কামাচার পরিত্যাগ করে। রোজা আমারই জন্য। তাই এর পুরষ্কার আমি নিজেই দান করব। আর প্রত্যেক নেক কাজের বিনিময় দশ গুণ। (বুখারি: ১৭৭৩)

আরো পড়ুন:

ইতিকাফের মর্যাদা ও বিধান

রমজান মাসে এই ভুলগুলো করছি না তো!

উল্লেখিত হাদিসটিতে চমৎকারভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে- মাহে রমাযানে কিভাবে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর মাধ্যমে উম্মতকে রাসুল সা. উন্নত আখলাক শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ ভালো রাগ যেমন উত্তম তেমনি বদমেজাজ কিংবা বেহুদা রাগ অথবা কথায় কথায় রাগ করা এটা সবার জন্যই ক্ষতিকারক। অপরদিকে, যারা নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন তাদের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সব জায়গাতেই কল্যাণ হয়ে থাকে। তিরমিজি শরিফের এক হাদিসে রাসুল সা. রাগ ও রাগী ব্যাক্তিকে চার ভাগে ভাগ করেছেন। 

হযরত আবু সাঈদ খুদুরি রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন আছরের পরে নবীজি সা. আমাদের সামনে দীর্ঘ বক্তৃতা করলেন। এ বক্তব্যে তিনি কোনো কিছুই বাদ দিচ্ছিলেন না। এমনকি কেয়ামতের বিষয়ে তিনি ব্যাপক আলোচনা করলেন।............. এক পর্যায়ে তিনি ‘রাগ’ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। তিনি বললেন, ১. কিছু মানুষ এমন আছে যারা দ্রুত রেগে যায় এবং দ্রুত রাগ সংবরণ করে। ২. কেউ তো এমন আছে যারা ধীরে ধীরে রেগে যায় এবং ধীরে ধীরে রাগ সংবরণ করে। ৩. আরেকজন তো এমন যে দ্রুত রেগে যায় কিন্তু রাগ সংবরণ করতে তার দীর্ঘ সময় লেগে যায়। ৪. আর শেষ ব্যক্তি এমন, যে ধীরে ধীরে রেগে যায় কিন্তু রাগ দ্রুত নিবারণ করে ফেলতে পারেন। জেনে রেখ, এদের মধ্যে সর্বোত্তম ওই ব্যক্তি যে রাগান্বিত হতে বেশ সময় নেয়। তবে রেগে গেলে দ্রুত আবার সে রাগ সংবরণ করতে পারে।

পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা রাগ সংবরণকারীদের প্রশংসা করে বলেন যারা নিজেরদের রাগ সংবরণ করে আর মানুষের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করে, বস্তুত আল্লাহতায়ালা এ সব সৎকর্মশীলদেরকেই ভালোবাসেন। (সুরা আল ইমরান: ১৩৪)

হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, অন্যের উপর আঘাত করা বা প্রতিশোধ নিতে পারাটাই বীরত্ব নয়, বরং রাগের সময় ধৈর্য্য ধারণ করতে পারাটাই আসল বীরত্ব। (সহি বুখারি: ৬১১৪)

ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ কাকে বলে আসুন দেখি এই ঘটনাটির মধ্যে:  মুসান্নিফে ইবনে শায়বাসহ অসংখ্য হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে: যখন নবি করীম সা. মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় যাচ্ছিলেন, তখন বাইতুল্লাহ শরিফের চাবি বহনকারী ওসমান ইবনে তালহাকে বলেছিলেন, “আল্লাহ তা’আলার এই ঘর একটু খুলে দাও। সেখানে প্রবেশ করে কিছুক্ষণ আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করতে খুব ইচ্ছা হচ্ছে।”

তখন সে সাফ জানালো, আমি খুলতে পারব না। নবি সা. বললেন, “আচ্ছা! বাস্তবেই তুমি দরজা খুলবে না? ওই দিন কী অবস্থা হবে, যেদিন তুমি আমার স্থানে থাকবে, আর আমি চাবি নিয়ে তোমার স্থানে থাকব।” নবিজির এই কথা শুনে ওসমান ইবনে তালহা আজেবাজে কথা বলতে শুরু করে।

যেদিন নবি সা. বিজয়ীর বেশে মক্কায় প্রবেশ করলেন, তখন বনি শায়বার ওই লোকই চাবিবাহক ছিলেন। নবি সা. চাবিবাহককে ডাকলেন। রাসুল সা. বললেন, চাবি আমাকে দাও। সে চাবি দিয়ে দিল। নবি সা. চাবি নিয়ে তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়ার জন্যে বললেন, “ওই সময়টির কথা কি মনে পড়ে, যখন আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, যেখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি, সেখানে তুমি দাঁড়িয়ে থাকবে, আর তুমি যেস্থানে দাঁড়িয়ে আছ, সে স্থানে আমি চাবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকব। আল্লাহ তা’আলা কি তার অঙ্গীকার পূর্ণ করেছেন?”

ওসমান ইবনে তালহা বলল, “হ্যাঁ। আল্লাহ তা’আলা তাঁর অঙ্গীকার পূরণ করেছেন।”

অতঃপর নবি সা. চাবি নিয়ে বাইতুল্লাহ শরিফের তালা খুললেন। কাবা ঘরে প্রবেশ করে আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করলেন। এরপর যখন বাইরে বেরিয়ে দরজায় তালা লাগিয়ে দিলেন, দেখলেন, কুরাইশের বিভিন্ন গোত্রের লোক তাঁর চতুর্দিকে এসে উপস্থিত হয়েছে। তাদের প্রত্যেকেই চাইছিলেন, যেন তাদের হাতে কাবার চাবি অর্পণ করা হয়।

কিন্তু নবি সা. কাবা ঘরের তালা লাগিয়ে যেই কাফেরের কাছ থেকে চাবি নিয়েছিলেন, পুনরায় তাকেই চাবির বাহক বানিয়ে দিলেন। বললেন, “তুমি এই চাবি তোমার হাতে রাখ। এই চাবি কিয়ামত পর্যন্ত তোমার বংশের মাঝেই থাকবে।”

ওসমান ইবনে তালহা নবি সা. এর এতো বড় অনুগ্রহ দেখে আবেগে কেঁদে ওঠেন এবং বলেন, “হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে মুসলমান বানিয়ে নিন।”

রাসুল সা. চাইলে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। তিনি না করে বরং এমন উদারতা দেখিয়ে উম্মতকে শিক্ষা দিলেন, কারো খারাপ আচরণে কেবল রেগে গিয়ে প্রতিশোধ পরায়ণ হলেই জয়ী হওয়া যায় না, বরং রাগ হজম করতে পারলে ফলাফলটা অনেক উত্তম হয়।

রাগ নিয়ন্ত্রণের উপায়ও শিখিয়েছেন নবিজি। হযরত আবু সাঈদ খুদুরি রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, নিশ্চয়ই ক্রোধ হচ্ছে আগুনের একটি জ্বলন্ত কয়লা। তোমাদের যে তা অনুভব করবে সে যদি দাঁড়িয়ে থাকে তবে যেন বসে পড়ে। আর যদি বসে থাকে তবে সে যেন শুয়ে পড়ে। (তিরমিজি) 

ক্রোধ সংবরণ করলে এর মর্যাদা অনেক বেশি। এ ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসে ব্যাপক আলোচনা এসেছে। মাহে রামাজান এই ক্রোধ নামক রোগটির দূরীকরনের জন্য বিরাট সহায়ক। মাহে রামাজানে যদি আমরা এ ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই এবং অনুশীলন করতে থাকি তাহলে আমরা বাকি মাসগুলোতে ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে তৌফিক দান করুন।

ঢাকা/শাহেদ

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স য় ম স ধন রমজ ন আল ল হ ত বর ণ ত র জন য কর ছ ন বলল ন করল ন

এছাড়াও পড়ুন:

ইরানে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য হটলাইন চালু

তেহরানের বাংলাদেশ দূতাবাসে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য হটলাইন চালু করা হয়েছে। 

রোববার তেহরান দূতাবাস এক বিশেষ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়।

বিজ্ঞ‌প্তিতে বলা হয়, ইরানে বসবাসরত সব বাংলাদেশি নাগরিকের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, বর্তমান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগের জন্য দূতাবাস ইমার্জেন্সি হটলাইন স্থাপন করেছে। ইরানে বসবাসরত সব বাংলাদেশি নাগরিকদের নিম্নোক্ত মোবাইলফোন নম্বরগুলোতে হোয়াটসঅ্যাপসহ সরাসরি যোগাযোগ করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
+ ৯৮৯৯০৮৫৭৭৩৬৮ ও  +৯৮৯১২২০৬৫৭৪৫।

সম্পর্কিত নিবন্ধ