কাজ, ব্যস্ততা, জীবনের ভীষণ নিয়ম–মনে হয় দেয়ালে হাতুড়ির ঘায়ে বেঁকে আটকে যাওয়া একটা পেরেক। সেই পেরেক থেকে ফাঁসির আসামির মতো ঝুলছে এক ক্যালেন্ডার। সে সকালবেলা মনে করিয়ে দিচ্ছে, এখনই ছুটতে হবে। জ্যামুক্ত তীরের মতো এখনই ছিটকে গিয়ে পড়তে হবে বাইরে ভাসমান মানুষের ভিড়ে। ক্যাব কল করা, ট্রেন ধরা, বাসে গুড়ের গায়ে মাছি বসা ভিড়; সেখানে নিজেকে গুঁজে দেয়া কোনোমতে। তারপর মানুষের জীবনে কোনো স্পার্টাকাস নেই জেনে অনেক স্ট্রিটফাইট শেষে কর্মস্থলে পৌঁছানো। প্রতিদিন প্রলয় ঘটানো এই তীব্র জীবনের মাঝেও কখনো ছুটি আসে। পুরোনো ক্যালেন্ডার চোখ রাঙায়, কিন্তু তারপরেও নিজেকে গুটিয়ে নেয়ার মতো ছুটি আসে। জীবনের ব্যস্ত প্রবাহে ছেদ পড়ে। দীর্ঘ সিঁথির মতো জনশূন্য পড়ে থাকা দিনরাত্রি, ঘরের কোণে আলসেমি অথবা ঘর ছেড়ে চেনা সমুদ্রের অচেনা স্বাদ নিতে বের হয়ে পড়া, অরণ্যের অন্তরালে বসে অবিশ্রান্ত পাতার পতন দেখতে যাওয়া।
কাজ আছে বলেই এমন করে আমাদের মনের মধ্যে ছুটির প্রার্থনা জেগে ওঠে। সেই প্রার্থনা কি রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটির নিমন্ত্রণের’ মতো? ছুটির নিমন্ত্রণ কে কাকে জানায়? কোথায় কোন অবসর পড়ে থাকে অরণ্যের প্রান্তে, কোনো নির্জন পাহাড়ের আলস্যের রাজ্যে? তবুও ছুটি মিললে আমরা বের হয়ে পড়ি। আমরা ছুটি চাই, ছুটি চাই প্রভু। জীবন নানা অন্বেষণে ঘুরিয়ে মারে আমাদের। ভিড়ভর্তি জীবন আকাশভর্তি পাখিদল দেখার সুযোগ দেয় না। প্রতিদিনকার মাপা জীবন জোয়ার আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। আবার ফিরিয়েও দেয় সংসার সীমান্তে। এই জ্যামিতিক মাপের কবল থেকে আমরা তাই অব্যাহতি চাই। যানবাহনের হর্ন, মানুষের কোলাহল, ভিড়ে রুদ্ধশ্বাস পথ, বিপণিবিতান, আলো ঝলমল শহুরে জীবন থেকে ছুটি পেলে তাই আমরা ফেরারি হওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠি।
কোথায় ফেরারি হই আমরা? কোথায় পালাই? ছুটি কি তাহলে এক ধরনের পলায়ন? পত্রিকার পাতায় দীর্ঘ অবসরকে ‘ছুটির ফাঁদ’ বলে লেখা হয় আজকাল। আমাদের কর্মময় জীবনপ্রবাহ কতদিনের জন্য অচল হয়ে যাবে তার চুলচেরা হিসাব কষেন সাংবাদিকরা তাদের প্রতিবেদনে। কবে কোন ছুটির সঙ্গে একটা দিন মিলিয়ে দিলে দীর্ঘ ছুটির ধাঁধার সমাধান মিলবে তারই আগাম সংকেত দিতে থাকেন তারা। সেই যে এক সিনেমা ‘ছুটির ফাঁদে’। নায়ক-নায়িকা ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে নানাভাবে নাকাল হয়েছিল। সেই সিনেমার গল্প হয়তো জীবনের আরেক প্রান্তের গল্পই বলতে চেয়েছিল আমাদের। কিন্তু পেশাজীবীদের স্পার্টাকাসের মতো মুক্তির দূতহীন জীবনে ছুটি তো ফাঁদ নয়, মুক্তি।
আমাদের দেশ কোথায়? অবশ্যই বাংলাদেশ। রাজধানীবাসীর অবস্থানও তো রাজধানীতেই। তবুও ছুটির ক্যালেন্ডার সামনে এলেই শুনতে হয়, ‘দেশে’ যাচ্ছি ছুটিতে। প্রতি বছরই বহু মানুষ উৎসবের ছুটিতে এই শহরকে ফাঁকা করে দিয়ে পাড়ি জমায় সেই ‘দেশের বাড়ির’ উদ্দেশে। তাহলে এই নগর কি দেশ নয়? এখানেই তো আমরা কাজের সন্ধানে এসে ভিড় জমাই। তাহলে আর ‘দেশের সন্ধান’ কেনো? দূর-দূরান্ত থেকে পাখিদের মতো মানুষ কাজের জায়গায় ভিড় জমায়। তারপর ছুটি মিললেই ‘দেশের’ উদ্দেশে ডানা মেলে দেয়। সেই দেশ কোথায়? কোথায়ই বা ভৌগোলিক সীমানা? সেই দেশ আসলে তার পেছনে ফেলে আসা গ্রাম। বিষণ্ন কোনো মফস্বল হয়তো।
সেখানে তার স্মৃতি বিস্তারিত। শিকড় ছিন্ন হয় না নগরবাসের ইতিকথার তলায় চাপা পড়েও। ফেলে আসা জীবনের স্নিগ্ধ ছবি মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় উৎসে। তাই তার ছুটি চাই। ঘাসের মাথায় জমে থাকা শিশিরে, ফুলের সৌরভে মুক্তি চাই। কর্মমুখর জীবনে দিনরাত কেবল জীবিকার ধান্দা, নানা ফন্দিফিকির, কূটতর্ক, ঝগড়া-ঝাটি। হয়তো তাই অবসরের জমিনে ক্ষণকাল সমাধিস্থ হওয়ার স্বপ্নটা-ই ছুটির ডাক নামে ক্যালেন্ডারে লাল রঙ দেয়া তারিখ হয়ে অপেক্ষা করে।
কিন্তু শুধুই কি শিকড়ের টানে ঘরে ফেরার নামই ছুটি? ব্যাগপত্তর বেঁধে, অফিসে ক্যাজুয়াল লিভের কঠিন হিসাব-নিকাশের শরীরে স্যালাইনের সুঁইয়ের মতো অবসরের স্বপ্ন গেঁথে দিয়ে, ঘরবাড়ির দুয়ারে তালা লটকে বের হয়ে পড়াই কি ছুটির অন্য নাম? ছুটির সংজ্ঞাই তো বদলে গেছে আজকাল। ছুটির ফাঁকে কত কেউ ক্ষণিকের উদ্বাস্তু হয়ে উড়ে যায় দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। অন্য কোনো দেশের পাহাড়, জঙ্গল অথবা সমুদ্রতট তাদের অলসবেলার চিহ্ন সাজাতে উদগ্রীব হয়ে থাকে। মার্কোপোলো তার পর্যটনের কাহিনি লিখেছিলেন। একবিংশ শতাব্দীর মানুষ তার অবসর বিনোদন নিয়ে লিখে চলেছে নিজস্ব ভ্রমণের গল্প। সমাজের ভিতরে দিনে দিনে তৈরি হয়েছে অসীম বিত্তের পরিসর। সে বিত্তের বড় অংশ অনুপার্জিত। ফলে আমাদের দেশে পাল্টে গেছে সমাজ কাঠামো। পাল্টে যাচ্ছে ছুটির দিনের চেনা গল্পগুলোও। ফেসবুকে স্ট্যাটাস, কোনো নীল সমুদ্রের ছবি, পাথুরে দ্বীপ, গভীর বনাঞ্চল অথবা ঠমকে চমকে দেয়ার মতো কোনো তারকা খচিত হোটেলের রোদমাখা অলস ব্যালকনি ছুটির দিনের গল্পের শিরোনাম হয়ে থাকে।
তবুও আমরা ছুটি চাই। পকেটে ট্রেনের টিকেট তাড়া দেয়। বাসের আগাম সময়সূচি ঠিক করে দেয় বেড়াতে যাওয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। বছর চল্লিশ আগেও বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে বেড়ানো, হলিডে, লং ভ্যাকেশন শব্দগুলো অনেকটাই অচেনা ছিল। তখন ছুটির দিনে ঘরে বসে রান্নার সূচিপত্র ঠিক করা, পার্কে বেড়াতে যাওয়া অথবা অবসরে সিনেমা হলের আলো আঁধারের নিভৃতি ছিল নির্দিষ্ট বিনোদনের উৎস। শিকড়ের টানে তখনও তল্পিতল্পা গুটিয়ে সাময়িক আবাস ছাড়তো মানুষ। কিন্তু ছুটির নিমন্ত্রণ এখনকার মতো ট্রেন্ড বা প্রবণতা হয়ে ওঠেনি। এই প্রবণতা বোধ করি ছোঁয়াচে রোগের মতো, শুধু আক্রান্ত করে। এখন ছুটি মানেই সামাজিক জ্বরের মতো এক অনুভূতি। নগরের কোলাহল থেকে, শব্দের বিপুল আগ্রাসন থেকে, অনুশাসন থেকে মুক্তি চেয়ে মানুষ কোথাও যেতে চায়। সে নিজেও হয়তো জানে না সে কোথায় যেতে চায়! তবুও তার চাওয়া অফুরান। শুরুতে তাই লিখেছিলাম, ছুটি আসলে কি এক ধরনের পালিয়ে যাওয়া? নিজের থেকেও দূরে কোথাও চলে যাওয়া? অদ্ভুত আর বিকলাঙ্গ সমাজ বিকাশের ধারায় মধ্যবিত্তের ধারণাটাই পাল্টে গেছে। এখন অবকাশ যাপনের জন্য যাবার জায়গা তৈরি হয়েছে অনেক। বহু মানুষ ছুটির ফাঁকে চলে যায় পর্যটনে। অলসতা, সীমাহীন রোদ অথবা মেঘাচ্ছন্ন দিন তাকে মুক্তি দেয়। তবু কিছু মানুষ পড়ে থাকে পেছনে। যারা ছিন্নমূল, যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। লম্বা ছুটির টাইম টেবিল সামনে রেখেও তারা কোথাও যায় না; নগরীর দুঃখ যন্ত্রণার সঙ্গে তারা আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা থাকে। ছুটির অবকাশে তাদের কোথাও যাবার থাকে না। যখন বহু মানুষ ছুটির নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ঘর ছাড়ে তখন কেউ কেউ পেছনে পড়ে থাকে। নগরের শান-বাঁধানো পথ, বিমুখ বিপণিকেন্দ্র, মুখ থুবড়ে পড়া গলি, সন্তানের অসুস্থতা তাদের টেনে ধরে রাখে। দুর্দিনের ইতিহাস তাদের লিখতে দেয় না
‘‘আজ আমাদের ছুটি’’। ‘‘মেঘের কোলে রোদ হেসেছে/ বাদল গেছে টুটি/ আজ আমাদের ছুটি, ও ভাই আজ আমাদের ছুটি’’। রবীন্দ্রনাথের ছুটির এই ধারণার সঙ্গে সময়ের ছুটির গল্পের মেরুদূর প্রভেদ আছে। আমরা এখন সবকিছুর স্বাদ নিতে চাই কিন্তু আস্বাদ গ্রহণে আগ্রহী নই। তাই ছুটি মানে যে ব্যস্ত জীবনের ওপর নেমে আসা বিরতি তা-ও ভুলে যাই। ছুটির দিনের নিভৃতি তাই মিশে যায় নানা হট্টগোলে।
দীর্ঘ ছুটির রুটিন সাজাচ্ছে এখন মানুষ। ঈদ উৎসবকে সামনে রেখে ছুটি মিলেছে। কী বলা যায় একে, ব্যস্ততার পুনরাবৃত্তির মাঝে হঠাৎ বিরতির উৎসব? ছন্দপতন তো নিশ্চয়ই নয়। নতুন ছন্দে জেগে ওঠার অবকাশ হয়তো। বিদেশ থেকে বাড়ি ফিরবে স্বজন। এই শহুরে প্রবাস থেকে ঘরে ফিরবে মানুষ। প্রতিদিন ব্যস্ত দিন যাপনের ক্লান্তি থেকে মুক্তি মিলবে কোথাও অবসর কাটানোর ফাঁকে। সুতরাং তৈরি হয়ে যাবে ভ্যাকেশন প্ল্যান। পেছনে পড়ে থাকবে বিষণ্ন নগরী। কাজ নেই, ছোটা নেই, ক্লান্তি নেই, বিশ্রামের আনন্দ নেই। নদীর চড়ায় রোদে পিঠ-পড়ে থাকা কুমিরের মতো অবসন্ন ছুটির দিন।
আমরা সবাই অবসর চাই। বিশ্রাম চাই, ভিড় থেকে দূরে যেতে চাই। কাজ আছে বলেই এমন করে ছুটির প্রার্থনা হয়তো আমাদের। বেকারের কাছে ছুটির দিনের কোনো অর্থ নেই, নেই ক্যালেন্ডারের তারিখে দৃষ্টি ফেরানোর গরজ। দেয়ালে বাঁকা হয়ে আটকে থাকা পেরেকের মতো আমাদের নিয়তি আসলে ব্যস্ত দিনে সমাহিত। ছুটির দিনগুলো লাল রঙ হয়ে তাকিয়ে থাকে গোটা বছর আমাদের দিকে। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ বন র র জ বন আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
তত্ত্বাবধায়ক সরকারযুক্ত সংবিধানই জনগণ চায়
ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা যুক্ত হয়েছিল সংবিধানে, তা–ই জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য বলে আপিল বিভাগে এ–সংক্রান্ত শুনানিতে বলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল–পরবর্তী নির্বাচনগুলোর চিত্র দেখিয়ে জয়নুল আবেদীন বলেছেন, ২০১৪ সালে ভোটারবিহীন এবং ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে—দেশের জনগণ এমন বিতর্কিত কোনো নির্বাচন হোক, তা চায় না।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের ওপর আজ রোববার ষষ্ঠ দিনের মতো শুনানি হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে বিএনপি মহাসচিবের আপিল–সংক্রান্ত শুনানি করেন জয়নুল আবেদীন।
সকাল ৯টা ২০ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। বেলা ১১টা থেকে মাঝে বিরতি দিয়ে ১টা পর্যন্ত শুনানি চলে। পরবর্তী শুনানির জন্য মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) দিন রাখা হয়েছে। এদিন বিরতির পর শুনানি শুরুর আগে প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অপর বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে আসেন বাংলাদেশে সফররত নেপালের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ মান সিং রাউত। বিচারপতিদের সঙ্গে এজলাসে বসে এই শুনানি পর্যবেক্ষণ করেন তিনি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেই একটি আলোচিত বিষয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের মুখে তৎকালীন বিএনপি সরকার সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন এই সরকারব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে যুক্ত করেছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার দুই বছর পর সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনে এই ব্যবস্থা বাতিল করে। তার আগে সর্বোচ্চ আদালতের এক রায়ে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছিল।
ওই রায়ের ক্ষেত্রে দেশের প্রচলিত আইন ও আপিল বিভাগের রুলসের ব্যত্যয় ঘটেছে দাবি করে শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘রায়ে সইয়ের আগেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার, সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে সংবিধান সংশোধন (পঞ্চদশ সংশোধনী) করে। পূর্ণাঙ্গ রায় লেখা ও স্বাক্ষরের (বিচারপতিদের রায়ে সই করা) আগে সরকার সংসদ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সংসদ সদস্যের বলে তড়িঘড়ি করে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করে, যা দেশবাসীর জানা। দেশের বিবেকবান মানুষ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগে এই সংবিধান সংশোধনকে সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করেছিল। এটি জনগণের বিরুদ্ধে বড় ষড়যন্ত্র।’
বিএনপির একসময়ের আইনবিষয়ক সম্পাদক জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ব্যবহার করেছেন। সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে বহাল রাখার লক্ষ্যে সাবেক প্রধান বিচারপতি (বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক) দেশের প্রচলিত আইন ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রুলস যথাযথভাবে অনুসরণ না করে সর্বশেষ (পূর্ণাঙ্গ রায়) রায় দেন, যা প্রথমে দেওয়া রায়ের (শর্ট অর্ডার সংক্ষিপ্ত রায়) সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।’
শুনানিতে অবসরের পর রায়ে সই প্রসঙ্গ
অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করলে তার আইনগত মূল্য কী হবে—এ প্রসঙ্গ ওঠে শুনানিতে। বিরতির পর শুনানিতে অংশ নিয়ে এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিবের অপর আইনজীবী মো. রুহুল কুদ্দুস বলেন, রায় ঘোষণা ও রায়ে সই করা দুটি ভিন্ন বিষয়। রায় ঘোষণার সময় এ বি এম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির পদে আসীন ছিলেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে যা ছিল, পূর্ণাঙ্গ রায়ে তা পরিবর্তন করা হয়েছে।
দেওয়ানি কার্যবিধি, আপিল বিভাগের রুলস ও সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ তুলে ধরে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘শর্ট অর্ডারের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ রায়ে যে পার্থক্য, তা পূর্ণাঙ্গ রায়ে উল্লেখ করেছেন একজন বিচারপতি। এই বিচারপতিও বলেননি অবসরের পরে বিচারপতি খায়রুল হকের লেখা রায়টি অবৈধ হয়েছে। স্বাক্ষর পরে করেছেন বলে রায় অবৈধ বলা যাবে না। কারণ, অবসরের পর কোনো বিচারপতি রায়ে সই করতে পারবেন না কিংবা কত দিনের মধ্যে সই না করলে সেটি অবৈধ হবে, এমন বাধ্যবাধকতা আইনে নেই।’
রুহুল কুদ্দুস বলেন, ‘প্রকাশ্য আদালতে কোনো বিচারপতি যখন কোনো রায় দেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতে দিলে ছোটখাটো দাড়ি, কমা, শব্দ বাদ পড়েছে—এগুলো ছাড়া যেকোনো পরিবর্তন করতে হলে অবশ্যই সেটি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) ছাড়া হবে না, যার ওপর শুনানি চলছে।’
এ মামলায় সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি নামের একটি সংগঠন ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়। ওই প্রসঙ্গে সংগঠনটির জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এহসান এ সিদ্দিক বলেন, ‘অবসরের পর রায়ে সই করলে তা বাতিল বা অকার্যকর হবে না। যেদিন প্রকাশ্য আদালতে রায় ঘোষণা করলেন, সেই তারিখ হচ্ছে মূল। এটি হচ্ছে রায়ের তারিখ। কবে সই করলেন, এটি প্রাসঙ্গিক নয়। আপিল বিভাগের রুলসে বলা আছে, এ ক্ষেত্রে দেওয়ানি কার্যবিধির (সিপিসি) বিধান কার্যকর হবে না। আপিল বিভাগের জন্য সিপিসি প্রযোজ্য নয়।’
মামলার পূর্বাপর
আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আপিল বিভাগের ২০১১ সালের রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন পৃথক আবেদন (রিভিউ) করেন। সেন্টার ফর ল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড পলিসি ইন্টারভেনার (পক্ষ) হিসেবে যুক্ত হয়।
রিভিউ আবেদনের ওপর শুনানি শেষে গত ২৭ আগস্ট লিভ মঞ্জুর (আপিলের অনুমতি) করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি এবং বিএনপির মহাসচিবের করা রিভিউ আবেদন থেকে উদ্ভূত আপিলের সঙ্গে অপর রিভিউ আবেদনগুলো শুনানির জন্য যুক্ত হবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়। এ অনুসারে পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের করা রিভিউসহ অপর রিভিউ আবেদন এবং বিএনপির মহাসচিবের আপিল শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় ওঠে।
পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তির করা আপিলের ওপর ২১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়। এরপর ইন্টারভেনার হিসেবে যুক্ত সংগঠনের পক্ষে শুনানি করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী। এরপর জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেলের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির শুনানি করেন। এরপর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেনের পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম বদরুদ্দোজা বাদল এবং এ এস এম শাহরিয়ার কবির শুনানি করেন। শাহরিয়ার কবিরের বক্তব্য উপস্থাপনের পর হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (রিভিউ আবেদনকারী) পক্ষে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ইমরান এ সিদ্দিক শুনানি করেন। এরপর বিএনপির মহাসচিবের পক্ষে জয়নুল আবেদীন শুনানি শুরু করেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের এক বছর পর গত আগস্টে বিচারপতি খায়রুল হক গ্রেপ্তার হন। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন।