চীন সরকার ও সে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ২১০ কোটি মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় ৩০টি চীনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ করবে। মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্প এবং প্রযুক্তি খাতে সহায়তা দেবে তারা। এ ছাড়া সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে ঢাকার পাশে থাকবে বেইজিং। 

প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে নানা খাতে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। শুক্রবার সকালে বেইজিংয়ের গ্রেট হল অব দ্য পিপলে এ বৈঠক হয়েছে। অত্যন্ত আন্তরিকতাপূর্ণ বৈঠকে শি জিনপিং বাংলাদেশে সংস্কার কার্যক্রমে ড. ইউনূসকে পূর্ণ সহযোগিতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। দু’দেশের সম্পর্ক আরও উঁচুতে নিয়ে যেতে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছে। 
এদিকে বাংলাদেশ ও চীন ১ চুক্তি, ৮ সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও শি জিনপিংয়ের বৈঠকের পর দুই দেশের মধ্যে এসব নথি সই হয়।

প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব আব্দুল কালাম আজাদ মজুমদার জানান, দুই দেশ অর্থনৈতিক এবং কারিগরি সহযোগিতা সংক্রান্ত একটি চুক্তি করেছে। এ ছাড়া সাহিত্যের অনুবাদ ও প্রকাশনা, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও সহযোগিতা, গণমাধ্যম, ক্রীড়া ও স্বাস্থ্য খাতে মোট আটটি সমঝোতা স্মারকে সই হয়েছে। এ ছাড়া বিনিয়োগ সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। চীনের শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রম শুরু করা, মোংলা বন্দরের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণের জন্য একটি বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষর, রোবট ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণ এবং হৃদরোগ সার্জারি যানবাহন প্রদান বিষয়ে পাঁচটি ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।

বাসস জানায়, ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৩০টি চীনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে। 
প্রধান উপদেষ্টা চীনের উদ্যোক্তাদের প্রতি বাংলাদেশে শিল্পে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানোর পর এসব অঙ্গীকার এসেছে।

চীন মোংলা বন্দর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে আরও প্রায় ৪০ কোটি ডলার ঋণ প্রদান, চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নয়নে ৩৫ কোটি ডলার এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা হিসেবে আরও ১৫ কোটি ডলার বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। বাকি অর্থ অনুদান ও অন্যান্য ঋণ সহায়তা হিসেবে আসবে।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং জানায়, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও শি জিনপিং অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন। বাংলাদেশকে চীনের উন্নয়ন থেকে অভিজ্ঞতা নেওয়া এবং বাংলাদেশে দ্রুত প্রবৃদ্ধির জন্য সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়ে প্রস্তাব দেন শি জিনপিং। তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণের দুই বছর পরও অর্থাৎ ২০২৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশে আরও চীনা বিনিয়োগের পথ প্রশস্ত করার জন্য একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি এবং বিনিয়োগ চুক্তির জন্য আলোচনা শুরু করতে চায় বেইজিং।
শি জিনপিং বলেন, বাংলাদেশে একটি বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং শিল্প পার্ক নির্মাণে সহায়তা করবে বেইজিং। তিনি চীনে আরও বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি, বিআরআইয়ে সহযোগিতা এবং ডিজিটাল ও সমুদ্র অর্থনীতির পরিকল্পনাকে স্বাগত জানান। ইউনান এবং চীনের অন্যান্য প্রদেশের হাসপাতালে বাংলাদেশিদের চিকিৎসার সুযোগ বাড়ানোর আগ্রহের কথা জানিয়েছেন জিনপিং। এ ছাড়া  বাংলাদেশে একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের ঘোষণাও দিয়েছে দেশটি।

বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের সহযোগিতা কামনা করেন। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে চীনের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন শি জিনপিং। ড. ইউনূস নতুন বাংলাদেশ গঠনে তরুণদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে চীনের সমর্থন চেয়েছেন এবং বাংলাদেশে চীনা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র স্থাপনের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তিনি চীনা প্রকল্প ঋণের সুদের হার কমানো এবং ঋণের প্রতিশ্রুত ফি মওকুফেরও দাবি জানান। এ সময় বিষয়টি ইতিবাচকভাবে বিবেচনার কথা জানিয়েছেন চীনের প্রেসিডেন্ট। জিনপিং জানান, বাংলাদেশি আম ও কাঁঠালের স্বাদ গ্রহণ করেছেন তিনি। এসবের গুণমানের প্রশংসা করে তিনি বলেন, চীন বাংলাদেশ থেকে ফল আমদানিতে প্রস্তুত।
বৈঠকে চীন থেকে যুদ্ধবিমান ক্রয় এবং কুনমিং ও বাংলাদেশের বন্দরের যোগাযোগের মাল্টিমডাল পরিবহন বিষয়েও আলোচনা করেন দুই নেতা।

বিনিয়োগ, ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি
বাসস জানায়, ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন এবং বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রায় ৩০টি চীনা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে, যা প্রধান উপদেষ্টা বেসরকারি খাতকে বাংলাদেশের উৎপাদন শিল্পে বিনিয়োগ করতে আহ্বান জানানোর পর এসেছে। 
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে ড. ইউনূস চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে বাংলাদেশে চীনা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগের জন্য ‘সবুজ সংকেত’ দেওয়ার অনুরোধ জানান। প্রেসিডেন্ট শি নিশ্চিত করেন, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের উৎপাদন কেন্দ্র বৈচিত্র্যময় করতে চাইলে বাংলাদেশে স্থানান্তরের জন্য তিনি উৎসাহিত করবেন। গতকাল ড. ইউনূস বেইজিংয়ে বিশ্বের কিছু বৃহৎ চীনা প্রতিষ্ঠানসহ ১০০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় বাংলাদেশে উৎপাদন খাতে বিশেষ করে উন্নত টেক্সটাইল, ওষুধ শিল্প, হালকা প্রকৌশল ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হয়। দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক নিয়ে যৌথ সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তা অব্যাহত রাখবে চীন
যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, মিয়ানমারের শান্তি আলোচনা এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মানুষের সমস্যা সমাধানে চীনের গঠনমূলক ভূমিকার প্রশংসা করে ঢাকা। রাখাইন রাজ্য থেকে বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা প্রদানের জন্য চীন বাংলাদেশের প্রশংসা করে। সেই সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে পারস্পরিকভাবে গ্রহণযোগ্য সমাধান খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে সমর্থন করে বেইজিং। চীন তার সর্বোচ্চ সামর্থ্য অনুযায়ী প্রত্যাবাসনের জন্য সহায়তা প্রদান অব্যাহত রাখবে।

তাইওয়ানের স্বাধীনতার বিরোধিতা করে বাংলাদেশ
বাংলাদেশ ও চীন একে অপরের মূল স্বার্থ এবং প্রধান উদ্বেগের বিষয়গুলোতে পারস্পরিক সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। চীন ধারাবাহিকভাবে অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি মেনে চলে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে সম্মান করে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় সমর্থন করে এবং বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা স্বাধীনভাবে নির্বাচিত উন্নয়নের পথকে সম্মান করে। এ ছাড়া পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়নের পথ অন্বেষণে বাংলাদেশকে সমর্থন করে।
চীন সর্বদা বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণ এবং বন্ধুত্বের নীতি অনুসরণ করে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্য ও স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমর্থন করে। উভয় পক্ষ জোর দিয়ে বলেছে, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৭৫৮ প্রস্তাবটি সব প্রশ্ন বা চ্যালেঞ্জের ঊর্ধ্বে। বাংলাদেশ এক চীন নীতির প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি এবং অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছে। বাংলাদেশ ‘তাইওয়ান স্বাধীনতার’ বিরোধিতা করে। চীনের মূল স্বার্থ এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষায় চীনের প্রচেষ্টা সম্পর্কিত বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ চীনকে সমর্থন করে।

স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রেখেছে ঢাকা-বেইজিং
বিবৃতিতে বলা হয়, চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক দৃশ্যপটের পরিবর্তন সত্ত্বেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক ভালো ও দুই দেশ স্থিতিশীল উন্নয়ন বজায় রেখেছে। উভয় পক্ষ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে চীনের পাঁচ নীতিকে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখতে একমত হয়েছে। এ ছাড়া ঐতিহ্যবাহী বন্ধুত্বকে এগিয়ে নিতে, রাজনৈতিক পারস্পরিক আস্থা এবং উন্নয়ন কৌশলগুলোর মধ্যে সমন্বয়কে আরও গভীর করতে একমত দুই দেশ। চীন-বাংলাদেশ সমন্বিত কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বে এগিয়ে যেতে এবং দুই দেশ ও তাদের জনগণের জন্য বৃহত্তর সুবিধা প্রদান করতে সম্মত হয়েছে।

কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকী যৌথভাবে উদযাপন
চলতি বছর দুই দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ৫০তম বার্ষিকী যৌথভাবে উদযাপন করতে সম্মত হয়েছে। দুই দেশ জনগণের মধ্যে সফর বিনিময় এবং সংস্কৃতি, পর্যটন, গণমাধ্যম, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা খাতে সহযোগিতা আরও গভীর করতে সম্মত হয়েছে। ইউনান প্রদেশে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা গ্রহণের জন্য চীন যে সুবিধা দিয়েছে, সে জন্য বাংলাদেশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে।

বিআরআইতে সহযোগিতায় একমত
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআইতে সহযোগিতার বিষয়ে দুই দেশ একমত। শিল্প ও সরবরাহ শৃঙ্খলা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার, আধুনিকীকরণের জন্য বিআরআইতে একসঙ্গে কাজ করতে দুই দেশ সম্মত হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে চীন দীর্ঘস্থায়ী এবং জোরালো সহায়তা করায় বাংলাদেশ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। চীন অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং শিল্পায়ন এগিয়ে নিতে বাংলাদেশকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে।
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের এটি প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। হাইনানে বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়া সম্মেলনে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে তিনি সফর শুরু করেন। গতকাল শুক্রবার তিনি চীনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ ছাড়া গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার একাধিক বৈঠক ও সেমিনারে অংশ নেন তিনি।

পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দেবেন ড. ইউনূস
আজ শনিবার সকালে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় প্রধান উপদেষ্টাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবে। এর পর ড. ইউনূস উপস্থিত সুধীজনের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। বিকেলে তিনি চীনা মিডিয়া গ্রুপকে (সিএমজি) সাক্ষাৎকার দেবেন। চার দিনের সফর শেষে প্রধান উপদেষ্টা আজ ঢাকা ফিরবেন।

 


 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ব ধ নত ক ত কর ছ সহয গ ত জনগণ র র জন য অন দ ন কর ছ ন ইউন স সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জাতির স্বার্থে খোলামেলা আলোচনায় বসার আহ্বান জামায়াতের 

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ও জাতির স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের আমির ডা. শফিকুর রহমান। তিনি বলেন, সরকারসহ সব পক্ষ আন্তরিক হলে আলোচনার মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধান সম্ভব।

মঙ্গলবার (৪ নভেম্বর) ভোরে বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন শফিকুর রহমান।

জাতীয় নির্বাচ‌নে দ‌লের চূড়ান্ত প্রার্থী তা‌লিকা সময়মতো ঘোষণা করা হ‌বে ব‌লে বলেও জানান তিনি। এছাড়া,  জোটবদ্ধ হ‌য়ে নির্বাচ‌নে অংশ নেওয়ার ইঙ্গিত দেন তি‌নি।

বিএন‌পির প্রার্থী তা‌লিকা ঘোষণা করা হ‌য়ে‌ছে, জামায়া‌তের তা‌লিকা ক‌বে ঘোষণা করা হ‌বে জান‌তে চাই‌লে দলের আমির ব‌লেন, “তারাও (বিএনপি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করেনি। আমি দেখেছি ২৩৭ টা আসনে তারা তালিকা প্রকাশ করেছেন, আবার এটিও চূড়ান্ত নয়। এরমধ্যেও পরিবর্তন আসতে পারে।” 

“আমরা কিন্তু এক বছর আগেই এই তালিকা আঞ্চলিকভাবে জানিয়ে দিয়েছি। চূড়ান্ত তালিকাটা সময়মতো আমরা কেন্দ্রের পক্ষ থেকে ঘোষণা করব। তবে যেহেতু আমরা একা ইলেকশন করব না, আরো অনেককে আমরা ধারণ করব, দেশ এবং জাতির স্বার্থে সব দিক বিবেচনা করেই চূড়ান্তভাবে যথাসময়ে আমরা ইনশাআল্লাহ প্রার্থী ঘোষণা করব।” 

আসন্ন নির্বাচন যথাসম‌য়ে অনুষ্ঠা‌নের বিষ‌য়ে আশাবাদ ব‌্যক্ত ক‌রে জামায়া‌তের আমির বলেন, “ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন, আমরা আপনারা দেশবাসী সবাই দেখতে চাই।” 

মতানৈক্য গণতন্ত্রের সৌন্দর্য: রাজনী‌তি‌তে মতানৈক্য কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে জামায়া‌তের আমির বলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমাদের মধ্যে মতানৈক্য থাকবে, তবে দোয়া করেন মতবিরোধ যেন না হয়। মতের ভিন্নতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। সব দল তো এক দল নয়। সবগুলো দল ভিন্ন ভিন্ন। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেও মতপার্থক্য থাকবে এটাই স্বাভাবিক।” 

“আমরা সকলের মতকে শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখি। তবে আমরা নিজেরা যে মতটা প্রকাশ করি আমরা চেষ্টা করি চিন্তাভাবনা করে জাতির স্বার্থেই সে মতগুলা প্রকাশ করা হয়। অতএব, মতানৈক্য এটা ডেমোক্রেসির সৌন্দর্য। এটার জন্য এখানে বিরোধ লেগে গেছে অথবা দেশ একেবারে অস্থির হয়ে গেছে আমরা এইটুকু চিন্তা করতে রাজি নই” বলেন তিনি।  

খোলামেলা আলোচনার আহ্বান:

জুলাই সনদ বাস্তবায়‌নে আদেশ জা‌রি ও গণ‌ভো‌টের বিষ‌য়ে শ‌ফিকুর রহমান ব‌লেন, “আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি অলরেডি দিয়ে দিয়েছি।”

সরকার রাজনৈতিক দলসমূহকে সময় বেঁধে দিয়েছেন, এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “না, উনারা সময় বেঁধে দেই নাই; আমি শুনেছি ভাল করে। উনারা অনুরোধ করেছেন যে, এক সপ্তাহ সময়ের ভেতরে রাজনৈতিক দলগুলা বসে যদি একটা কনসেনসাসে পৌঁছাতে পারে, তাহ‌লে তারা সিদ্ধান্ত দি‌য়ে দে‌বে। সরকার ভালো কথাই ব‌লে‌ছে।” 

তি‌নি ব‌লেন, “আমরাই সবার আগে আহ্বান জানিয়েছি যে, আসুন, আমরা খোলামেলা আলোচনা করে জাতির স্বার্থে একটা সমাধানে পৌঁছি। আমরা আশা করি, অন্যরা আমাদের এই আহ্বানে সাড়া দেবেন।” 

এর আগে গতকাল সোমবার জুলাই জাতীয় সনদ বা সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে মতভেদ দেখা দিয়েছে, তাতে উদ্বেগ প্রকাশ করে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সম্ভাব্য দ্রুততম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।

আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি:

আবারো দ‌লের আমির নির্বা‌চত হওয়া প্রস‌ঙ্গে শ‌ফিকুর রহমান ব‌লেন, “আমি ‘আমির’ নির্বাচিত হইনি। আমার সহকর্মীরা আমার ওপর একটা দায়িত্বের ভার অর্পণ করেছেন, এই দায়িত্বটা বড় ভারী। আপনারা দোয়া করবেন, দেশ এবং দ্বীনের জন্য এই দায়িত্ব পালনে আল্লাহ যেন আমাকে সাহায্য করেন। আর পাশাপাশি আমি আপনাদেরও সহযোগিতা চাই।”

সাংবাদিকদের উদ্দেশে জামায়া‌তের আমির ব‌লেন, “আমি সবাইকে ধন্যবাদ জানাবার আগে আরেকবার আপনাদের আন্তরিক সহযোগিতা কামনা করব। আসলে আপনারা ব্যক্তিগতভাবে জাতির বিবেক আর আপনাদের হাউসগুলো দর্পণ। আমরা সমাজের এই দর্পণ এবং জাতির বিবেকের কাছে দেশ গড়ার অভিযাত্রায় জামায়াতে ইসলামী যেসব কর্মসূচি ঘোষণা করছে যা দেশ এবং জাতির কল্যাণে আমরা এই সবগুলোতে আপনাদেরও কাছে চাই। কারণ আপনারা এই সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন নন। আপনারা শুধু সাংবাদিক নন, আপনারা এই দেশের নাগরিকও বটে। অতএব, আমরা যারা নাগরিক অধিকারটা নিশ্চিত করে একটা মানবিক বাংলাদেশ গড়তে চাই, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়তে চাই, এই ক্ষেত্রে আপনাদের ভূমিকা হবে অগ্রগণ্য, আমরা সেটা প্রত্যাশা রাখি। কারণ সাংবাদিকরা যখন জাতির কল্যাণে সিদ্ধান্ত নেন, জাতি তখন কল্যাণের পথ খুঁজে পায়।”

বি‌দেশ সফ‌রের কথা তু‌লে ধ‌রে শ‌ফিকুর রহমান ব‌লেন, “আপনারা হয়ত জানেন গত মাসের ১৯ তারিখ আমি ওমরা করার উদ্দেশ্যে দেশ থেকে বের হয়েছিলাম। তিন দিনে ওমরা সম্পন্ন করার পর ২২ তারিখ সকাল ৯টায় আমেরিকার জেএফকে এয়ারপোর্টে আমি আল্লাহর মেহেরবাণীতে সেখানে পৌঁছাই এবং সেখানে ৮ দিনব্যাপী বিভিন্ন স্তরে সরকারি বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ সংস্থা এবং ব্যক্তিদের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হই। খুব অল্প সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৪টি শহরে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিদের দেখা করার সু‌যোগ হ‌য়ে‌ছে।”

“সেখান গুরুত্বপূর্ণ দুটি কথা দুটি মেসেজ তাদেরকে দিয়েছি। একটা হচ্ছে বাংলাদেশ আমাদের সকলের। দীর্ঘদিনের বঞ্চনা এবং নিষ্পেশন ও ফ্যাসিবাদী শাসনের পর বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে। মুক্তির এই সংগ্রামে দেশবাসীর সাথে প্রবাসে যারা ছিলেন, তারাও সমানতালে লড়াই করেছেন। তাদের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেই অবদানের জন্য তাদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। আর আমরা বলেছি, প্রবাসীদের সবচেয়ে বড় অধিকার ভোটাধিকার এত দিন ছিল না। এ দাবি সবার আগে আমরা তুলেছিলাম। আমরা এ দাবি নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ও নির্বাচন কমিশনসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল জায়গায় প্রবাসীদের হয়ে কথা বলেছি। আমরা সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানাই; এই প্রথমবারের মত ব্যাপক ভিত্তিক আমাদের প্রবাসীদেরকে ভোটার করার উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু সেখানে কিছু সমস্যা রয়ে গিয়েছে।”

ভোটার হওয়ার জন্য অক্টোবরের ৩০ তারিখ পর্যন্ত সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, “এ জন্য যে সফটওয়ার ইনস্টল করা হয়েছে তা প্রোপারলি ফাংশন করে নাই, যার কারণে আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই ভোটার হতে পারেননি। আমাদের দাবি থাকবে নির্বাচন কমিশনের কাছে কমপক্ষে আরও ১৫ দিন এই সময় বর্ধিত করা হোক এবং যে জটিলতাগুলো রয়েছে- এগুলো সহজ করে তাদেরকে ভোটার হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। আরও কিছু সমস্যা আছে; কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা বলব একজন নাগরিকের নাগরিকত্ব প্রমাণের জন্য তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড যথেষ্ট। পাশাপাশি তার যদি একটা ভ্যালিড পাসপোর্ট থাকে-তাহলে আর কিছুরই প্রয়োজন হয় না। এর বাই‌রে যে সব শর্ত তা যেন শিথিল ক‌রে দেয়।” 

তুরস্ক সফর সফল হ‌য়ে‌ছে জা‌নি‌য়ে দল‌টির আমির ব‌লেন,  “তুরস্কে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বশীলদের আমার গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হয়েছে। আর বাংলাদেশি যারা আছেন তাদের সঙ্গে আমার বসা হয়েছে, তাদের কথাও শোনার সুযোগ হয়েছে। আমি আসলে নিজের কোনো প্রয়োজনে দেশ থেকে বের হইনি। আমি বের হয়েছিলাম দেশ এবং জনগণের প্রয়োজনে। যেখানেই গিয়েছে জনগণের স্বার্থকে দেশের স্বার্থকে সামনে রেখেই কথা বলার চেষ্টা করেছি।” 

তিনি বলেন, “দুনিয়ার সকলের সাথেই আমরা সম্মানজনক সম্পর্ক চাই। এই সম্পর্কটা হবে মিউচুয়াল রেসপেক্ট এবং ইকিউয়িটির ভিত্তিতে।” 

সৌদি আরবে পবিত্র ওমরা পালন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক সফর শেষে জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান মঙ্গলবার ভো‌রে ঢাকায় ফেরেন।

এ সময় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে দ‌লের সি‌নিয়র নেতারা তা‌কে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।

দ‌লের নায়েবে আমির সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মুজিবুর রহমান, সাবেক সংসদ সংসদ সদস্য মাওলানা আনম শামসুল ইসলাম, সেক্রেটারি জেনারেল সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মা’ছুম, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ড. হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা আবদুল হালিম ও এড. মোয়াযযম হোসাইন হেলালসহ কেন্দ্রীয় আরো অনেক নেতাকর্মী বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন।

ঢাকা/নঈমুদ্দীন/ইভা 

সম্পর্কিত নিবন্ধ