ভূমিকম্পের পর ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত একটি সোনালি সুযোগ বা ‘গোল্ডেন উইন্ড’ খোলা থাকে। এ সময়ে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়া অধিকাংশ ব্যক্তির জীবিত থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

কিন্তু মিয়ানমারে গত শুক্রবার ৭ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর সামরিক কর্তৃপক্ষের বাধায় ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি এলাকায় উদ্ধার ও ত্রাণকর্মীরা প্রবেশই করতে পারেননি।

মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষ ওই সব এলাকা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। তাদের কাছে উদ্ধার ও ত্রাণকর্মীদের প্রবেশ করতে দেওয়ার অনুমতি চাইতে হচ্ছে বলে বিবিসিকে জানিয়েছে একাধিক ত্রাণ ও মানবাধিকার গ্রুপ।

অথচ ভূমিকম্পের পর মিয়ানমারের জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাঁর দেশে মানবিক সহায়তা পাঠানোর আবেদন জানিয়েছিলেন। জান্তা সরকারের প্রধানকে এমন আবেদন করতে প্রায় দেখাই যায় না।

ভূমিকম্পের পরপরই এক ভাষণে মিন অং হ্লাইং বলেছিলেন, ‘আমি যেকোনো দেশ, যেকোনো সংগঠন অথবা মিয়ানমারের যে কাউকে এগিয়ে আসার ও সাহায্য করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

বিদেশি ত্রাণসহায়তার জন্য সব দরজা খুলে দিয়েছেন বলেও ওই ভাষণে বলেছিলেন জান্তাপ্রধান।

কিন্তু বাস্তবে সেখানে সবকিছু এতটা স্বাধীনভাবে করতে দেওয়া হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গ্রুপ ফর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি বলেছেন, ‘সাগাইং ও মান্দালয় উভয় জায়গায় উদ্ধারকাজের অংশ ছিলেন, এমন কয়েকজনের সঙ্গে এখন আমার কথা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, (সেনাবাহিনী) কারফিউ জারি করেছে.

..সড়ক অবরুদ্ধ, তল্লাশিচৌকিগুলোর সামনে দীর্ঘ লাইন, পণ্য ও পরিষেবা প্রবেশের আগে ব্যাপক তল্লাশি চলছে এবং অনেক প্রশ্ন করা হচ্ছে।’

ওই মানুষদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া অনেক সহজ হতে পারত বলেও মনে করেন কুইনলি। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই মিয়ানমার জান্তা বলেছে, নিরাপত্তার কারণে এটা করা হয়েছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে এই যুক্তি ধোপে টেকে।’

ইতিমধ্যে সোনালি জানালা বন্ধ হয়ে গেছে। মিয়ানমারে ভূমিকম্পে এরই মধ্যে ২ হাজার ৮৮৬ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়েছে।

গত মঙ্গলবার রাতে একটি ত্রাণ বহরের ওপর হামলা উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

তা’আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি (টিএনএলএ) বলেছে, স্থানীয় সময় রাত ৯টা ২১ মিনিটে চীনের রেডক্রস সোসাইটির ৯টি গাড়ির একটি বহর মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছে। ওই বহর মিয়ানমারের ভূমিকম্প দুর্গত ব্যক্তিদের জন্য ত্রাণসহায়তা নিয়ে যাচ্ছিল।

মিয়ানমারের শান রাজ্যের জান্তা প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর একটি টিএনএলএ।

মঙ্গলবার রাতে টেলিগ্রামে এক পোস্টে টিএনএলএ বলেছে, যখন হামলার শিকার হয়, সে সময়ে ত্রাণ বহরটি মান্দালয়ের দিকে যাচ্ছিল। সৈন্যরা মেশিনগান দিয়ে গুলি করলে সেটি ফিরে যেতে বাধ্য হয়।

পরে জান্তা সরকারের এক মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন, সৈন্যরা ওই গাড়িবহরে গুলি চালিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, ওই গাড়িবহরে যাওয়ার বিষয়ে আগে থেকে তাঁদের কিছু জানানো হয়নি। সৈন্যরা বহরটি থামাতে ব্যর্থ হওয়ার পর সতর্ক করতে গুলি ছোড়েন।

আরও পড়ুনমিয়ানমারে ভূমিকম্পে ১৭০ স্বজন–প্রিয়জনকে হারিয়ে শোকস্তব্ধ ইমাম সোয়ে০২ এপ্রিল ২০২৫

ত্রাণকর্মীদের ওপর মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর হামলার ঘটনা এটাই প্রথম নয় বলে জানিয়েছেন কুইনলি।

কুইনলি বলেন, ‘ত্রাণ নিয়ে কখন প্রবেশ করা যাবে, সেটা তারাই ঠিক করে দেয়, এবং যদি তারা এটা পর্যবেক্ষণ করতে না পারে এবং যেভাবে ইচ্ছা ব্যবহার করতে না পারে, তারা এটিকে আটকে দেয়। সর্বোপরি, এটা নিশ্চিত যে তারা তৎপর হয়ে মানবিক সহায়তা কর্মীদের লক্ষ্যবস্তু করেছে।’

২০২১ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। তার পর থেকে প্রতিরোধ বাহিনীর সঙ্গে দেশটির জান্তা বাহিনীর লড়াই চলছে।

মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী এর আগেও ত্রাণ ও মানবিক সহায়তাকে অস্ত্রে পরিণত করেছে। নিজেদের দখলে থাকা এলাকায় তারা ত্রাণ ও মানবিক সহায়তা প্রবেশ করতে দিয়েছে। কিন্তু যেসব এলাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, সেখানে সেগুলো প্রবেশে বাধা দিয়েছে।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আজ

‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ ভয় নাই ওরে ভয় নাই/ নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই’। তাঁদের নিঃশেষে প্রাণদানের স্মৃতি আজ গভীর বেদনায় স্মরণ করবে জাতি। আজ থেকে ৫৪ বছর আগে দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা হানাদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নীলনকশার শিকার হয়ে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছিলেন।

অমিত বিক্রম বাঙালির জীবনপণ যুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয় তখন ছিল কেবল দিনগণনার বিষয়। সেই অনিবার্য পরাজয়ের প্রাক্কালে মরণকামড় দেওয়ার চেষ্টা করেছিল ঘাতক বাহিনী। স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাঙালি জাতি যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে, সেই চক্রান্ত করেছিল তারা। দেশের সেরা বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল। এ কাজে পাকিস্তানি সেনাদের সরাসরি সহায়তা করেছিল তাদের মিত্র এ দেশি রাজাকার, আলবদর বাহিনী। এরাই ঘাতক সেনাদের নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিয়েছে বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি। চিনিয়ে দিয়েছে সেই নিরীহ মানুষগুলোকে।

মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে পরে মিরপুরে রায়েরবাজার পরিত্যক্ত ইটখোলা ও মিরপুরে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া সেসব বুদ্ধিবৃত্তিক পেশায় যুক্ত মানুষের মরদেহগুলো উদ্ধার করা হয়। তাঁদের অনেকের ছিল পিছমোড়া করে হাত ও চোখ বাঁধা। ভয়ানক নির্যাতনের চিহ্ন ছিল শরীরে। তাঁদের মরদেহ উদ্ধার হওয়ার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বুদ্ধিজীবী হত্যার গভীর ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে পড়ে। এর পর থেকেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা ও শোক প্রকাশ করে ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হয়ে আসছে।

শুধু ঢাকাতেই নয়, সারা দেশেই বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে যুক্ত মানুষদের হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ডের ছিল দুটি পর্যায়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে হানাদার সেনারা রাজধানীতে গণহত্যা শুরু করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় সাধারণ নিরীহ জনসাধারণের পাশাপাশি শিক্ষক, চিকিৎসকদেরও হত্যা করে। এরপর থেকে হানাদাররা সারা দেশের শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, গবেষক, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা মনন সৃজনশীল কাজে যুক্ত মানুষদের বেছে বেছে হত্যা করতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যায় তারা এই বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য তালিকা করে হত্যা চালাতে থাকে। তাঁদের মধ্যে যেমন প্রবীণ প্রাজ্ঞজনেরা ছিলেন, তেমনি ছিলেন উদিত যৌবনের বহু সম্ভাবনাময় তরতাজা প্রাণ। আজ তাঁদের স্মৃতির স্মরণ করা হবে সারা দেশে।

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণী দিয়েছেন।

কর্মসূচি

শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তমন্ত্রণালয়ের সভায় জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ৭টা ৫ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং ৭টা ৬ মিনিটে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। তাঁরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবেন। এ সময় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টাকে রাষ্ট্রীয় স্যালুট প্রদান করবে।

রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার পুষ্পস্তবক অর্পণের পর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সচিব ইসরাত চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য এবং হুইলচেয়ারধারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ