৩ কোটি টাকায় ১ রান, ফেরারির দামে অটোরিকশার পারফরম্যান্স
Published: 5th, April 2025 GMT
আউট হয়েছেন ঋষভ পন্ত, সবাই তাকিয়ে সঞ্জীব গোয়েঙ্কার দিকে।
আগের ম্যাচে পন্ত ২ রান করে আউট হওয়ার পর গোয়েঙ্কা মুখ গোমড়া করে ফেলেছিলেন। সেটি ছিল এবারের আসরে পন্তের টানা তৃতীয় ব্যর্থতা। এ নিয়ে আলোচনা কম হয়নি। এবারের আইপিএলের আগে নিলাম থেকে রেকর্ড ২৭ কোটি রুপি দিয়ে পন্তকে কিনেছেন গোয়েঙ্কা। দাম আরও বেশি উঠলেও পন্তকেই নিতেন, এমনও বলেছিলেন লক্ষ্ণৌ সুপার জায়ান্টসের মালিক। সেই পন্ত মাঠে নামার পর প্রথম তিন ম্যাচে আউট হয়েছেন ০, ১৫ ও ২ রানে।
পন্তের মতো ব্যাটসম্যান আর হতাশ করবেন না বলে যাঁরা আশাবাদী ছিলেন, চতুর্থ ম্যাচে তাঁদের লজ্জাতেই ফেলেছেন পন্ত। গতকাল লক্ষ্ণৌতে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের বিপক্ষে বাঁহাতি এ ব্যাটসম্যান ৬ বল খেলে হার্দিক পান্ডিয়ার নিরীহ এক বলে ক্যাচ তুলেছেন।
আরও একবার ২ রান করে যখন মাঠ ছাড়ছিলেন, ক্যামেরা খুঁজে নিল গোয়েঙ্কাকে। লক্ষ্ণৌ মালিক নিজেও হয়তো জানতেন সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে। প্রথমে নির্লিপ্ত থাকার চেষ্টা করলেন। পরে হেসেই দিলেন। আর কত মুখ গোমড়া করে থাকবেন!
ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত লক্ষ্ণৌ জিতলেও (১২ রানে) পন্তের টানা চতুর্থ ব্যর্থতার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁর দাম নিয়ে আবারও হাসিঠাট্টা শুরু হয়েছে। ক্রিকেটবিষয়ক কিছু সাইট বসে গেছে পন্তের রানকে দামের পাল্লায় মাপামাপিতে। যেমন ওয়ানক্রিকেট একটা হিসাব কষে বের করেছে, পন্তের প্রতিটি রানের দামে ৪৭টি রয়্যাল এনফিল্ড মোটরসাইকেল কেনা যাবে।
দিল্লি ক্যাপিটালস ছেড়ে নিলামে ওঠা পন্ত গত বছরের মেগা নিলামে পেয়েছেন ২৭ কোটি রুপি দাম, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৮ কোটি টাকার বেশি। এর বাইরে ম্যাচ ফিও পাবেন তিনি। তবে নিলামে যে দাম উঠেছে, সে অনুসারে ৪ ম্যাচে তাঁর পাওনা ৭ কোটি ৭১ লাখ বা প্রায় ১১ কোটি রুপি। এই চার ম্যাচে পন্তের ব্যাট থেকে এসেছে মোট ১৯ রান। অর্থ্যাৎ পন্তের কাছ থেকে প্রতি ৩ কোটি ৩৫ লাখ টাকায় ১ রান করে পেয়েছে লক্ষ্ণৌ।
ওয়ানক্রিকেট মজার ছলে লিখেছে, পন্তের কাছ থেকে ফেরারি গাড়ির দামে অটোরিকশার পারফরম্যান্স পাচ্ছে লক্ষ্ণৌ। অর্থনীতির ভাষায় দলটি এরই মধ্যে ৪ ম্যাচে ৬.
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
লরা উলভার্ট: হিমালয়ের চূড়ায় এক নিঃসঙ্গ শেরপা
লরা উলভার্ট- দক্ষিণ আফ্রিকা নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক। বয়স মাত্র ছাব্বিশ, কিন্তু মনের দৃঢ়তায় যেন পাহাড়। এবারের ২০২৫ নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন প্রোটিয়া আশার একমাত্র আলোকবর্তিকা। নিজের একক নৈপুণ্যে, এক অসম্ভব সাহসিকতায় দলকে টেনে তুলেছিলেন ফাইনালের মঞ্চে।
সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলে ফেলেছিলেন ১৬৯ রানের অনবদ্য ইনিংস। যেন একক নাটকের একমাত্র নায়িকা তিনি। আর ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হিমালয়ের মতো দৃঢ় হয়ে। একপ্রান্ত আগলে রেখেছিলেন অনবদ্যভাবে। শতরান ছুঁয়ে যখন আকাশে ছুড়লেন ব্যাট, তখন মনে হচ্ছিল, স্বপ্নের ট্রফি যেন হাতের নাগালেই। কিন্তু ক্রিকেটের নির্মম বাস্তবতা! উলভার্ট যখন সাজঘরে ফিরলেন, ঠিক তখনই প্রোটিয়া শিবিরে নেমে এল নীরবতা। জয় হাতছাড়া হলো নিঃশ্বাস দূরত্বে।
আরো পড়ুন:
আরব আমিরাতকে ৪৯ রানে গুঁড়িয়ে ইতিহাস গড়ল যুক্তরাষ্ট্র
মিতালিকে ছাড়িয়ে ইতিহাস গড়লেন মান্ধানা
চোখের কোণে জলের কণা তখনও ঝলমল করছিল। সেটা ঘামের ছিল, নাকি অপূর্ণতার অশ্রু, তা কেউ জানে না। কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল, হৃদয়ের গভীরে আগুন জ্বলছে। একটা স্বপ্নের দগ্ধ ছাই হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণা।
তবুও এই ব্যর্থতার মাঝেই উলভার্টের জয় আছে। বিশ্বকাপে তিন ফাইনাল, টানা তিনবার! এবং প্রতিবারই দলের একমাত্র ভরসা ছিলেন তিনি। এবারের বিশ্বকাপে করেছেন ৯ ম্যাচে ৫৭১ রান, গড়ে ৭১.৩৭। যা নারীদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ। এর আগে অ্যালিসা হিলির ৫০৯ রান ছিল শীর্ষে।
শুরুটা ছিল নিস্তরঙ্গ- প্রথম ম্যাচে মাত্র ৫, পরেরটিতে ১৪। কিন্তু ধীরে ধীরে আগুন জ্বলে উঠল তার ব্যাটে। ভারতের বিপক্ষে ৭০, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৬০, পাকিস্তানের বিপক্ষে ৯০, আর সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ১৬৯। প্রতিটি ইনিংস যেন নিজের সীমাকে ছাপিয়ে যাওয়া একেকটি যাত্রা।
তবে উলভার্টের কীর্তি শুধু এই বিশ্বকাপেই নয়। ২০২৩ ও ২০২৪ দুই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেই ছিলেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক। প্রতিবারই দলকে তুলেছিলেন ফাইনালে। কিন্তু ভাগ্য যেন নিষ্ঠুরভাবে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে তার দিক থেকে। তিনটি ফাইনাল, তিনটি পরাজয়।
তবু লরার গল্পটা হারের নয়- এ এক অনমনীয়তার গল্প, এক নিঃসঙ্গ অভিযাত্রার গল্প। যেমন শেরপা অক্সিজেনহীন উচ্চতায় পৌঁছে দেয় অন্যদের। কিন্তু নিজে ফিরে আসে নীরবে, তেমনি উলভার্টও দলের স্বপ্নগুলো কাঁধে তুলে বয়ে নিয়েছেন, একা।
ফাইনাল শেষে ভারতীয় খেলোয়াড়রাও যখন এগিয়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরলেন, তখন বোঝা গেল; এই হার, এই অশ্রু, এই নীরবতা- সবই সম্মানের প্রতীক।
রবিবার ফাইনাল শেষে লরা বলেছেন অনেক কথা। সেখানে হাতাশার কিছু পাওয়া যায়নি। পাওয়া গেছে প্রেরণা ও সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস।
“আমি মনে করি, ২০২৩ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের (নিউল্যান্ডসে অনুষ্ঠিত) পর থেকেই আমাদের জন্য অনেক পরিবর্তনের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় থেকেই ঘরোয়া পর্যায়ে কেন্দ্রীয় চুক্তির ব্যবস্থা চালু হয়। আমাদের দলের গভীরতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে এটা ছিল এক বিশাল পদক্ষেপ।”
“এরপরের (২০২৪ সালের) বিশ্বকাপটা আমাদের দলের নামটা বিশ্ব ক্রিকেটে আরও বড় করে তুলেছে, আমার তাই মনে হয়। এখন আমরা এমন একটি দল, যারা নিয়মিত ফাইনালে পৌঁছাচ্ছে। যেখানে আগে এটা একবারের সাফল্য বলেই ধরা হতো।”
“টানা তিনবার ফাইনালে উঠতে পারাটা সত্যিই গর্বের বিষয়। এটা প্রমাণ করে আমরা ঘরোয়া ক্রিকেটে এবং দলীয় কাঠামোয় সঠিক দিকেই এগোচ্ছি। ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের এই ফলেই আমরা এখানে পৌঁছেছি। আশা করি, আমরা এমন আরও ফাইনাল খেলতে থাকব… আর একদিন, হ্যাঁ, একদিন আমরা অবশ্যই একটা জিতব।”
টুর্নামেন্টের পারফরম্যান্স নিয়ে উলভার্ট বলেন, “আমার মনে হয়, আমাদের এই আসরটা অসাধারণ কেটেছে। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছানোই একটা বড় সাফল্য। আমরা পুরো টুর্নামেন্ট জুড়ে দারুণ ক্রিকেট খেলেছি। এই বিষয়টা নিয়েই আমি সবচেয়ে বেশি গর্বিত।”
“একপর্যায়ে আমরা টানা পাঁচটা ম্যাচ জিতেছিলাম। যা আমাদের দলের জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি। দুই দলের মধ্যকার সিরিজগুলোতে আমরা সবসময় এই ধারাবাহিকতা পাই না। তাই বড় মঞ্চে, বড় টুর্নামেন্টে এমন পারফরম্যান্স দিতে পারাটা সত্যিই গর্বের। আমরা প্রমাণ করেছি, বড় আসরে দক্ষিণ আফ্রিকাও এখন বড় দল।”
সত্যিই তাই। লরার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকা এখন বড় দল। হয়তো একদিন, কোনো এক প্রভাতে, লরা উলভার্ট সেই অধরা ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখবেন। কিন্তু আজকের দিনে, তিনি রয়েছেন বিশ্বকাপের হিমালয়ের চূড়ায়, এক নিঃসঙ্গ শেরপা হয়ে। যিনি নিজের কীর্তিতে চূড়ায় উঠেছেন।
ঢাকা/আমিনুল